পরিবর্তনের পরিণতি

পরিবর্তনের পরিণতি

নাসার চীফ সাইফুদ্দীনের রিসার্চ সেন্টারে বসে আছেন নাসার সাবেক বিজ্ঞানী আসাদ। যদিও সাইফুদ্দীনকে খুব একটা পছন্দ না করলেও বিজ্ঞানের প্রসারণের স্বার্থে এসেছেন। বহু কষ্টে সাক্ষাৎকারের সূচিতে নিজের নাম পেয়েছেন। যথাসময়ে আসাদের ডাক পড়লো। আসাদ ভেতরে গেলেন। সাক্ষাৎকার শেষে আসাদ রিসার্চ সেন্টার থেকে বেরিয়ে সোজা বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের একটা নির্জন পরিবেশে এলেন। এখন বুড়িগঙ্গার নদীর পানি একেবারে স্বচ্ছ। এখন সন্ধ্যার পর হাজারো মানুষের ভীড় জমে নদীর বাতাস উপভোগ করার জন্য। এখন আর নদীর পানিতে দুর্গন্ধ নেই, আছে প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা। বিজ্ঞানের কল্যাণের নদীর পানি সংস্কার ও মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে এটা সম্ভব হয়েছে।

অনেকক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করার পর উত্তরার বাড়িতে এলেন আসাদ। তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। বাড়ির ভেতরে নির্মিত নিজের গুপ্ত ল্যাবে এলেন। নূরী ও শরীফ সেখানেই আছেন। এরা তার সহকর্মী। আগে নাসায় একত্রে কাজ করতেন। আসাদ সিনিয়র হলেও তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব রেখেছেন। মহাকাশ বিষয়ক গবেষণায় এরা তার সাহায্য করেন। আসাদ ল্যাবের এককোণায় চেয়ারে বসে আছেন। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তা দেখে নূরী বললেন, “তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?” আসাদ একটু নড়েচড়ে বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন, “নাবিলা কোথায়?”

– তুমি আসার কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। আকাশ আবার ঝিম মেরে বসে রইলেন। নাবিলাও বিজ্ঞানী। তবে তিনি মেশিন নিয়ে গবেষণা করেন। আসাদের পুরানো বন্ধু তাই এই গুপ্ত ল্যাব সম্পর্কে তিনিও জানেন। গত চার বছর ধরে আসাদ বাকি দুজনের সাথে মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। যার ফলাফল কিছুদিন আগে পেয়েছেন। পৃথিবী থেকে কোটি মাইল দূরে এমজেবি গ্রহে এলিয়েনের সন্ধান পেয়েছেন। নাসা কর্তৃক এর আগেও একবার এই গ্রহে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু এলিয়েনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে আসাদরা পেয়েছেন। জেনেছেন এলিয়েনরা কীভাবে আত্মগোপন করে থাকে।

এলিয়েনের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই সবাই বেশ হাসিখুশি আছেন। এ তো এক বিশাল সফলতা। খুব শীঘ্রই তারা ব্যাপারটা পৃথিবীবাসীর সামনে তুলে ধরবেন। প্রস্তুতি সবই নেওয়া হয়েছে। এমন খুশির মুহূর্তে আসাদের গোমরা মুখ দেখে শরীফ ও নূরী বেশ চিন্তায় পড়লেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আসাদ বললেন, “আমি দুটো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশাকরি তোমরা সমর্থন দিবে।” শরীফ বললেন, “কী সিদ্ধান্ত?” আসাদ একনাগাড়ে বলতে লাগলেন, “প্রথমতো, এযাবৎ আমরা যত গবেষণা করেছি তার সকল তথ্য নাসার কাছে হস্তান্তর করবো। এই গবেষণায় আমাদের কোনো দাবি থাকবে না। দ্বিতীয়ত, আমরা এই ল্যাবটি এখানেই বন্ধ করে দিব।”

শরীফ-নূরী একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। এসব কি বলছে আসাদ? তার মাথা ঠিক আছে তো? এর কষ্টের গবেষণা অন্যের হাতে তুলে দিব তাও দাবি ছাড়া! শরীফ বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই দুষ্টামি করছো, তাই না?” দৃষ্টি স্থির রেখে আসাদ বললেন, “মোটেই নয়। আমি সিরিয়াস।” পরিবেশ বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। তারপর করতালির শব্দে ল্যাব ভরে উঠলো। নূরী তালি দিতে দিতে বললেন, “কত টাকায় বিক্রি করেছ নিজের সততা ও আমাদের চার বছরের পরিশ্রম?” নূরীর কথার মাঝে তাচ্ছিল্য ভাব আছে। নূরীর কথা শুনে শরীফ বললেন, “কী যাতা বলছো? ও এমন মানুষ না।” চিত্‍কার দিয়ে নূরী বললেন, “তাহলে এই সিদ্ধান্ত কেন? আমাদের কষ্টার্জিত তথ্য আমরা নাসাকে কেন দিবো?” বেশ শান্ত গলায় আসাদ বললেন, “তোমার কথায় আমি কিছু মনে করিনি। তবে এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।

– আমি মানি না এই সিদ্ধান্ত। আমাদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার তুমি কে? এই গবেষণায় আমাদের প্রত্যেকের অধিকার আছে।
– তাহলে নিয়ে যাও তোমাদের গবেষণা। আমি তোমাদেরকে বাধা দিব না।

এবার নূরী কেঁদে উঠলেন। আর বললেন, “তুমি আমাদের সাথে এটা করতে পারো না। এটা অন্যায়।” আসাদ বেশ কর্কশ ভাষায় বললেন, “এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। তোমরা তোমাদের গবেষণার তথ্য নিয়ে চলে যেতে পারো।” টাইলসের তৈরি মেঝেতে নূরী বসে পড়লেন। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ঘর সংসার সাজাইনি। নিজের চারটা বছর এই ল্যাবের পেছনে দিয়েছি কী এই দিন দেখার জন্য?” শরীফ সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। কিন্তু তিনি জানেন যে এই সান্ত্বনা নূরীর কান্না থামাতে পারবে না।

এই পুরো ল্যাবটাকে তারা নিজেদের সন্তানের ন্যায় দেখাশোনা করেছেন। যত্নে রেখেছেন গবেষণার প্রতিটি তথ্য। সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া যে কতটা কষ্টের তা শরীফ উপলব্ধি করতে পারছে। আসাদ ল্যাবের কোণায় কোণায় চোখ বুলাচ্ছেন। অনেক হাসিকান্না, পরিশ্রম, স্মৃতি, মায়া জড়িয়ে আছে এই ল্যাবে। তারও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। সে যে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে। আসাদ জানেন যে এলিয়েনের সম্পূর্ণ গবেষণা নাসার সাহায্য ব্যতীত সম্ভব নয়। তাছাড়া নাসার অনুমতি ছাড়া এই ধরণের গবেষণা বৈধ নয়। আইনী জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে।

তাই এলিয়েনের ব্যাপারটা নাসার চীফ সাইফুদ্দীনকে জানানোর জন্য তার রিসার্চ সেন্টারে গিয়েছিলেন। এতে নিজেই বিপাকে পড়ে যান আসাদ। খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে সাইফুদ্দীন ব্যাপারটাকে আইনের চক্রে জড়ানোর কথা বলেছেন। এই ধরণের গবেষণা আইনগত নয়। তাই এই অবৈধ গবেষণার জন্য তাদেরকে গ্রেফতার করা হতে পারে। এমনকি দেশদ্রোহীও ঘোষণা করা হতে পারে। বাঁচার শর্ত হিসেবে গবেষণার সব তথ্য সাইফুদ্দীনের হাতে হস্তান্তর করে ল্যাব বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সাইফুদ্দীনের সাথে আইনী লড়াই করতে পারতেন আসাদ। কিন্তু শরীফ ও নূরীর কথা ভেবে গবেষণার তথ্য হস্তান্তরে রাজি হয়ে যান। কেননা এই গবেষণা কেন্দ্র তার উদ্যোগেই চালু করা হয়েছিল।

“তুমি বড় ভুল করছো, আসাদ।” নাবিলার কণ্ঠ শুনে সবাই পেছনে তাকালেন। ল্যাবের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন নাবিলা। ল্যাবের গুপ্ত পথ তিনিও চিনেন। নূরীর কান্না যেন আরও বেড়ে গেল। একজন বুঝদার মানুষকে সচরাচর এভাবে কাঁদতে দেখা যায় না।

কিন্তু হৃদয় এসব বুঝে না। চার বছরের স্বপ্ন আজ ভাঙতে চলেছে। তাই চোখের জল বাঁধ ভেঙ বেরিয়ে আসছে। বেশ স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলেন আসাদ। “তুমি বুঝবে না, নাবিলা। তাই এই ব্যাপারে তুমি কথা বলো না।” কঠোর বাক্য হলেও আসাদ বলতে দ্বিধাবোধ করেননি। কেননা আজ যদি আবেগের কাছে হেরে যান তবে শরীফ ও নূরীর জীবনে বড় পরিবর্তন আসবে। বেশ দৃঢ়তার সাথে নাবিলা বললেন, “আমি সবই জানি। আমি অতীত, ভবিষ্যৎ দুটোই দেখে এসেছি। সাইফুদ্দীন তোমাকে ফাসাচ্ছে।” বেশ অবাক হয়ে গেলেন আসাদ। সাইফুদ্দীনের ব্যাপারে নাবিলার কিছু জানার কথা নয়। এদিকে বিস্মিত স্বরে শরীফ বললেন, “অতীত, ভবিষ্যৎ দেখ এসেছো মানে!”

চার বছর আগের কথা। সায়েন্স অব মেশিন গবেষণা কেন্দ্র থেকে ছাটাই করে দেওয়া হয় নাবিলাকে। একই সময় আসাদদেরকেও নাসা থেকে ছাটাই করা হয়। শুধু তাদেরকেই নয়, বিভিন্ন বিভাগ থেকে বেশ কিছু বিজ্ঞানীদের ছাটাই করা হয় সেই সময়। এতে নাবিলা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তবে আসাদরা নিজেরাই নিজেদের গবেষণা কেন্দ্র খুলেন। যা নাবিলাকেও জানায়।

এতে নাবিলাও অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের গবেষণা কেন্দ্র খুলে। আসাদ নাবিলা দুজনই পারিবারিকভাবে ধনী। দুজনের ল্যাবই সবই গুপ্ত ভাবে বানানো হয়। আসাদদের ল্যাবের কথা তারা জানালেও নাবিলা নিজের গবেষণার ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাননি। নিজের গুপ্ত ল্যাবে নাবিলা টাইম মেশিন বানানোর চেষ্টায় জুড়ে যান। যার সফলতা দীর্ঘ চার বছর পর এসেছে। কিছুক্ষণ আগেই নাবিলা সেই মেশিনের মাধ্যমে অতীত ও ভবিষ্যৎ দেখে এসেছেন। সে এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ। যা শোনার পর কেউই বিশ্বাস করতে চাইলেন না। অতঃপর নাবিলা সবাইকে নিয়ে তার গুপ্ত গবেষণা কেন্দ্রে এলেন।

টাইম মেশিন দেখে আসাদরাও অবাক হয়ে গেলেন। প্রথমে ল্যাবে কিছুই ছিল না। নাবিলা একটা বাটন চাপ দেওয়ার পর একটা যন্ত্র দৃশ্যমান হলো। যা এতক্ষণ অদৃশ্যমান ছিল। দোতলা বিশিষ্ট একটি যন্ত্র। তারা নিচতলায় উঠলেন। নাবিলা বললেন, “আমি এটাকে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান করতে পারি। যাতে কারও চোখে না পড়ে। বিজ্ঞানের খেলা।” নাবিলা সবার হাতে মুখোশ দিয়ে পরে নিতে বললেন। নাবিলা সময় ও স্থান নির্ধারণ করে একটা লাল বাটনে চাপ দিলেন। চারদিক আলোকিত হয়ে গেল। যা চোখের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। সবাই চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কিছুক্ষণ পরেই তারা চলেন এলেন ভবিষ্যতে। তারা এক মাস আগে এলেন। প্রথমে নাবিলা সবাইকে উত্তরায় আনলেন। যেখানে আসাদের গুপ্ত ল্যাব আছে।

সেখানে এসে আসাদরা অবাক হলেন। বাড়িটি পুলিশ কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লোকমুখে জানতে পারলেন নাসার চীফ সাইফুদ্দীনের করা মামলায় আসাদ, শরীফ ও নূরী দোষী সাব্যস্ত হোন। দেশের বিরুদ্ধে অবৈধ গবেষণা করার কারণে তাদেরকে দশ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে ল্যাব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নানান পত্রিকা ও টেলিভিশন দেখে তারা এক ভয়াবহ সত্য জানলেন। তাদের গবেষণাকে নিজের গবেষণা বলে জনসম্মুখে প্রকাশ করেন চীফ সাইফুদ্দীন। বিশ্বের কাছে প্রশংসনীয় হোন। তারপর এমজেবি গ্রহে নাসার একটা দল পাঠানো হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে টিমটা এলিয়েনের কাছে বন্দী হয়ে যায়। এতে বেশ রেগে যান সাইফুদ্দীন। এ যেন তার পরাজয়। আর তিনি পরাজয় মানতে নারাজ। অতঃপর এক বিশাল মহাকাশ ফোর্স নিয়ে স্বয়ং তিনি সেখানে যান। এরপর শুরু করেন ধ্বংসলীলা।

স্যাটেলাইটের কল্যাণে এই ধ্বংসলীলার স্বাক্ষী হয় পৃথিবীবাসীও। বাঁচার তাগিদে এলিয়েনদের আত্মচিৎকার ও এই ভয়ানক ধ্বংসলীলা দেখে পৃথিবীবাসীও কেঁপে উঠে। পারমাণবিক বোমা ও অন্যান্য বিষক্রিয়া দিয়ে পুরো গ্রহ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পৃথিবীবাসী এর বিপক্ষে মানববন্ধন করেছেন। সাইফুদ্দীনের পদত্যাগের চায় তারা। তাদের মতে এই ধ্বংসলীলা গ্রহণযোগ্য নয়। আসাদরাও নিজ চোখে বেশ কয়েকটি মিছিল দেখেছেন। এদিকে নাবিলার qহাতের ঘড়িটা লাল সংকেত দিতে লাগল। “চলো, আমাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে।” অতঃপর তারা টাইম মেশিনে এসে বর্তমানে ফিরে এলেন। নাবিলা বেশ শান্ত গলায় বললেন, “দেখলে তো সাইফুদ্দীনের চক্রান্ত ও ধ্বংসলীলা। ভবিষ্যতে সে পুরো গ্রহটা ধ্বংস করে দিবে। তোমাদেরকেও জেলে দিবে। আমাদের উচিত তাকে আটকানো।” আসাদ বললেন, “কীভাবে? সাইফুদ্দীন সবই জানেন।”

– অতীত পরিবর্তন করে। তোমার আর সাইফুদ্দীনের সাক্ষাৎকারে বাধা দিয়ে। বাকিটা আমরা বর্তমানে সামলে নিবো।
নূরী আতকে উঠে বললেন, “এতে কোনো সমস্যা হবে না তো?” নাবিলা বললেন, “নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চলে এলে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা তো এইমাত্রই ভবিষ্যৎ থেকে এলাম।”

অতঃপর আসাদ টাইম মেশিনে প্রবেশ করলেন। অতীতের সময় ও স্থান নির্ধারণ করা হলো। আসাদের হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়ে নাবিলা বললেন, “লাল সংকেত শুরু হলে যেভাবেই হোক দেরি না করে টাইম মেশিনে ফিরে আসবা। নয়তো” নাবিলা আর কিছু বললেন না। আসাদ মুখোশ পরে লাল বাটন চাপ দিলেন। পূর্বের মতো চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আসাদ অতীতে এলেন। ঠিক সেই সময় যখন সাইফুদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎকারের জন্য আসাদ তার ল্যাব বের হচ্ছিলেন।

যেভাবেই হোক তাকে আটকাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? নিজে যদি নিজের সামনে গিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে তবে উল্টো ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। কেননা অতীতের আসাদ তো ভবিষ্যৎ জানেন না। অনেক ভেবেচিন্তে আসাদ সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের উপর নিজেই আক্রমণ করবেন। এই মুহূর্তে কেউই ল্যাবে নেই। অতএব এটাই মোক্ষম সুযোগ। মুখোশ তো আগেই পরেছে। সুযোগ দেখে আসাদ তার অতীতের আসাদর উপর ঝাপিয়ে পড়েন। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। আসাদ নিজেই নিজের শক্তি দেখে অবাক হয়ে যান। কোনোমতে আসাদ তার অতীতের আসাদকে আহত করেন। অতীতের আসাদও কম নন। তিনিও বর্তমান আসাদকে আহত করেন। অতীতের আসাদ মাটিতে লুটিয়ে আছেন। আসাদের হাতের ঘড়িতে লাল সংকেত দেওয়া শুরু হলো। তিনি টাইম মেশিনে ফিরে আসেন। লাল রঙের “রিটার্ন” বাটন চাপতেই সবকিছু সাদা হয়ে যায় আসাদের কাছে।

নাবিলা ও বাকিরা মেগা ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। মেগা ল্যাপটপের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা আছে। ল্যাপটপ যখন জানালো টাইম মেশিনের লাল সংকেত শুরু হয়েছে তখন থেকেই নাবিলাদের হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল। আসাদ কোথায় এই চিন্তায় সবাই বিভোর। ঠিক কিছুক্ষণ পরেই ল্যাপটপ জানান দিলো টাইম মেশিন ফিরে আসছে। টাইম মেশিনের আসার সংকেত পেতেই সবাই আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। টাইম মেশিন দৃশ্যমান হলো। কিন্তু দরজা খোলার পর সেখানে আসাদ দেখলো না।

নূরী কেঁদে উঠে বললেন, “আমার আসাদ কোথায়?” শরীফের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। আজ তিন বছর পর নূরী তার মনের কথা বলেছেন। আমার আসাদ, শব্দ দুটোর মধ্যে যে কত ভালোবাসা আছে তা বলে বলা সম্ভব নয়। আপন মানুষটিকে হারানোর এক ভয়াল চিন্তায় নূরীর অবচেতন মন ভালোবাসার প্রকাশ করেছে। যা হয়তো নূরী জানেনও না। নাবিলা ছুটে গেলেন মেগা ল্যাপটপের কাছে। ল্যাপটপ জানালো আসাদ মেশিনে প্রবেশ করেছিল। শরীফ বললেন, “তাহলে গেল কোথায়?” নাবিলা চুপ করে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন, “আসাদ অতীত পরিবর্তন করতে গিয়েছিল। হয়তো সেখানে বিরাট কোনো পরিবর্তন হয়েছে। উত্তরার ল্যাবে যাওয়া উচিত।”

মিটমিট করে চোখ খুলে আসাদ নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করেন। নাবিলারা উত্তরার ল্যাবে এসে আসাদকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। মূলত আসাদ চলে আসার পর অতীতের আসাদ টলমলিয়ে ল্যাবে থাকা বিষাক্ত সিসার উপর পড়ে এই দশা হয়। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন আসাদ আর বাঁচবেন না। নূরী কেঁদে কেঁদে আসাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন। “আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি না বুঝেই তোমাকে অনেক কিছু বলেছি।” শরীফ নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছেন বেডে শুয়ে থাকা মৃত্যুর পথযাত্রী আসাদের দিকে।

মানুষটা সত্যিই মহান। প্রথমে তাদেরকে বাঁচাতে আসাদ সন্তান সমতুল্য ল্যাব বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর আবার এলিয়েনদের বাঁচাতে অতীতে যাওয়ায় আজ এই দশা। বেডের অন্যপাশে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছেন নাবিলা। তার দাদাও একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি সবসময়ই বলতেন, “প্রকৃতির সাথে খেলা করতে নেই। এর পরিণাম ভয়াবহ।” নাবিলার মতে বিজ্ঞান চাইলেই সবকিছু সম্ভব করতে পারে। কিন্তু আজ নাবিলা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে যে প্রকৃতির সাথে খেলা করতে নেই। এর ফলাফল সত্যিই ভয়াবহ। যার প্রমাণ আজ নাবিলার সামনে। মৃত্যর আগে আসাদ কিছু বলতে পারেননি। তবে সবার চোখে ভালোবাসা ও ধ্বংসলীলা মুক্ত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পরম সুখে দুনিয়া ত্যাগ করলেন।

নূরী ও শরীফ ল্যাবে থাকা গবেষণার সব তথ্য নষ্ট করে দেন। আসাদ চেয়েছিলেন এলিয়েনরা ভালো থাকুক। এই গবেষণা আজ নয়তো কাল আবার সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নাবিলাও তার টাইম মেশিন সহ ল্যাব বন্ধ করে দেন। প্রকৃতির সাথে খেলার পরিণত একবার দেখেছেন। আর দেখতে চান না। আসাদের ব্যবহৃত এপ্রোনটা পরে মাঝেমাঝে নূরী উত্তরায় আসেন। তবে ভেতরে যান না। শরীফ মাঝেমাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবেন, মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করা মানুষটি আজ আকাশের কোনো এককোণায় হারিয়ে গেছেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত