কুয়াশার চাদর

কুয়াশার চাদর

কথা নেই বার্তা নেই হুট করে দীপু বলে বসলো-অনিতার কথা মনে আছে তোর?ঐযে ছয়তলার ৩বোনের মাঝে সবচেয়ে বড়টা।ঐযে বারবার আঙ্গুল দিয়ে অগোছালো চুলগুলো কানের উপর গুছিয়ে রাখতো আর দাঁত দিয়ে নখ কাটতো।আছে মনে? আমি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।ধোয়ার রং কিছুটা নীলচে।ঠিক আকাশের মতো না,তবে কিছুটা মিলে যায়।

অনিতাকে ভুলে যাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি।খুব মনে আছে আমার।আমার ছোট থেকে বড়বেলার মানুষ।ইংরেজিতে খুব ভালো ছিল মেয়েটা।এক বার্ষিক পরীক্ষায় আমার পিছনে সিট পড়েছিল ওর।আমি ওকে অংক দেখিয়েছিলাম পরীক্ষার সময়।আর ইংরেজি পরীক্ষার দিন ওকে ডাকলেও ও যেন সেদিন আমার ডাক শুনতে পায়নি।পরীক্ষার সময় শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে বলেছিল-কিছুই পারিনা।নিশ্চিত ফেল করমু। অথচ ইংরেজি খাতা দেয়ার সময় ও সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন ওশিল্পীর হাতে গড়া হা করা একটা ভাস্কর্য মাত্র।

-কেমনে হইলো এইডা?!?
:স্যার তো তোর দুলাভাই লাগে,তাই তোর সাদা খাতায়ও নম্বর ঢাইলা দিছে।
-বিশ্বাস কর…
:সর কুত্তারবাচ্চা।তুই আমার লগে আর কোনদিন কথা কবি না।

বিটলামি চোদাস আমার লগে?অংকের বেলায় ষোলআনা আর ইংরেজির বেলায় ঠনঠনা! মেয়েটার দাঁত দিয়ে নখ কাটাটা খুব ভালো লাগতো আমার।মানুষ খুব অদ্ভূত একটা প্রাণী।কিছু কিছু বদঅভ্যাস আর খারাপ কাজকেও ভালোলাগার স্হানে ঠাঁই দেয়।

নখ কাটার ফাঁকে অনিতা যখন আঁড়চোখে আমার দিকে তাকাতো তখন আমি চোখ সরিয়ে নিতাম না।মনে হতো ঐ চোখে ডুব দিয়ে যদি মরে যেতে পারতাম!যদি কবর হতো ঐ কালো পাপড়ির চোখের পাতার নিচে!সে মরণ ভয়ঙ্কর হলেও আমার মনে ভয়কে জায়গা দিতাম না।যাকে ভালবাসা যায় তার জন্য বুকের ভিতর ভয় জমা রাখলে কামানুষ ছাড়া অন্য কোন পরিচয় জোটেনা।কামানুষ আর কাপুরুষদের জন্য ভালবাসার বন্ধ দরজা খোলা ভীষণ অন্যায়।
এক শীতের ভোরে লুঙ্গি পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।কুয়াশার চাদর কালো বোরকাকেও হার মানায় এমন অবস্হা।সম্ভবত ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় হাঁটার জন্য বের হয়েছিল অনিতা।

-এতভোরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
:কুয়াশা দেখছি।
-কুয়াশা দেখার কি হলো?
:জ্যোত্স্নার মতো কুয়াশারও একটা নীরব সৌন্দর্য্য আছে।
-লুঙ্গি পড়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?শীত লাগে না?
:প্যান্ট পরলে চেইন খোলার ঝামেলা থাকে,রাস্তার পাশে হুট করে কিছু করার জন্য বসা যায় না।প্যান্ট পরে আগুন পোহালে আগুন ভিতর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।

-থাক থাক!আর ব্যাখ্যা করতে হবে না।তুই কি সবার সাথেই এমন অশালীন কথা বলিস?
:সবাইতো আর তোর মতো লুঙ্গির কথা জিজ্ঞেস করেনা।
-জিজ্ঞেস করলে কি এভাবেই বলতি?
:ঠিক জানিনা।ধরতে পারলে হয়তো বলতাম।
-কি ধরতে পারলে?
:কথা।
-কথা আবার ধরা যায় নাকি?
:হুম!কথা হলো বাতাসে ভেসে বেড়ানো শিমুলের শুভ্র পেঁজা তুলার মতো।যখন যেটা মুখে এসে পড়ে!
-তুই খুব সুন্দর করে কথা বলিস।
:দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য।
-মানে?
:একটু আগেইতো বললি আমার কথা অশালীন।দুই মিনিটেই কথা সুন্দর হয়ে গেল!

হঠাত্ই যেন আমার শীতটা বেড়ে গেল।মনে হলো অনিতার চাদরের ভিতরে ঢুকলে আমার শীতটা চলে যাবে।লজ্জা শরম আমার এমনিতেই কম।বলেই ফেললাম,তোর চাদরের জমিনে দুজনার জায়গা হবে? অনিতা চুপ হয়ে গেল।একবার শুধু চারদিকে তাকালো।কুয়াশার চাদরের মাঝে ওর চাদর কারো চোখে পড়বে না হয়তো এটাই ভাবলো। দুহাতে চাদর দুদিকে সরিয়ে দিল অনিতা।আমি চরিত্রহীনের মতো ওকে জড়িয়ে ধরলাম।ওর শরীরের উষ্ণতার কাছে জাহান্নামের আগুনও কম মনে হলো আমার কাছে।কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট দুটোকে মনে হচ্ছিল জ্বলন্ত ইটের ভাটা।

–কি রে উত্তর দিলিনা?দীপুর পাল্টা প্রশ্ন।
:হুম!নামটা মনে আছে।চেহারা ভুলে গেছি।
–অনিতা গতকাল দেশে এসেছে।
:ভালো।
–ওর ছেলেটার চেহারা খুব মিষ্টি।একদম মায়ের মতো।নাম শুনলে অবাক হয়ে যাবি।
:এখন অবাক হতে ইচ্ছে করছে না।এতকিছু আমাকে বলছিস কেন?
–না মানে!অনিতা তোর সাথে দেখা করতে চায়।আমাকে বললো তোকে যেন কথাটা বলি।দেখা করবি?
:না।

অনিতার হাত পিছনে।বুঝতে পারলাম হাতে কিছু একটা আছে।কি আছে সেটা জানার কৌতুহল হলো না।একসময় ওর সবকিছুতেই কৌতুহল কাজ করতো আমার।সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলে বোধহয় কৌতুহলও ধীরে ধীরে চলে যায়।
বিকেল মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যের অধঃপতনের মাধ্যমে।চারপাশে সিঁদুর আলোর আবরণ।এই সময়টাকে খুব সম্ভবত গোধূলী বলে। অনিতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেশিক্ষণ হয়নি।আমার কাছে মনে হচ্ছে ও সেই ছোটবেলা থেকে বড়বেলা পর্যন্ত আমার সামনে দাঁড়িয়ে।ওর মুখে কোন কথা নেই।আমিও আগ বাড়িয়ে কথা বললাম না।নিজের একটা ব্যক্তিত্ব আছে এখন আমার। এতবছর পর আমি সত্যিই খুব অবাক হলাম,যখন দেখলাম ওর হাতে ৭বছর আগের সেই চাদরটা।পৃথিবীতে একই ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটে তাহলে!

অনিতা কোন কথা না বলে সেদিন ভোরের মতো আমাকে ওর চাদরে নিমন্ত্রণ জানালো।আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না।ওর শরীরের স্পর্শ পাওয়ার লোভে নয়-একসময়ের ভালবাসার অস্তিত্ব টের পাওয়ার তীব্র নেশায় আসক্ত আমি ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে আবারও ৭বছর পূর্বের সেই কুয়াশায় ফিরে গেলাম।এবার কিন্তু চরিত্রহীনের মতো করে ধরিনি।অভিমান,রাগ,ঘৃণা সব পায়ের তলায় ফেলে দিয়ে ধরলাম।প্রথম ভালবাসা ভোলার সাহস এ পৃথিবীর কারো বুকেই ছিল না। চলে যাওয়ার সময় অনিতা নিজ হাতে চাদরটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে গেল।এই চাদরটার খুব দরকার ছিল আমার।আমি চাদরটা গায়ে ভালভাবে জড়িয়ে ওকে পিছু ডাকলাম।

:অনিতা শোন!
-কি!কিছু বলবি?
:আমার এই চাদরের জমিনে আর কারো জায়গা হবেনা কোনদিন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত