অন্ধকারে রাস্তাটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। কোনোমতে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটা অন করে হাঁটছে রেহান। ভাঙা রাস্তা দেখে নিজে থেকেই রিকশা থেকে নেমে গিয়েছিল সে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে যে কত বড় ভুল করেছে।
একেই তো অন্ধকার রাস্তা। তার উপর এত রাতে কোনো মানুষজনও নেই এখানে। দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে একটা অচেনা আর অস্বস্তিকর পরিবেশ। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে তার। শ্রীমঙ্গলে শিয়ালের আধিপত্য বেশি সেটা সে শুনেছিল। তবে কথাটা যে কতটা সত্যি সেটা এখন প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারছে।
ভূতের ভয় সে পায় না। কারণ বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হয়ে এসব বিশ্বাস করা তার কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে হয়। তবুও আজ নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দেওয়ার ব্যাপারটা তার কাছে পুরোটাই অজানা। সকালেই বন্ধুদের সাথে চলে যাওয়া উচিত ছিল। বেশি বাহানা আর বাহাদুরি দেখাতে গিয়েই এখন এই দশা। মেজাজটা বিগড়ে গেল রেহানের। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়াতে আসার মজা এবার হারে হারে টের পাচ্ছে। রেলস্টেশনে পৌঁছে গেছে সে। কিন্তু নীরবতা দেখে এটা যে রেলস্টেশন সেটা মনে হচ্ছে না। একরকম অবাকই হলো রেহান। এমন সময় স্টেশন মাস্টার এলো তার কাছে। লোকটা বেশ খাটো,রোগা ধরনের। দাঁতগুলো পান খেতে খেতে লাল হয়ে গেছে।
–কী ব্যাপার ভাই? ঘড়িতে কি সময় দেখেননি? রেহান ঠিক তখনই হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকাল। ঠিক বারোটা বাজে তখন।
–আজ রাতের কি আর ট্রেন নেই? আমার একটু তাড়া আছে।
— না ভাই,শেষের ট্রেনটা ছাড়লো আধঘন্টা আগে। পরের ট্রেন আবার সকাল ৭টায়। এত দূর থেকে এসে আবার এই মাঝরাতে ফিরে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সকাল পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে যেভাবে হোক।এমনটাই ভাবছিল রেহান।
–কী ভাবছেন ভাই? তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান। জায়গাটা ঠিক সুবিধার না। তার উপর আবার আজকে অমাবস্যা। লোকটার কথায় মাথাটা আরও গরম হয়ে গেল রেহানের।
–আমি এখানেই থাকব। আর আপনার ওইসব ঠাকুমার ঝুলির গল্প শেষ হলে আপনি যেতে পারেন।
যত্তসব অদ্ভুত মানুষ এখানকার।
–ভালো কথা শুনলেন না তো ভাইসাব। পরে কিছু হলে আমাকে বলতে পারবেন না বলে রাখলাম।
কথা শেষ করে লোকটা পান চিবোতে চিবোতে চলে গেল। এত বড় জায়গাটা একদম ফাঁকা। পিনপতন নীরবতা যাকে বলে একদম সেরকম।
একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো রেহান। হঠাৎ ভীষণ শীত করছে তার। ব্যাগ থেকে অনেক খুঁজে একটা মাফলার বের করে গলায় জড়িয়ে নিলো সে। এই মার্চ মাসে এরকম ঠান্ডা আবহাওয়ার কোনো মানেই হয় না। সেই কখন ডিনার করেছে। বেশ ক্ষুধাও লেগেছে এতক্ষণে। তবে এখন শরীরটা গরম করার জন্য হলেও এক মগ চা বা কফির খুব দরকার। কিন্তু এত রাতে এখানে কফি তো দূরেই থাক,চা পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এদিক সেদিক চোখ ফিরিয়ে একটু আশার আলো খুঁজছিল রেহান। তখনই বেশ দূরে একটা আলো দেখা গেল। কিছুটা অবাক হলো রেহান। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই তো এখানে বসে আছে। কিন্তু এতক্ষণ তো ওদিকে কোনো আলো ছিল না! যাই হোক এভাবে তো আর বসে থাকা যায় না। তাই এবার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে রেহান আলোর উৎসের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ভাগ্য ভালো হলে একটা চায়ের দোকান খোলা পাওয়া যেতেও পারে।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা কাছে চলে এসেছে সে। যা ভেবেছিল তাই। একটা চায়ের দোকান। বেশ কয়েকজন লোক সেখানে বসে আছে আর নিচু স্বরে আলাপ আলোচনাও করছে। এত রাতে যেখানে পুরো স্টেশনে একটা লোকও নেই সেখানে এই চায়ের দোকানটাতে এত মানুষ দেখে অবাক লাগছে তার। চায়ের দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রেহান। কিন্তু কারো কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই তাতে। যেন তাকে কেউ দেখতেই পাচ্ছে না। মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কয়েকটা কাশি দিলো সে। এবারে দোকানদার লোকটা ফিরে তাকাল তার দিকে। মুখে চরম বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বাধা পড়েছে। বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল রেহান। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমাকে এক কাপ চা দিতে পারবেন? কড়া করে।’
লোকটা কোনো উত্তর দিলো না,কিন্তু চায়ের কেটলির তাপটা বাড়িয়ে দিলো। রেহান তাই বেঞ্চের একটা কর্ণারে বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তার আসার পর লোকগুলো তাদের মধ্যকার আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছে। আর কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সত্যিই এখানকার মানুষগুলো কেমন যেন। একটা আগন্তুক লোকের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার কোনো মানে আছে নাকি? রেহান এবার সোজাসুজি পাশে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকাল। লোকটার হাতে একটা খবরের কাগজ। এমনিতে প্রতিদিনই খবরের কাগজ পড়ে রেহান।
কিন্তু বেড়াতে এসে এতদিনে একদমই পড়া হয়ে ওঠেনি। তাই কৌতুহল বশে পাশে বসা লোকটির হাতের খবরের কাগজের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করছিল সে। খবরের শিরোনামগুলো দেখে একটা খটকা লাগল তার। তাই কাগজের উপরে থাকা তারিখের দিকে দৃষ্টি ফেরালো। তারপর যেটা দেখল সেটা দেখে পুরোপুরি ভয়ে জমে গেল রেহান। খবরের কাগজের উপর তারিখের জায়গাটাতে ২৭শে মার্চ ১৯৭১ লেখা। ব্যাপারটাতে কীরকম প্রতিক্রিয়া করা উচিত বুঝতে পারছে না সে। শুধুমাত্র একটা খবরের কাগজ নিয়ে এতটা ঘাবড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। হয়তো লোকটা বিশেষ দরকারে কোনোভাবে জোগাড় করেছে কাগজটা। পরিস্থিতিটা খুব বেশি অস্বস্তিকর হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে,কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার জন্য রেহান এবার হঠাৎ কথা বলে উঠল।
–আচ্ছা,আজ রাতের কি আর কোনো শেষ ট্রেন আছে?
এতগুলো মানুষের মধ্যে একজন মানুষও তার কথার উত্তর দিলো না। উল্টে এমনভাবে তার দিকে তাকাল যে এবার সত্যিই রেহানের ভীষণ ভয় করতে শুরু করলো। কী শীতল সে দৃষ্টি! পুরো শরীরে একদম কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। একটা লোক আচমকা তার আঙুল দিয়ে কিছু ইশারা করে। ইশারা করা জায়গাটার দিকে তাকাতেই রেহান দেখল দূর থেকে একটা ট্রেন আসছে। শব্দও শোনা যাচ্ছে ট্রেনের।
রেহান আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না। এই শেষ ট্রেনটা যে করে হোক ধরতেই হবে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ট্রেনটাতে উঠল সে। আর সাথে সাথেই ট্রেনটা ছেড়ে দিলো। কিন্তু ট্রেনের চালক কী করে বুঝল যে সে ছাড়া স্টেশনে আর কোনো যাত্রী নেই? ধুর এসব ভেবে এখন আর কোনো দরকার নেই। শেষমেষ একটা ট্রেন যে পাওয়া গেছে সেটাই তো অনেক। কিন্তু স্টেশন মাস্টার লোকটা মিথ্যে কথা কেন বলল তাকে? কী বাজে লোক। সুযোগ পেয়েছে আর ভয় দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। এরকম মানুষগুলোকে শায়েস্তা করা উচিত। এসব বিড়বিড় করতে করতে একটা সিটে গিয়ে বসলো রেহান। পুরো বগিটাতে সে একা,শুধু কিছুটা দূরে এক বৃদ্ধা বসে আছে। রেহান উঠে গিয়ে সেই বৃদ্ধার পাশে বসলো। বৃদ্ধা তখন ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘আপনি কি একা দাদিমা?’
রেহানের শব্দে বৃদ্ধা তার দিকে ফিরে তাকাল আর বৃদ্ধার হাতের লাঠিটা মাটিতে পড়ে গেল। আমি অত্যন্ত দুঃখিত বলেই রেহান যখন মাটিতে হাত বাড়ালো লাঠিটা উঠানোর জন্য,দেখল বৃদ্ধা মহিলার পায়ের পাতা উল্টো দিকে। রেহান ভয়ার্ত চোখে বৃদ্ধার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখেও রাতের মতোই শুধু অন্ধকার। যেন কেউ দুই চোখে গাঢ় কালো কালি ঢেলে দিয়েছে। রেহান কোনো চিৎকার করতে পারলো না। গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না।
কোনোমতে পাশের বগির দিকে ছুটলো রেহান সাহায্যের জন্য। সেখানে একটা লোকের সাথে ধাক্কা লাগল তার। লোকটি তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ানো আর মুখটা চাদর দিয়ে ঢাকা। ‘ভাই আমাকে সাহায্য করুন। ও ও ওখানে একজন মহিলা’ তোতলাতে তোতলাতে কোনোভাবে বলল রেহান।
ততক্ষণে লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। লোকটার কপালের মাঝ বরাবর গুলির ক্ষত। আর সেই ক্ষত থেকে এখনো চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। সেই রক্তে লোকটার গায়ের সাদা চাদরটা ভিজে লাল হয়ে গেছে। ভয়ের একটা শীতল স্রোত রেহানের মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেল। উন্মাদের মতো কাঁপতে লাগল সে। ছুটে গিয়ে ট্রেনের শিকলটা টেনে দিলো। আর ট্রেনটা থামার অপেক্ষা করতে লাগল। যে করেই হোক তাকে এই ট্রেন থেকে নামতে হবে। নাহলে আজ এখানেই তার মৃত্যু নিশ্চিত। আর যাই হোক, আত্মার কবলে পড়ে মরতে চায় না সে। প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে এক যুগ সমান দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে। অবশেষে ট্রেনটা থামল। সাথে সাথেই রেহান নেমে গেল ট্রেন থেকে।
রেহান নামার পরেই ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলো। আর রেহান শুধু অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সেদিকে। আজকে রাতের কোনো ঘটনারই ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। কিন্তু সত্যটা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। স্বয়ং মৃত্যুদূত যেন দেখা দিয়ে গেল তাকে। ততক্ষণে ট্রেনটা তার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। যেন কখনো কোনো কিছুই হয়নি এখানে। তবে রেহান এখনও শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে।
হঠাৎ তার কাঁধের উপর একটা হাত এসে পড়লো। পিছন ঘুরে তাকাতেই সেই স্টেশন মাস্টার তার লালচে দাঁতগুলো বের করে বলতে লাগল, ‘কী ভাই,আমার কথা তো শুনলেন না। সারাটা রাত তো এখানেই কাটিয়ে দিলেন। আর একটু সময় তবে কষ্ট করে অপেক্ষা করুন। ভোর হতে তো আর মাত্র কিছুক্ষণ বাকি।’