লুকোনোর অভিনয়

লুকোনোর অভিনয়

লোকের ভিড় পেরিয়ে আসাদ ও তার এসিস্ট্যান্ট শরীফ কোনোমতে নিজেদের আসনে এলো। আজ ট্রেনে প্রচুর ভিড়। ঈদ বলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক। আসনে বসে শরীফ ব্যাগ থেকে পানি বের করে পান করলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “স্যার, একটা প্রশ্ন করি? আসাদও হাপিয়ে গেছে। প্রচন্ড ঘেমেও গেছে। বড় শ্বাস নিতে নিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। শরীফ বলল, “স্যার, বাংলাদেশের অবস্থা তো জানেন। ঈদের সময় ট্রেনে প্রচুর ভিড় হয়।” আসাদ জবাব দিলো, “হ্যা, তা তো জানি।” একটু বিস্মিত হয়ে শরীফ বলল, “আপনি তো সব যাত্রাই বিমানে করেন। তবে এত কষ্ট হবে জেনেও কেন ট্রেনে এলেন?” হাসি দিয়ে আসাদ বলল, “এই ভ্রমণে মজা ও শিক্ষা দুটাই আছে।” অবাক হয়ে শরীফ বলল, “যেমন?”

– একটু উপভোগ করার চেষ্টা করলে তুমি আশেপাশের মানুষের কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তা শুনে মজা পাবে। তারপর ট্রেনে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ উঠে। ধনী-গরীব, ভিখারী, বিক্রেতা এদেরকে দেখে তুমি চাইলেই শিক্ষা নিতে পারবে। আমরা যেমনই পরিস্থিতিতে থাকি না কেন তবুও অসন্তোষ থাকি। এখানে এসে তুমি নানান রকম মানুষ দেখে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করার কারণ খুঁজে পাবে।

শরীফ মন দিয়ে আসাদের কথাগুলো শুনলো। তারপর বলল, “ধন্যবাদ স্যার। এই শিক্ষাটা দেওয়ার জন্য।”
কিছুক্ষণ পর ট্রেন ছাড়লো। জানালা দিয়ে আসাদ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল। কি সুন্দর ও মনোরম পরিবেশ! মুগ্ধ হওয়ার মতো। আসাদ তার সিট থেকে উঠে উপরে রাখা ব্যাগ থেকে বইটা বের করলো। ঠিক তখনই আড়চোখে একটা পরিচিত মুখ লক্ষ্য করলো। আসাদ একটু ভালো করে লক্ষ্য চিনে ফেলল। এ তো নূরী। তার অধরা এক সাধনা। বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু নূরী যেন সেই বাইশের কৌটায় বসে আছে। চেহারার লাবণ্য একটুও কমেনি। নূরীর সাথে একজন লোক আছে।

যার কোলে একটা শিশু আছে। লোকটা নূরীর হাজব্যান্ড। শিশুটা তাদেরই হবে। পাঁচ বছর আগে লোকটার ছবি দেখিয়ে নূরী বলেছিল, “এই হলো আমার হবু স্বামী। সরকারি চাকরি করে। যে মাসে হাজার পঞ্চাশে বেতন পায়। তুমি তো আমার কসমেটিকসের ভারই উঠাতে পারবে না। বাকিগুলো না হয় বাদই দিলাম। আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ।” সেদিন নূরীকে থামানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি আসাদ। কেননা যার চোখে অর্থসম্পদের প্রলেপ আছে তাকে আটকানো যায় না। উচিতও নয়। আসাদ তার আসনে বসে বসে অতীত নিয়ে ভাবছিল। শরীফের কথায় অতীত থেকে বেরিয়ে এলো।

– স্যার, বই হাতে নিয়ে কি ভাবছেন?

কিছুক্ষণ নীরব থেকে আসাদ তার কোট খুলে শরীফের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একটা সাহায্য করবে?”
বর্তমান আসাদের কোট পরে বসে আছে শরীফ। আর কিছু কাগজপত্র নিয়ে ফরমাল শার্টে শরীফের সামনে বসে আছে আসাদ। কিছুক্ষণ পর নূরী ও তার হাজব্যান্ড তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। আসাদ ভেবেছিল হয়তো নূরীর নজরে আসবে। তবে এতেও আসাদ খুশি। অতীত সামনে না আসাই উত্তম। বইটা হাতে নিয়ে আসাদ পড়তে লাগল। কিছু সময় বাদে শরীফ চেঁচিয়ে উঠলো।

– এই এসিস্ট্যান্ট, তোকে কী বই পড়ার জন্য এনেছি?

বই থেকে আসাদ চোখ তুলে তাকালো। পাশে নূরীকে দেখে ব্যাপারটা বুঝলো। তবে না দেখার ভান করে রইলো। আমতা আমতা করে আসাদ বলল, “দুঃখিত স্যার।” কিছুটা রাগ নিয়ে শরীফ বলল, “আমার পরবর্তী সিডিউল কী?” আসাদ একটা কাগজ বের করে বলল, “আজ কোনো সিডিউল নেই। আগামীকাল আছে।”

– আচ্ছা। পানির বোতল দাও। আর তোমাকে না বলেছিলাম আমার জুতায় কালি করে আনতে! আসাদ শান্ত গলায় লজ্জার ভঙ্গিতে বলল, “ভুলে গেছি স্যার।” বেশ কর্কশ ভাষায় শরীফ বলল, “বেতন নিতে তো ভুলো না। তুমি লান্স বক্স বের করো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।” শরীফ উঠে চলে গেল। আসাদ এমন ভান করলো যেন লান্স বক্স নিতে গিয়ে নূরীকে দেখলো।

– আরে তুমি? এখানে?
– হ্যাঁ, ফার্স্ট ক্লাসে আছে আমার স্বামী আর সন্তান।
– তা কেমন আছ?
– আমার নেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে আজ বেশ ভালোই আছি।

আসাদ একটা সরল হাসি দিলো। ভালো থেকো বলে নূরী চলে গেল। আসাদ চুপচাপ বসে পড়লো। মনে মনে বলল যা হয় ভালোর জন্যই হয়। যে নারী মন নয় অর্থসম্পদকে ভালোবাসে, সে নারীর ভালোবাসা বালির বাঁধের মতো। বালির বাঁধের যেমন স্থায়ীত্ব নেই। তেমনই এই ভালোবাসারও স্থায়ীত্ব নেই। কিছুক্ষণ পর শরীফ এলো। মূলত তাদেরকে সময় দিতেই তখন চলে গিয়েছিল।

– স্যার, অভিনয় কেমন হলো?
– অস্কারজয়ী।

শরীফ হাসি দিলো। আসাদ জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আজ কেন জানি খুব ভালো লাগছে। প্রকৃতি তার রূপ যেন আসাদের জন্যই প্রদর্শন করছে। ট্রেনের ঝুকঝুক আওয়াজ, আশেপাশের কলরব, শীতল বাতাস সবকিছু যেন আসাদকে আরও বেশি চমকপ্রদ করে তুলছে। কিছু সত্য লুকোনোর মাঝে এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে। আসাদের অনুভূতি এখন সেটাই। নূরীর মতো মেয়েরা মিথ্যাতেই ভালো থাকুক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত