স্বপ্ন থাকে স্বপ্ন ছোঁয়া স্বপ্ন যায়না ধরা হৃদয় কাঁদে মরণ ব্যথায় স্বপ্ন ছুবে কবে মন পুড়ে রক্ত ঝরে দেখে না কেউ নীল বেদনায় সিক্ত থাকে বুঝে না কেউ।
– ‘এই যে তাওহীদ সাহেব, অনেক কাব্য সাধনা করেছেন। এখন একটু ঘর সাধনায় মন দেন।’
– ‘হাহ!, মেয়ে জাতি অদ্ভুদ জাতি। বুঝা যায় না তাদের মনের গতি। কখন ভালোবাসবে কখন দূরে ঠেলে দিবে পুরুষ জাতি নাহি বুঝে।’ কোমরে হাত রেখে বলে,
– ‘কিহ! কি বললেন আপনি? আমি শুনতে পাইনি আপনি আবার বলেন।’
– ‘ঘর সাধনা বড় সাধনা যদি কেউ বুঝে ঘর সাধনা রেখে কেউ মন বসাবে না অন্য কোন কাজে।’ মুচকি হেসে বলে,
– ‘এই তো ভালো ঘরের ছেলে।’
– ‘আমি জানি তো আমি ভালো ঘরের ছেলে। বেগটা দেন যাই বাজারে।’ ফারাহ বাজারের বেগ নিয়ে আসতে রুমে চলে যায়।
– ‘ভালো ছেলে ভালো ছেলে বলে আমাকে। কথা না শুনলে বলে বাপের জন্মে দেখিনি এমন খারাপ ছেলে। উপর ওয়ালা কপালে কি বউ ঝুটাইলা!’
– ‘আবার কি বললেন?’ মুখ খানা এমন করেছে যেন কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
– ‘কই নাতো আমি কিছু বলেনি। আমি, আমি তো কবিতা আবৃত্তি করছিলাম। উফ বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে। বেগ? বেগ কোথায়? বেগ?’ তাওহীদের বলার ভঙ্গি দেখে ফারাহ হাসতে থাকে। তাওহীদ এক মুহূর্ত কাল এই হাসির মায়ায় হারিয়ে যায়। তাওহীদ চলে যাচ্ছে। ফারাহ ওর গমন পথের পানে তাকিয়ে আছে।
– ‘এই যে কোথায় গেলেন? তাড়াতাড়ি দেখে যান বাজার থেকে কি কি নিয়ে এসেছি।’ বেগ থেকে তরকারি বের করতেই ফারাহর মেজাজ নষ্ট হয়। তাওহীদকে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাওহীদ তরকারি নিয়ে ঠিকেই এসেছে কিন্তু সব নষ্ট। যদি সে তিন দিন ভালো নিয়ে আসে তাহলে একদিন খারাপ নিয়ে আসবেই। আবার যদি কখনও তাকে বলা হয় আপনি এই জিনিসটা নিয়ে আসবেন। তাওহীদ ভুল করে ঠিক অন্য একটা জিনিস নিয়ে আসবে। এটা তার এক দোষ। এই দোষটা সে ছোটকাল থেকে নিয়ে বড় হচ্ছে। যেকোন কাজে এই ভুলটা করবেই সে। এই ভুলের জন্য রাতের আঁধারে অনেক কাঁদতে হয়েছে তাকে।
– ‘এই যে তাওহীদ সাহেব, কি নিয়ে এসেছেন বাজার থেকে?’
– ‘কেন তরকারি।’
– ‘তা কেমন তরকারি নিয়ে এসেছেন?’
– ‘ভালো তরকারি।’
– ‘ও ভালো তরকারি?’
– ‘হ্যা বাজারের টাটকা তরকারি। দোকানদাররা বললো তো আমাকে। তরকারিগুলো নাকি অনেক সতেজ’
– ‘দোকানদাররা বললো আর ভালো হয়ে গেল?
এসব ভালো তরকারি না? এই আপনার টাটকা তরকারি? এই আপনার সতেজ তরকারি? এই? লজ্জা করে না আপনার, লজ্জা? বাজার করার সময় চোখ কোথায় রাখেন? চোখ? বলছে আর এক এক করে সব ছুড়ে ফেলছে।
– তাওহীদ অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখছে।
– ‘আপনি কেন বার বার ভুল করেন? ইচ্ছা করে ভুল করেন তাই না? আমার হাতের রান্না আপনার আর ভালো লাগে না। এখন নতুন কারো হাতের রান্না খেতে ইচ্ছা হয়? সেজন্য অভিনয় করার কী প্রয়োজন? আমাকে সরাসরি বলে ফেলেন, ‘তোকে আমার ভালো লাগছে না। আমি তোকে তিন তালাক দিলাম। এখন আমার ঘর ছেড়ে চলে যা। ব্যস, তাহলে তো আর একটা বি….’
– ‘ঠাসসসসসসসস।’ তাওহীদ নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারেনি। ফারাহ কথা শেষ করার পূর্বেই চড় বসায়।
– ‘একদম চুপ। আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে খুন করে ফেলবো।’
ফারাহ ভেজা চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। ফারাহর কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই কষ্টটা বলার মতো তার কেউ নেই।
মুহূর্তের মধ্যে রুমটা কেমন পাল্টে গেল। তাওহীদ অভাগার মত বসে আছে। মনে হচ্ছে আপন বলতে এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই। এক দৃষ্টিতে রুমটাকে দেখছে। বিভিন্ন ভাবে তরকারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বেলকনিতে তাকিয়ে দেখে, ফারাহ ব্যস্ত নগরীর বুকে তাকিয়ে আছে। তাওহীদ এর বুকের ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে। তাওহীদ কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছে না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছে। তার হৃদয়টা ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। এলার্ম ঘড়িটা বেজে ওঠে। তাওহীদকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তার অফিস যাওয়ার সময় হয়েছে। মলিন মুখে ফারাহর পানে এক নজর তাকায়। যে তাকানোতে ছিল না বলা কথা, না বলা ব্যথা। ব্যস্ত নগরী। ফারাহ বেলকনির গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে কান্নার পানি। নীরব কান্না করছে। যে কান্নায় কোন শব্দ নেই। এই নিয়ে তাওহীদের হাতে অনেক বার থাপ্পড় খেয়েছে। ফারাহ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছে। তাওহীদকে ছেড়ে চলে যাবে অনেক দূর। যে ঠিকানা তাওহীদ কখনও পাবে না।
তাওহীদ এর দোষটাকে অন্য ভাবে বললে বলা হয় মুদ্রাদোষ। এই দোষের জন্যই বার বার ভুল করে। তাই ছোট থেকে কতবার কথা শুনতে হয়েছে। সেটা বলে শেষ করা যাবে না। তাওহীদ কতবার একা একা কেঁদেছে। কতবার মানুষের নজর এড়িয়ে চোখের জল ফেলেছে। তা গুণে শেষ করা যাবে না। তাওহীদ যতোবার বার বলেছে, আমি ইচ্ছা করে করি না।’ ততোবার তারা ভুল বুঝেছে। এক এক জন এক এক রকম নাম দিয়েছে। সে নামগুলি আজও তাকে কাঁদায়। তাওহীদ রেগে গেলে ফারাহকে অনেক ভাবে কষ্ট দেয়। ফারাহ এই কষ্টের মাঝে এক টুকরো সুখ খুঁজে পায়। যে সুখটা কুটি কুটি টাকা দিয়ে পাওয়া যায় না। ফারাহ রুমটার দিকে তাকায়। মনের অজান্তেই বুকের ভিতর থেকে একটা কষ্ট বের হয়ে আসে।
– ‘এই যে নাক ফুলানী! আমি অফিসে চলে যাচ্ছি।’ ফারাহ দুঃখের মাঝেও এক অদ্ভুত সুখে হেসে ফেলে। যেদিনেই মারামারি করবে সেদিনেই বিভিন্ন কথার বুলি ছড়াবে। তাওহীদ একটা কথা বললেই ফারাহ সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়। তখন আর রাগ করে থাকতে পারে না। কেন পারে না? উত্তর জানে না। তাওহীদ অফিসে চলে যাচ্ছে। ফারাহ বেলকনিতে থেকে দেখছে। এতো কষ্টের পরেও তার ঘরে কেন পড়ে থাকে? কেন তাকে ভালোবেসে? ফারাহ জানে না। শুধু একটায় জানে তাওহীদকে ভালোবাসবে। এবং জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ভালো বেসে যাবে।
পড়ন্ত বিকেল। ফারাহ ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয় মানুষটার জন্য অপেক্ষা করছে। সারাটাদিন চলে যায়। তাকে একটি বারের জন্য ফোন করেনি। সেও রাগে অভিমানে একবারও খবর নেয়নি। পুরনো দিন গুলি ভেবে ভেবে তার সারাটাদিন কেটেছে। তাওহীদ ড্রাইভিং করছে আর মনে মনে বলছে, ‘কিভাবে নিজেকে শুধরাবো? কেন নিজেকে পাল্টাতে পারছি না আমি? কিভাবে আমি…’ নিজের সাথে কথা বলেই যাচ্ছে। নিজের সাথে কথা বলতে বলতে বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে দেখে রুমগুলো গুছানো। কিন্তু তার প্রিয়তমা নেই। তাওহীদ ভয় পেয়ে যায়। তার কিছু হল নাতো? চারদিক থেকে ভয় ঘিরে ধরে। বুকে চিন চিন ব্যথা শুরু করে। প্রিয়তমাকে খুঁজছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে ছাদে আসে। প্রিয়তমাকে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
গোধূলি বেলায় ফারাহকে অপূর্ব লাগছে। ফারাহকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমার বাবুই পাখি কাছে আসো আদর করি। যা ভুল করেছি তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। বাবুই পাখি আমাকে ক্ষমা করেছো তুমি?’ স্বামীর হাতের স্পর্শ পেয়ে ফারাহ কাঁদছে। সেতো একটু ভালোবাসায় চায় আর কিছু না। মুহূর্তের মধ্যে মনের সকল দুঃখ কষ্ট চলে যায়। কিন্তু বাহিরের অভিমানটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ফারাহ অভিমানে তাওহীদকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। তাওহীদ আবার আসে। আবার ধাক্কা দেয়। আবারও আসে। আবারও ধাক্কা দেয়। এবার তাওহীদ ভার সাম্য ঠিক রাখতে পারলো না। সে পড়ে যায়। তাওহীদ একটা ছোট চিৎকার দেয়। কিভাবে কী হলো ফারাহ বুঝতেই পারলো না। ভয়ে ফারাহর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তাওহীদ কাতর চোখে তাকায়। তাওহীদ এর তাকানো ফারাহর হৃদয়টাকে চুরমার করে ফেলে। ফারাহর নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। তাওহীদের চোখে তাকাতে পারছে না। তাওহীদ চোখ মুছে নিচে নামছে। ফারাহ পাথরের মত দাঁড়িয়েই আছে।
রাতের আকাশে তাঁরা উঠেছে। জোনাকিরা দলে দলে আলো ছড়িয়েছে। তাওহীদ এর হৃদয় থেকে রক্ত ঝরছে। তার চোখ দুটো জলে ভেজা। ফারাহ এমনটা করবে ভাবতে পারেনি। মনে মনে বলে, ‘ফারাহ তোমাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলি না? তোমাকে আর কষ্ট পেতে হবে না। তোমাকে সারা জীবনের জন্য মুক্তি দিবো আমি।’ ফারাহ কাঁদছে। এটা কি করলো সে? কিভাবে করলো? এই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। যে মানুষটা তাকে তার জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসে! তাকে সে এভাবে আঘাত করতে পারলো? না কোন ক্ষমা নেই। না জানি নিজেকে সারাদিন কত ভাবে কষ্ট দিয়েছে। যেদিন ফারাহকে কষ্ট দিবে সেদিন তাওহীদ নিজেকেও কষ্ট দিবে। এখন পর্যন্ত তাওহীদ এর এই ভালোবাসা ফারাহ বুঝতে পারলো না।
ফারাহ সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নামছে। একটা অস্পষ্ট চিৎকার তার কানে আসে। প্রথমে বুঝতে পারেনি পরে বুঝতে পারে। যখন বুঝতে পারে তখন নিজের অস্তিত্বটাকে হারিয়ে ফেলে। তাওহীদ গ্যাসের ব্যথায় চিৎকার করছে। সে গ্যাসের ব্যথা একদম সহ্য করতে পারে না। তার তিন বেলায় গ্যাসের ট্যাবলেট খেতে হয়। কিন্তু আজ? অভিমানে তার কোন খোঁজ রাখেনি? ফারাহ চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। রাগ অভিমান একটা মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়! আজ ফারাহ বুঝতে পারলো। ফারাহ মনে মনে বলছে, ‘এই দৃশ্য দেখার আগে আমার মরণ হলো না কেন? মরন?’ ফারাহ ধীরে ধীরে তাওহীদ এর কাছে আসে। তাওহীদকে ধরতে যেতেই বলে ওঠে,
– ‘ছুবেন না আমাকে। আমাকে স্পর্শ করলে আপনার পাপ হবে।’ আবার ফারাহর চোখ ভিজে ওঠে।
– ‘ট্যাবলেটটা খেয়ে নেন।’
– ‘খেলে খাবো না খেলে নাই। তাতে কারো যায় আসে না।’
– ‘খেয়ে নেন বলছি।’
– ‘মরে যেতে রাজি আছি। কিন্তু আছ আমি খাবো না।’
– ‘খাবেন না তো?’
– ‘না।’
এমন একরোখা ছেলেকে এখন কিভাবে সামলাবে? ফারাহর নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে। ব্লেড হাতে নিয়ে ফারাহ বলে,
– ‘আমি মরে গেলে তো খাবেন? এই ব্লেড দিয়েই আপনার সামনে আমি মরবো। তারপর আমার লাশ দেখে দেখে আপনি শান্তিতে খাবেন কেমন!’
– ‘যান মরলেই তো বাঁচেন। আমাকে আর সহ্য হয় না। কেউ আমাকে বুজতে পারে না, কেউ না। ফারাহর হৃদয়টা কেঁদে ওঠে। কি বলবে? কি উত্তর দিবে?
– ‘আমি ফারাহ তাওহীদ এর মুখ চেপে ধরে। দুটি চোখ দুটি চোখকে দেখছে। কত না বলা কথা বলে যাচ্ছে। তাওহীদ বলে,
– ‘আমি কষ্ট পেলে আপনি খুশি হন।’
– ‘ঠিক এই প্রশ্নটা যদি আমি আপনাকে করি?’
তাওহীদ ফারাহকে জড়িয়ে ধরে। কানে কানে বলে, ‘আমাকে একা ফেলে যাবেন না। জানেন তো আমার কেউ নেই। একা আমি মরেই যাবো।’ ফারাহ তাওহীদকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। দুজন দুজনকে খাইয়ে দিচ্ছে। শত রাগ অভিমান ভুলে কাছে চলে আসে। অদ্ভুদ পৃথিবী! কখন সম্পর্কের ভাঙন ধরাবে কখন সম্পর্কের জোড়া লাগাবে। বোঝার সাধ্য কারো নেই। তাওহীদ ও ফারাহ চোখে চোখে কথা বলছে। সকল অভিমান ভুলে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন বুনছে।