গল্পটা একজন নায়কের। অঘোষিত ভাবে আমার গল্পের নায়কের নাম সবাই দিয়েছে পথশিশু। আমার গল্পের নায়ককে সবাই এই নামেই চেনে। আমার গল্পের নায়ক অন্যসব গল্পের নায়কের মতো বিলাস বহুল, সুন্দর চেহারার অধিকারী, নম্র মিষ্টি কন্ঠের অধিকারী নয়। আমার গল্পের নায়ক অতি সাধারণ একজন মানুষ। আমার গল্পের নায়ক যখন খালি পায়ে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে ছুটতে থাকে তখনও আমার গল্পের নায়কের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। তাও এই পথশিশুটি আজ আমার গল্পের নায়ক।
আমার গল্পের নায়কের ঘুম ভাঙে সূর্য মামারও ঘুম ভাঙার আগে। মুয়াজ্জিনের মিষ্টি কন্ঠের সুরেলা ধ্বণিতে উচ্চারিত ফজরের আজানের শব্দ নায়কের কানে যেতেই নায়ক দ্রুত ঘুম থেকে উঠে। এরপর নায়ক তার ইঁটের বালিশ আর চটের বিছানাটা পথের একপাশে গুছিয়ে রাখে। আমার গল্পের নায়ক অগুছালো নয়! পরক্ষণেই নায়ক খালি পায়ে ধুলো উড়াতে উড়াতে ছুটে বস্তীর দিকে। কারণ নায়ক জানে, বস্তীর অন্ধ বুড়ো নায়কের অপেক্ষায় রোজকার মত আজও বসে আছে। অন্ধ বুড়োর এ পৃথিবীতে আপন বলে কেউ নেই। সারাদিন একা একা থাকে সে। তার বড় ইচ্ছে সে রোজ জামায়াতে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়বে। কিন্তু তার যে কোন আপনজন নেই এ পৃথিবীতে। কে নিয়ে যাবে তাকে মসজিদে? তাইতো আমার গল্পের নায়ক রোজ মুয়াজ্জিনের আজানের পর বুড়োর কাছে ছুটে যায়! এরপর বুড়োকে ওযু করিয়ে নিজে হাতে ধরে ধরে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে যায়। এরপর বুড়ো সবার সাথে কাতারে দাঁড়িয়ে জামায়াতে নামাজ পড়ে।
আমার গল্পের নায়কেরো মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে সবার সাথে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে। কিন্তু আমার গল্পের নায়কের পরনে শুধু ময়লা একটা ছ্যাড়া প্যান্ট! তাই তার মসজিদে প্রবেশের অনুমতি নেই। বুড়োর নামাজ শেষ হওয়ার পর আবার তাকে তার বস্তীর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে আমার গল্পের নায়ক। বুড়োর প্রতি নায়কের কাজ এতটুকুই। এরপর সূর্য উঠার সাথে সাথেই নায়ক একটা বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ তার কাঁধে ঝুলিয়ে ছুটে পথ থেকে পথান্তরে। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য সাথে থাকে শুধু এক বোতল পানি। সে কখনো বোতল কুড়ায় কখনো কাগজ। রাস্তায় পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যেগুলোর তার প্রয়োজন নেই ,সেগুলোকেও এড়িয়ে চলে না আমার গল্পের নায়ক।
নায়ক রাস্তায় পড়ে থাকা অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় সব বস্তুগুলো রাস্তা থেকে উঠিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। আমার গল্পের নায়ক মনের চোখ, কান বন্ধ রেখে রাস্তা দিয়ে হাঁটে না! রাস্তায় হঠাৎ কোন বৃদ্ধ রাস্তা পাড় হাতে ভয় পেলে আমার গল্পের নায়ক তার হাত ধরে রাস্তা পাড় করিয়ে দেয়। কোন ঠেলাওয়ালার ঠেলা ঠেলতে কষ্ট হলে নায়ক শত কাজ ফেলেও ঠেলা ধাক্কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। যদিও তার শরীরে তেমন শক্তি নেই! তবে তার ইচ্ছা শক্তি প্রবল। আমার গল্পের নায়ক পথে ছুটতে ছুটতে যখন ক্লান্ত হয়ে যায় তখন নিজের সঙ্গে আনা পানি পান করে। তবে অবশিষ্ট পানি সে অপচয় করে না! দুপুরের গরম উত্তাপে যখন রাস্তার পাশের সেই শিমুল গাছটা তৃষ্ণার্থ থাকে তখন আমার গল্পের নায়ক তার পানি পান করার পরের অবশিষ্ট পানিটুকু সেই গাছটার গোড়ায় ঢেলে দেয়।
সে জানে যে এতটুকু পানি গাছটার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাও সে চেষ্টা করে। বিকেলে রোজ সে তার বাসস্হানে ফেরার আগে ২টা বিস্কুট কিনে। একটা সে নিজে খায় আর আরেকটা রাস্তার পাশের একটা ছোট কুকুরকে খাওয়ায় সে। কুকুরটা যেন রোজ নায়কের হাতের বিস্কুট খাওয়ার অপেক্ষায়ই সেখানে বসে থাকে। আমার গল্পের নায়ক রোজ বোতল আর কাগজ বিক্রির টাকা অল্প অল্প করে জমায়। আর মাস শেষে ছুটে যায় বস্তীর একটা ক্ষুদ্রঘরে রহিমা বাণুর কাছে। রহিমা বাণুর স্বামী তাকে অন্তরসত্ত্বা অবস্হাতেই ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। তার মেয়েকে নিয়ে বর্তমানে খুব অভাবে জীবন যাপন করছে রহিমা বাণু। তাই আমার গল্পের নায়ক যতটা পারে রহিমা বাণুকে তার সংসার চালাতে সাহায্য করে প্রতিমাসে।
তবে আমার গল্পের নায়ক পৃথিবীর কাছে মুল্যহীন। হয়তো কোন বোঝা! কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার গল্পের নায়ককে খুব ভালোবাসেন। আর তিনি যাদের খুব ভালোবাসেন তাদের খুব দ্রুত তাঁর কাছে নিয়ে যান। তাইতো আমার গল্পের নায়ককেও তিনি বেশিদিন পৃথিবীতে থাকতে দিলেন না। এক রাতে একটা বাস এসে উঠে যায় সরাসরি আমার গল্পের নায়কের শরীরের উপর দিয়ে। ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে নায়কের দেহ। তবে এই দেহটাও যেন পৃথিবীর জন্য বোঝা। তাইতো এটা অবশেষে ঠাঁই পেলো ময়লাস্তুপের উপর। পুরো পৃথিবী ভুলে গেল আমার গল্পের নায়ককে। তবে আমার গল্পের নায়ক ফেলে গেল কিছু স্মৃতি আর অনেক জ্ঞান।
আমার গল্পের নায়কের চলে যাওয়ার পর পৃথিবীর মানুষগুলো যেন অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো । এখন রোজ মুয়াজ্জিনের আজানের শব্দে অনেক গুলো মানুষ আসে বুড়োকে মসজিদ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে। কিন্তু বুড়ো কারো সাথেই যায় না। সে লাঠি ভর করে একা একাই মসজিদের দিকে ছুটে যায় আর চিৎকার করে সৃষ্টিকর্তাকে বলে, “চাই না আমার এই এক শহর সহানুভূতিশীল মানুষ। তুমি আমার নায়ককে ফিরিয়ে দাও। আমি আরেকটি বার নায়কের হাত ধরে মসজিদ পর্যন্ত যেতে চাই!”
আমার গল্পের নায়কের চলে যাওয়ার পর এই প্রকৃতি যেন একটু বেশিই উদ্ভিদগুলোকে ভালোবাসতে শুরু করল। রোজ দুপুরে এক আকাশ বৃষ্টি এসে রাস্তার পাশের সেই শিমুল গাছটাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু গাছটা তাতেও খুশি হয় না। গাছটাও চিৎকার করে সৃষ্টিকর্তাকে বলে, “চাইনা আমার এই এক আকাশ জল! তুমি আমার কাছে আবার
আমার নায়ককে ফিরিয়ে দাও। আমি আরেকটি বার নায়কের পান করার পরের অবশিষ্ট থাকা সেই পানিটুকুর স্বাদ পেতে চাই!”
আমার গল্পের নায়ক চলে যাওয়ার পর পৃথিবীর মানুষের যেন জীব প্রেম জেগে উঠলো। সেই গলির কুকুরটাকে এখন এলাকার অনেকেই নানান ধরণের ভালো খাবার দিয়ে যায়। তবে কুকুরটা একটা খাবারেও মুখ লাগায় না। সে শুধু চিৎকার করে সৃষ্টিকর্তাকে বলে, “চাই না আমার এই এক পাহাড় খাবার। তুমি আমার কাছে আমার নায়ককে ফিরিয়ে দাও! আমি আরো একটি বার নায়কের হাতের ছোয়া সেই বিস্কুটটা খেতে চাই।”
আমার গল্পের নায়ক পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর এবার যেন পৃথিবীর মানুষদের মানবতা আর দানশীলতা একটু বেড়েই গেল। অনেকেই রহিমা বাণুকে এখন অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চায়। কিন্তু রহিমা বাণু কারো সাহায্যই নেয় না! সে শুধু চিৎকার করে সৃষ্টিকর্তাকে বলে, ” চাই না আমার এই এক পৃথিবী দানশীল ভালো মানুষ। তুমি আমার কাছে শুধু নায়ককে ফিরিয়ে দাও আবার। আমি আরো একটা দিন কিছু টাকা হাতে নায়কের সেই মায়া ভরা হাসিটা দেখতে চাই!”
আমার গল্পের নায়কতো চলে গেল। তবে আমি কুড়িয়ে নিলাম তার ফেলে যাওয়া কিছু শিক্ষা। আমার গল্পের নায়কের একটা উপদেশ রয়েছে সবার জন্য: “এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে আমাদের সবারই এমন কিছু কাজ করে যাওয়া উচিত, যেই কাজগুলোর জন্য মৃত্যুর পরে আমাদের পরিবারের মানুষ ছাড়াও অন্তত ৪ জন মানুষ আমাদের কথা মনে রাখবে।”