দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজাতেই শ্রাবণী দরজা খুললো। আমাকে দেখে মুখে লেগে থাকা হাসিটা নিমিষে হারিয়ে গেলো। মুখটা মলিন করে শ্রাবণী বললো,
-স্যার, আজ তো শুক্রবার। আজতো আপনার আশার কথা ছিল না আমি মুচকি হেসে বললাম,
— কয়েকদিন পর তো তোমার পরীক্ষা তাই শুক্রবারও এসে পড়লাম। মনে একরাশ বিরক্ত নিয়ে শ্রাবণী পড়তে বসলো। ঝটপট করে যে পড়াগুলো ছিলো সেগুলো খুব তাড়াতাড়ি আমায় দিয়ে বললো,
– স্যার, আজকের মত এখনি ছুটি দিয়ে দেন। আজ আমরা বান্ধবীরা মিলে একটু ঘুরতে যাবো। এমন সময় শ্রাবণীর আম্মু টেবিলে নাস্তা রাখতে রাখতে বললো,
~ দুইদিন পর পরীক্ষা এখন ঘুরাঘুরি কিসের? একটা ভালো ভার্সিটিতে চান্স নাও তারপর যত ইচ্ছে ঘুরাঘুরি করো।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আন্টি বললো,
— বাবা ও খুব ফাঁকিবাজ। ওর কথা তুমি শুনো না। ওকে তুমি পড়াও…
আন্টির কথা শুনে শ্রাবণী কান্না করে দিলো। এক হাতদিয়ে খাতায় লিখছিলো আর অন্য হাতদিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছছিলো শ্রাবণীর পড়ানো যখন শেষ হলো তখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে। আমি বাসা থেকে যখন বের হবো তখন আন্টি বললো,
~পিয়াস, আজকে মুরগী গোশত রান্না করেছিলাম। অল্প খেয়ে না হয় যাও দুপুর থেকে আজ আকাশটা মেঘলা ছিলো। যখন বিকেল হলো তখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। ছোট থেকেই শ্রাবণীর বৃষ্টিতে ভেজার খুব শখ। শ্রাবণী তার মাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার অনুমতি পেলো। খুশিতে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে যখন সে ছাদে উঠছিলো বৃষ্টিতে ভিজবে বলে তখন সে খেয়াল করলো তার স্যার ড্রয়িং রুমে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণীর মা শ্রাবণীকে বললো,
~তোমার স্যার এসেছে। আজ বৃষ্টিতে ভিজতে হবে না। অন্য একদিন ভিজো আজ শ্রাবণীকে অন্য রকম লাগছে। ২ ঘন্টা পড়িয়েছি এই ২ ঘন্টার ভিতর শ্রাবণী আমার সাথে কোন কথায় বলে নি। আমার জন্য আজ মেয়েটার বৃষ্টিতে ভেজা হলো না সেদিন শ্রাবণীকে পড়ানোর সময় হঠাৎ শ্রাবণী বললো,
-স্যার, আমি যে আপনার উপর প্রচন্ড বিরক্ত সেটা কি আপনি জানেন? আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। শ্রাবণী বললো,
-আমাকে পড়ানো বাদে আপনার কি কোন কাজ নেই? সকাল নেই সন্ধ্যা নেই আমায় পড়াতে এসে পড়েন। অন্য টিচাররা স্টুডেন্টকে সপ্তাহে ৩ দিন পড়ায় তাও আবার ৪০ মিনিট। আর আপনি আমায় ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ান সপ্তাহে ৭ দিনেই। আমাকে যে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ান সেটা আমার বাবা মার ভালো লাগলেও আমার কিন্তু মোটেও ভালো লাগে না। আপনার জন্য আমি বাহিরে যেতে পারি না। কখন না কখন বাসায় এসে পড়েন আর বাসায় আসলে আমায় না পেলে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেন তারপর আমি বাসায় আসলে বাবা মার বকা শুনতে হয়। বৃষ্টিতেও ভিজতে পারি না আপনি কাকভেজা হয়ে আমাকে পড়াতে এসে পড়েন। আমি ছাত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো। কোন না কোন পাবলিক ভার্সিটিতে আমার চান্স হয়ে যাবে। দয়া করে আমার উপর এত চাপ দিবেন না শ্রাবণীর কথা গুলো চুপচাপ বসে হজম করলাম। তারপর ওকে পড়ানো শেষ করে হাসিমুখে বললাম,
–কালকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আসবো
রাগে শ্রাবণীর সারাশরীর কাঁপছে। ওর মা খেতে ডেকেছিলো কিন্তু ও রাগে খেতেও যায় নি। একটা মানুষ এতটা বেহায়া কিভাবে হয়। এতগুলো কথা শুনানোর পরেও হাসিমুখে বলে কাল পড়াতে আসবে। হঠাৎ শ্রাবণী খেয়াল করলো টেবিলের উপর সবুজ রঙের একটা ডায়েরি। ওর তো কোন সবুজ রঙের ডায়েরি নেই। তারমানে এটা স্যারের ডায়েরি । ভুল করে হয়তো ফেলে গেছে অন্যের ডায়রি কখনোই পড়া ঠিক না কিন্তু শ্রাবণীর কেন জানি ইচ্ছে হলো ডায়রিটা পড়তে। এই বেহায়া মানুষটা ডায়েরিতে কি লিখতে পারে সেটা জানার জন্যই শ্রাবণী ডায়েরিটা খুললো…
ডায়েরিটা খুলে শ্রাবণী অবাক হয়ে গেলো। ডায়েরির প্রথম পাতায় খুব সুন্দর করে পেন্সিল দিয়ে ওর একটা ছবি আঁকা আর ছবির নিচে তার নাম লেখা। শ্রাবণী দ্বিতীয় পাতাটা উল্টে দেখলো তাতে লেখা, আমি জানি শ্রাবণী আমার উপর খুব বিরক্ত। আমার চেহারাটা দেখলেই মেয়েটার মুখ থেকে মিষ্টি হাসিটা নিমিষেই হারিয়ে যায়। অবশ্য এর জন্য আমি দায়ী। ওর উপর আমি অযথা পড়ার চাপ দিচ্ছি। কিন্তু কেন দিচ্ছি সেটা শ্রাবণী কখনোই জানবে না। শ্রাবণীকে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াই কারণ আমি এতক্ষণ পড়ালে দুইবার নাস্তা পাই।
মাঝে মাঝে কপাল ভালো হলে ভরপেট ভাত জুটে যায়। খুব দরিদ্র পরিবারের ছেলে আমি। গ্রামে দুইটা ভাই বোনের পড়ার খরচ আমাকে দিতে হয়। বাবা মসজিদের মুয়াজ্জিন। মাস শেষে ১৫০০ টাকার মত পায় আর টুকটাক কৃষি কাজ করে কোনরকম সংসার চালায়। ঢাকা শহরে থেকে ৩ বেলা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই সকাল শুরু হয় এককাপ চা আর ৫ টাকা দামের পাউরুটি দিয়ে। দুপুর শেষ হয় গ্রাম থেকে আনা মুড়ি আর মিঠাই দিয়ে কিন্তু বিকাল থেকে ক্ষুধার অসহ্য যন্ত্রণা আর সহ্য করা যায় না। তাই বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রাবণীকে পড়াই কিছু খাবারের আশায়। মাঝে মাঝে সন্ধ্যা ৭ টা দিকে পড়াতে চলে যায় যেন রাতের খাবারটা পেট ভরে খেতে পারি…
শ্রাবণীর পড়ছিলো আর চোখের পানি দিয়ে ডায়েরির পাতা ভিজে যাচ্ছিলো। শ্রাবণী ডায়েরির পরের পাতাটা উল্টালো আর তাতে লেখা, শ্রাবণী মেয়েটা আজ নীল রঙের শাড়ি পরেছিলো। কাপালে ছোট একটা নীল টিপ চোখে কাজল আর দুই হাত ভর্তি কাঁচের নীল চুড়ি আর খোলা চুলে মেয়েটাকে অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগছিলো। মনে হয় কোথাও বের হবার জন্য সেজেছিলো কিন্তু আমি এসে সব নষ্ট করে দিলাম। ও যখন খাতায় লিখছিলো তখন ওর হাতের কাঁচের চুড়ির রিনঝিন শব্দে আমার বুকের বামপাশে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছিলো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি একফোঁটা কৃষ্ণ বর্ণের জল ওর গাল বেঁয়ে পড়ছে। আচ্ছা আমার এমন লাগছে কেন? আগেও তো শ্রাবণীকে দেখেছি কিন্তু এমন তো লাগে নি তাহলে কি আমি শ্রাবণীকে……
না আর কিছু লেখা নেই। শ্রাবণী দ্রুত একটার পর একটা ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগলো কিন্তু সবগুলো পাতা সাদা। কোথাও কলমের কালো স্পর্শ নেই। তাহলে কি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে ডায়েরির শেষ লেখা লাইনটা | আজ নিজের মেয়েকে রান্না ঘরে রান্না করতে দেখে অবাক হয়ে যায় রেহেনা। গরমে তার মেয়ের সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেছে। চোখের সামনে তার পিচ্চি মেয়েটা কিভাবে যেন বড় হয়ে গেছে। কিন্তু আজ শ্রাবণী এত সব রান্না করছে কেন
শ্রাবণী আজ আবারও নীল শাড়ি পড়েছে কপালে নীল টিপ খোলা চুল আর হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। সেই বিকাল থেকে সে অপেক্ষা করছে পিয়াসের জন্য। কিছু এলোমেলো শব্দ তার মাথায় ঘুরছে আর সে মিটিমিটি হাসছে…
রাত ৯টা বেজে গেছে কিন্তু এখনো পিয়াস আসে নি। শ্রাবণী খুব অস্তির হয়ে গেছে। বারবার সে তার মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে, স্যার এখনো আসছে না কেন? আমার তো অনেক পড়া বাকী আছে…
মেয়ের হঠাৎ রান্নাঘরে রান্না করা অবেলায় সাজগোজ আর স্যার না আসার জন্য ছটফট করা খুব অস্বাভাবিক লাগছে রেহেনার। হঠাৎ রেহেনার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখে পিয়াসের নাম্বারটা ফোনের রঙিন আলোতে জ্বলজ্বল করছে…
শ্রাবণী এখনো মন খারাপের বিকালে বেলকণিতে দাঁড়িয়ে পিয়াসের জন্য অপেক্ষা করে আর পিয়াস উত্তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে পায়ে হেটে ছুটাছুটি করে নতুন একটা টিউশনির জন্য। সে এখনো বুঝতে পারছে না কেন আন্টি তাকে শ্রাবণীকে পড়াতে না করে দিলো। সে তো শুধু ফোন করে বলেছিলো, আন্টি আমি আজ শ্রাবণীকে পড়াতে আসতে পারবো না।আর আন্টি বলে দিলো, পিয়াস তোমার আর শ্রাবণীকে কখনো পড়াতে আসতে হবে না..