সেদিন সকালেও পেপারওয়ালা পেপার দিতে ভুলে গিয়েছিল। আজও একইভাবে ভুলে গেছে, যা মোটেও আমার চিত্তসত্তাকে আনন্দ দিচ্ছেনা। সদ্য বিবাহিত পুরুষের যে সকালে আধোয়া মুখে এক কাপ চা আর সাথে একটা পেপারের খুব প্রয়োজন তা বুঝি পেপারওয়ালা কিংবা আমার সদ্য বিবাহিত অর্ধাঙ্গিণীর অজানা। সামনে চা আর পেপার না পাওয়ায়, মনের মাঝে এক প্রকার রাগ সৃষ্টি হলো।
তাই যেই মুহুর্তে তার উপর রাগ ঝাড়বার জন্যে তাকে নাম ধরে ডাকব, ঠিক সেই মুহুর্তে আমার অতি একান্ত প্রিয় গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এলো সে। অষ্টাদশী মেয়ের ঘন কালো ভেজা কেশ, সাথে ঘাড় হতে চুইয়ে পরা পানি যেন তাকে বানিয়েছে স্রোতস্বিনীর জলকন্যা! তারুণ্যের মাঝে যৌবন বুঝি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে তার। এক ঘোরের মাঝে চলে গেছিলাম! হঠাৎ তার চোখ আমার চোখের সাথে মিলিত হলে, সে চোখের ইশারায় প্রশ্ন করলো, কী দেখছি আমি? গলাটা একটু খাকারি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বললাম, “ আমার সকাল সকাল আধোয়া মুখে এক কাপ চা আর পেপারের প্রয়োজন হয়, তা আপনার জানা নেই?” এই বলেই তার দিকে ফিরে তাকালাম। সেই তারুণ্যময়ী চেহেরায় তখন ভয়ের ছাপ! মাথার চুলের খোঁপা জলদি বেঁধে দৌড় দিল রান্নাঘরে। আমি একটু অবাক চোখেই তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী আজব! আমি কী এতোটাই রেগে বলেছি?
বিকেল এখন চারটে, সেলিম চাচার দোকানে বসে গরম গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছি, আর রাস্তার মাঝে চলা ঝুম বৃষ্টির নৃত্য দেখছি। কখনোবা ডান দিকে বাকা হয়ে, আবার কখনও বাম দিকে বাকা হয়ে, আবার মাঝে মাঝে সোজা লম্বভাবে আকাশ থেকে পড়ছে। ছোটকালে এই লম্ব আঁকা নিয়ে গণিত স্যারের কাছে অনেক বকা খেয়েছি। একবার স্যার লম্ব আঁকতে বলেছিল, মুশকিল হলো আমি পারিনা কিভাবে লম্ব আঁকতে হয়! আমার চারপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই কম্পাসটা এদিক ওদিক ঘোরাতে ব্যস্ত। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি গণির স্যার তখন, সমাজবিজ্ঞান ম্যাডামের সাথে আলাপে ব্যস্ত। তখনি দেখি আমার পাশের জনের লম্ব আঁকা শেষ! ইচ্ছে করে নিজের পেন্সিলটা তার দিকে ফেলে তাকে নিয়ে দিতে বললাম।
নিচের দিকে তাকিয়ে সে হাতাতে হাতাতে পেন্সিল খুঁজতে লাগল। আর আমি তার লম্ব আঁকা পেইজটা নিয়ে নিজের বোর্ডে লাগিয়ে দিলাম। সে উঠে যখন দেখে তার লম্ব আঁকা পেইজ আমার কাছে, সাথে সাথে সে প্রতিবাদ করে উঠলো। আমিও পালটা জবাব দিলাম, বেঁধে গেল ক্লাসের মাঝে একাত্তর তম বিশ্বযুদ্ধ! স্যারের নজর ততক্ষণে ম্যাডাম হতে ক্লাসের দিকে চলে এসেছে। আমাদের কাছে এসে স্যার প্রশ্ন করে যে কি হয়েছে? তখন পুরো ব্যাপারটা আমার পাশের জন বললে, আমি দাবী করি যে না ওই লম্ব আমার। সেদিন স্যার আমাকে আরেকটা লম্ব আঁকতে বললে ধরা খেয়ে যায় আমি! ছোট্ট নিরীহ শিশু এই আমিকে সেদিন মুরগী বানিয়ে রাখা হয়েছিলো পুরো ক্লাসটাতে। আজও আমি ভাবি, “লম্ব! তুমি কার, কে তোমার?”
বৃষ্টি আমার বরাবরের মতোই প্রিয়, সেখানে আমার পুরনো প্রেয়সীর নাম যেখানে বৃষ্টি অতএব এই বাদল মেঘলা সময়টুকুতো উপভোগ্য হওয়ার কথাই। কিন্তু অফিস থেকে বের হয়ে এই মুহুর্তে এই ঝুম বৃষ্টি মোটেও ভালো লাগছে না, তার উপর সকালে না খেয়েই চলে এসেছি। আজ প্রায় এক মাস ধরে প্রায়সময় এভাবে না খেয়ে চলে আসি। অষ্টাদশী মেয়েটার মাঝে যে ভুলগুলো আমার মেজাজের লাল বাতী জ্বালিয়ে দেয়, তার একমাত্র শাস্তি হিসেবে এক মাস পর্যন্ত এটাই পেয়েছে যে তাকে আমি এখনও তুমি বলে ডাকিনি, কাছে যাওয়া তো দূরের কথা! প্রেমিকার জীবন হতে প্রস্তান আমার গোছালো চেতনা জাগানো শহরকে অগোছালো করে দিয়েছিল বেশ। আমি সেসময় প্রেমিকার প্রস্তানে শোক পালন করছিলাম, আমার মমতাময়ী মা এসে ধরিয়ে দিলো একটা ছবি।
ছবিতে একটা তারুণ্যময়ী অষ্টাদশী মেয়ে ছিলো, একটা মুচকি হাঁসি আর ডান হাতে মেহেদী দিয়ে। যাওয়ার আগে আমার মা জননী বলে গেল, “ পছন্দ হয়েছে কিনা দেখ, অবশ্য পছন্দ না হলেও তাকেই বিয়ে করতে হবে, আসছে শুক্রুবার তোমার বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নাও”। মেসেঞ্জারে রবীঠাকুরের এক্টিভ দেখার চেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় আমার কাছে ছিলো মায়ের বাণীটা। মায়ের মতে বিয়ে হওয়ায় সেই মেয়েটির সাথে বিয়ের দিন হতেই দূর্ব্যবহার করে আসছি। বাংলা সিনেমার মতো করে বাসর রাতেই বলে দিয়েছি, “আপনাকে আমি স্ত্রীর অধিকার দিতে পারবো না”। অবাক করে দিয়ে মেয়েটা সেদিন কাঁদেনি, আমিতো ভেবেছিলাম সিনেমায় দেখানো বউদের মতো করে কাঁদবে। তবে এরপর থেকে প্রতিটা ভোর আমার পাশের বালিশটা ভেজা পেয়েছি।
চা শেষ করে বৃষ্টি দেখতে দেখতে এসবই ভাবছিলাম, তখনি দেখলাম একটা ছেলে, বয়স দশ কি বারো হবে, আমার কাছে একটা ফুল এনে বলল, “ভাইজান এই একটা মাত্র ফুল আছে বাকি, এটা নেন দয়া করে, আমার খুব প্রয়োজন”। ফুলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ফুলের অবস্থা তেমন ভালোনা, রঙ কালো হয়ে গিয়েছে খানিকটা। তবে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো, তাই পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে তাকে দিলাম।
সে আমার দিকে খুশি হয়ে বাড়িয়ে দিল ফুলটা, আমি বললাম, “ওটা তুমি রেখে দাও, আমার আর লাগবেনা”। সে তখনি ফুলটা রাস্তার ধারে ছুঁড়ে মারলো। তারপর দোকানে গিয়ে একটা বড় পলিথিন আর দু’কাপ চা কিনে রাস্তার ওপাশে চলে গেলো। একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তার বয়সী এক মেয়ে বসে আছে। হঠাৎ তার পাশে ছেলেটার অস্তিত্ব পেয়ে অন্যমনস্ক মেয়েটা খুশি হয়ে উঠে। ছেলেটা দুজনের মাথায় পলিথি দিয়ে ঢেকে মেয়েটার দিকে চা বাড়িয়ে দিলে, মেয়েটা ছেলেটার গালে একটা ভালোবাসার চুমু একে দেয়।
দৃশ্যটা এতোটাই মধুময় ছিলো যে আমার নিজের মাঝের সত্তার চেতনা নড়ে উঠলো। নিজের স্ত্রীর প্রতি করা অন্যায়গুলোর জন্য কেমন যেন, নিজের মাঝে কষ্ট হতে লাগল। হঠাৎ ভাবলাম আজ তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে সবকিছুর জন্য। তাই টিপ টিপ বৃষ্টির মাঝেই হাঁটা দিলাম, সাথে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ফুলটা নিলাম। এখন হাঁটছি বড় রাস্তার আলপথ ধরে, আর ফুলটার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ আমি তাকে প্রথম ফুল দিবো, আমার ভালোবাসার কদমফুল।