জুন মাস। শরীর ঝলসে যাওয়ার মতো গরম পড়ছে। সুস্থ টগবগে যৌবনে ভরপুর মানুষও কেমন যেন মিইয়ে যায়। সেখানে ছাপ্পান্ন বছরের রোগক্লিষ্ট নিঝুম নির্জন বাড়ির চারতলার একটা ঘরে দিনের পর দিন বন্দি থাকা নাজনীন সুলতানা নাজ নামের প্রাক্তন একজন নার্সের তো ক্লান্ত লাগবেই। বড়ই ক্লান্ত তিনি । হাজারো মানুষের সেবা করা নার্স আজকে অন্যের সেবা ছাড়া চলতে পারেন না। দুই পায়েই গ্যাংগ্রিন হয়েছে। বেঢপ ফোলা পায়ের দশ আঙুলে কালো পোড়া ঘা। ছিপছিপে শরীরে এখন প্রায় আড়াই মণ মাংস থলথল করছে। মাথায় যে কয়টা চুল আছে তা প্রায় গুনে বলে দেয়া যায়। এমন ভাবে কি বেঁচে থাকতে পারে মানুষ? তবুও তিনি বেঁচে আছেন।
বদ্ধ ঘরে এসির বাতাসও অসহ্য লাগে। খুব কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে জানালাটা খুলে দেন। সাথে সাথে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢোকে। খুব ভালো লাগে উনার। জানালার কাছের একটা চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকান। বাড়ির সামনের বাগানে অজস্র ফুল ফুটেছে। নানারকম ফলের গাছেও ফল আছে। সবমিলিয়ে খুব ভালো লাগছে উনার। মনে মনে ভাবেন,’ টিয়ার ( উনার মেয়ে) বেশ যত্ন করে বাগানের। ইশ,নেমে যদি একটু হাঁটতে পারতেন!’
টিয়ার বাবার জন্য একটু মায়া এবং নিজের অসহায়ত্বের জন্য যখন চোখটা একটু ভিজে ভিজে উঠছে ঠিক তখন দেখলেন খুব সাজগোজ করা একটা মেয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে তাদের বাগানের দিকের ঘরে দরজা খুলে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। শরীরের অন্যান্য কলকব্জা অকেজো হলেও উনার চোখ এবং মাথা পুরো মাত্রায় সজাগ। ঘটনা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগলো না। মনের ভেজা ভাবটা হঠাৎ করেই উবে গেল। কপালের দুপাশের শিরা দপদপ করে জ্বলতে লাগলো। মাথার মধ্যে যেন আগুন ধরে গেছে। ঠিক তখন বাসার দরজা খুলে নাজনীন সুলতানা নাজের স্বামী মুহাম্মদ মাহবুব কায়সার বাসায় ঢুকলেন।
অফিস থেকে এসেছেন কিন্তু চেহারায় কোনো মনিলতা নেই। পোশাকের ভাঁজ কোথাও কুঁচকে যায় নি। কড়া দামি পারফিউমের গন্ধে চারপাশ মো মো করছে। পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চি লম্বা মানুষটা দামী ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে খুব আভিজাত্য নিয়ে তাকান। শিড়দাড়া সোজা করে হাঁটেন। প্রায় সময় তার গলায় উর্দু গজল শোনা যায় । সদাহাস্য মুখে কথা বলেন। মেয়েরা উনাকে বিশেষ পছন্দ করেন। পয়ষট্টি বছরের মানুষটাকে চল্লিশ বছরের ঝকঝকে যুবকের মত মনে হয়। বর্তমানে নাজকে উনার পাশে যে কেউ দেখে বলবে,’ এমন অসুন্দর জুটি কিভাবে এতদিন সংসার করছে?’
যাইহোক মানুষের কথা থাক। মাহবুব কায়সারের কথায় আসি। যশোরের গাড়িখানা রোডের বিশেষ একটা বাড়িতে উনার অফিস। যে অফিসে ষাট জন মেয়ে নিজের শরীর বিক্রির কাজ করেন। এবং তাদের উপার্জিত আয়ের পঞ্চাশ ভাগ মাহবুব কায়সার পান। এখানে এতো ফিটফাট হয়ে অফিস করার জন্য উনার আত্মীরস্বজনরা প্রচন্ড ঘৃনা করেন। তাতে অবশ্য উনার যায় আসে না। উনার ভাষায় আত্মীয়স্বজন মোছার সময় নেয়। উনি প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে মিনিট দুয়েকের জন্য নাজের ঘরে আসেন। নাকমুখ কুঁচকে দুটো একটা কথা বলে দ্রুত বের হয়ে যান। নাজ সব বোঝেন। তবুও সারাদিনে এই দুই মিনিটের জন্য তিনি অপেক্ষা করেন।
আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। অফিসের কাপড় পরিবর্তন করে খুব দামী ট্রাউজার আর একটা নীল ফতুয়া পরলেন। তারপর নাজের ঘরে খোঁজ নিতে গেলেন। দরজার কাছ থেকে ‘আজকে কেমন আছো?’ বলেই সরে আসছিলেন। নাজের উত্তর শোনার অপেক্ষাও করলেন না। অবশ্য নাজ প্রতিদিন যে উনার কথার উত্তর দেন এমনও না। তবে আজকে দিলেন। তিক্ষ্ণ কন্ঠে নিজের জায়গা থেকে চিৎকার করে উঠলেন,’ ইদানিং তাহলে বাড়িতেও বেশ্যার যাতায়াত শুরু হয়েছে? অফিসে গিয়ে সুখ হচ্ছে না। তাই ঘরে নিয়ে চটকিয়ে সুখ হবে তিনি ঠিক অসুস্থ মানুষ না এখন। রাগান্বিত মুখে তার আগুনের আঁচ। এক দমে কথাগুলো বলে হাঁফ ছাড়লেন।
ঠিক তখন মাহবুব কায়সারেরও ভদ্র মুখোশটা খুলে গেল। কি বললিরে খা*** মাগী….। তরে আজকে আমি জ্যান্ত কবর দেব..’ বলে দৌড়ে গিয়ে গায়ের জোরে চড় মারলেন। বাসায় ঠেকানোর মতো কেউ নেই। মাইনে করা আয়াও এসময় বাড়ি যায় দুই ঘন্টার জন্য।
চড় মেরেও রাগ কমে না। খুঁজে পেতে একটা লাঠি এনে ইচ্ছা মতো পিটান। দুহাতে মুখ ঢেকে গোঙানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না নাজ। এ নতুন না। প্রায় দিনই এই অত্যাচার চলে। অথর্ব একজনকে সামনে রাখতে হচ্ছে এই রাগ মাহবুব কায়সারের যায় না। নাজনীন সুলতানারও তিক্ষ্ণ কথার বান কমে না।
কিন্তু এমনতো ছিল না তাদের জীবন। বরং বেকার যুবক মাহবুব সরকারী নার্স বিয়ে করে বর্তে গিয়েছিলেন। আয় ইনকাম ভালো। সেবাযত্নও করে। তাছাড়া শরীর শরীর খেলায়ও নার্সের খুব উৎসাহ। সব মিলিয়ে বউকে খুব তোয়াজ করে চলেন। এই বাড়ির এক বিঘা জমিও নাজনীন সুলতানার টাকায় কেনা। একেবারে দইওয়ালার ছেলে পাকেচক্রে এমন ভাগ্যে ভারি আহ্লাদিত হন। এর মধ্যে সরকারীভাবে সৌদি আরব কয়েকজন নার্স পাঠানো হয় তারমধ্যে নাজনীন একজন।
ভালো টাকা আসবে ঘরে এই চিন্তায় বিভোর মাহবুব কায়সার খুব উৎসাহ দেন। তাছাড়া একটা মাত্র ছেলে। তার বয়স পাঁচ। তাকে তো তিনি নিজেই দেখাশোনা করতে পারবেন বলে বউকে উৎসাহ দেন। নাজও খুশি মনে চলে যান। বউয়ের পাঠানো টাকা সম্পদ বাড়াতে যেমন মনোযোগ দেন তেমনি নিজের শরীরকেও সতেজ রাখতে খরচ করেন। বোকা মেয়ে কিছুই বুঝতে পারেন না। চারবছর পর স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে যান। তাঁর জন্য একটা চাকরীরও ব্যবস্থা করেন। পরের দুই মেয়ে ওখানেই জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় দুজনের ইনকামও হতো বেশ। যদিও সিংহভাগ আয় নাজের। তাঁর জন্য অবশ্য স্বামীকে উনি কখনও ছোট করেননি।
অফিস থেকেও অনেক সময় রাত করে বাড়ি আসতেন। তবুও কিছু বলতেন না সারাদিন নানান ধরনের রোগী ঘেঁটে বাড়িতে একটু শান্তির পরিবেশ বজায় রাখতেন। তাছাড়া ছেলেমেয়েরাও বড় হচ্ছে। তাদের সামনে দাম্পত্যকলহ উনি এড়িয়ে চলতেন। সত্যি বলতে স্বামীকে তার গড়পরতা ভালো মানুষ বলেই মনে হতো। দেশে এত সম্পদ গড়ার পিছনেও যে স্বামীর অবদান এটা সবসময় ভাবতেন। যদিও শত অসস্তির মধ্যেও স্বামীর কাছে একবার শরীর মেলে ধরতেই হত। তাও স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু পঞ্চাশের কোঠায় পা দিয়েই শরীরে মেদ জমতে শুরু করলো। তারপর পুরো শরীর অসুখ গ্রাস করে নিল। চাকরি ছেড়ে দিতে হলো। তখন থেকেই মাহবুব কায়সারের আসল চেহারা বের হলো। ওদেশে চিকিৎসা চলাকালীন রাতে তার পাশে শুয়ে প্রচন্ড রাগ দেখাতো। অবশ্য তখন কিছু বললেও আস্তে বলতো।
তারপর চলে আসা হলো দেশে। দেশে মোটামুটি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন মাহবুব কায়সার। পরে অবশ্য নাজনীন জেনেছেন তার কষ্টের টাকা বিনিয়োগ হয়েছে পতিতাপল্লি ইজারায়। এবং তা থেকে টাকাও এসেছে হু হু করে। দিন দিন উনার অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগলো। স্ত্রীর শরীর রাতে কোনো ভাবেই পাওয়া সম্ভব না জেনে তার নগ্ন রাগ ফুটে উঠল। ছেলেমেয়ে কাউকে পরোয়া করে না। বড় মেয়েটা বাড়ির বিষাক্ত বাতাস সহ্য করতে না পেরে একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে বাঁচে। ছেলেটা বাবার অভ্যাস পুরোটা পেয়েছে। বন্ধুর বউকে বলাৎকার করতে গিয়ে ধরা পড়ে। বন্ধু প্রতিবাদ করলে রাগের মাথায় খুন করে ফেলে। এখন জেলে। ছোট মেয়েটা কিছুদিন আগে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। চিরকুট লিখে রেখে গেছে,’ মা, কেন মরলাম জানতে চেও না। পারলে তুমিও মরো। মরে নিজেকে উদ্ধার করো।’
কিন্তু অসুস্থ অথর্ব নাজ মরেননি। বেঁচে আছেন এবং প্রতিনিয়ত অপমানিত হয়েও বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানেই যত রাগ মাহবুব কায়সারের। তবে আজকের রাগটা যেন পুরো মাথায় উঠে যায়। মেয়েমানুষ এর আগেও এনেছে বাড়িতে। তবে একটা আড়াল রাখার চেষ্টা করতো নাজের কাছে। নাজ বুঝেও না বোঝার ভান করতো। চোখ বন্ধ করে কিছুই দেখছি না এমন ভাব। তবে আজকের পরিস্থিতি পুরো ভিন্ন। মাহবুব কায়সার দ্রুত নিচে নেমে গিয়ে নিচের ঘরের মেয়েটার হাত ধরে উপরে নিয়ে আসে। তার শোবার ঘর আর নাজের ঘর মুখোমুখি। দরজা খোলা রাখলে এ ঘর থেকে সব দেখা যায়। মাহবুব সেটাই করলেন। ঘরে ঢুকে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। নিখুঁত অভিজ্ঞতায় মেয়েটা বুঝে গেছে কি করতে হবে।
নাজ এ ঘর থেকে সব দেখছেন। হঠাৎ করেই তার নিজের উপর প্রচন্ড ঘৃনা হয়। এই নোংরার মধ্যেও দিনের পর দিন নিজেকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন! ঘৃনায় কুঁচকে ওঠে তার মুখ। সে নিজেকে শেষ করবে। তবে তার আগে। কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায়। পায়ের পাতায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে। তবে মনের তিব্র ব্যথার কাছে এ ব্যথা ভুলতে বেশী সময় লাগে না। থপ থপ করে পা ফেলে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যান। পায়ের ঘায়ের অংশ ফেটে গলগল করে রক্ত বের হয়। এসব তিনি দেখেনও না। মূহুর্তের মধ্যে আশবটিটা হাতে নিয়ে চলে আসেন। চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। এক কোপ বসিয়ে দেন মেয়েটার উপর নগ্ন নিমগ্ন মাহবুব কায়সারের ঘাড়ে। টাটকা রক্তের ছিটকে এসে পড়ে নাজের মুখে। আর চুঁইয়ে পড়া রক্তের মাঝে ডুবতে ডুবতে নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েটি বুঝতে পারে তার উপরের মানুষটি নিথর হয়ে যাচ্ছে।
নাজের তখন শারীরিক কোনো কষ্টের ছাপ নেই চোখে মুখে। এতো দিন বাদে একটা কুৎসিত কীটসম মানুষকে সরিয়ে দেবার আনন্দ তার চোখে মুখে। মেয়েটির ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সে বললো, তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। উঠে আস্তে ধীরে সব গুছিয়ে নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। তোমার কোনো চিহ্ন যেন না থাকে। আমি পুলিশের জন্য অপেক্ষা করবো…..’