কল্লা কাটা

কল্লা কাটা

গল্পের শুরুতেই পরিচয় করিয়ে দেবো বন্ড বাহিনীর সাথে। না, না, এটা সেই নয়ন বন্ডের বাহিনী না। এটা সদ্য প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন ফুটপাতের ৭/৮ বছরের বাচ্চার বাহিনী। এদের কাজ হলো, রাস্তায় কোনো অচেনা/অজানা লোককে দেখলে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা।

ভাবছেন ছোট ছোট কচি বাচ্চারা আবার কীভাবে ভয় দেখায়? শুনলে আপনার চোখ দুটো নাকের উপর থেকে কপালের নিচে চলে আসবে। তাহলে শুনুন, এরা কোনো অচেনা লোক দেখলেই যেকোনো একজন যাবে ওর কাছে। তারপর টাকা চাইবে। টাকা না দিলে ভয় দেখাবে। বলবে, ‘টাকা না দিলে চেঁচিয়ে সবাইকে বলে দিবো আপনি কল্লা কাটতে আসছেন।’ তখন বেচারা লোকটা টাকা দিতে বাধ্য হয়। আর না দিলে কী যে হয় সেটা কেবল পল্টু মামাই জানে। বাহিনীটার পরিচয় এখনও কেউ জানে না। শুধুমাত্র তারাই জানে, যারা এদের কবলে পড়েছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে পল্টু মামা। পল্টু মামার একমাত্র ভাগ্নে বাবলু, ক্লাস টুতে পড়ে। বাবলু তার পল্টু মামাকে একদমই দেখতে পারে না। তাদের বাড়িতে আসলেই শুধু পড়া জিজ্ঞেস করে। বিরক্তিকর! আগেরদিন এসেছে পল্টু মামা। আজ তাকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। যেতে যেতে মামা বললো,

-বাবলু, সব পড়া ঠিকঠাক শিখেছিস তো?
-হুমম…
-স্কুল শেষে আমি সব স্যারকে জিজ্ঞেস করবো তুই পড়া পেরেছিস কি না।’ বাবলু উত্তর দিলো না।

-কী রে কথা বলছিস না কেন? আর কী পড়ালেখা করিস এসব? এখনও সাতের নামাতাও পারিস না। রাতে জিজ্ঞেস করলাম, চার সাতে বলেছিস ঊনচল্লিশ। ভালো করে লেখাপড়া করতে পারিস না?’ বলতে বলতে বাবলুর কান মলে দিলো পল্টু মামা। তখন থেকেই রাগটা বেড়ে যায় বাবলুর। মনে মনে ভাবে, মামাকে শাস্তি দিতে হবে।

বাবলুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে পল্টু মামা বাজারের দিকে যায়। বের হওয়ার সময় বোন তাকে বাজার করার জন্য বড় একটা ব্যাগ দিয়েছিল। বাজার করে করে সেই ব্যাগেই নিতে লাগলো সে। বড় তিনটা বাঁধাকপি আর একটা মিষ্টি কুমড়াও নিলো। আর দুটো ফার্মের মুরগি কিনলো রান্না করার জন্য। মুরগি দুটো জবাই করে নিলো যাতে ‘চিইক চিইক’ করে ডাকতে না পারে।

সব বাজার করে সে বাসার দিকে যখন যাচ্ছিল, তখন চোখে পড়ে সুন্দরী মেয়েরা কলেজে যাচ্ছে। একটা মেয়েকে তার ভালোও লেগে যায়। বাজারের ব্যাগ নিয়ে সে ফেরার কথা ভুলে যায় তখন। মেয়েটাকে ফলো করতে থাকে। জবাই করা মুরগি দুটো সে ব্যাগেই রাখে। সুন্দরী মেয়ের সামনে প্রেস্টিজ বলে কথা! এবার মেয়েটাও তার দিকে তাকায়। তারপর মেয়েটার দৃষ্টি গেল বাজারের ব্যাগের দিকে। বাজারের ব্যাগ দেখেই মেয়েটার মুখ হা হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে তাকালো সে পল্টু মামার দিকে। পল্টু মামা তখন নিজের চুলের উপর হাত বুলিয়ে হিরো হিরো ভাব আনার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। বাজারের ব্যাগটার কারণেই হিরোভাবটা ঠিক আসছে না। তার বোনটাও বোঝে না কিছু, বেড়াতে আসলেই শুধু বাজার করতে দেয়। কিন্তু এ কী! মেয়েটা তাকে দেখে এভাবে ভয় পেয়ে পালাচ্ছে কেন? পল্টু মামা মেয়েটার উদ্দেশ্যে ডাক দিলো,

-এই যে হ্যালো মিস, শুনছেন?’ বলতে বলতে পল্টু মামাও যায় মেয়েটার পিছুপিছু। মেয়েটা এবার চিৎকার করে বলতে থাকে,

-কে আছেন? বাঁচান! কল্লা কাটার লোক আসছে, বাঁচান!’ সাথে সাথে অনেকগুলো লোক এসে হাজির। মেয়েটা তাদেরকে পল্টু মামার ব্যাগ দেখিয়ে বললো,

-ঐ যে দেখেন, ওর ব্যাগে মানুষের কাটা মাথা আছে। ব্যাগ থেকে রক্ত পড়ছে দেখেন। আর দুই/তিনটা কাটা মাথা কীভাবে ব্যাগে ফুলে আছে দেখেন।’ পল্টু মামা হেসে বললো,
-আরে এগুলো বাঁধাকপি আর মিষ্টি কুমড়া।
-মিষ্টি কুমড়া থেকে কি রক্ত ঝরে শালা কল্লা কাটার লোক?’

উত্তেজিত পাবলিক আর দেরি করে না, পল্টু মামাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গণপিটুনি দিতে থাকে। শেষে তার বাজারের ব্যাগ থেকে সব বাজার ছিটকে পড়লে পাবলিক নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। ততোক্ষণে পল্টু মামার হাড্ডি মাংস এক হয়ে গেছে। ব্যাথায় নড়াচড়াও করতে পারছে না। পাবলিক এবার তাকে সহানুভূতি দেখিয়ে সব বাজার ব্যাগে ভরে দিয়ে একটা রিকশায় তুলে দেয়। পল্টু মামা আশেপাশে তাকিয়ে ঐ মেয়েটার খোঁজ করে। বদমাইশ মাইয়াটাকে কোথাও দেখা গেল না। তাকে ফাঁসিয়ে কেটে পড়েছে। ঘরে ফিরে পল্টু মামা বোনকে কিছুই বুঝতে দিলো না। এমন ভান করলো যেন সবকিছু স্বাভাবিক। বাজারগুলো রেখে সে একটা রুমে ঢুকে ব্যাথায় কাঁদতে লাগলো। মিঠুনদা ওরফে ফাটাকেষ্টর ডায়লগটা বারবার কানে বাজতে লাগলো, “পাবলিকের মার, কেওড়াতলা পার। শরীরের ব্যথায় অনেকক্ষণ বিছানায় একাত ওকাত করলো পল্টু মামা। রান্না ঘর থেকে তখন বোন ডাক দিয়ে বললো,

-পল্টু, বাবলুর স্কুল মনে হয় ছুটি হয়েছে, ওকে একটু নিয়ে আয় তো ভাই।’ বোনের কথা শুনে ‘হু হু’ করে কেঁদে উঠলো পল্টু মামা। বোনকে সে কী করে বোঝাবে যে, শরীরের ব্যথায় সে হাঁটতে পারছে না। তবুও কষ্ট করে জামাটা বদলিয়ে বের হলো সে। পাবলিক যদিকে কম, সেদিক দিয়েই হাঁটছে সে। একটু আগে মার খেয়েছে সে পাবলিকের, এখন কেমন যেন লজ্জায় হাঁটতেও পারছে না। পাবলিক যাতে তার চেহারাটা চিনতে না পারে তাই মুখে একটা রুমাল বাঁধলো সে। রুমাল বাঁধা পল্টু মামাকে চিনতে পারলেও বাবলু না চেনার ভান করলো। মামাকে শাস্তি না দিলে তার মন শান্ত হবে না। মামা যখন তার হাত ধরে ‘আয়’ বলে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে চিৎকার করে উঠে,

-মাগো, বাঁচাও। কল্লা কাটা আসছে, বাঁচাও।’ বাবলুর চিৎকার শুনে আবারও পাবলিক এসে হাজির। আবারও পল্টু মামার উপর চললো মারের দ্বিতীয় ডোজ। মার খেতে খেতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, মুখ থেকে তার রুমালটা সরে গেছে। তখন বাবলু চিৎকার করে বললো,

-থামুন আপনারা, এটা আমার মামা।’ পাবলিক তো অবাক! এ কী কাণ্ড! পরে সবাই পল্টু মামার মাথায় সহানুভূতির হাত বুলিয়ে চলে যায়। বাবলু এসে মামার হাত ধরে বললো,

-মামা, তুমি এভাবে মুখে রুমাল পেঁচিয়েছো, আমি তো চিনতেই পারিনি।’
-ওরে হতচ্ছাড়া, তুই কি আমার কণ্ঠটাও ভুলে গেলি?’ ব্যথায় ককিয়ে উঠলো পল্টু মামা।
-ভুল হয়ে গেছে মামা, আমি বাসায় কিচ্ছু বলবো না। চলো।

করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পল্টু মামা ভাগ্নের দিকে। বাবলুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে পল্টু মামা এবার ফার্মেসীতে এলো ব্যথার ওষুধ কিনতে। ওষুধ নিয়ে ফেরার সময় কলেজের সেই মেয়েটাকে চোখে পড়লো। না, না এই মেয়েটার সাথে আর লাগা ঠিক হবে না। সাংঘাতিক মেয়ে একটা! মেয়েটাকে না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল সে। তখন মেয়েটা পেছন থেকে ডাক দিলো,

-এই যে শুনুন পল্টু মামা না শোনার ভান করে পায়ের গতি বাড়ালো। মেয়েটাও আসতে লাগলো পেছন পেছন। পল্টু মামা দৌড়ে পালাতে গিয়েও পারলো না গায়ের ব্যথার কারণে। মেয়েটা এসে তাকে ধরে ফেললো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

-কী ব্যাপার এভাবে পালাচ্ছেন কেন? সকালে না হয় একটা ছোট ভুল করেই ফেলেছি।
-এটা ছোট ভুল? আমার পাঁচদিনের আয়ু দুইদিন করে দিছে পাবলিকরা মেরে।
-আমার কী দোষ? আমি কি জানতাম আপনি মুরগি জবাই করে ব্যাগে নিবেন? তার উপর ব্যাগে আরো মিষ্টি কুমড়া, বাঁধাকপি নিছেন। কেমন যেন কল্লা কাটার মতো মনে হচ্ছিল।

-থাক, থাক, আর সহানুভূতি দেখাতে হবে না। আমি কালকেই নিজ এলাকায় চলে যাবো। অনেকদিন পর একটু বোনের বাসায় বেড়াতে আসলাম। বেড়ানো আর হলো না। এখানে থাকলে মার খেতে খেতে মরে যাবো।
-ও মা, এ কী! আবার মার খেয়েছেন? আবার কে মার খাওয়ালো?
-আমার ভাগ্নে! এই যে অনেকগুলো ব্যথার ওষুধ কিনেছি, ব্যথাটা যদি সারে!
-তা সকালে আমার পিছু নিয়েছিলেন কেন?
-ভালো লেগেছিল আপনাকে তাই।
-আপনার নাম্বার দিন। আমি যোগাযোগ করবো।’

মুহূর্তেই সব ব্যথা ভুলে গেল পল্টু মামা। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মেয়েটাকে নাম্বারটা দিয়ে চলে এলো বোনের বাসায়। পরদিন নিজের ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাচ্ছিল পল্টু মামা। বাস স্টেশনের কাছে আসতেই সামনে এলো একটা ৭/৮ বছরের ছেলে। এসেই ছেলেটা পল্টু মামার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

-টাকা দে পাঁচহাজার।’ পল্টু মামা ছেলেটার আপাদমস্তক দেখে নিলো। কেমন যেন সিনেমার বড় ভিলেনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। শার্টটা প্যান্টের ভেতর গুঁজানো, আর শার্টের কলার উপরের দিকে তোলা। কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা। পল্টু মামা জিজ্ঞেস করলো,

-কে রে তুই? তোকে টাকা দেবো কেন?’ ছেলেটা হাতে চুটকি বাজিয়ে বললো,
-বন্ড ০০৮। টাকা দে। নয়তো মার খাবি।
-কী! তুই আমাকে মারবি? তোর সাইজ আর আমার সাইজ দেখেছিস? আর কী বন্ড বন্ড করছিস? নয়ন বন্ড তো মারা গেছে।
-এটা নয়ন বন্ডের বাহিনী না। এটা বিচ্ছু বন্ডের বাহিনী, বন্ড জিরো জিরো এইট! পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কেটে পর, যা।
-ঐ যা তো, যা এখান থেকে।
-আবারও বলছি, টাকা দে। নয়তো খুব খারাপ হবে।
-যা পারিস কর যা।’ বলেই বাসের দিকে যেতে লাগলো পল্টু মামা। ছেলেটা এসে পল্টু মামার হাত শক্ত করে ধরে চিৎকার করতে লাগলো,
-আমাকে কল্লা কাটা নিয়ে যাচ্ছে। আমার কল্লা কেটে ফেললো গো আল্লাহ, বাঁচাও। কল্লা কাটা, কল্লা কাটা!

ছেলেটার চিৎকার শুনে চারদিক থেকে লোকজন এসে ঘিরে ফেললো পল্টু মামাকে। তারপর ঢোল পিটানোর মতো করে পিটাতে লাগলো তাকে। পল্টু মামা কোনো মতে ফাঁক গলে বের হয়ে প্রাণটা হাতে নিয়ে দৌড় দিলো আবার বোনের বাড়ির দিকে। লোকজনও পেছন পেছন ছুটে আসতে লাগলো। নিজের ব্যাগটা লোকজনের লাথি ঘুষা খেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে নেয়ার সুযোগও পেল না পল্টু মামা। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে সে, পেছনে উত্তেজিত পাবলিক লাঠিসোটা নিয়ে তাড়া করছে ওকে। ভাগ্যিস, মাঝপথে কলেজের সেই মেয়েটাকে পেয়ে যায় সে। মেয়েটা নিজের পরিচিত বলে লোকজনের পিটুনি থেকে বাঁচায় তাকে। লোকজন চলে যেতেই সে খেয়াল করে মারতে মারতে ওরা তার প্যান্টটাও খুলে রেখে দিয়েছে। ভাগ্যিস আন্ডারওয়্যার ছিল। আন্ডারওয়্যারের আশীর্বাদে পল্টু মামার বাকি ইজ্জতটা বেঁচে যায় সে যাত্রায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত