নার্গিস বেগম তার মেয়ে কে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই বাসায় এসে ভাত চড়িয়ে দিলো। স্কুল ছুটি হলে আবার আনতে যেতে হবে তাই চটজলদি আলু-বেগুন কেটে ইলিশের ঝোলটা চুলায় বসিয়ে দিলো পাশাপাশি অন্য চুলায় ভাত। শাশুড়ী মারা গিয়েছে দুই বছর আগে আর দুটো ননদ ছিলো তাদের ও বিয়ে হয়ে গেছে। তাই বাসায় সাহায্য করার মতন কোন লোক ও নাই। সব কাজ নিজের হাতে করতে হয়।
নার্গিস বেগমের স্বামী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক।খুব নীতিবান এবং সৎ লোক।সব সময় নার্গিস বেগমকে বোঝাবে সীমিত আয়ের মানুষদেরকে তো একটু হিসেব-নিকেশ করেই চলতে হয়, একটু হিসেব করে চলো নার্গিস। স্বামীর দেখানো পথেই চলছেন, পিঁপড়ে তার চিনির কৌটা থেকে চিনি নিলে তিনি চিপে নিজের চিনি টুকু রেখে দেবেন!! নার্গিস বেগম ঘরদোর গোছাতে না গোছাতেই মোবাইলে রিং বেজে ওঠলো…
হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে, নার্গিস ম্যাডাম বলছেন?
-জি! আপনি কে বলছেন?
-আমি লীলার স্কুল টিচার। আজ ওদের বৃত্তির রেজাল্ট দিয়েছে, লীলা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন৷ আমরা সব বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী ও গার্ডিয়ানদের কে একত্রিত করছি।
দু-রাকাত শুকরিয়া নামাজ পড়ে নার্গিস বেগম স্কুলে যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে পড়লেন। সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে লীলার জন্য দূয়া চাইলেন৷ ফেরার পথে লীলা ওর বাবাকে ছালাম করে আসলো।
নার্গিস বেগম যখন মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন দেখলেন মেয়েটার মুখ বেশ মনমরা।
-কি রে মা? বৃত্তি পায়ছিস তারপরও মন খারাপ ক্যান?
-মা, আমাদের কনা বৃত্তি পায় নাই, কিন্তু ও তো ভালোই পড়াশোনা করছিল। আজ অনেক কান্নাকাটি করছে।
– ওকে কাল স্কুল গিয়া বুঝাবি এই বৃত্তি তো আর শেষ বৃত্তি নয়। এসএসসিতেও ভালো রেজাল্ট করলে বৃত্তি পেতে পারে।
– মা, বৃত্তির টাকাটা ওর দরকার ছ। সামনে সায়েন্স নিবে,অনেক টাকা-পয়সা লাগবো। জানোই তো আগুন লাগার পর ওর বাবার দোকান ঘর পুরে যায়। ওদের বসত-ভিটাও শুনেছি বন্ধক দেওয়া। টাকার অভাবে এখন ওর পড়াটা তো বন্ধ হয়ে যাবে।
– ভাবনার বিষয়। স্যারদের কে অনুরোধ করলে তারা তো ওকে ফ্রী পড়াতে পারে।
-মা, ও ফ্রী ই পড়ে। তাও কি কম খরচ? আমি ফার্স্ট বলে আমিও তো ফ্রী ই পড়ি। তারপর ও কি কম টাকা যায় মা?? আর নাইনে সায়েন্স, প্রাকটিকাল আর কত কিছু লাগবে।
-ওরে আমার মেয়ের কত চিন্তা!! এই স্কুলে ভর্তির আগে কনা ফার্স্ট ছিল না?
-হুম। এই স্কুলে ভর্তির আগে কনা আর আমি এক সাথে প্রাইভেট পড়তাম, কত মজা করতাম। যেই এই স্কুলে ভর্তি হইলাম, আমি ফার্স্ট হলাম ও আমার সাথে মিশা বন্ধ করলো, যারা আমার সাথে মিশে ও তাদের সাথে ও মিশতো না।
-এমন করছিল ক্যান? কনার সাথে তুই কি কোন খারাপ ব্যবহার করছিলি নাকি?
-না মা, ও ভাবছে ওর ফার্স্ট আর ওর ভালোবাসার রাজত্ব আমি কেড়ে নিচ্ছি। আমার বেঞ্চে ও কালি লাগাতো যাতে সাদা স্কুল ড্রেস নষ্ট হয় ,মনে আছে আমার চুলের যে চুইংগাম তুমি ছাড়িয়ে দিয়েছিলা সেটা ও লাগিয়েছিল। পরীক্ষার আগের দিন যেই বই খুঁজে পাচ্ছিলাম শুনছি ও সেটা চুরি করেছিল।
-এত কষ্ট দিয়েছে ও তোকে?
-জানো মা কখন বেশি কষ্ট লেগেছে? আমি টিফিন পিরিয়ডে যখন নিচে যাচ্ছিলাম ও ফিসফাস করে ওর বান্ধবীকে বলছিল ইচ্ছে করে লীলাকে আমি হারপিক খাওয়াই মেরে ফেলি।
-বালাই ষাট, বলে এক দলা থুতু নার্গিস বেগম লীলার বুকে মিশিয়ে দেয়। মনে মনে ভাবতে থাকে এত অল্প বয়সে “প্রতিযোগিতা ” নামক শব্দ চাপিয়ে সন্তান কে কত নিকৃষ্ট করে গড়ে তুলছি আমরা।
– মা, আমি কনার উপর একটা প্রতিশোধ নেই?
নার্গিস বেগমের আত্মা ভয়ে শুকিয়ে আসে। কি নোংরা চিন্তা আসতেছে লীলার মাথায় কে জানে!! কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, কী প্রতিশোধ লীলা??
-আমি প্রথম মাসের যে বৃত্তির টাকা পাবো সেই টাকাটা আর বাগাটের রসগোল্লা একসাথে প্যাকেট করে কনাকে উপহার দেই। সাথে একটা চিরকুট দেবো। তাতে লেখা থাকবে হারপিক খেলে তো হারিয়ে ই যাবো, তারচেয়ে বরং মিষ্টি খেয়ে আমৃত্যু বন্ধু হয়ে যাই?? আর বৃত্তির টাকাটা দিয়ে বই কিনো। এখন থেকে বৃত্তির যে টাকা পাবো অর্ধেক তোমার আর অর্ধেক আমার!!
-ওরে দুষ্টু মেয়ে আমরাই টানাটানি করে চলি,আর তুই দিব্যি টাকা ভাগ করে ফেললি। আয় পাগলী বুকে আয়…এ তোর কেমন প্রতিশোধ! এমন মধুর প্রতিশোধ তো শুনি নাই।।
-মা! একে বলে উত্তম প্রতিশোধ। এ যে তোমার থেকে পাওয়া শিক্ষা। দাদী আর ফুপীরা তোমায় শত আঘাত করলেও তুমি ওদের অনেক যত্ন নিতে, কোনদিন নিন্দেমন্দ করনি। তোমার ভালোবাসার কাছে দাদী আর ফুপীরা হেরে গিয়েছিল।মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত দাদীর সেবা করেছ।তার হাগু-মুতু পরিষ্কার করেছ। ফুপীদের কে নিজের গয়না দিয়ে বিয়ে দিয়েছিলে।
-লক্ষী মেয়ে, এত খেয়াল তোর।
-মা, আমি তোমার মতনই হতে চাই। আমি আজ তোমায় ছুঁয়ে বলতেছি মা,আমি আমার শত্রুর উপর সর্বদা প্রতিশোধ নেবো। আর তা হচ্ছে “উত্তম প্রতিশোধ”