আমি যখন কোতলপুর স্টেশানে নামলাম, তখন রাত 12 টা। সম্ভবত ওটাই শেষ ট্রেন, যেটা এখানে হল্ট দেয়। ট্রেন টা যেমন পুরো ফাঁকা ছিল, প্লার্টফর্ম টাও তাই। চাঁদের আলোয় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পরিস্কার দেখা যায়। দু একটা কুকুর ছাড়া আমাকে বাদে আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই! স্টেশনে কোন বিদ্যুৎ বা বিজলি বাতি নেই।
আমি নামতেই ট্রেন টা লম্বা একটা বাঁশি বাজিয়ে প্লার্টফর্ম কাঁপিয়ে মিলিয়ে গেল। গঙ্গার পাড়ের হিম শীতল বাতাস আসছিল। সেটা গায়ে মেখে দু পা এগতেই দেখলাম সবুজ পতাকা নিয়ে একজন রেল কর্মী প্লাটফর্ম ধরে এগিয়ে আসছে। ছোট একটা শেড দেওয়া ঘর ও রয়েছে। সঙ্গের ছোট কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ টা নিয়ে ধীরে ধীরে শেড টার দিকে এগোলাম। আপনি কি অচিন্ত্য বণিক? প্রশ্ন টা শুনে একটু ঘাবরে গেলাম। প্রশ্ন কর্তা সেই পতাকা বাহক, মানে সিগনাল ম্যান। অন্ধকারে মুখ পরিস্কার মালুম হয় না। ঢোক গিলে বললাম– আপনি কি করে জানলেন?
—আজ্ঞে ঘণ্টা দুয়েক আগে আপনার দুই বন্ধু এসে নাম লিখিয়েছেন। ওরাই বললেন আপনার কথা।
–নাম লিখিয়েছে! কিসে?
–ওয়েটিং রেজিস্টারে।
–সেটা আবার কি?
কোন দিন তো নাম শুনিনি। –বেশ বিরক্ত সহকারে বললাম। বিরক্ত হবার কারণ অফিস থেকে হিসেব মিলিয়ে বের হতেই আধ ঘণ্টা লেট। যার ফলে প্রশান্ত আর কুন্তল নির্দিষ্ট ট্রেন চেপে বহু আগে বেড়িয়ে গেছে। আর আমি ট্রেন মিস করলাম। আমার দুর্ভাগ্য এর পর সারা রাস্তা ফাঁকা শেষ ট্রেনের এধার ওধার দেখে বেড়িয়েছি।
— আজ্ঞে, যারা এর আগে নুর মহলে গেছেন, কেউ আর ফিরে আসেন নি। সরকারী ভাবে জানা যায় না কত জন ওখানে যান, আর কত জনের বডি পাওয়া যায়। তাই যারা যান, তাদের নাম ঠিকানা টা এখন লিখে রাখা হচ্ছে।
— ফিরে আসেন না! সে কি! তবে তারা কোথায় যান? — ভয় না পেলে ও একটু অবাক হলাম লোক টার কথা শুনে। তারপর তার ইশারা তে একটা পাতাতে নিজের নাম লিখে সই করলাম। মোবাইলে একটা ছবি ও তুললাম। পর পর সবার নাম লেখা। আমার শুধু শেষ দিকের কয়েক টা নামের উপর চোখ পড়ল।
12. মনোতোষ মাইতি
13. শিবাজী জানা
14. মিলন সাহা
15. শিবু মাহাতো
16. জনার্দন সোরেন
17. নরেন হালদার
18. কার্তিক যাদব
19. প্রশান্ত মল্লিক
20. কুন্তল সূত্রধর
21. অচিন্ত্য বণিক
বলাবাহুল্য শেষ তিনটে নাম আমাদের 3 বন্ধুর। না, নাম গুলো পড়ে আমার মধ্যে কোন কাঁপুনি আসে নি। কারণ আমরা তো মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। নুর মহলের রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। বিজ্ঞানের যুগে কোন ভূত, প্রেত হয় না। এগুলো মানুষের কারসাজি।
এর আগে আমরা রাজস্হানের ভানগড় ঘুরে এসেছি। যেখানকার ভৌতিক ক্রিয়া কলাপ পৃথিবী বিখ্যাত। এছাড়া বিভিন্ন ভৌতিক বাড়ি, স্টেশন, অফিস, সৌধ ইত্যাদি তে ঢু মারাই আমাদের 3 বন্ধুর নেশা তা পেশা যাই হোক না কেন। প্রশান্ত ই আমাদের লিডার। আর কুন্তলের কাজ যেখানে রহস্য সন্ধানে যাব, তার ইতিহাস সংগ্রহ।
রেজিস্টারে সই করার পর উঠে দাঁড়ালাম। লোকটার মুখে হাসি দেখলাম। বলল– সব সময় হিরো সাজা ভাল না দাদা। যারা গেছিল মোহে পড়ে গেছিল। কেউ ফিরে আসে নি। আসবে কি করে? যা ভুতুরে কাণ্ডকারখানা! কত করে বারণ করলাম সবাই কে। কিন্তু কেউ শুনলো না। ভূতুড়ে উপদ্রবের কোন প্রমাণ আছে? — আমার প্রশ্নে লোকটা যেন চমকে উঠল। সতর্ক হয়ে বলল –আজ্ঞে সে তো লোক মুখে শোনা। আমি তো স্টেশন মাস্টার। স্টেশন ছেড়ে তো ও আর কখনো যাই নি। — ওর কথায় সম্মতি জানালাম।
লোক টা এরপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল– যান বাইরে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। আর দেরি করলে ও চলে যাবে। ওনার কথায় বাইরে বেড়িয়ে দেখি মলিন পোশাকে একটা বয়ষ্ক লোক স্টেশন চত্তরে শুয়ে আছে। কোন ফকির বোধহয়। আমার দিকে তাকিয়ে বলল– বিষ, বিষ, চারদিকে বিষ। কোথায় ও যেও না। বিষ! কিসের বিষ? ও কিছু না, লোক টা পাগল। –কথা কটা বলে স্টেশন মাস্টার যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। বেশ অদ্ভুত তো! ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সারে 12 টা। স্টেশনের বাইরে প্রায় অন্ধকার। মোবাইল জ্বেলে দেখলাম এ যেন এক অজ গাঁ। কাঁচা রাস্তা। জন বসতি কাছে পিঠে আছে বলে মনে হয় না। কোন জায়গাতে আলোর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। জোছনার আলো ছাড়া। বাবু কি নুর মহল যাবেন গো ?
–পিছন থেকে আচমকা একটা কন্ঠস্বরে চমকে গেলাম। একটা বেটেখাটো লোক। গলায় গামছা।
— আপনি কে? — একটু থতমত খেয়ে প্রশ্ন করলাম।
— আমি মিলন। রিকশা চালাই। আন্দাজ করলাম, আপনি নুর মহল যাবেন বলে দাইড়েছেন। — কর্কশ কন্ঠে লোক টা বলল।
— হুম, তা বটে। ভাল ই হল তোমাকে পেয়ে। তা কত নেবে?
— দেবেন যা মনে লাইগবে। আর কি ই বা চাব। আপনারা পয়সা খরচ কইরা মরার লাইগা আসছেন। — লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মনে হল।
— এ কথা বলছ কেন? — আমি হাসি চেপে বললাম।
— গেলেই বুইঝবেন বাবু। কেউ আর ফিরে আয়ে না। কোন গুপ্তধন টন কিছু ই নাই। বেবাক গুজব সব। শুধু ভূত আছে।
— ভূত!- কিছু টা অবাক হয়ে হাসতে লাগলাম। মনে পড়ল স্টেশনের লোকটা ও বলেছিল বটে।
কথা বলতে বলতে আমরা এগচ্ছি। নভেম্বর মাস হলেও গঙ্গার হাওয়া তে হাড়ে কাঁপন ধরছে। একটা হাফ সোয়েটার সঙ্গে এনেছিলাম। ওটা ব্যাগ খুলে বার করে পরলাম। অনেকক্ষণ লোকটা কোন কথা বলছে না। নিজের মনে রিকশা চালাচ্ছে। চালাচ্ছে তো না ওড়াচ্ছে। ভাঙা চোরা রাস্তা দিয়ে যেন ঝড়ের বেগে চলেছি। জিজ্ঞাসা করলাম, — এখানে কোন লোকজনের বাড়ি চোখে পড়ছে না কেন? কেউ কি থাকে না? না সব গ্রামের ভিতরে আছে?
— না বাবু, এখানে কেউ থাকে না। ফি বছর নদীর পাড় ধ্বসে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বাবু। শুধু নুর মহল বাদে সব কিছু ই তলায়ে গেছে।
— আশ্চর্য! নুর মহল তলায় নি কেন? — অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে লোকটা হাসল।
— আপনি শহর থেইকা আসছেন বাবু। কারণ তো আপনারা বুইঝবেনই। কিন্তু যদি লোকটা একটা মন্দিরের সামনে রিকশা থামিয়ে দিল। অসম্পূর্ণ কথা টা কিসের ইঙ্গিত সেটা বুঝতে বাকি রইল না!
— কিন্তু এরা আমাকে বা আমার বন্ধু দের চেনে না। আমাদের কাজ ই হল ভৌতিক রহস্য ভেদ করা।
নুর মহলের রহস্য ও কাল প্রকাশ্যে আসবে। এক রাত ই যথেষ্ট। আমরা যে এ ধরনের কাজে ভয় পাই না। সেটা অনেকেই জানে না। তাই তো সেদিন রাতে যখন ফোন টা এল, চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিলাম। লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিল। –হা হা, অনেক শুনেছি আপনার কথা। খুব সাহস আপনার। তা আসুন না একবার নুর মহল। একটা রাত কাটিয়ে বের হলে বুঝব খোকা বাবুর দম আছে। হা হা..
–মানে, কি ভাবেন আপনি? দম নেই আমাদের? ঠিকানা টা বলুন। ঠিক চলে যাব।
—আহা, চলে যাব বলে তো যে কোন দিন গেলে হবে না। পুর্ণিমা তে ই আসতে হবে। না হলে চোখে কিছু দেখবেন না। ওখানে কিন্তু বিদ্যুৎ নেই।– লোক টা সেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
— ঠিক আছে তাই হবে। আমরা তিন বন্ধু যাব। এই মাসের পুর্ণিমা তে। মানে আর সাত দিন পর।
— হা হা হা — লোকটার ফোন টা কাটল। হাসি শুনে গা পিত্তি জ্বলে উঠল। সেদিন ই প্রশান্ত আর কুন্তল কে ফোন করে ব্যাপার টা বলতেই ওরা এক পায়ে রাজি।
ছোট খাট একটা গ্রুপ মিটিং হল আমাদের। এই নুর মহল সম্পর্কে কোন ইতিহাস বইতে কিছু পড়ি নি। গুগল সার্চ করে ও কিছু পেলাম না। কোতল পুর স্টেশন টার কথা শুধু লোকটা বলে দিয়েছিল। ওটা তে আবার সরাসরি কোন ট্রেন নেই। যাই হোক পৌঁছে তো গেলাম। এবার নদী পেরনোর পালা। কিন্তু মিলন কোথায় গেল? ওকে তো টাকা টাই দেওয়া হল না! শেষ পর্যন্ত এলেন তা হলে? হা হা হা। — কথাটা শুনে কেমন যেন একটু ঘাবরে গেলাম। সাদা চাদর মুরী দেওয়া লোকটা আমার থেকে মাত্র এক হাত পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে। দেখে চমকেই গেলাম।
— আপনি কি সেই ভদ্রলোক, যিনি আমাকে ফোন করেছিলেন?
— হা হা, আমি মনোতোষ মাইতি। ধন্যবাদ আসার জন্য।
— আমি অচিন্ত… – জানি জানি, আপনার নাম গোত্র সব জানি। কি কাজ করেন সব জানি। — আমাকে থামিয়ে দিয়ে লোকটা বলল।
–আমার বন্ধু রা কোথায়? ওরা কি পৌঁছে গেছে? কথাটা বলে লোকটার পিছনে তাকিয়ে দেখলাম একটা পুরানো ভাঙাচোরা মন্দির। বহু বছর মানুষের পা পড়ে নি।
—আপনার বন্ধু রা এতক্ষণে হয়তো… হা হা হা। — লোকটার হাসি টা বড্ড নির্মম শোনাল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ বৃষ্টি নামল।
নভেম্বর মাসে বৃষ্টি। তাও আবার আগাম পূর্বাভাষ ছাড়া। চাঁদের আলো হঠাৎ ভ্যানিশ। তার পরিবর্তে অন্ধকার এখন।
লোক টার সঙ্গে দ্বিতীয় কোন কথা বলার আগে মন্দিরের ভিতর ঢুকলাম। আমার মাথায় লেগে বহু দিনের অব্যবহিত ঘণ্টা টা বেজে উঠল। লোক টাও নির্বিকার চিত্তে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। দেখে কেমন যেন অসহ্য লাগল।
— বলছি সঙ্গে খাবার দাবার থাকলে খেয়ে নিন। এর পর তো সে সুযোগ আর আসবে না। হা হা হা….
লোকটার কথা অসহ্য লাগলেও কিছু বললাম না। উপরন্তু সত্যি সত্যি সঙ্গের রুটি-তরকারী টা খাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলাম। বারান্দার এক কোনে বসে পড়লাম। ব্যাগ থেকে টিফিন কারি বের করে মায়ের হাতে বানানো রুটি – তরকারি সাবার করলাম। মনোতোষ বাবু এখনো অসহ্যের মতন দাঁড়িয়ে আছে। এই নাম টা কোথায় যেন শুনেছি। ঠিক মনে করতে পারছি না। খাওয়া শেষ করতে দেখলাম বৃষ্টি বন্ধ। আবার জোছনা দেখা যাচ্ছে। লোক টা আমার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। এবার বিরক্ত হয়েই বললাম– মশাই আপনার কি কাজ কর্ম নেই। পিছন পিছন আসতে হবে?
— হা হা হা। সেরকম কোন ব্যাপার না। আপনাকে নৌকো তে তুলে দিয়ে চলে যাব।
— কেন বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি নুর মহল সত্যি যাব কিনা? — ঘাটের একদম কাছে এসে ক্ষেপে উঠে বললাম।
লোকটা হঠাৎ বেশ গম্ভীর হল। একটা নৌকা পাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিকে তাকিয়ে বলল– শিবু, নে আর এক বখরা। সাবধানে পৌঁছে দিস। আমি কোন রকম কথা না বলে নৌকা তে উঠলাম। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। এ আবার বড্ড চুপচাপ। যাই হোক দারুণ একটা অনুভূতি হচ্ছিল। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। ছোট ছোট ঢেউ। চাঁদের আলো পড়ে পুরো জল টাই কখনো সোনালী, কখনো রূপালী লাগছে। তার মধ্যে ই ছপাত ছপাত শব্দ করে নৌকা চলল। ঠাণ্ডা টা ভালই অনুভব করছি। রাত প্রায় একটা। অনেক দূরে একটা কাল মতন কিছু দেখা যাচ্ছে। ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। তাই ভাবলাম লোক টার সঙ্গে একটু বগবগ করি। তাই জিজ্ঞাসা করলাম– শিবু ভাই কতক্ষণ লাগবে?
— আধাঘণ্টা স্যার।– ওর উত্তম শুনে বুঝলাম স্রোতের বিপরীতে ওকে যেতে হচ্ছে। তার মানে রাত প্রায় দেড় টা হবে। একদম মাহেন্দ্রক্ষণ। মন টা বেশ উৎফুল্ল রয়েছে। ভাবলাম মোবাইল টা খুলি। ভাবা মাত্রই পকেট থেকে 6 ইঞ্চির সঙ্গী কে বের করলাম। স্টেশনে রেজিস্টারের যে ছবিটি তুলেছিলাম, তার নাম গুলো দেখতে বসলাম। যারা নুর মহল এসেছিল, ওদের নাম গুলো আবার চোখের সামনে। কিন্তু হঠাৎ মনোতোষ মাইতির নাম টা দেখে একটা মৃদু শিহরণ খেলে গেল। এই মনোতোষ আর রেজিস্টারের মনোতোষ কি এক নাকি? কিন্তু রেজিস্টারের মনতোষ তো মারা গিয়েছেন!
–ধুস, এক নাম কি দুটো লোকের হয় না? — আলবাত হয়। তবে? নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে ছবি টা মুছতে গিয়ে সত্যি চমকে গেলাম। এখানে তো মিলন, শিবু ওদের নাম ও আছে। তবে কি মাথা টা কেমন যেন ঘুরতে লাগল। এরা ও কি আলাদা আলাদা ব্যক্তি?
কিন্তু প্রত্যেকেই যেন কেমন রহস্যময়! ভাল করে কারোর মুখ ও দেখি নি। মিলন তো যেভাবে রিকশা টানল, তাতে তা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয় না। আবার এদিকে শিবু ও স্রোতের বিপরীতে কি দ্রুততার সঙ্গে দার বাইছে! এরা প্রত্যেকে ই জীবিত তো? ধুর কি সব ভাবছি! আমি নিজে ভূতের অস্তিত্ব মানি না বলেই তো এই অভিষানে এসেছি। নিজের মনেই হাসলাম এবার। কিন্তু প্রশান্ত আর কুন্তলের খবর কি? দেখি তো একটা ফোন করে। ভাবনা শেষ করে কুন্তল কে ফোন লাগালাম। না লাগল না। এবার প্রশান্ত কে করলাম। একই উত্তর। নট রিচেবল। অগত্যা হোয়াটস্যাপ টা খুললাম। পর পর কয়েক টা ম্যাসেজ এসেছে। প্রশান্ত আ র কুন্তল এর টাই খুললাম।
প্রশান্ত লিখেছে — ভাই তোর ট্রেন মিসের জন্য খারাপ লাগছে। আমরা নদী পার হলাম যাস্ট। কিন্তু প্রথম থেকেই বেশ উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছে। জানি না তুই কখন হোয়াটস্যাপ খুলবি। তবু সতর্ক থাকিস। স্টেশন মাস্টার শিবাজী জানা থেকে শুরু করে রিকশা চালক মিলন, মন্দিরের পূজারী মনোতোষ মাইতি এমন কি নৌকার মাঝি শিবু সবাই কেমন যেন সবাই রহস্যময়। সাবধানে থাকিস।
সময় দেখলাম রাত 12 টা। মানে যখন আমি প্লাটফর্মে নামলাম। এবার কুন্তলের ম্যাসেজ টা খুললাম। প্রথমেই একটা খিস্তি। তারপর– মাল টা, এত কাজ দেখালে হবে? পুরো ট্রিপ টা না ঝুলে যায়! তোর থেকে ও মিস করব তোর ডিজিটাল সাউন্ড রেকর্ডার টা। নাইট ভিশন ক্যামেরা টা আমরা নিয়েছি। আর হ্যাঁ, এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম। প্রধান ফটকের সামনে একটা নামের ফলক। কারা কারা কবে কবে এই নুর মহলে রহস্যভেদ করতে ঢুকেছে, তাদের নাম লেখা। সব চেয়ে অবাক হবার বিষয় আমার আর প্রশান্তের নাম ও লেখা। বেশ রহস্য পাচ্ছি এর মধ্যেই। সত্যিই কি কিছু আছে?….
সময় টা দেখলাম রাত 12 টা 20, মানে আমি তখন মন্দিরের কাছা কাছি। কতক্ষণ ওদের কথা গুলো ভাবছিলাম জানি না। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেতেই দেখলাম নৌকা পাড়ে ঠেকেছে। সামনে প্রকাণ্ড একটা অট্টালিকা। অন্ধকারে হাজার খানা রহস্য নিয়ে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মাঝে কি ভাবে যে এই মহল দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঢুকল না! নুর মহলের দু পাশ দিয়ে গঙ্গা বইছে। যেন সমুদ্রে জাহাজ ভাসছে!
— বাবু আমরা এসে গেছি। শিবুর কথায় হুঁশ ফিরল। তোমার ভাড়া টা?
— আজ্ঞে যা দেবেন বাবু। আপনার কাছ থেকে কিছু নেব কিনা ভাবছি।
— মানে? বিরক্তি সহকারে বললাম। — তোমার কি বদ্ধমূল ধারণা যে, আমি বা আমরা আর ফিরব না?
আমার কথায় শিবু খচ খচ করে হাসল। বলল– গুপ্ত ধনের সন্ধানে যারা এসেছিল, কেউ বাঁচেনি। হা হা। আপনাকে ভূত ধরল বলে। আমি কথা না বাড়িয়ে পাড়ে লাফিয়ে নামলাম। নুর মহলের সামনে ত্রিকোনা ঘাস জমি। তবে কর্দমাক্ত। নেমে পিছন ঘুরতেই দেখি শিবু নৌকো নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। তার মানে এখানে এখন আমরা তিন টি প্রাণী। হোয়াটস্যাপ টা খুলে ওদের শেষ আপডেট টা দেখে মাথা চুলকোতে লাগলাম।
প্রশান্ত লিখেছে– ভাই রহস্য অনেক। স্টেশনে যে নাম গুলো রেজিস্টারে আছে, প্রত্যেকের নাম ই এখানকার নাম ফলকে আছে। তার মানে এরা যদি কেউ বেঁচে না ফেরে তবে কি শিবাজী, মনোতোষ বাবু, শিবু, মিলন এরা সত্যিই তো রহস্যময়! আমরা ভুত মানি না। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে এরা কেউ বেঁচে নেই। তবে আমরা স্টেশনে কার রেজিস্টারে নাম লিখলাম? কার নৌকাতে চড়লাম? কার রিকশা তে উঠলাম? মন্দিরের পাশের লোক টাই বা কে?
ভাবতে ভাবতে দু এক পা করে কখন যে খোলা হা করা গেট পেড়িয়ে ঐ ফটক টার সামনে চলে এসেছি, জানি না। চাঁদের আলো না থাকলে ও মনে হয় শ্বেত পাথরের উপর লেখা নাম গুলো পড়া যেত। এমন ই চকচক করছে।
সবার শেষ নাম টি বলা বাহুল্য আমার! জীবনে অনেক দুর্গম, রহস্যময়, ভৌতিক স্হানে ঘুরেছি। কিন্তু এরকম কোথায় ও কিন্তু পায় নি। আমি অবাক হয়ে দাঁড়াতেই এক সঙ্গে গোটা দশেক বাদুড় এলো পাথারি উড়তে লাগল।
আমি মূল কক্ষে ঢোকার আগে কুন্তলের হোয়াটস্যাপ টা খুললাম। ওতে লেখা— কিছু একটা আছে ভাই। প্রশান্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু ফোনের সাউন্ডে সমস্যা হতে পারে। তাই হোয়াটস্যাপ টা খোলা রাখ। সময় পৌনে সওয়া একটা। মানে প্রায় আধ ঘণ্টা আগে। মোবাইল টা হাতে রেখে নাম ফলক টা পেরিয়ে বাম দিকে মূল বিল্ডিং এর ভিতর ঢুকলাম। এখানে কোন চাঁদের আলো নেই। নিকস কালো অন্ধকার। মোবাইল এর টর্চ জ্বাললাম। আলো ও জ্বলল, তবে কিছুটা ক্ষীণ। এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে চার্জ 40% এ নেমে গেছে। এরকম একটা বড় ভুল কিভাবে করলাম! যাই হোক সাহস আর বুদ্ধির উপর ভর করে অন্ধকার রাজ পথে পা বাড়ালাম।
সবার প্রথমে একটা সিঁড়ি দেখলাম উপরে ওঠার। প্রায় ভাঙাচোড়া। আমি না উঠে নিচ তলা টা ভাল করে জরিপ করতে লাগলাম। দু পাশেই লম্বা করিডোর, শেষ মাথা দেখা যায় না। উদ্দেশ্য হীন ভাবে একবার ডান দিকে আর একবার বাম দিকে মৃদু শব্দে হাঁটলাম। জায়গায় জায়গায় মাকরসার জাল। নাকে, মুখে চোখে পেচিয়ে গেল। বাঁধা পেয়ে এক জায়গাতে থমকে দাঁড়ালাম। চারদিকে ধুলো আর ঝুলের গন্ধ।
দেওয়ালে টর্চ মেরে দেখলাম, কোন জায়গাতে ই আর প্লাস্টারের চিহ্ন নেই। শুধু দাঁত বার করে ইট গুলো দাঁড়িয়ে আছে। পুরো দেওয়ালেই শেওলা। মাঝে মাঝে বটের শিকর ও দেখা যাচ্ছে। জায়গাটা সাংঘাতিক রকমের স্যাঁতস্যাঁতে । চার দিক থেকে জলের স্রোতের আওয়াজ কানে আসছে। আমি এবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। যে কোন মুহূর্তে মনে হচ্ছে কড়ি বরগা ভেঙে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাব। খুব সাবধানে পা ফেলে উঠতে লাগলাম। দূরে একটা জায়গাতে চোখ পড়তে থামতে বাধ্য হলাম। ঠিক চার ইঞ্চি তফাতে দুটো চোখ জ্বলছে! সঙ্গে হিস হিস শব্দ! সামনে ফণা তুলে যিনি অভ্যর্থনা করলেন, জানি না কোন জাতের, তবে বিষধর যে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আমি সাহসী তা ঠিক। এজন্য এখানে ভূত ধরতে এসেছি। কিন্তু তা বলে সাপের সঙ্গে সহবাস সম্ভব না। কি করব ভাবছি, এমন সময় একটা সোনা ব্যাঙ সব প্রশ্নের সমাধান করে দিল। এবার বুঝতে পারছি, যে আমি না, টার্গেট ব্যাঙ টা ই ছিল। সাপটা এখন ব্যাঙ গিলতে ব্যস্ত। সেই ফাঁকে গুটি গুটি পায়ে দোতলা পৌঁছলাম।
এখানে সামনের বারান্দা দিয়ে কিছু টা চাঁদের আলো এসে পড়েছে। আমি এবার প্রশান্ত আর কুন্তল এর নাম করে ডাকতে শুরু করলাম। কোন সারা পেলাম না। মনের কোনে একটা চিন্তা উঁকি মারতে লাগল। কারণ প্রশান্ত অসুস্থ। পাশা পাশা বড় বড় সব ঘর। কোন টা তে কপাট আছে । কোন টা তে নেই। চারদিকে জলের কুল কুল শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। আমার কাছে ডিজিটাল সাউন্ড রেকর্ডার টা ছিল। ভূতের অস্তিত্ব টের পেতে গেলে যেটা ভীষণ দরকারী। প্যারা নরমাল টিম নাইট ভিশন ক্যামেরা আর ডিজিটাল সাউন্ড রেকর্ডার ছাড়া এই ধরনের অভিযান ভাবতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা হল নাইট ভিশন ক্যামেরা টা ওদের কাছে। আর এত বড় প্রাসাদে যেখানে প্রায় পঞ্চাস খানা ঘর, সেখানে ওরা ঠিক কোথায় আমার পক্ষে বলা মুশকিল। যাই হোক কিছু টা ত্রস্ত পায়ে একটা হল ঘরে ঢুকলাম।
মোবাইল এর আলো যত দূর চোখ যায় ঘরের আয়তন বোঝা কম্য নয়। এটা কি কোন সভা কক্ষ না শয়ন কক্ষ বুঝলাম না। সংরক্ষণ এর চেষ্টা হলে হয়তো জানা যেত। এর আগে বিভিন্ন ঐতিহাসিক মহলে যাবার সুযোগ হয়েছে। সর্বত্র ই নামা রকম দিক নির্দেশক রেপ্লিকা বা ছোট ছোট সাইন বোর্ড থাকে যাতে বোঝা সম্ভব হয়, কোনটা রাজা দের গোসল খানা, কোন টা শয়ন কক্ষ, কোন টা সভা কক্ষ, কোন টা লাইব্রেরী ইত্যাদি। এখানে সে সব কিছু নেই। বা থাকার সম্ভাবনা ও নেই। আর কালের কবলে কঙ্কাল বার করে প্রাসাদ আজ ধুঁকছে। না, কোন সন্দেহ জনক কিছু কোথায়ও চোখে পড়ল না।।
ধীরে ধীরে সামনের বারান্দা তে এলাম। একটা শতাব্দী প্রাচীন বট গাছ।ঝুড়ি নেমে নেমে আসল কাণ্ড কে খুঁজে পাওয়া মুশকিল করে দিয়েছে। বারান্দাতে রেলিং রয়েছে। তাতে সাহস করেই ঠেস দিয়ে হল ঘরের দিকে ফিরলাম।
জানি না এটা কোন রাজার প্রাসাদ। নাম যখন নুর মহল। তখন ধরে নিলাম মুসলিম কোন রাজা বা জমিদার। দেওয়ালের বয়স দেখে মনে হল প্রায় দু-তিনশ বছরের পুরানো। কড়ি বরগা খসে খসে পড়ছে। ভিতরের আসবাব বছর বছর ধরে লুঠ হয়ে গেছে। মনে হয় গঙ্গা গ্রাস করার পর লোকালয় শূন্য হয়ে যায়। আর কালের কবলে প্রাসাদ টি পরিচর্যার অভাবে এভাবে ভগ্নপ্রায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
গুপ্ত ধনের যে কাহিনী শুনলাম, তা হয়তো সত্যি। লুঠেরা রা তো সব কিছু ই বার করে নিয়ে গেছে। আর সবার আড়ালে সরকারের অগোচরে এটা ভৌতিক বাড়ির পরিচয় পেয়েছে। সত্যি মানুষ তিলকে কিভাবে তাল করে! কতক্ষণ এভাবে ভাবছিলাম জানিনা। আচমকা রেলিং ভেঙে গেল। আমি ছিটকে নিচে পড়লাম। ভাগ্য ভাল বটগাছের ডালে আটকে গেলাম। ঈশ্বর কে ধন্যবাদ এভাবে বেঁচে যাবার জন্য। তবে শরীরের বেশ কয়েক জায়গা ছড়ে গেল। জ্বালা করতে লাগল। অনেক কষ্টে গাছ থেকে নামলাম। কাছাকাছি কোন জল নেই, যে ক্ষত স্থান গুলো ধোব। জল বলতে তো সেই কাদা পেরিয়ে গঙ্গার পাড়। কি করব ভাবছি, এমন সময় দূরে দেখলাম দুটো ছায়ামূর্তি। ওরা কি প্রশান্ত আর কুন্তল?
— প্রশান্ত নাকি? দু পা এগিয়ে বললাম। মূর্তি দুটি স্থির, কোন উত্তর নেই। আবার জিজ্ঞাসা করলাম– কুন্তল কি রে কথা বলছিস না কেন? — কিন্তু দু জনেই চুপ!
ধীর পায়ে এগতে লাগলাম। এই প্রথম মনের ভিতর ‘ভয়’ দানা বাঁধল। আমি দু পা এগতেই দেখলাম কেউ কোথায় ও নেই! এ কি ভোজবাজি নাকি? ততক্ষণে সব ব্যথা ভুলে গেছি। নিচের ঘর গুলো মোবাইল জেলে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম। না কেউ কোথায় ও নেই। শুধু বাদুড় আর চামচিকে ছাড়া কিছু নেই। এতক্ষণে বুঝলাম, শরীরে এই ঠাণ্ডা তেও ঘাম হচ্ছে। জল তেষ্টা ও পেয়েছে। ব্যাগ থেকে বোতল টা বার করে তৃষ্ণা নিবারণ করলাম। আর অল্প ই বেঁচে আছে। তাই ক্ষত স্থান গুলো আর ধোয়া হল না।
মোবাইল টা খুললাম। কিন্তু নেট নেই বলে হোয়াটস্যাপ টা অন হল না। প্রশান্ত আর কুন্তল কে কোথায় খুঁজব। কিছুই মাথায় আসল না। আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠা শুরু করলাম। দোতলা তে উঠে এবার ডান দিকে গেলাম। পর পর কয়েক টা বন্ধ দরজা। আচ্ছা এই দরজা গুলো বন্ধ কেন? ভিতরে কি আছে? কৌতূহল বশতঃ একটা দরজা ধাক্কা মারলাম। পুরো বাড়ি শুদ্ধ কম্পন হতে লাগল। বোধহয় মরচে ধরা কপাট। তাই পাল্লা দুটো কিছুটা ফাঁকা হল। ভিতরে টর্চ মেরে দেখলাম এটাও একটা বড় ঘর। মনে সাহস এনে ঢুকলাম। মোবাইলের আলো ক্রমশঃ কমে আসছে।
কিছু টা যেতেই কিসে পা বেঁধে পড়ে গেলাম। কি ওটা? টর্চ মারতেই আমার হৃৎপিন্ড যেন ধরাস করে উঠল। একটা পঁচা, গলা মৃতদেহ। আমি ঢোক গিলে দু পা পিছিয়ে গেলাম। তার পর অসীম সাহস বুকে নিয়ে লোক টার মাথা টা তুলে দেখতে গেলাম। তারপর একটা চিৎকার করে পিছিয়ে এলাম। এতো রিকশা ওয়ালা মিলন! আমার সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগল। মোবাইল টা হাত থেকে পড়ে নিভে গেল। অন্ধকারে আর খোঁজার সাহস নিতে পারলাম না।
এক ছুটে বাইরে বেড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখি সিঁড়ির মুখে আবার দুটো চোখ জ্বল জ্বল করছে। তবে এটা সাপ না। কোন চার পেয়ে! মোবাইল টা হাতে থাকলে সহজেই বুঝতে পারতাম। কিন্তু না, এখানে তো আর বাঘ, চিতা বাঘ আসবে না। হয় শিয়াল না হয় ভাম। তবু মনের দ্রুত নির্দেশে আমি তিন তলার দিকে দৌড় লাগালাম। কারণ এখানে চাঁদের আলো বেশী আছে। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে সামনের বড় ঘর টা তে ঢুকে পড়লাম। হাঁপিয়ে গেছি, তাই মেঝের ধুলোর উপরই বসে পড়লাম। মাথা আর কাজ করছে না। মনে হচ্ছে পুরো মিশন টাই ব্যর্থ হল। মাথার মধ্যে হাজার হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল।
মিলন কি তবে ভূত?
পরক্ষণেই আবার নিজের মনকে যুক্তি দিয়ে বোঝালাম, এটা তে কোন রহস্য আছে। ভাবতে ভাবতে বেশ ঘুম পেতে লাগল। রাত এখন প্রায় তিন টে। ঘুম পাবার ই কথা। কিন্তু একটা মিস্টি গন্ধে যেন বেশী করে ঘুম পাচ্ছে। কোথা থেকে আসছে গন্ধ টা? যেন কেউ পারফিউম চড়িয়েছে। কিন্তু এখন ঘুমালে চলবেনা। ঠিক করলাম এবার তারস্বরে চিৎকার করব প্রশান্ত আর কুন্তলের নাম করে। সেই মতন চিৎকার শুরু করলাম। এক বার, দুই বার, তিন বার না, কেউ সারা দিল না। তবে মনে হল ঘরের দরজা টা কেউ একজন কিছুটা খুলল। আমি স্পষ্ট দেখছি একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে!
—কে, কে ওখানে?
কোন উত্তর নেই। আবার চিৎকার করলাম। — কথা বলছেন না কেন? কে আপনি? মূর্তি নিরুত্তর। আমি এক প্রকার বাধ্য হয়েই আত্মরক্ষার জন্য ব্যাগ থেকে ফল কাটার ছুরি টা বার করে এগিয়ে গেলাম। চাঁদের আলোয় যা দেখলাম, তাতে শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। এতো শিবু! বিবর্ণ, পাংশুটে মুখ। চাঁদের আলোতে চোখ জ্বলছে পশু দের মতন। আমি এসব কি দেখছি! এরা কি সত্যিই….
পিছন ফিরে আবার ঊর্ধশ্বাষে ছুটলাম। মিষ্টি গন্ধ টা বেড়ে চলেছে। তার সঙ্গে হৃতস্পন্দন ও। এদিকে ঘুমে চোখ মেলে রাখতে পারছি না। কেমন যেন শরীর টা অবশ হয়ে আসছে। মাটিতে পড়ে যাবার আগে দেখলাম, এই জায়গা টাই সব থেকে সুন্দর এই মহলে। এটা একটা ছোট ছাদ। চাঁদের আলোর যেন বন্যা বইছে। এ যে কি স্বর্গীয় সৌন্দর্য। মনে হচ্ছে কোন জাহাজের ডেকে বসে আছি। চার দিকেই নদী। মাঝে এই ভগ্ন প্রাসাদ। এখান থেকে পুরো জমি টা দেখা যাচ্ছে। দু দিকে সারি বদ্ধ অচেনা সব গাছ। তার থেকে ই আসছে মিস্টি গন্ধ। আমার আর কিছু মনে নেই।
কতক্ষণ পড়ে ছিলাম জানি না। তবে যখন উঠলাম, কোন ক্লান্তি নেই, শরীর একদম ফ্রেশ। ভোরের আলো ফুটছে। সঙ্গের জিনিসপত্র, মোবাইল কিছু আর দেখলাম না। উঠে এক পা দু পা এগতেই মৃদু কথাবার্তার আওয়াজ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। মনে বল এল সামনে যখন প্রশান্ত আর কুন্তল কে একজায়গায় বসে গল্প করতে দেখে। এটা ঐ স্বর্গীয় মহলের অপর প্রান্ত। ওরা ও আমাকে দেখে আনন্দে উঠে এল। একে অপর কে জড়িয়ে ধরলাম আবেগে। — তোরা কোথায় ছিলি সারা রাত? আমি তো খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেছি!
— আমরা এখানেই ছিলাম। তুই আমাদের দেখতে না পেলে ও আমরা তোকে সব সময় দেখে চলেছি। — প্রশান্ত বলল।
— এমন কি তুই যখন রেলিং ভেঙে পড়ে যাচ্ছিলি, তখন ও আমরা নিচে তোর কাছা কাছি ই ছিলাম। তুই হয়তো খেয়াল করিস নি। কারণ আতঙ্কে তোর চোখ বন্ধ হয়ে গেছিল। প্রশান্তের কথা শুনে বেশ অবাক হলাম। আমি জানি, বরাবর ঐ আমাদের পথপ্রদর্শক আর লিডার ও। কিন্তু গাছ থেকে পড়ার সময় ওরা কোথায় ছিল? ঢপ মারছে না তো? আমি তখন পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম– তাহলে যে দুটো ছায়া মূর্তি কে দেখে আমি ছুটে গেলাম, ওগুলো তোরাই ছিলি?
–হ্যাঁ, ছিলাম — কুন্তল হেসে বলল। — কিন্তু তোরা পালিয়ে গেলি কেন? আমি তো ভাবলাম অন্য কিছু।
–আসলে তখন ধরা দিলে পুরো রহস্যের কিনারা হতো না। — কুন্তল গম্ভীর হয়ে বলল।
আমি বললাম– কিসের রহস্য? যেটা তোরা রহস্য বলছিস, সেটা তো আমি ও ধরে ফেলেছি। বেশ গর্বিত হয়ে বললাম।
ততক্ষণে ভোরের আলো গাড় হয়েছে। প্রশান্ত আমার মুখের দিকে তাকাল অবাক হয়ে। অন্য সময় হলে প্রশান্ত কে ঘন ঘন সিগারেট টানতে দেখতাম। কিন্তু আজ বড় হতাশ যেন! তুই কি রহস্য পেয়েছিস? — গলা একেবারে খাদে নামিয়ে ও আমার মুখের দিকে তাকাল।
— রহস্য এই যে, যে মনোতোষ লোক টা আমাকে কল করে আমন্ত্রণ করেছিল, স্টেশন মাস্টার শিবাজী, মাঝি শিবু, রিকশাওয়ালা মিলন সবাই মৃত। আর এই বাড়ি টা ভুতুড়ে। আর আমি কোন দিন এই ভূতুড়ে বাড়ির রহস্য উন্মোচনে যাব না। আমি সব বিশ্বাস করে নিচ্ছি যে আমরা এত দিন ভুল ছিলাম।
আমার কথা ওরা মন দিয়ে শুনল। কিন্তু দু জনেই কিছুক্ষন কথা বলল না। প্রশান্ত কে দেখলাম দূরে গঙ্গা বক্ষের একটা নৌকা দেখছে। নৌকা টা দেখিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বাইনোকুলার টা এগিয়ে দিল। আমি ওর উদ্দেশ্য টা তখন বুঝলাম না। এক প্রকার অনিচ্ছা স্বত্বেও হাতে নিয়ে চোখ রাখলাম। তারপর 440 ভোল্ট কারেন্ট খাওয়ার মতন চমকে উঠলাম।– আরে, এ যে শিবুর নৌকো, শিবু ছাড়া ও মনোতোষ মাইতি, স্টেশন মাস্টার শিবাজী জানা, রিকশাওয়ালা মিলন সবাই আছে। সঙ্গে আরও তিন-চার জন। দু জন পুলিশ ও আছে দেখলাম!
–.তার মানে এরা বেঁচে সবাই?
আমার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে কুন্তল বলল– ওরা ভুত না। সবাই বেঁচে। আসলে ওরা একটা নাটক করে ছিল। একটা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। আমরা সমস্ত ঘটনা টা ধরে ফেলেছি। কুন্তলের কথাতে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। কি বলবে কুন্তল?
— এটা একটা চক্র। অপরাধ টা এমন বেনজির, যে চট করে কোথায় ও ধরা পড়ার ভয় নেই। কারণ ‘অপরাধ’ টাই তো হয়তো সংবিধান বহির্ভূত।
এখানে আসার আগে আমি আর প্রশান্ত জায়গা টা নিয়ে অনেক রিসার্চ করেছি। না কোন ইতিহাস বিদ কিছু বলতে পেরেছে, না কোন সাংবাদিক না গুগুল এ কোন খবর। তবে বিভিন্ন পুরানো খবরের কাগজ ঘেঁটে আর বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জেনে ছিলাম, প্রায় সত্তর বছর আগে সম্পূর্ণ এরিয়া টি নদী গর্ভে তলিয়ে যায়। শুধু প্রাসাদ টি আশ্চর্যজনক ভাবে টিকে যায়। স্টেশনের কাছে এক বয়স্ক ফকিরের কাছে শুনেছিলাম, বহু আগে এটা বাংলার নবাব সিরাজের হাভেলি ছিল। পরে এক হিন্দু জমিদার ভেট পায় বা তার হাতে আসে। যদিও কোন সঠিক তথ্য নেই। সব কিছু আনুমানিক। এদের ই এক বংশধর ব্রাজিলে যায় কর্মসূত্রে। সেখানে আমাজনের পাড়ে এক প্রকার গাছ দেখে উনি অবাক হন। এই গাছ ভূমিক্ষয় রোধ করে। উনি সেই গাছের চারা ভারতে নিয়ে আসেন। তারপর জমি তে লাগান। কারণ তিনি আশঙ্কা করে ছিলেন, যে ভবিষ্যতে এই গাছ গঙ্গার ভাঙন রোধ করবে।
তিনি মারা গেছেন বহুদিন। কিন্তু তার অনুমান মিলে গেছে। তাই সম্পূর্ণ অঞ্চল নদী গর্ভে তলিয়ে গেলেও এই প্রাসাদ টি ভাঙনের কবলে পড়ে নি। সেই গাছ গুলো ততদিনে অনেক বড় বড় হয়ে গিয়ে বাড়ি টিকে আগলে রেখেছে। মনোতোষ মাইতি এই বাড়ির ই বংশধর। মাঝে এই বাড়িতে পর পর মড়ক লাগলে উনি বাড়ি ছেড়ে ঐ মন্দিরে আশ্রয় নেন। কিন্তু কেন পর পর ঐ বাড়ি র বাসিন্দারা মারা গেছেন, তা কেউ বলতে পারে না। মনোতোষ বাবুর ও পুরো পরিবার শেষ হয়ে যায়। উনি পরবর্তী জীবনে আর বিয়ে থা করেন নি। এক বুক শোক নিয়ে পূজা পাঠ নিয়ে মন্দিরেই থেকে যান।
এ অবধি সব ঠিক ই ছিল। বাঁধ সাধল স্টেশন মাস্টার শিবাজী জানা। উনি কোন সিগনাল ম্যান না। স্টেশন মাস্টার ই। যেহেতু কোতল পুর খুব ছোট স্টেশন। সারা দিনে 3-4 টি গাড়ি দাঁড়ায়। তাই সব কিছু ওনাকে ই করতে হয়। একদিন মন্দিরে গিয়ে তিনি এই পুরো ঘটনা জানতে পারেন। ওনার মাথাতেই একটা আইডিয়া চাপল। যদি এই জায়গাটা কে জনপ্রিয় করে দেওয়া যায়, তবে এই স্টেশন টার আধুনিকি করণ হবে। আর ও অনেক ট্রেন থামবে। লোক জন ঘন ঘন আসবে ‘নুর মহল ‘ কে দেখতে। জমির দাম বাড়বে। বিভিন্ন হোটেল, দোকান হবে। উনি তাই যারা ভাঙনের ভয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে গেছে, তাদের জমি জলের দরে কিনে ফেলেন। এখন এখানে গঙ্গার পাড়ের বেশীর ভাগ জমি ওনার।
— কিন্তু মনোতোষ মাইতির কি লাভ এতে? — আমি গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। এবার প্রশান্ত ঘুরে দাঁড়াল। বলল– না ওনার কোন আর্থিক লাভ নেই। ওনার সম্পত্তির ব্যাপারে কোন লোভ নেই বলেই সবাই মারা যাবার পর গৃহত্যাগী হয়ে এখানে এই মন্দিরে পূজা অর্চনা করেন। তার বাড়ির ইতিহাস সমৃদ্ধ দর্শনীয় স্থান হলে তার গর্ব। ভৌতিক হলে তো আরো বড় ব্যাপার। লোক- জন আসবে, তিনি যে এই বিশাল প্রাসাদের উত্তরাধিকারী সেটাও তো যথেষ্ট গর্বের বিশয়। এবার আসি নাম ফলকের ব্যাপারে। ওটা কোন ফলক ই না। পুরো টাই ধোঁকা। হ্যাঁ, একটা পুরানো ফলক ছিল বটে। কিন্তু তার লেখা গুলো অবহেলাতে ঝাপসা হয়ে গেছে। আর তার উপর ই কাঠ কয়লা দিয়ে নাম গুলো টাটকা লেখা হয়েছে। — প্রশান্ত কথাটা বলে হাসল।
— আমরা হাত দিয়ে ঘষতেই লেখা গুলো উঠে যায়। আর কার হাতের লেখা যদি বলিস, তবে আমি বলব ওটা স্টেশন মাস্টার শিবাজী বাবুর। রেজিস্ট?