আমি হুরমুরিয়ে ট্রেনে উঠে পড়তেই একটা শিষের মত শব্দ করে ট্রেনটা গতি নিলো। যেন আমার উঠে পড়ার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আমি বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। একটু আগেই পুরো হাওড়া ষ্টেশন জুড়ে যে ইঁদুর দৌড় দৌড়ালাম। আরেকটু হলেই প্রানপাখি খাঁচা থেকে বেরিয়ে যেত বোধহয়। হৃৎপিন্ডটা এখনও গরম হয়ে আছে। দরজার মুখটা ছেড়ে আমি ট্রেনের ভিতরে চলে এলাম। কামরাটা মোটামোটি ফাকা। আমার বাঁ দিকে জানালার ধারে বছর পঞ্চাশেক এর একটা বাঙ্গালী ভদ্রলোক বসে আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাহিরে তাকিয়ে কি যেন দেখছেন। তার উল্টোদিকে জানলার ধারটা ফাকা। ডানদিকে কতগুলো অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে বসে পা ছড়িয়ে কি যেন আলোচনা করছে। তাদের সবার গায়ে ইউনিফর্ম। আমি সেদিকে আর না তাকিয়ে বাঁ দিকে এসে জানালার ধারে বসে পরলাম।
বাঙ্গালী ভদ্রলোক একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। চায়ের কাপটা এমন ভাবে মুঠো করে ধরলেন মনে হলো যেন তার হাত সেটা ছিনিয়ে নেওয়ার মতলবেই এখানে এসেছি। লোকটা এত মন দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে কি যে দেখছে কে জানে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেলাম। সাথে একটা গল্পের বইও এনেছি। গল্প-উপন্যাসে পড়েছি দুরপাল্লার জার্নিতে নাকি খোশগল্প করে কাটানোর জন্য সহযাত্রী জুটে যায়। আমারতো একবারও তেমন হয়নি। সামনে যদি নিয়মিত যাত্রী বসে তাহলে চশমার উপর দিয়ে এমন ভাবে তাকায় মনে হয় যেন এই মাত্র টিকিট দেখতে চাইবে। আর অনিয়মিত যাত্রী বসলে সারাক্ষণ এই টেনশনে কাটিয়ে দেয় যে এই বুঝি তার স্টেশনটা পেড়িয়ে গেলো। আজও সামনে তাকিয়ে খোশগল্পের কোনো আশা দেখলাম না। ব্যাগ থেকে বইটা বের করতে যাচ্ছি এমন সময় সামনে থেকে একটা ভারী গলা ভেসে এলো।
– কতদুর?? আমি ব্যাগের মুখ অব্দি বের করা বই আবার ব্যাগের মধ্যে চালান করে বললাম,
– শিমুলপাহাড়, আপনি.?
– ওই কাছেপিঠেই।
আমি আঁড়চোখে দেখে নিলাম লোকটা চা শেষ হয়েছে। কি আশ্চর্য সেটার জন্যই এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলো নাকি.? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে লোকটা নিজে থেকেই আবার প্রশ্ন করলো,
– এ লাইনে খুব একটা যাওয়া আসা হয়না তাইতো.?
– নাহ ওই বছরে একবার।
– হুম ওই জন্যই চেনা মুখ নয়। আরও দুয়েকজন হলে তাসটা বের করা যেত। এখন কি করি বলুন তো।
পাশে তাকিয়ে দেখলাম কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা আর গল্প করছেনা যে যার খাতা বের করে নোট মুখস্ত করছে।
– এই শিমুলপাহাড় তো গ্রাম মশাই, কোনো আত্মীয়ও বাড়ি নাকি.? লোকটা যে লাইনে প্রশ্ন করছে তাতে একটু পরেই আমাকে একটা গল্প বলতে হবে। তবে সেটা বলতে যে খুব একটা খারাপ লাগে তাও নয়। বললাম,
– নাহ, একজনের সাথে দেখা করতে।
– প্রতিবছরই নাকি.?
– হ্যা প্রতিবছর, এই আজকের দিনেই।
বুঝলাম লোকটার চোখ ছানাবড়া হতে আর বেশি দেরি নেই। মোক্ষম প্রশ্নটা করবেন কিনা ভাবছি সাথে সাথে প্রশ্নটা গুলির মত ছুটে এলো।
– এই কে আছে বলুনতো ওখানে.? বছরে মাত্র একদিন দেখা করেন।
– আমার এক পরিচিতা, আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে সে মারা গেছে।
লোকটার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। শীতকাল এসে পড়লেও একটুও বিরক্ত লাগছেনা। আমার সামনে সহযাত্রী থেকে থেকে আঁড় চোখে আমাকে দেখছে। আমি যে মজা করছিনা সেটা এতক্ষণে বুঝে গেছে। কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিষয়য় তাই জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত হচ্ছে। শেষে থাকতে না পেরে বললেন,
– আপনি কি তান্ত্রিক নাকি মশাই.? প্রশ্নটা শুনে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।
– তান্ত্রিক ভেবে বসলেন শেষ পর্যন্ত.? আরেহ না মশাই আমি একটা আইটি কোম্পানিতে সফটওয়্যার ডেভেলোপারের কাজ করি। যন্ত্রপাতি নিয়েই কাজ। তন্ত্র-মন্ত্রের ধার কাছ দিয়েও যাইনা।
– তো এই বলছেন, মরা মানুষের সাথে দেখা করেন। ভদ্রলোক এবার আমাকে মনে হয় পাগল ভাবছেন।
– দেখা করি তো বলিনি.? বলেছি দেখা করতে যাচ্ছি।
– কেন.? ভদ্রলোকের কৌতূহল এইবার মাথায় উঠেছে। ব্যক্তিগত প্রশ্নের ধারই ধারছেন না।
– তাহলে আপনাকে একটা গল্প বলতে হয়.?
– ভুতের গল্প.?
– একেবারেই না। সহযাত্রী একটু হতাশ হলেন। পানশে মুখে বললেন,
– বেশ তা-ই বলুন।
ভাবখানা এমন যে তাকে গল্প শুনিয়ে মনোরঞ্জন করার জন্যই রেলদপ্তর আমাকে পাঠিয়েছে । যাইহোক, আমার চোখের সামনে থেকে ট্রেনের জানালার দ্রুতগামী দৃশ্য মুছে গিয়ে ফুটে উঠছে একটা শান্ত দুপুর। আমাদের নতুন কেনা বাড়ির দোতলায় মা ঘুমাচ্ছেন। বাহিরে কি একটা অচেনা পাখি চকোর চকোর করে ডেকে চলেছে। আমার সামনে খোলা ভুগোল বইটা। এই দুপুরটা আমি কোনোদিন ভুলবোনা। আমি ভুলতে পারবোনা। আমি ভুলতে চাইনা।
বইটার দিকে যতই মন দিতে চাইছি ততই মন যেন অস্থির হয়ে উঠছে। কাল সকালেই স্যার একটা পঞ্চাশ নম্বরের পরীক্ষা নেবে। আমি ভুগোলে কিছুই পারিনা। বইয়ের পাতা গুলো জন্মদিনে পাওয়া গিফটের কত রহস্যময়। পাশেই স্কুল ব্যাগ ছিল সেটা টেনে নিয়ে তার ভিতরে হাত চালালাম। কিছু একটা অনুভব করার চেস্টা করলাম। অনুভব করলাম।তারপর সেটা নিয়ে বিড়ালেই মত চুপিসারে ঘর থেকে বেড়িয়ে একবার মায়ের ঘরে উঁকি দিলাম। নাহ,এখনও ঘুমাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে আমি ছাদে চলে এলাম। নতুন ছাদটা খুব একটা বড়সড় নয়। একধারে ঠিক লাগোয়া পাশের বাড়ির ছাদ।সেটারও পাঁচিল তোলা হয়নি। দুপুরের শান্ত পাড়া যেন ঝিমিয়ে আছে। আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলাম।সাথে দিয়াশলাইটাও। একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। ছাদের দরজাটা আরেকবার তদন্ত করে সিগারেটটা ঠোটের কোনে ধরে দিয়াশলাইটা শবে জ্বালাতে যাচ্ছি এমন সময় কোথথেকে একটা মিহি গলা অথচ ধমকের স্বর শুনে থমকে গেলাম।
– এ্যাই, এ্যাই কি হচ্ছে ওটা.?
সামনে তাকিয়ে দেখি পাশের বাড়ির ছাদে একটা বছর পনেরোর মেয়ে কোমরে হাত বেধে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। দেখেই আমার গা টা রি রি করে জ্বলে উঠল। নেহাত পাশের বাড়ির ছাদে ছিল নাহলে ঠাস করে বসিয়ে দিতাম। গলা উঁচিয়ে বললাম,
– কিসের কি হচ্ছে.?
– তুই বিড়ি ফুঁকছিলি.? সে ছাদের ধারের দিকে আরও এগিয়ে এলো।
– বেশ করছিলাম তাতে তোর কি.? কেন জানিনা সিগারেটসহ হাতটা কোমরের পিছনে লুকিয়ে পড়লো নিজে থেকেই।
– এহহহহ, লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকে আবার রোয়াব নেওয়া হচ্ছে.? দেবো কাকিমাকে বলে.?
এইটারই ভয় পাচ্ছিলাম। মেয়েটার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বলে দেওয়াটা তার কাছে মোটেই অস্বাভাবিক কিছুনা। কিন্তু নিজের দূর্বল জায়গাটা কোনো ভাবেই শত্রুপক্ষকে বুঝতে দেওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে এইরকম হিংসুটে মেয়েদের।
– বিড়ি কোথায় সিগারেট খাচ্ছিলাম। লুকিয়ে খাচ্ছিলাম তোকে কে বলেছে.?
– তো আমাকে দেখে ওটা লুকোলি কেন.? আমি হাতের কাছেই একটা মোক্ষম উত্তর পেয়ে গেলাম।
– বাচ্চাদের সামনে সিগারেট খাওয়া ঠিক নয়। আমার উত্তরটা শুনে মেয়েটার লালচে মুখ আরো লালচে হয়ে গেলো। গলাটা ভিষনরকম উপরে তুলে এমন ভাবে দাঁড়া বলল মনে হলো বাংলা বর্ণমালায় “ড়” এর থেকে আরো শক্তিশালী “র” থাকলে ভালো হতো।
– দাঁড়া, দাঁড়া হচ্ছে তোর আজ কাকীমা। কথাটা পুরোপুরি শেষ করলো না সে। আমার শরীরের পাশ দিয়ে কিসের উপর যেন চোখ পড়েছে তার। সেটা অনুসরণ করে পিছনে তাকাতেই আমি কারণ বুঝতে পারলাম। আজ সকালেই ছাদে কাসন্দি শুকোতে দিয়ে মা। বোয়ামটার দিকে তাকিয়েই থেমে গেছে মেয়েটা। তার মুখ দেখে বুঝলাম মনে মনে কিছু একটা ফন্দি আঁটছে। এবার আমার ভ্রু কুঁচকানোর পালা।
– কি দেখছিস ওদিকে হ্যা।
– ওটা কি রে.? কাসন্দি.?
– কোনটা বলতো.? আমি সদ্য ডিম থেকে বেরোনো কাকের ছানার মত এদিক ওদিক তাকালাম।
– ও হ্যা, ওটা কাসন্দি।
আমি একপাশে সরে গিয়ে দাঁড়ালাম। পিছন থেকে সিগারেট সহ হাতটা বেরিয়ে এসেছে নিজে থেকেই। জীবনবিজ্ঞান বইতে কি যেন একটা লিখা ছিল।আমি মনে করার চেস্টা করলাম।
– যাহ, তোকে মাফ করে দিলাম।
মেয়েটা আমার উপর দয়া দেখালো। আমি মনে মনে জীবনবিজ্ঞান বইয়ের ব্যাপারটা ভাবার চেস্টা করলাম। কি যেন একটা নাম। মটর গাছে না কি.।
– এখনও শুকোয়নি.?
– কি জানি.? চেখে দেখতে হবে। মটর না শিম নিয়ে কি জানি লিখা ছিল মনে হচ্ছে।
– ওখান থেকে সরে যা আমি ঝাঁপাবো।
কথাটা শুনে আমার এতক্ষণে ভাবনাগুলো গুলিয়ে গেল। মেয়েটা বলে কি.? দুটো ছাদের মধ্যে অন্তত মিটার দুয়েকের ফাক। সেটা লাফিয়ে পার হওয়া অসম্ভব নয় কিন্তু মেয়েটার বয়স অল্প। একবার পা পিছলে গেলে দোতলার ছাদ থেকে সোজা নিচে। কংক্রিটের মেঝের উপর গিয়ে পড়লে আর রক্ষা থাকবেনা।
– তুই কি.? তুই কি পাগল.? নিচে পড়ে মরার শখ হয়েছে.?
সে আমার কথা কানেই নিলনা। জামার নিচের দিকটা তুলে হাটুর উপর বেধে নিলো।তারপর আমার দিকে হাত নাড়িয়ে এমন ভাবে সড়সড় করলো যেন কাঁক তাড়াচ্ছে। আমার বুকের ভিতর তখন গরম তেলের ফোটা পড়ছে। এর থেকে মা-কে বলে দিলেই ভালো হত। নিঃশ্বাস বন্ধ ছিল মেয়েটা ঝাপ দেওয়ার আগে চোখটাও বন্ধ করে নিলাম। খুলতেই দেখলাম সে সামনে নেই। পিছনে থেকে চাকুমচুকুম আওয়াজ শুনে দেখলাম আমাকে বিন্দু মাত্র পাত্তা না দিয়ে কাসন্দি শুকিয়েছে কিনা তদন্ত করতে শুরু করেছে সে। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। মেয়েটার মুখ লাল হয়ে আছে। চুলগুলো মুখের উপর দুলছে। খেতে এতটাই মগ্ন যে সেগুলো সরানোর সময় পাচ্ছেনা। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম,
– মা এখন আসবেনা শান্তিতে খা। সে আমার দিকে তাকিয়ে অল্প একটু হাসলো তারপর পা ছড়িয়ে বসে বোয়ামটা কোলের উপর তুলে নিলো। সে প্রথম ভালো করে দেখেছিলাম তাকে। খুব সে সুন্দরী তা নয়। ফরশা গায়ের রঙ, নাকটা বোঁচাই বলা চলে। কপালের এক প্রান্তে চুল শুরু হওয়ার আগে একটা সরু দাগ আছে। তার কোনো দিকে না তাকিয়ে তার খাওয়া দেখতে লাগলাম।
– এতটা লাফালি যে, ভয় করলোনা.? সে আমার দিকে তাকিয়ে কৌতূকের গলায় বলল,
– ধুর, আমি তোর মত ভিতু নাকি.?
আমার আর তখন তার সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছিল না। হয়তো হার মেনে নেওয়ার একটা দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি তখনই হয়ে গেছিল। খেয়েদেয়ে সে সেখানেই হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। নীল ভরাট আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
– মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে আকাশটা শেষ কোথায়.?
– আধ বোয়াম কাসন্দি সাবড়ে দিলে ওরকম অনেক চিন্তা মাথায় আসে। সে মুখটা আমার দিকে করে বলল,
– কাল আমার বিড়ালটা মরে গেছে।
– কোনটা ওই খয়েরী মোটা হুলো টা.?
– হু।
আমি আর কিছু বললাম না। সে একটানা আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলো। মনে হয় তার সেই বিড়াল টাকেই খুঁজতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক এভাবেই কেটে গেলো। তার ঠিক পরেই এমন একটা আশ্চর্যরকম ঘটনা ঘটল যে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠলো। ছাদের ঠিক বাহিরের কার্নিশ থেকে মোটা গলায় ডেকে উঠলো একটা বিড়াল। মেয়েটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। অন্যসময় হলে তেমন কিছু হতোনা। কিন্তু এই সময় আমার মনে হলো এটাই সেই মরা বিড়ালটা তার মালকিনকে ডাকছে। ছাদ থেকে কার্নিশ টা দেখা যায়না। অবশ্য একটু চেস্টা করলে লাফিয়ে তার উপর নামা যায়। মেয়েটা ছাদের ধার ধরে তরতর করে নিচে নেমে গেল। তারপর নিচে থেকে একটা হাত উপরে উঠে এলো।
– উঠতে পারছিনা ধর আমার হাতটা। আমি একটা হাত ধরে টান দিতে আরেকটা পা ছাদের উপর দিয়ে উঠে এলো মেয়েটা। উপরে আসতেই দেখলাম তার জামার নিচে দিকে কিছু একটা বাধা আছে । উপরে এসে সেটা খুলতেই দেখলাম একটা সদ্যজাত বিড়ালের বাচ্চা। সে আমার দিকে তাকিয়ে ঠোট কামরে বলল,
– মা টা ডাকছিল দেখ, এখনও চোখ ফুটেনি। মেয়েটার হাতের ভিতর সুয়ে মিউ মিউ করে ডাকছে বিড়ালটা। আমি ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা তার দিকে ধরতেই তার দাতটা আমার আঙ্গুলে লেগে গেল। আমি হাত সরিয়ে নিলাম। মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
– বলেছিলাম তুই ভিতু। তারপর হাতটা টেনে নিয়ে বিড়ালের গায়ে রাখলো। তুলতুলে লোমে সুরসুরি লাগছিল।
– কি সুন্দর না.?
এর উত্তরটা সে বোঝেনি কোনোদিন। আমার শরীরটা শিরশির করছিল তবে সেটা বিড়ালের লোমে নয়। বাচ্চা মেয়েটার কাসন্দি মাখা তুলতুলে হাতটা তখনও ধরে ছিল আমার হাতের কব্জির কাছটা শক্ত করে। ট্রেনটার আজকে কি মতলব কে জানে। আমি কথা শেষ করার সাথে সাথে এত জোরে একটা ঝাকুনি দিলো যে আমার সামনের ভদ্রলোকটা প্রায় ছিটকে আমার গায়ের এসে পড়লেন। আমার কনুইটা ঠুকে গেলো পিছনে। কোনো রকমে সামলে নিলে বাহিরে তাকিয়ে দেখলাম হুগলি স্টেশনে এসেছে। আমার সামনের ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি মশাই, বোর হয়ে গেলেন নাকি.?
– না, তা নয়, ভাবছিলাম আমার জীবনটা পানশে হয়েই কেটে গেল। আমি বাইরে তাকিয়ে বললাম,
– আমারটাও তাই। একটু আগে ডোবার উপর একটা লাল রঙএর ভাঙ্গা ব্রিজ পড়েছিল দেখেছেন.? অর্ধেকটা এসে আর নেই। ঠিক ওইরকমই। একটা সময়ের পর থেকে মনে করার মত কিছু নেই।
– হুম, আচ্ছা, আপনি তারপর বলুন।
আমি মুখ খোলার সাথে সাথে ট্রেনটা আবার গতি নিল। ছাদটা ছিল আমাদের কথা বলার জায়গা। দুপুরে মা ঘুমিয়ে পড়লে আমি চুপিসারে ছাদে চলে আসতাম। কোনোদিন সে আগে আসতো কোনোদিন আমি। জানিনা কেন আর সিগারেট খেতে আমার ইচ্ছা করতো না। ওর ও কাসন্দিতে অরুচি ধরে গেছিলো। মাঝে মাঝে মা ঘুম থেকে উঠে আমাকে ডাকতো। কথা বার্তা সেদিনকার মত ইতি। সে বছর বর্ষাটা বেশ জাঁকিয়েই এলো। ছাদে দাঁড়ালে মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোটা পড়তো। সাথে সাথে নিচ থেকে চিৎকার ভেসে আসে।
– বাবু বৃষ্টি পড়ছে জামা-কাপড় গুলো তুলে নিয়ে নিচে আয়। আমি ভিজবো বলে বায়না ধরলে মা বলতো,
– এইরকম বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগে, সামনে পরীক্ষা।
আমি মুশলধারা বৃষ্টি নামার আসায় চাতকের মত চেয়ে থাকতাম আকাশের দিকে। সেটা কোনোদিনও নামেনি। বর্ষা পেড়িয়ে শরতের একটা ভোর। সকাল থেকেই ঢাক বাজছে। আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনেই ছোট্ট ডোবা মত ছিল। সেখানে এত পরিমাণ কাশফুল ফুটেছিল মত হত শহরের সমস্ত বালিশ-তোশক কেউ ফর্দাফাঁই করে জরো করেছে। শুধু তাদের জেগে থাকা মাথা গুলো ঢাকের তালে তালে নাচতো। একদিন জানলায় দাঁড়িয়ে সেই নাচ দেখছি। এমন সময় দেখি কে যেন সেদিক দিয়ে হেটে গেলো। এপাশটাই কেউ সাধারণত আসাযাওয়া করেনা। প্রথমে চমকে গেলেও পরে বুঝলাম এ আর কেউ নয়, সে। আমি যে জানলায় দাঁড়িয়ে আছি কিভাবে বুঝলো জানিনা। আমার দিকে তাকিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে গোপন কিছু করতে চলেছে। আমি নিচে নেমে এলাম। এতক্ষণে সে আমার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। আমি দৌড়ে তার কাছে গেলাম।
– করছিস কি এখানে.? জঙ্গল তো ওদিকে।
– এখানে একটা ডাইনি থাকে।
আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম সে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো আমি থেমে গেলাম। এইসব ছেলেমানুষি আদিক্ষেতা আমার একদম ভালো লাগেনা। বয়স অনুযায়ী মানুষের বড় হওয়া উচিত, চিন্তায় ভাবনায় গাম্ভীর্য আসা দরকার। বিকেলের সাথে সাথে আলোটাও কমে এসেছে। একটা খসখস শব্দ হতেই সে দাঁড়িয়ে গেলো।
– এবার বিশ্বাস হলো তো.?
– এর মধ্যে বিশ্বাসের কি আছে.? আওয়াজ কি হতে পারেনা.?
আমার কথাটার বিশেষ গুরুত্ব দিলোনা সে। কাশবনের ধারে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। ডাইনি দেখছি বর্জাসন ছাড়া পুজো নেয়না।
– আপনি কি এসেছেন.? কাশের বন থেকে শনশন হাওয়ার স্রোত এসে তার কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিলো।
– মিনু এখন কোথায়.? ওও এখানে বলে রাখি মিনু সেই হুলোটা। বেচারি এখনও তার শোক ভুলতে পারেনি।
– যে মারা যায় সে আর ফিরেনা। এটা জানার মত বয়স হয়েছে তোর।
আমি তার পাশে এগিয়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মুখের কোনে যেন হালকা হাসির ছোয়া। জলটাতো বুঝলাম কিন্তু হাসিটার মানে কি.? আমি এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম। চোখে পড়লো একটু দুরেই ঘাসের উপর একটা পুরোনো ছেড়া কাপড় পরে আছে। হঠাৎ আমি চমকে উঠলাম। কাপড়টা নড়লো না.? আমি ভুল দেখছি নাকি.? আমি তার কাধ ধরে ঠেলা দিলাম।
– সন্ধে হচ্ছে উঠে আয়। মা বকবে এবার।
– তোর ভয় লাগলে তুই যা। ভিতু একটা।
আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না। একটু পরে মশার ঝাক বসবে এইখানে। আস্তে আস্তে সেই অচেনা হাওয়ার স্রোতটাও শক্তিশালী হচ্ছে। আমাদেরকে ঘীরে যেন পাক খাচ্ছে সেটা। আমি তার কাছে আরো কিছুটা সরে এলাম।
– মিনুকে আবার কি করে দেখবো.?
তার গলাটা আকুতির মত শুনাচ্ছে। আমার মাথা ঘুরতে লাগলো আমি বসলাম। প্রশ্নটা করার সাথে সাথে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেল। হাওয়ার টানে কাশের বন থেকে সেই ছেড়া কাপড়টা উড়ে এসে পড়ল তার কোলে। তারপর হঠাত প্রান পেল সেটা। তার কানে কি যেন বলতে চায়। ভয়ে আমার হাত পা কাপছিল। দুহাতে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। একবার মনে হল এক ছুটে পালাই। হঠাৎ মনে হলো সে খিলখিল করে হাসছে.!! কি ব্যাপার আমি কি ভুল শুনছি নাকি স্বপ্ন দেখছি। হাওয়ার স্রোত এসে আমাকে আছড়ে ফেলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। হঠাৎ খেয়াল হলো তার ডান হাতটা সজোরে চেপে ধরেছে আমার বাম হাতের কবজি টা। আমার আর পালানোর উপায় নেই। একটু পরেই হাওয়ার তেজ নিজে থেকে কমে গেলো। তার গা থেকে খসে পড়লো কাপড়টা। এবার সে উঠে দাঁড়াল। তারপর আগের মত নিরুত্তাপ মুখ করে বলল,
– চ ভিতু চ, মশা কামড়াবে এবার। আমি কোনোরকমে মুখে কথা এনে বললাম,
– কি হলো, কি হলো এখন.?
– দেখতেই পেলি ডাইনির সাথে কথা বললাম। আমার ব্যাপারটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা। আমি বললাম,
– কি বলল ডাইনি তোকে.? সে আমার দিকে মুখ করে একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
– ভিতুদের বলতে বারণ আছে।
– কে বলছে আমি ভিতু.?
– তুই ভিতু।
– ধেত বলনা।
– বলল মিনুকে আমি আবার দেখতে পাবো।
– কি করে.? তার চোখমুখ থমকে গেলো। সে দাঁড়িয়ে গিয়ে ভয়ার্ত মুখে বলল,
– তোর পিছনে একবার তাকা।
– কেন.?
– কেউ এসে দাড়িয়েছে।
আমি দম বন্ধ করে পিছনে তাকালাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না । আমি সাথে সাথে তার দিকে তাকালাম কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না। কাশবনে রাস্তা ছেড়ে একটু দুরেই মিলিয়ে যাচ্ছে তার নুপুরের শব্দ। তার কাছেই আমি প্রথম শিখেছিলাম যে আমাদের জানাশোনা গ্যাণিতিক সূত্রে বাধা জগতের বাহিরে আরো কিছু আছে। অবশ্য সে চাবিকাঠি আমাকে দিয়েছিল অনেক পরে। হয়তো আমি যোগ্য ছিলাম না।
তারপর পুরোদমে স্কুল শুরু হয়ে গেলো। তার সাথে আর দেখা-ই হতনা। গোটা দুপুর স্কুলেই কাটতো। স্কুল থেকে টিউশন। কখনও তাকে দেখতে না পেলেও তার ছায়া দেখতাম। যখনকার কথা বলছি তখন এত ইনভার্টারের ছড়াছড়ি ছিল না। সন্ধেবেলা লোডশেডিং হলে আমরা গোটা পাড়া লোক যে যার ছাদে চলে আসতাম হাওয়া খেতে। বাবা মা আমি সবাই মিলে ছাদে বসে গল্প করতাম। পাশের বাড়ির ছাদেও অনেকে বসে গল্প করতো। তার মধ্যে ঠিক তার গলা খুজে নিতাম। নিজেরটা শোনানোর জন্য ইচ্ছা করে জোরে জোরে কথা বলতাম। কথা বলতে বলতে সে উঠে এসে দাড়াতো ছাদের কিনারায়। চাঁদের অল্প আলোয় দেখতে পেতাম তার ছায়া মূর্তি। আমিও উঠে দাড়াতাম। দুটো অন্ধকার ছায়ামূর্তি ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতো একে অপরের দিকে।
যাইহোক এরকমই একটা লোডশেডিং এর রাত। আমরাও যথারীতি গল্প করছি ছাদে। পাশের বাড়ির ছাদ থেকে আওয়াজ আসছে না। আমার কেমন জানি একটা আশংকা হলো। ওরা কি বাড়ি নেই কেউ.? তা কি করে হয়.? আজ বিকেলেই দোতলার ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছি। ব্যাপারটা বড় কিছু নয়। তবুও আমার মনের ভেতর অস্থিরতা শুরু হলো। আমি মাকে বলে নিচে নেমে এলাম। বাড়ির বাইরে এসে রাস্তায় পা রাখলাম । আর সাথে সাথে দেখতে পেলাম আমার ঠিক হাত দুয়েকের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে। মাথাটা সামনে ঝুকিয়ে কি যেন ভাবছে।
– আজ উপরে এলিনা কেন.?
সে মনে হয় ভাবেনি আমি নিচে আসবো। একটু হকচকিয়ে গেলো। একটু চুপ করে থেকে কি যেন বলতে চেয়েও বলল না। তারপর আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে গম্ভির গলায় বলল,
– এত বড় ছেলে এখনও বাবার সাথে স্কুল থেকে ফিরিস.? আমি প্রতিবাদ জানালাম,
– আমি কি করবো.? বাবা ছাড়তে চায়না।
– কাল থেকে একা ফিরবি।
– একা ফিরবো.?
– তবে নয়তো কি.?
– আচ্ছা দেখা যাক।
মনে মনে ভয় করতে লাগলো হঠাৎ যদি কারেন্ট চলে আসে তাহলে উপরে যেতে হবে। ঠিক এই সময় তার হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। না হাতের না, নখের। তার হাত দিয়ে আমার হাত খামছে ধরেছে।খুব নিচু গলায় আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। একফালি তরল জ্যোৎস্না তার মুখটা ভিজিয়ে দিয়েছে। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি তার দুই চোখে কাজল মেশানো জল টলটল করছে। ও কি কাঁদছিল.?
– কি হয়েছে তোর.? সে আমার প্রশ্নের জবাব দিলোনা। যেটা বলল সেটাকে উত্তর নয় অনুরোধ বলা চলে।
– আমার সাথে একটু দৌড়াবি.? ভালো করে বুঝে নিয়ে বললাম,
– তোর পাগলামি ছাড় আমাকে উপরে যেতে হবে।
– না আয় আমার সাথে দরকার আছে।
সে আমার হাতে হালকা চাপ দিলো। জানিনা সেদিন কেন না বলতে পারিনি। আমার মতামতের কোনো ধারই ধারেনি সে। কোনোদিন না। যেদিন আসবার এসেছে নাহলে আসেনি।
– কতদূর দৌড়াতে হবে.?
– এই মাঠটা পর্যন্ত।
আমি হিসেব করে দেখলাম মিনিট দশেকের বেশি সময় লাগবেনা। আমি অগত্যা রাজি হলাম। কাঁচা রাস্তা দিয়ে আমরা দৌড়াতে লাগলাম। সমস্ত রাস্তাটা আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো। নিঃশ্বাসের শব্দের মধ্যে কেমন যেন একটা যন্ত্রনা লুকিয়ে আছে। যেন এই দৌড়টা শেষে খারাপ কিছু একটা ঘটবে। মাঠে পৌছেই আমরা দুজনে হাফাতে লাগলাম। মাঠের একপাশে আধশোয়া হয়ে বসে পড়লো সে। আমি ওতটা হাফাইনি। জিজ্ঞেস করলাম,
– এসবের মানে কি.?
– বস, বলছি। আমি তার পাশে বসে পড়লাম। সে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, তারপর বলল,
– আমার দৌড়ানো বারণ।
– কেন.?
– জানিনা, কি যেন হয়েছে।
আমার মনে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসছিল কিন্তু একটাও তাকে জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো না। আজকের তার জ্যোৎস্নামাখা মুখ আর রাতের হাওয়ায় উড়ন্ত চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার বহুদিনের চেনা সেই পাগলাটে সেই পেটুক মেয়েটার একটুও মিল পাচ্ছিলাম না। মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায় সেটা সেদিনও জানতাম না।
– যেটা করতে বারণ করেছে সেটা তুই করিস। তুই এরকম কেন.?
– কাল থেকে একলা ফিরিস এই মাঠেই দাঁড়াস।
– তারপর.?
– আমি দৌড়াবো তুই টাইম দেখবি।
আমি তাকে বহুবার বারণ করেছিলাম জানেন। তবুও সে শোনেনি। বললাম না.? তার কাছে হেরেছিলাম আমি বহু আগে। বাকিদিনগুলো সে হারেরই মহড়া দিয়ে গেছি। আমি রোজ স্কুল ছুটির পর দাঁড়াতাম মাঠের এক পাশে। গোটামাঠ জুরে তখন অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের ভীড়।
আমার কাছে ব্যাগ দিয়ে সে মাঠের এক ধার দিয়ে গোল করে দৌড়াতো। ঘড়িতে সময় দেখতাম আমি। দৌড়াতে দৌড়াতে দম ফুরিয়ে গেলে সে হাফাতে হাফাতে আমার কাছে এসে বলতো সময় কত হলো। মাঝে মাঝে আমি বারিয়ে বলতাম। সে খুশি হয়ে আমার দোকান থেকে চকলেট কিনে দিতো। আমি বুঝতে পারতাম সময় আস্তে আস্তে কমছে তার। চকলেট গুলো কোনোদিন খাইনি। সেগুলোর দিকে তাকালে আমি শান্তি পেতাম। জানি মিথ্যা তবুও পুরোনো কথা বলতে বলতে খেয়ালই ছিলনা আমার ডান পাশের কলেজ যাত্রীরা কখন নেমে গেছে.? কামরায় এখন আমরা দুজন। লোকটা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,
– আপনি ঠিক কোথায় নামবেন বলুন তো.?
– আগের স্টেশনে। এই মাত্র চলে গেলো।
– এ কি.!!! নামলেন না কেন.?
– আপনি বলুননা.? ওই নেমে ডাউনের ট্রেন ধরলেই হবে। আমি বাইরেটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম। তারপর বললাম,
– আমি গল্পটা খুব বেশি একটা বাকি নেই। জীবনটা উপন্যাসের মত হয়না কেন কে জানে। তাকে আমার অনেক কথা বলার ছিল। যেকথাগুলো বলতে পারিনি। শেষ কয়েকটা মাস বিছানা থেকে উঠতে পারেনি সে। শেষ কয়েকটা দিন ভালো জ্ঞান ছিলনা। নিঃশব্দে কখন হৃৎপিন্ড বন্ধ হয়ে গেছে কেউ বুঝতেই পারেনি। আমি খবর পেয়েছিলাম সেদিনই রাতে। আমি একটুও কাদিনি জানেন.? খালি একটা দিনের কথা মনে পড়ছিল।
সেদিন আমরা দুজন স্কুল থেকে ফিরছিলাম। কয়েকদিন হলো আর দৌড়াতো না ও। হয়তো আর পারতোনা। চুপচাপ দুজনে হেটে হেটে বাড়ি ফিরতাম। বিশেষ কথা বলতাম না। হয়ত কি বলবো সেটা ভাবতে ভাবতেই সময়টা কেটে যেত। সেদিন মাঠের উপর দিয়ে হাটছিলাম। বেশ বুঝতে পারছি দৌড়ানো তো দুরের কথা এতটা রাস্তা হাটতেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে তার। ডান হাতে আমার কনুইটা খামছে ধরে কোনো রকমে এগিয়ে নিয়ে চলেছে শরীরটা। হঠাৎ একটু পরে আমার দিকে থেকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বলল। শিতের বিকেল বলে মাঠটা ফাকা ছিল। পুরোটা শুনতে পাইনি কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম সে কি বলতে চাচ্ছে।
– মানুষ মরে গেলে কোথায় যায় জানিস.? ( হাফাতে হাফাতে বলল সে) আমি মাথা দোলালাম।সে মুখ নামিয়ে নিল মনে মনে কি যেন হিসেব করে আরো খানিকটা সরে এলো আমার দিকে। এখন তার দীর্ঘ যন্ত্রনাময় নিঃশ্বাস পড়ছে আমার বুকে। আমি তার মাথায় একটা হাত রাখলাম। সে যতটুকু পারে একসাথে বলার চেস্টা করলো কথা গুলো,
– আমাকে একটা কথা দিবি.? আমি চুপ.! দেবো বলতে পারিনি বিশ্বাস করুন।
– আমার যদি কিছু হয়। মানে আমি যদি না থাকি। তোকে তো কিছু বলতে পারবোনা। প্রত্যেকবছর আমার জন্মদিনের দিন আমার কবরের পাশে একটু আসবি.? যদি কোনোভাবে পারি তোর কাছে আসবো আমি। কথা বলবো তোর সাথে।
– সেদিন কাশের বনের উড়ন্ত কাপড়টা তোকে এটাই বলেছিল না.?
– হ্যা।
– দেখতে পেয়েছিল আর মিনু কে.?
সে আর কোনো উত্তর দিলোনা। আমার গলা ধীরে ধীরে বুজে আসছিল। চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার হাতে। সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে যতটা সম্ভব হাসার চেস্টা করলো
– বাচ্চাদের সামনে কি চোখের জল উল্লেখ করতে হয়.? আমার হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে তার মাথার চুলগুলোকে। সে ডান হাত দিয়ে আমার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,
– দেখিস বাবা তুই আবার যা ভিতু.? ভুত দেখে ভয়ে পালিয়ে যাস না।
ট্রেনটা যখন শিমূলপাহাড় পৌছালো তখন কামড়াটা পুরো ফাকা। আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক একটু আগেই নেমে গেছেন। যাওয়ার সময় কেন জানিনা আমার মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে গেছে। কি যে করবে কে জানে। আমি স্টেশনে পা রাখলাম। এখান থেকে একটু হাটলেই পড়বে কবরস্থান। অভারব্রীজ দিয়ে নিচে নেমে এলাম। প্রতিবছর এখানে রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকে আজ কিছুই পেলাম না। অগত্যা হাটা দিলাম। কাঁচা মাটির রাস্তা। দুপাশে ঝাঁউবন পাতলা হয়ে এসেছে। কিন্তু ঘরবাড়ি নেই বললেই চলে।
পায়ের তলায় ঝাঁউয়ের পাতা যেন তুলোর চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ধীরেসুস্থে ঠিক পনেরো মিনিট হাটার পর কবরস্থান চোখে পড়লো। আগের মতই আছে। আগের বছর ঠিক এই সময় এখানে কিসের যেন একটা মেলা চলছিল। এখন চারিদিকে শান্ত। সেটাই ভালো।আমি দরজার ফাক দিতে ভিতরে ঢুকে এলাম। কোথাও কোনো মানুষজন চোখে পড়ছে না। চারদিকটা বুনো গাছের ডালপালায় ভরে গেছে। তার মধ্যে মাঝে মাঝে দুয়েকটা পাথরের বেদি চোখে পড়ছে। একটা বুড়ো অশ্বথগাছের নিছে আছে তার কবর টা। সে ঘুমিয়ে আছে আজ পাঁচ বছর হতে চলল। সাদা পাথরের উপর তার নাম খোদাই করা আছে। সেটাতে একবার হাত বোলালাম আমি। দুহাতে এগিয়ে আসা ডালপালাগুলো সরিয়ে দিলাম। শ্বেতপাথরে ধুলো জমেছে।
কবরটার ঠিক পাশে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। এখন আমি কিছু বললে কি সে শুনতে পাবে.? যদি পেতো তাহলে এতদিনে একবারো আসতো না আমার কাছে.? নাহ, এবারো সে আসবে না। হয়তো কোনোদিন আসবে না। হয়তো মৃত্যুর পরে আর কিছু নেই। তবু আমি আসবো প্রতিবছর। সেভাবেই বেঁচে থাকবো আমি। একফোঁটা জল আমার চোখ থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়লো। আরওও কিছুক্ষণ সেখানে বসে আমি উঠে পড়লাম। দিগন্তের একপাশে সুর্য্যটা তখন ঢলে পড়েছে। সন্ধ্যের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে হবে। কবরস্থানের গেটের কাছে চলে এসেছিলাম। তখুনি পিছনে থেকে একটা মিহি গলার ধমক শুনতে পেলাম।
– এ্যাই, এ্যাই কি হচ্ছে ওটা.? আমি পিছন ফিরলাম না। চোখ বন্ধ করে নিলাম। পিছনে ডালপালার উপর পায়ের শব্দ হলো। তারপরেই একটা নরম হাত এসে স্পর্শ করলো আমার পিঠ।
– কত বড় হয়ে গেছিস.????? আমার একটাই কথা বলার ছিল। এতদিন ভেবে এসেছি তার সাথে দেখা হলে অনেক কথা বলবো তাকে। আজ কিন্তু মনে হলো মাত্র একটাই কথা বলার আছে তাকে। আমি এখনও তাকাইনি তার দিকে। আমার চোখ বন্ধ। বললাম,
– শোন, আমি আর কোথাও যেতে দেবোনা তোকে। বুঝতে পারলাম সে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাও আমি চোখ খুললাম না। সে অস্ফুটে একটা শব্দ উচ্চারণ করলো,
– আমিও।
আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম তার মুখ। সে আমার দিকে আরো খানিকটা এগিয়ে এলো। আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
– আমি কিন্তু ভুত, ভয় করছেনা তোর.?
– নাহ, আমি আর ভিতু নই।
– তাহলে চোখ খোল।
আমি চোখ খুলে তাকে দেখতে লাগলাম। আজ সন্ধ্যার পর খবরে জানা যাচ্ছে যে হাওড়া থেকে শিমুলপাহাড়গামী ট্রেনের একটি বগি হুগলি স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয়। ঘটনাস্থলে ওই বগির সমস্ত যাত্রির মৃত্যু হয়। এ ধরনের দুর্ঘটনা কেন ঘটলো তা নিয়ে এখুনি বিশদে কিছু বলা যাচ্ছেনা।