সুদিনে দূর্দিনের গল্প অতি সুখের হয়। সেই সুখের দিন আর কোনোদিন আসবে বলে খুব বিশেষ আশা নেই। যথাসম্ভব নিরুদ্বেগ নির্ভাবনায় দিন অতিক্রম করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় মনের কষ্টের সাময়িক উপশম ঘটে বটে। কিন্তু সংসারে কেবলমাত্র আমার কষ্টই কষ্ট নয়, আরেকটা প্রাণ সেখানে বর্তমান। সে আমার স্ত্রী, সুরভি।
প্রায় তিন বছর হল সুরভি আমার সুখ দুঃখের সাথী। সুখের বললে ভুল হবে, বরং দুঃখের বলাই শ্রেয়। বছরের অন্য সকল দিন ঠেলেঠুলে একপ্রকার বয়ে যায়। কিন্তু বিশেষ দিনগুলোতে অভাব যেন চীনা জোকের মত জেঁকে বসে। সহজে ছাড়তে চায় না। ছাড়লে পরে জোকের গায়ে লবন দিলে যা বের হয় তা কেবল নিজেরই রক্ত।
“কী পড় তুমি?” স্ত্রীর প্রশ্নে শোয়া থেকে আধাশোয়া হই। রবীন্দ্রনাথের “পণ রক্ষা” গল্পের বংশীবদন তখন বাপ-মা মরা ছোট ভাইকে গভীর মাতৃস্নেহে মানুষ করতে মরিয়া। ছোট ভাইয়ের প্রয়োজন যখন ক্রমে উর্দ্ধমুখী; জীবনের টানাপোড়েনে বংশিকে তখন হিসেবী হয়ে উঠতে হয়। তবুও ছোট ভাইয়ের জন্য সে সারাজীবন অকৃপণ মনকে লালন করে যায়।
আমি স্ত্রীর প্রতি মনে মনে বিরক্ত হই। বিরক্তি মনের কোনে চেপে রেখে গল্প এগিয়ে চলে। ততক্ষণে রসিককে তাঁতের কাজে হাত লাগানোর সর্ব প্রকার চেষ্টা করেও বিফল হয় বংশীবদন। রসিকের মনে তখন একাদশী সৈরির আনাগোনা। চারপাশ রসে ভিজে টইটুম্বুর। কিছু বলার আগে ঈশারায় স্ত্রীকে বসতে বলি। নিজের বিয়ের আশা ত্যাগ করে ছোট ভাইকে সৈরির সাথে বিয়ে দিবে বলে মনস্থির করে বংশি। কিন্তু বিয়ের পণের অংক সাংঘাতিক রকমের বেশি। তবুও ছোট ভাইয়ের চাওয়াকে পাওয়া করা চাই।
চিরকাল নরম স্বভাবের বংশির কঠোরতায় রসিকের মন অভিমানী হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী রসিক গোপনে বাড়ি ছাড়ে। অনুতপ্ত বংশি দিন রাত এক করে তাঁত বুনে যায়। ছোট ভাই দাদাকে ছেড়ে কয়দিনই আর বাইরে থাকবে? একদিন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। সেদিন এসে যেন দেখে তার শখের বাইসাইকেল অপেক্ষায় আছে। সৈরির সাথে বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। সুখ স্বপ্নে ভেসে বংশি দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করে। শরীরের জোর শেষে যখন মনের জোরে খাটতে থাকল তখন স্বপ্ন পূরণ হলো; কিন্তু বংশির হলো মরণ। ব্যাথাতুর মনে গল্পের ভাঁজে আমার মন পড়ে থাকে।
বুঝতে পারি স্ত্রী এই পর্যায়ে চরম বিরক্ত হয়ে উঠেছে। পুনরায় প্রশ্ন করলে সংক্ষেপে উত্তর করলাম, “রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পড়ি”। স্ত্রী ঝাঝালো কণ্ঠে বলল, “সে তো দেখতেই পাচ্ছি।” আমি নিরুদ্বেগ বাক্যে বলি, “তাহলে?” তাচ্ছিল্য সহযোগে স্ত্রী আমাকে বলল, “তা মশাই তোমার রবীন্দ্রনাথে কী পেটে ভাত হবে? আজ বাদে কাল ঈদ অথচ সুরভির অসম্পূর্ণ বাক্য সম্পূর্ণ হতে পারে না। ইশারায় থামতে বলি। গল্প পাঠে ছন্দপতন ঘটলেও চালিয়ে যাই। রসিক তখন নিজেকে বিক্রির খাতায় তুলে দামদরে ব্যস্ত। নগদ অর্থ ও বহুমূল্যের পণ্য যৌতুক নিয়ে বিয়ে শেষে সফলতার ঢেঁকুর তুলছে। স্বপ্নের বাইসাইকেলে বাড়ি ফিরবে রসিক। দাদার সাথে আজ যেন তাঁরই জিত হয়েছে।
বাড়ি যখন আসল ফিরে তখন সেখানে কোনো প্রাণের চিহ্ন নাই। অজানা আশঙ্কায় গিয়ে দাঁড়ায় সৈরিদের বাড়ি। সৈরিকে দেয়া কাঁথায় ঢাকা নতুন বাইসাইকেল আর সৈরি যখন তার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ বংশি তখন অতীত ইতিহাস। শুধু কী বংশিবদন, রসিকও তখন অনেক দূরের। আজ সবকিছু তার হাতের মুঠোয়। কিন্তু সে নিজেই নিজের নয়, অন্যের।
গল্পের শেষ অনুভূতিটুকু বুকে নিয়ে মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকাই। সে বলল, “সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠলে। খাওয়া শেষে সোজা বিছানায়। চায়ের নাম করে বাইরে গিয়ে ফিরে ফের বিছানায়। এখন গোসল সেরে খাওয়া শেষে নিশ্চয়ই আবার বিছানামুখী হবে।”
আমি নির্ভার জবাব দিলাম, “ইহার অধিক আমার করণীয় কী?” সুরভি বলল, “ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আঁতুড় লোকের পাল্লায় পড়ে জীবন আমার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। শুধু আমি জন্যে আমি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, “কী বলতে চাও? শুধু তুমি জন্যে আমার ঘর করে গেলে? শুনো তবে, এই কথার মত ছল আর কিছুতেই নেই। আমাদের গ্রামের চান্দুর বউ দিনে সত্তরবার এই কথা বলে। আবার দিনশেষে একই সাথে খায়, একই সাথে শোয়।”
আরেকটু রস মিশিয়ে বললাম, “তোমার এই কথায় আমি অবশ্য রাগ করি না। দুনিয়ার সব স্ত্রীলোকই কম বেশি এই কথায় পটু। এই চিন্তা যদি বিয়ের আগে করতে তাহলে বরং লাভ হতো।” স্ত্রী মুখ ভার করে থাকে। রান্না শেষে খেতে বসি। কিছুক্ষণ আগের মুহূর্ত সে যেন ভুলে যায়। ভাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “কালকে ঈদ।” স্ত্রীর কথায় মনে হয় যেন মাত্রই জানতে পারলাম কাল ঈদ। আমি গোগ্রাসে আরেকটা গ্রাস মুখে পুরে বলি, “হুম।”
দতিন বছর হলো ছয় তলার এই চিলে কোঠা বাসায় আমাদের বাস। প্রমাণ সাইজের একটি রুম, ছোট্ট একটা গোছানো কিচেন, একটা বেলকোনী আর তার সাথেই ওয়াশরুম। অফিস থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে বাসা। অল্প আয়ের লোকের জন্য এর থেকে বড় সুবিধা আর কীসে! ঘরে গরম আছে, বাতাসও পর্যাপ্ত। খাবার শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। একটুবাদে স্ত্রীও শরীক হয়। বলল, “ভালই হয়েছে আমাদের কোনো যানজট নেই।” সুরভির কথায় আমি সচকিত হই। ভাবি, সত্যিই তো তাই। আমাদের গ্রামে যাওয়া নেই, কোনোরূপ যানজট, জনজট নেই। আমাদের যেন ঈদও নেই।
আমরা আট ভাই, তিন বোন। বাবা, মা এখনো বর্তমান। অভিন্ন সংসারে সবাই যেন ভিন্ন। যে যার মত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ যেন কারো নয়। কারও জন্যে কিছু করতে না পারা আমার থাকা না থাকা সমান কথা। আমার দিনহীন, মানহীন জীবনে নিজেকে নিজেই গুটিয়ে নিয়েছি। খুব হিসেব করে চললে তবেই একমাস বেঁচে থাকা যায়। সামান্য বোনাসে জমে থাকা ঋণের পাল্লার ওজন একটু কমে বটে; কিন্তু শখ আহ্লাদ পূরণের সুযোগ ঘটে না।
ছোট ছোট সুখ দুঃখের গল্পের স্রোতে আর উত্তপ্ত দক্ষিণা বাতাসে সুরভি ঘুমিয়ে পড়ে। আমি ওর মুখের দিকে তাকাই। চোখের নিচে বিস্তর কালি জমেছে। মুখ জুড়ে ক্লান্ত জীবনের সুস্পষ্ট ছাপ। কখনো কখনো স্ত্রীর হাত ধরে বলতে ইচ্ছে করে, “সত্যি করে বলো তো সুরভি, তোমার কী কখনো মনে হয় আমাকে বিয়ে করা তোমার মস্ত বড় ভুল ছিল?”
আমার বলা হয়ে ওঠে না। জীবনে কত কীই হতে পারতাম। কিন্তু আমি আমার সকল সম্ভাবনা পায়ে পিষে নিঃশেষ করেছি। আজ আমি সামান্য অফিসের এক সামান্য অফিসার। নামেই অফিসার, কাজে পুরোদস্তুর কেরানি। সকল বিষয়ে সকল প্রকার আফসোস আজ ঘুচে গেছে। নিজের প্রতি নিজের আশা সেই কবেই হারিয়ে ফেলেছি। স্ত্রীর কপালে হাত রেখে মনে মনে বলি, “কোনো উৎসব- পার্বণে কিংবা বিশেষ দিবসে কিছুই দিতে পারি না। আমার এই অক্ষমতাকে ক্ষমা করে দিও সুরভি।”
সুরভি জেগে ওঠে। আড়মোড়া ভেঙে চোখ তুলে তাকায়। আমি বলি, “বিকেল গড়িয়ে গেছে। চলো যাই ঘুরে আসি।” বাইরে ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে ওর কখনো কোনো আপত্তি থাকে না। কোন চাওয়া নেই, বিশেষ কিছু খাওয়ার আবদারও নেই। পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটতে পারাই ওর যেন বড় পাওয়া। আমরা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে দাঁড়াই। একলা ঘরে হাঁপিয়ে ওঠা জীবনে ও প্রাণ ভরে মানুষ দেখে। মুক্ত আকাশের বাতাস গায়ে মাখে। কতজন কতরকমের রাইডে ওঠে চিৎকারে মেতে উঠেছে। তাঁদের আমোদ আমাদের বিনোদনের খোরাক জোগায়।
আমরা গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসি নতুন বাজারে। আমি বাজারের কথা জিজ্ঞেস করি। কাল কোরবানির ঈদ। ন্যূনতম কিছু করা দরকার। সুরভি আমার পকেটের আদি বৃত্তান্ত সম্মন্ধে সম্যক অবগত। আমি একটা হাঁসের দাম জিজ্ঞেস করে দমে গেলাম। শেষে একটা কবুতরের বাচ্চা নেয়ার মনস্থির করছিলাম। সুরভি বলল, “কবুতর আজ থাক। তুমি বরং এক হালি ডিম নাও। ডিম ভূনা আর চিকন চালের খিচুড়ি ভাল লাগবে।” আমি বললাম, “তাই বলে ঈদের দিন মাংস খাব না।” সুরভি বলল, “এবারের ঈদ না হয় এভাবেই স্পেশাল হোক। মাত্র দুই আড়াইশ টাকা পকেটে; তাও যদি না থাকে।”
বাজার থেকে ফিরে আসি। নীচে বাড়িওয়ালার সাথে দেখা হয়। কোরবানির গরুর যত্ন নিচ্ছিলেন। আফসার হাজী দিল খোলা হাসি হেঁসে বললেন, “আংকেল আজকেই কিনলাম। কেমন হইছে কন দেখি।” বাড়িওয়ালার সাথে আমার যথেষ্ট খাতির। দেখতে পেলেই দূর থেকে গলা চড়িয়ে আঙ্কেল বলে ডাক দিবেন। আমি সালাম দিয়ে এগিয়ে যাই। গল্প করি। জীবনের যে প্রান্তেই দাঁড়িয়ে থাকি না কেন; বয়সে প্রবীণ কিন্তু মনে ও মননে নবীন একজন আফসার হাজীর সৌম্য শান্ত মুখচ্ছবি আমার মনে চির জাগরুক হয়ে থাকবে।
ঘরে ফিরে আসি। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত আমরা রাতের খাবার খাই। সুরভি ঘুমিয়ে পড়ে। আমি ফেসবুকে ঘুরি। কতজন এখনো রাস্তায় আটকে আছে, কেউ কেউ পৌঁছে গেছে ইতোমধ্যে। দীর্ঘ যানজট ঠেলে বাড়ির মেঠোপথে গিয়ে ক্লান্তি ভুলে একটা হাসিমুখের সেল্ফি তুলে দিয়েছে। আমি সেসব দেখতে থাকি। পরিচিতজনদের কল্যাণে আমার ফেসবুক নিউজ ফিড যেন একটা গ্রাম হয়ে উঠেছে। নাক ডুবিয়ে আমি তার স্বাদ গ্রহণ করি। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত আমার দুচোখে জল গড়িয়ে পড়ে। আজ ঈদের দিন। সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিই। আব্বার কাছে ফোন করি। সালাম দিয়ে বলি, “আব্বা ঈদ মুবারক।” কাঁপা কাঁপা গলায় সালামের উত্তর নিয়ে স্বভাবসুলভ দুবার ঈদ মুবারক বললেন। বেশি কথা বলতে পারলেন না। মাকে দিলেন। মা কেঁদে বললেন, “আমার চাচা কী খাইয়া নামাজে যায়? খিচুড়ি মুরগী কি রান্না শেষ করতে পারছে সুরভি।” আমি নাকি দেখতে ছোট নানার মত। সেজন্য মা আমাকে ছোট চাচা বলে ডাকেন। আমি শুধু বলি, “হুম।”
বাড়ির বাইরে এই প্রথম ঈদ আমার। সেমাই আমার খুব বিশেষ পছন্দের নয়। মিষ্টির মধ্যে একটু আধটু লাচ্ছা খাই। এই যা! কিন্তু মা আমার জন্য সকালেই খিচুড়ি রান্না করেন। সাথে মুরগির ঝোল। মাকে আমি বলতে পারি না, “ঝাল আমি খেয়েছি মা কিন্তু ডিমের ঝোল।” এবার আমার কোনো ঈদ বোনাস নেই। ঈদের নামাজে নেই কোনো চেনা মুখ। আব্বার বিশ টাকা না পাওয়ার ব্যথায় নিরবে ডুকরে কেঁদে উঠি। আমার কাছে কারো কোনো আবদার নেই। সুরভির সাথে আমি ভাল করে কথা বলতে পারি না। চোখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি ভাঙি। নামাজে বসে কৌশলে চোখ মুছি।
নামাজ শেষে ফিরে আসি। সুরভিকে সাথে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করি। আমি বিছানায় আধাশোয়া হয়ে বিশ্রাম নিই। সুরভি বেলকোনীতে দাঁড়িয়ে নিচের রাস্তায় তাকিয়ে থাকে। আমাকে বার-বার ডাকে। উৎফুল্ল হয়ে বলে, “দেখো দেখো কী সুন্দর নাদুস-নুদুস লাল গরু। এই তো এবার আঙ্কেলের গরু কোরবানি করছে। আসো আসো দেখে যাও আঙ্কেল ভয়ে কেমন করে দূরে সরে গেছে।” উত্তর না পেয়ে আমার পাশে এসে বসে। চুলে আঙ্গুল চালিয়ে বলে, “মন খারাপ?” আমি মাথা নেড়ে উত্তর করি, “না।”
কপাল টিপে দেয়। চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। একটু চোখ বুঁজে আসতেই এক ফোঁটা জল আমার গালে এসে পড়ে। চোখ খুলে দেখি সুরভি ঠোঁট কামড়ে কান্নার বেগ প্রাণপণে আটকে রেখেছে। ধরা পড়ে যেন তার সংকোচ গেল ঘুচে। কান্নার বাষ্পোচ্ছাসে ঘর ভারি হয়ে উঠে। আমি কী করে বুঝাই, ঈদের দিনটাই শুধু ঈদের, আমাদের আর কোনো কিছুই ঈদের নয়। আর সেজন্যেই গরীবের ঈদের দিন হয় দুঃখ কষ্টে ভরা। দুঃখের রোদনে ক্লান্ত দুটি প্রাণ একসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। যোহরের আযানে আমার ঘুম ভেঙে যায়। সুরভি তখনো বেঘোরে ঘুমে ডুবে আছে। আমার মনে এক অদ্ভুত হতাশা কাজ করে। আশা ভঙ্গের আরেক নাম হতাশা এই যেন প্রথম অনুভব করলাম। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আমার সময় কেটে যেতে থাকে।
প্রায় চারটা ছুঁই ছুঁই। কলিংবেলের শব্দের সাথে দরজায় সজোরে করাঘাত পড়ে। সুরভি ধড়মড় করে উঠে বসে। আমি দরজা খুলি। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল স্বভাব সুলভ হাঁসি হেঁসে বললেন, “কী আঙ্কেল ঘুমাইছেন নি? এর আগেও একবার টোকা দিলাম সাড়াশব্দ পাইলাম না। আমার সাথে একটু কষ্ট কইরা নিচে চলেন।” মুখে আরেকপ্রস্ত হাসি টেনে বললেন, “না হইলে আমার আবার কষ্ট করা লাগব। আসেন যাই।” আমার স্ত্রী আঙ্কেলকে বসতে বললেন। বসলেন না। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে সিড়ি ভাঙতে থাকলেন। তিন-চার কেজির মত মাংসের একটা পোটলা হাতে দিলেন। বললেন, “এই সামান্যই পারলাম আঙ্কেল। আমার মায়েরে সাথে করে একবেলা খাইয়েন।”
আমি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকি। লজ্জা সংকোচে আমার কাছে ঐ মাংসের ওজন যেন কয়েক মণ। আজ অব্দি প্রতি কোরবানিতে নিজ হাতে মাংস বানিয়েছি। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি বিতরণ করেছি। সেই আমার আজকের কোরবানির দিনটা একদম ফাঁকা, একেবারে শূন্য। তবুও এই মাংসটুকুন নিয়ে যখন ঘরে ফিরছিলাম তখন কী এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল। এর নাম হয়ত আনন্দানুভূতি নতুবা সুখ। ঘরে ফিরে স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললাম, “আঙ্কেল দিলেন।”
সুরভির উজ্জ্বল মুখ দেখে মনে হলো, আমাদের ঘরে যেন এইমাত্র ঈদ শুরু হলো। বললাম, “আমি মাংস কেটেকুটে ধুয়ে দেই, তুমি বরং মসলা কর।” স্ত্রী নিরবে মাংস পাত্রে ঢালতে ঢালতে বলল, “মসলা আমি আগেই করে রেখেছি। তুমি বরং বিশ্রাম নাও।” আমি অবাক হই। চোখের কোনে জল এসে টলমল করে। বেলকোনীতে এসে লুকিয়ে সে জল মুছি। ভাবি, জীবনের অতি ক্ষুদ্র পাওয়া অথচ কত আনন্দের। একই ঘরে দুটি প্রাণের একই আশা, অথচ একে-অপরকে প্রকাশ করতে কত দ্বিধা সংকোচ।
স্ত্রী রন্ধনশালায় রান্নায় ব্যস্ত। মাংসের গন্ধে ঘর ভরে উঠেছে। অন্য বাসার গন্ধ এসে এখন আর কুলিয়ে উঠে পারছে না। আব্বা ফোন করেছেন। সুরভি রিসিভ করল। আমি ঠিক শুনতে পাচ্ছি; মা বলছে, “সুরভি আমার চাচামিয়া কি গোস্ত মুড়ি খাইছে?” সুরভি মুড়ির প্লেটে মাংস দিতে দিতে বলল, “এই তো মা এখনি দিব।” আমি আজ যেন ভুলেই গিয়েছিলাম, মাংস রান্না হলে আমরা সবাই চূলার পাড়ে বসেই মুড়িভোজে মেতে উঠি। আমাদের গ্রামে তুলনামূলক দেরিতে কোরবানি হয়। ঈদের দিন বিকেলে মাংস মুড়ি আমাদের অপরিহার্য আহার।
স্ত্রী আমার কাছে ফোন দেয়। মা বলল, “আর রাগ করে থেকো না চাচা মিয়া। এই প্রথম এই শেষ~ আর কখনো বাড়ির বাইরে ঈদ করতে পারবে না। শুধু তো তোমার একার কষ্ট না, আমাদেরও তো কষ্ট হয়।” আমার মুখে কোনো কথা গুছিয়ে আসে না। কেবল চোখের পানি টলমল করে। দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে। মাংস মুখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি।
সুদিন আসলেও দূর্দিনের এই সকল দুঃখে গাথা কথাগুলো যেন ভুলে না যাই; সেজন্যে দূর্দিনের কথা দূর্দিনেই লিখে রাখা গেল। আমার এই কাঁচা অনুভূতি আজীবন কাঁচা হয়ে থাকুক। পাকা হয়ে ঝড়ে যেন না পড়ে। যদি কোনোদিন দিন আসে তবে আমি যেন দীনহীনে দিন দিতে না পারি; অন্তত একমুহূর্তের সুখের কারণ হতে পারি।