আমাদের সত্যিই অনেক মিল

আমাদের সত্যিই অনেক মিল

প্রিয়তি, তোর বাম হাতটা দে তো”, বলেই আমার বাম হাত টেনে ধরলো নায়লা।

– ওয়াও দোস্ত! তোর নখগুলো কতো সুন্দর আর বড় বড়। কালো নেইলপালিশে আরো সুন্দর লাগছে। তর্জনীটা দেখ, এটা বেশি সুন্দর। একটা ম্যাজিক দেখবি দোস্ত? নে চোখটা বন্ধ কর। নিশ্চয় নায়লার কোনো কুমতলব আছে। হঠাৎ কি ম্যাজিক দেখাবে ও আমাকে। না না ওর ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।

– ম্যাজিক মানে! কিসের ম্যাজিক? তুই আবার ম্যাজিক পারিস নাকি?
– হ্যাঁ দোস্ত পারি তো। তুই চোখ দুটো বন্ধ কর, আমি দেখাচ্ছি।
– চোখ বন্ধ করলে ম্যাজিক দেখবো কিভাবে?
– আরেহ চোখ খোলার পরই তো আসল ম্যাজিকটা দেখতে পাবি। যাহ প্রমিজ করলাম, ম্যাজিকটা দেখানোর পর তোকেও শেখাবো।

– নায়লার জোরাজোরি আার ম্যাজিক শেখার লোভ সামলাতে না পেরে চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হলাম।
চোখ বন্ধ করে ভাবছি ম্যাজিকটা কি হতে পারে। সাথে সাথেই নেইল কাটারের খটাশ শব্দ শুনতে পেলাম। চোখ খুলে যা দেখার তাই দেখলাম, আমার বাম হাতের তর্জনীর নেইলপালিশ দেয়া দুই সেন্টিমিটার নখটা ছোট বাদামের দানার মতো হয়ে গেছে।

– এটা তুই কি করলি নায়লা! নায়লা ওর বাম হাতের তর্জনীটা বের করে দেখিয়ে বললো, আর বলিস না প্রিয়তি, কালকে নখগুলো সাইজ করতে গিয়ে এই নখটা কেটে ফেলেছি। আমার হাতের একটা নখ ছোট থাকবে আর তোরটা বড়, এটা কখনও হয় প্রিয়তি বল। ভালো করেছি না দোস্ত? এখন দেখ তোর আমার কত্তো মিল!

আমি জানি এখন কোনো কিছু বলেই লাভ হবে না। নায়লা এমনই। ওর আর আমার সবকিছুতেই মিল থাকতে হবে। ওর ভাষ্যমতে, ” পৃথিবীর সবগুলো বেস্টফ্রেন্ডদের মাঝেই কিছু মিল থাকে। এ মিলের কারনেই তারা বেস্টফ্রেন্ড। তবে তোর আর আমার মধ্যে কিছু মিল না, বরং কিছু অমিল থাকবে। আর বাকি সবকিছুতেই মিল থাকতে হবে। মিল না হলে মিল বানানোর নিঞ্জা টেকনিকও আমার জানা আছে। বুঝেছিস প্রিয়তি? একটু আগে কৌশলে আমার নখ কেটে দেওয়া নায়লার নিঞ্জা টেকনিকেরই অন্তর্ভুক্ত। এরকম কাহিনী ও প্রায় প্রতিদিনই করে।

এইতো কিছু দিন আগের ঘটনা। আমি খুব সুন্দর করে দুই বেণী করে কলেজে গিয়ে সবেমাত্র বসলাম। একটু পরই একটা ঝুঁটি করে কলেজে আসা নায়লা চোখ মুখ অন্ধকার করে আমার সামনে এসে বসলো। নায়লা কোনো কথা বলছে না, শুধু ভিতরে ভিতরে ফোঁপাচ্ছে। আমি ঘটনা বুঝতে পারলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চুলের বেণী দুটো খুলে ফেললাম। নায়লাকে বললাম, নে একটা ঝুঁটি করে দে। নায়লা এবার খুব খুশি হলো মনে হয়। চিরুনি ছাড়াই খুব তারাতারি একটা ঝুঁটি করে দিলো। তারপর ঝুঁটির নিচের চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,

– এই না হলে আমার বান্ধবী। এখন দেখ তোর আর আমার কত্তো মিল। নে এবার বায়োলজি বইটা বের কর তো প্রিয়তি।
– বায়োলজি বই! কেনো কি করবি? তুই আজকেও বই আনিস নি?
– আরেহ, এনেছি তো। তুই তোর বইটা বের কর।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে বইটা বের করলাম। নায়লা বললো, ৭৩ নং পেজটা বের কর প্রিয়তি। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো ৭৩ নং পেজ বের করলাম। তারপর আাবার বললো, একটা কলম দে।এবারও বাধ্য মেয়ের মতো একটা কলম বের করলাম। নায়লা এবার আর কিছু না বলে তারাতারি বইটা আর কলম টা আমার হাত থেকে নিয়ে নিলো। তারপর কলম দিয়ে আমার বইয়ের ৭৩ নং পেজটা আমার সামনেই ইচ্ছেমতো দাগাদাগি শুরু করলো।

– “কি করছিস তুই নায়লা! পাগল হয়ে গেছিস!” একটানে বইটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিলাম। নায়লা ওর ব্যাগ থেকে ওর বায়োলজি বইটা বের করে ৭৩ নং পেজটা দেখালো। ওর বইয়ের অবস্থাও আমারটার মতোই।

– আর বলিস না প্রিয়তি, আমার বজ্জাত ছোট ভাইটা কালকে রাতে আমার বইয়ের এই অবস্থা করেছে। তাইতো তোর বইটাও এমন করে দিলাম। ভালো করেছি না প্রিয়তি। এখন দেখ তোর আর আমার কত্তো মিল!- বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো নায়লা। নায়লার এসব কান্ডকারখানায় আমি মাঝে মাঝে খুবই বিরক্ত হই। কিন্তু কিছুই বলি না। কারন ভালোবেসেই করে এসব। তাই একইরকম জামা কাপড় বানানো,কলেজে একইরকম টিফিন আনা, একইরকম কলম দিয়ে একইরকম খাতায় লেখা সবই করতে হয় ওর জন্য।

সেদিন একটু দেরি করে কলেজে গেলাম। বাসা থেকেই কেমন যেন অসুস্থতা বোধ করছিলাম। কলেজে আসার পর আরো বেশি খারাপ লাগছে। নায়লা আমার পাশে বসে কিছু একটা নিয়ে অনেক কথা বলছে। পেট ব্যথা আর মাথা ব্যথাতে ওর কোনো কথাই মাথায় ঢুকছে না। চারপাশে সবকিছু অন্ধকার লাগছে। হঠাৎই মাথা ঘুরে বেঞ্চ থেকে নিচে পড়ে গেলাম আর নায়লার জোরে চিৎকার শুনতে পেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটা হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম। আম্মুকে দেখলাম আমার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে। একটু দূরে আব্বু দাঁড়িয়ে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। আম্মু আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে খুশি হয়ে আব্বুকে ডাক দিলেন। হঠাৎ ডানদিকের বেডটাতে চোখ পড়তেই ধাক্কা খেলাম। আরে এ তো নায়লা। ওর আম্মুও আছে দেখছি।

– নায়লা, তুই এখানে! কি হয়েছে তোর? নায়লা কিছু বলার আগেই ডাক্তার আঙ্কেল এসে বললেন,
– নায়লার কিছু হয়নি। তোমার হয়েছিল।
– কি হয়েছিল আমার?
– দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তোমার।
– কিহ!
– হ্যাঁ,তবে ভয় পেও না। নায়লা ওর একটা কিডনি তোমাকে দিয়ে দিয়েছে। নায়লার একটা কিডনি এখন তোমার কাছে। তোমরা দুজনেই এখন সুস্থ। ডাক্তারের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। নায়লার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

– এটা তুই কি করেছিস নায়লা!
– দোস্ত, আমার দুটো কিডনিই ভালো থাকবে আর তোর দুটোই নষ্ট! এটা কখনও হয় বল। এখন দেখ তোরও একটা কিডনি আমারও। আমাদের কত্তো মিল দোস্ত! তাই না? আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কি বলবো বুঝতে পারছি না। ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে নায়লার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম, “হ্যাঁ দোস্ত আমাদের সত্যিই অনেক মিল!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত