ঢাকার কোন এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মাঠে গোল হয়ে বসে আছে কয়েকজন ছেলে মেয়ে। সবাই একে অপরের সাথে বিভিন্নরকম কথাবার্তা বলছে আর একটু পরপর হাসছে। প্রায় সবাই কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মোবাইল দেখছে বা মোবাইল দেখার ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছে। কে কবে কোথায় কিভাবে কার গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবে এসব নিয়েই মূলত আলোচনা চলছে। তবে এই দলেরই একজন ছেলে ভাবছে অন্য কথা। তার বাবা গত একমাস আগে তাকে একটা মোবাইল কিনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বাবা তাকে মোবাইল কিনে দেয়নি।
এদিকে তার এই মোবাইলের বাটন দুই একটা খুলে গেছে বহু আগে। ইদানিং ব্যাটারি ফুলে যাওয়ার কারণে মোবাইলের পেছনের অংশ বারবার খুলে পড়ে যায়। তাই কয়েকদিন হলো রাবার প্যাঁচিয়ে মোবাইল চালাতে হচ্ছে। অর্থাৎ মোবাইলের অবস্থা খুবই করুণ। মোবাইল একটা না কিনলেই নয়। ছেলেটার নাম আবির। গরীব বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা রিকশা চালক আর মা গৃহিণী। আবিরের সামনে যারা বসে আছে তারা সবাই মোটামুটি বড়লোক ঘরের সন্তান। এই বড়লোক ছেলেমেয়েদের মাঝখানে আবিরকে অনেকটা ময়ূরের বেশে কাকের মত মনে হয়। তবে এরা সবাই আবিরের খুব ভাল বন্ধু। সবসময় বড়লোক বাবার ছেলে মেয়েরা অহংকারি হয় না। আবিরের এই বন্ধু আর বান্ধবীগণ তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।
আবির ভাবছে আজকে বাসায় গিয়ে কিছুক্ষন মায়ের আঁচল ধরে কাঁদবে। আবির একটা টিউশনি করায়। সেই টিউশনের কিছু টাকা জমা হয়েছে। সেই টাকার সাথে যদি বাবা কিছু দেয় তাহলে মোটামুটি ভাল একটা মোবাইল কেনা যাবে। এসবই ভাবছিল আবির। হঠাৎ আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে আবিরের রাবার দিয়ে প্যাঁচানো ফোনটা বেজে উঠলো। রিংটোনের শব্দে তার সামনে বসে থাকা সবাই একসাথে আবিরের দিকে তাকালো। আবির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কল রিসিভ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পাঁচ ছয়বার রিসিভ বাটনে চাপ দেয়ার পর রিসিভ হলো।
— হ্যালো অবন্তী কেমন আছো?
— পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেগম রোকেয়া ভবনের সামনে আসবা। জাস্ট পাঁচ মিনিট।
— আচ্ছা।
অাবির ফোন রেখে দিল। অবন্তীর কথা শুনে মনে হচ্ছে কোন একটা কারণে রেগে আছে। কারণটা কি হতে পারে তা ভাবতে ভাবতেই আবির উঠে দাঁড়ালো। তখন আবিরের এক বান্ধবী বলে উঠলো,
— কিরে অবন্তী যেতে বললো নাকি?
— হুম যেতে বললো তো।
— আমি বুঝি না তোর মত একটা ক্ষেত মার্কা ছেলের মধ্যে অবন্তী কি পেল?
— আরে বুঝিস নাই এখনো? আমি তো গরীব ঘরের ছেলে। আর ও বড়লোকের মেয়ে। আমার উপর করুণা দেখাচ্ছে আরকি। আচ্ছা তোরা থাক। আমি গেলাম। আর আজকে দুপুরে বাসায় যাব না। তোদের মধ্যে কে আমাকে লাঞ্চ করাবি ঠিক কর।
— হুহ শখ কত তোর। যাহ ভাগ।
আবির তার বান্ধবীর কথা শুনে মুচকি হাসি দিয়ে বেগম রোকেয়া ভবনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। দুই মিনিটের মাথায় গেটের সামনে অবন্তীকে দেখা গেল ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আবির গিয়ে অবন্তীর পাশে দাঁড়ালো। অবন্তী সাপের মত ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। আবির হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো,
— কি হয়েছে তোমার? এমন ফুটবলের মত ফুলে আছো কেন? বাসায় কি আব্বু বকা দিয়েছে নাকি রান্না পারোনা দেখে আম্মু বকেছে? আবিরের কথাগুলে শেষ হওয়ার সাথে সাথে অবন্তী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
— তুই এত কথা বলিস কেন? আমি রাগ করি আর যাই করি তোর তাতে কি? তোকে দেখা করতে বলেছি তুই দেখা করবি। এত কথা বলার দরকার কি তোর? আর ফোন ধরতে তোর এত দেরী হয় কেন? কথাগুলো বলে অবন্তী চোখ পাকিয়ে আবিরের দিকে তাকালো। এতগুলো কথা শুনেও আবির একটুও বিব্রত হলো না। সে মুখ গোমড়া করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আল্লাহ আজকে গরীব বলে প্রেমিকাও তুই তুকারি করে। আল্লাহ কেন তুমি গরীব বানালে আমায়?
একথা বলে আবির তাকালো অবন্তীর দিকে। অবন্তীর চেহারা এতক্ষন রাগে লাল হয়ে ছিল। আবিরের কথা শুনে হঠাৎ ওই রাগে লাল হয়ে যাওয়া চেহারাটা কালো হয়ে গেল। চোখদুটো ছলছল করতে লাগলো অবন্তীর। এখনই বুঝি বর্ষন হবে। অবন্তী ছলছল চোখে আবিরের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবিরের হাত ধরে বললো,
— চলো কোথাও গিয়ে বসি।
— হ্যা চলো যাই। কোন ভাল ফাস্টফুডে গিয়ে বসলে কেমন হয়? আমি তো সকাল থেকে খালি পেটে ঘুরছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কিছু খাওয়ালো না। তুমি খাওয়াবে?
— হ্যা চলো খাওয়াবো।
একথা বলেই অবন্তী আবিরের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। পাশের একটা ফাস্টফুডে গিয়ে বসলো তারা দুজনে। দুজনেই ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ আর লাচ্ছি অর্ডার করলো। খাবার আসার সাথে সাথে আবির হামলে পড়লো খাবারের উপর। অবন্তী তাকিয়ে রইলো আবিরের দিকে। আবিরের খাওয়া দেখছে সে। আবিরের খাওয়ার দৃশ্য দেখতে অবন্তীর ভাল লাগে। তাই সে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে।
— কি ব্যাপার তুমি খাবে না নাকি? এভাবে খাবার সামনে রেখে দেয়া ঠিক না। তুমি যদি খেতে না চাও তাহলে….!
আবির কথাটা বলে অবন্তীর দিকে তাকালো। অবন্তী টু শব্দটি করলো না। আস্তে করে স্যান্ডউইচের প্লেট আবিরের দিকে ঠেলে দিল। আবির নিজ হাতে অবন্তীর লাচ্ছির গ্লাসটা নিজের দিকে টেনে নিল। তারপর আবার মনযোগ দিল খাওয়ার দিকে। খাওয়া শেষে আবির তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। অবন্তী তখনো আবিরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আবির বললো,
— সেই কখন থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছো। আমার খাওয়ার উপর নজর দাওনি তো? পেট খারাপ হলে কিন্তু ঔষুধের টাকা তোমায় দিতে হবে। এমনিই গরীব মানু! আবির তার কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই অবন্তী আবিরের একটা হাত ধরে আলতো করে চাপ দিল। এই চাপ দেয়ার মানে হচ্ছে ” তুমি চুপ করো, আমি কিছু বলবো।” তাই আবির চুপ হয়ে গেল। অবন্তী বললো,
— আবির তুমি সবসময় কথায় কথায় কেন নিজেকে গরীব বলে দাবী করো? আমার কাছে তোমার এই গরীব বলাটা খুব খারাপ লাগে। নিজেকে কেন এতো ছোট করে দেখো তুমি। প্লীজ আর কখনো এমনটা করো না। একথা বলতে বলতে হঠাৎ অবন্তীর গাল বেয়ে পানি পড়ার ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো আবির। আবির টিস্যু দিয়ে অবন্তীর চোখের পানি মুছে দিল। অবন্তী তখনো আবিরের হাত ধরে আছে। এমন ভাবে ধরে আছে যে মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই বুঝি আবির কোথাও চলে যাবে।
— আমার বাবা কি করে তাতো জানো। আমি কখনো আমার বাবার পেশা নিয়ে মিথ্যা বলিনি। আর আমি কখনো সমাজে আমাদের পরিবারের অবস্থান নিয়ে মিথ্যা বলিনি। আমি গরীবের বাচ্চা, এই কথাটা বুক ফুলিয়ে বলেছি। কারণ আমি চাই মানুষের কাছ থেকে করুণা ভিক্ষা করতে। গরীব মানুষের প্রতি মানুষের দয়া মায়া বেশি হয়। আর এই করুণা ভিক্ষা কেন করি জানো? কারণ আমার জীবনটা চলছেই কারো না কারো করুণার উপর। এই যে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তাও আমার এক চাচার করুণায়। প্রতিবছর সেমিষ্টারের টাকা দেয়ার মত সামর্থ্য নেই আমার বাবার। সেমিষ্টার শেষে হাত পাততে হয় চাচার কাছে। আর এই যে এই জামা দেখছো এটাও আমার বাবাকে কেউ দিয়েছিল, পুরোনা জামা। আমার বাবা জামাটা আমাকে দিয়েছে। এভাবেই ছোট ছোট ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই করুণা পেয়ে আমার মাথায় করুণা পাওয়ার ভূত উঠে গেছে। এতটুকু বলে আবির থামলো। অবন্তী অবাক চোখে আবিরের বলা কথাগুলো শুনছে। তার হাত এখনো আবিরের হাতে। সে আবিরের হাত ছাড়তে চায় না।
— এমন নয় যে আমরা সবসময় মানুষের দেয়া পুরোনো জামা পরেই থাকি। দুই ঈদে আমরা জামা কাপড় কিনি। তাও গুলিস্তান বা এমনই কোন ফুটপাত মার্কেট থেকে। আমাদের একটা ঘরেই চারজন মানুষ থাকতে হয়। আমি আর আমার ছোটবোন খাটে ঘুমাই, বাবা মা ঘুমায় নিচে পাটি বিছিয়ে। অবন্তী তুমি হয়তো জানো না যে বাবা মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে আমি নিজে বাবার রিক্সা নিয়ে বের হই। আমার বন্ধু নজরুল একদিন আমাকে দেখে ফেলেছিল। আমি ভেবেছিলাম ও পুরো বন্ধুমহলে খবরটা ছড়িয়ে দিবে। কিন্তু আমি গরীব হওয়া সত্বেও আল্লাহ আমার কপালে কিছু ভাল বন্ধু জুটিয়ে দিয়েছে। যার মধ্যে নজরুল অন্যতম।
ও কাউকে কিছু জানায়নি। এভাবেই প্রতিনিয়ত দারিদ্রতাকে মাথায় বসিয়ে চলাফেরা করি। তাহলে আমি গরীব এই কথাটা মুখে স্বীকার করতে দোষ কোথায়? আর এই গরীব শব্দটা বললে আমার লিমিট কতটুকু তা আমার মনে থাকে। যেমন ধরো তোমাকে আমি ভালবাসি। এটা মিনারেল ওয়াটারের মত বিশুদ্ধ। কিন্তু তোমাকে ভালবেসে কখনো বিয়ে করার স্বপ্ন আমি দেখিনি। কারণ এমনিতেই তোমাকে ভালবেসে আমি আমার লিমিট ক্রস করে ফেলেছি। বিয়ের স্বপ্ন দেখে সেই লিমিট ক্রসের লিমিটটা ক্রস করতে চাই না। তোমাকে ভালবাসতে পেরেছি এটাই তো আমার জন্য যথেষ্ট। এখন কোন একদিন যদি তুমি এসে বলো যে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তোমাকে ভুলে যেতে হবে তাহলে আমি কষ্ট পাবো না। কারণ আমি আমার যতটুকু পাওনা তার চেয়ে বেশি পেয়ে গেছি। কারণ আমি গরীব মানুষ, বেশি খেতে গেলে আমার মুখ পুড়ে যাবে। আমি!
আবির এবার কথা শেষ করার আগেই অবন্তী শব্দ করে কেঁদে উঠলো। আবির কথায় কথায় এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে অবন্তীর দিকে খেয়ালই ছিল না। যতক্ষনে খেয়াল করলে ততক্ষনে কয়েক টুকরো টিস্যু অবন্তী ভিজিয়ে ফেলেছে। আবির কথা থামিয়ে অবন্তীর হাত শক্ত করে ধরলো। তারপর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই অবন্তী বলে উঠলো,
— চুপ, একদম চুপ। আর একটা কথা বলবা না তুমি। তুমি এসবই ভাবো মনে মনে। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো? এটাই তোমার বিশ্বাস আমার উপর? তাহলে থাকো তুমি তোমার বিশ্বাস নিয়ে। একথা বলে অবন্তী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আবির কি করবে ভেবে না পেয়ে অবন্তীর হাত ধরে টান দিল। অবন্তী এক ঝটকায় আবিরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। তখনই আবির চেঁচিয়ে উঠলো,
— অবন্তী খাবারের বিল কে দিবে? আমি গরীব মানুষ, বিল দেয়ার সামর্থ্য নেই আমার। বিলটা দিয়ে যাও প্লীজ। আবিরের কথায় অবন্তী থেমে গেল। অগ্নি দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো গেটের কাছে। তারপর হুট করে তেড়ে এলো আবিরের দিকে। আবির ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল।
— আবির আর একবার যদি মুখ দিয়ে গরীব শব্দটা বের হয় তাহলে তোমাকে খুন করে ফেলবো আমি। তুমি আমার মনের রাজা। আর রাজা কখনো গরীব হয়না। বুঝতে পেরেছো আমার কথা? কি হলো কথা বলো না কেন? আমার কথা কানে গিয়েছে? কথা বলতে বলতে অবন্তী আবিরের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। আবির অবন্তীর গরম নিশ্বাসের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। সে কি করবে ভেবে না পেয়ে বললো,
— অনেকদিন কান পরিষ্কার করি না। কি বললা শুনিনি। আরেকবার বলো।
— তোমার আর শুনতে হবে না। তুমি থাকো।
অবন্তী এবার বিল মিটিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। তার পিছু পিছু বেরিয়ে এলো আবির। অবন্তীর চোখে মুখে রাজ্যের রাগ। আর অাবিরের চোখে মুখে রাজ্যের দুষ্টুমি। তারা দুজনে অপেক্ষা করছে একটা রিক্সার। রিক্সা পেলে তারা দুজনে উঠে বসবে রিক্সায়। একে অপরের গা ঘেঁষে, একে অপরের হাতে হাত রেখে তারা চলবে আরো কিছুটা পথ। কারণ তারা একে অপরের রাজা রাণী। আর রাজা রাণী সবসময় পাশাপাশিই থাকে।