তোমাকে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না চৈতি। আমি বাবা মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবো। আমি চাইনা তাদের কষ্ট দিতে । বাবা নাকি অনেক আগেই নিজের ভাইয়ের মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে রেখেছে । কিছু দিনের ভিতরে আমার বিয়ে । পারলে ক্ষমা করে দিও। এই বলেই ফয়সাল হনহন করে চলে গেল । আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছি। বুকের বা পাশে চিনচিন করে বড্ড যন্ত্রণা করছে । গলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এক দলা চাপা কষ্টে। কতো সহজে তিন বছরের সম্পর্ক এভাবে শেষ করে দিয়ে গেল । একবার পিছনে ফিরে যদি দেখতো আমার চোখের আর্তনাদ তাহলে হয়তো ফিরে আসতো।
ফয়সাল একটা বিদেশি কম্পানিতে জব করে । কতো রাত কতো দিন আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছি আমাকে বিয়ে করবে হানিমুন করতে কোথায় যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি । ফয়সালের সাথে আমার পরিচয় একটা বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে । প্রথম দেখাতেই প্রেম তারপর কাছে আসা। ফয়সাল সেদিন চলে গেল আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে । এক সময় নিজেকে সামলে নিলাম । মনে করতাম আমার ভালোবাসা আমার আবেগের চাদরে মোড়ানো থাকুক । কখনও নষ্ট করতে দেব না। আজ ছ বছর দুই মাস পর ফয়সালের সাথে আমার দেখা হলো একটা হাসপাতালে । আমি রুগি দেখছি এমন সময় একজন নার্স এসে বললো ,
– ম্যাম ইমার্জেন্সি একটা রুগি এসেছে বড়ো স্যার ভিতরে ডাকছে ।
আমি খুব তাড়াহুড়ো করে ভিতরে গেলাম । ভিতরে ঢুকে আমি অবাক । আমার সামনে ফয়সাল বসে আছে । উস্কো চুল চোখ দুটি গর্তের ভিতরে । হঠাৎ করে কাশি দিতেই এক দলা তাজা রক্ত বের হয়ে গেল । পাশে বসে থাকা একটা তরুণী কাঁদতে কাঁদতে রক্ত মুছে দিয়ে দৌড়ে আমার কাছে এসে বললো ,
– ডাক্তার আপা আমার স্বামী কে বাঁচান । আমার স্বামী মরে যাচ্ছে । যতো টাকা লাগে দেব। তাকে বাঁচিয়ে দিন।
আমি থরথর করে কাপছি। একি সেই ফয়সাল যে কিনা হাজার হাজার মেয়ের ক্রাশ ছিল । যার জন্য পৃথিবীর সব মেয়ে মরতে ও রাজি। ফয়সাল আমার দিকে করুন দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে । যা আমাকে বলে দিচ্ছে চৈতি তোমাকে ছেড়ে আমি খুব ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।একটি বার ক্ষমা করে দাও।
— মিসেস আমান , আমাদের আর দেরি করলে চলবে না। আপনি আজই অপারেশনের ব্যবস্থা করুন?
— জি আমি এখনই ব্যবস্থা করছি স্যার।
দুই ঘন্টা ফয়সালের অপারেশন চললো। ফয়সালের দুইটাই কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । প্রায় এক মাস পর ফয়সাল সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে চলে গেল । কেউ একজন একটা কিডনি দিয়ে ওকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে । কিন্তু সে ডক্টর কে অনুরোধ করে গেছে কখনও যেন ফয়সাল জানতে না পারে কে এই কিডনি দিয়েছে । এমনকী ফয়সালের পরিবারের কেউ না।
— চৈতি তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? এভাবে ছটফট করছো কেন ?
— আমান আমি একটু পানি খাব।
— এখন ই আনছি।
আমান চলে গেল চৈতির জন্য পানি আনতে । চার বছরের বিবাহিত জীবন আমান আর চৈতির । নিজের থেকে ও বেশি ভালোবাসে চৈতিকে। সেদিন ফয়সালের অপারেশন হয় সেদিন কিডনি কোথাও পাওয়া যায়নি। ফয়সালের অবস্থা খুব খারাপ তখন, চৈতি আমান কে ফোন করে বলে,
— আমান তোমার সাথে আমার একটা জরুরি কথা আছে?
— বলো কোনও সমস্যা হয়েছে হাসপাতালে?
— আগে বলো আমার কথা রাখবে?
— আচ্ছা আমি কখনও তোমাকে কোনও কাজে বাধা দিয়েছি। বলো কি বলবে?
— আমি আমার একটা কিডনি একজন অসুস্থ মানুষ কে দান করতে চাই। সে জীবনের সাথে লড়াই করছে । প্লিজ আমার শেষ অনুরোধ রাখ।
— তোমার কি মাথা খারাপ চৈতি। আমাদের অভ্রর বয়স মাত্র এক বছর । ও তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে ?
— আমান আমার কিছু হবে না। একটা কিডনি দিয়ে বাঁচতে পারে মানুষ । আমি নিজে ডক্টর । খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবো দেখ।
— আমি জানি তুমি যা করবে ভেবে চিন্তা করে করবে । তোমার উপরে আমার ভরসা আছে । সেদিন চৈতি দেরি না করে নিজের কিডনি দিয়ে ফয়সাল কে বাঁচিয়ে তোলে। বার বার ভেসে ওঠে ফয়সালের দুই সন্তান আর স্ত্রীর হাউমাউ করে কান্নার দৃশ্য । এক সপ্তাহ পর ফিরে আসার সময় চাকরি টা ছেড়ে দিয়ে আসে চৈতি। কোনও দিন যেন প্রিয় কোনও মানুষের করুন আর্তনাদ দেখতে না হয়।
আমান পানি নিয়ে ফিরে এসে বললো,
— এই নাও পানি । চৈতি ঢকঢক করে পানি টুকু খেয়ে আমানের বুকে মাথা রেখে বললো ,
— একটু ছাদে যাবে আমান ?
— এতো রাতে ছাদে ? তোমার কি মাথা ঠিক আছে?
— তোমার বুকে মাথা রেখে আমার খুব চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছে । চলোনা যাই। এই বলেই চৈতি বিছানা থেকে নামতে গেল । আমান বাধা দিয়ে বললো, ,
— এই দাঁড়াও, আমি তোমাকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে যাই চলো। এই বলেই চৈতি কে কোলে তুলে নিল। চৈতি ভয়ে চিৎকার করে বললো ,
— এই কি করছো আমি পরে যাবো ? আমান কিছু টা রেগে বললো ,
— কাল থেকে তোমার কম খেতে হবে বুঝলে ? চৈতি অবাক হয়ে বললো কেন ? আমান জোরে জোরে হেসে দিয়ে বললো ,
— আগের থেকে অনেক মোটা হয়ে গেছ। আমার কোলে উঠাতে কষ্ট হচ্ছে ।
এই বলে দু জনেই হাসতে লাগলো। ওদের সামনে জ্বল জ্বল করতে লাগলো মিষ্টি একটা চাঁদ । চৈতি স্বামীর বুকে মাথা রেখে মুগ্ধ চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে ।