আজ আমি খুবই খুশি। না, আমি কোনো লটারি জিতিনি। মাটি খুঁড়ে কোনো গুপ্তধনও আবিষ্কার করিনি। এমনকি অনেকদিন ধরে ভুগতে থাকা গেঁটে বাত থেকেও সেরে উঠিনি। আমার হজমের সমস্যাটাও বহাল তবিয়তেই আছে।
কিছুই যখন হয়নি তাহলে হঠাৎ করে আমার খুশি হয়ে উঠার কারণ কী? আসলে আমার অনেকদিনের পেইন্টার্স ব্লকটা কেটে গেছে।
আমি একজন পেইন্টার। ছবি আঁকাটাই আমার কাজ। আমার পেশা, নেশা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন সব। যেদিন থেকে আমি বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকেই আমার জীবনের প্রতিটা সেকেণ্ড এই একটা বিষয়কে ঘিরেই ঘুরছে। অথচ এই আমিই কি-না গত দশ মাস যাবৎ তুলির বিক্ষিপ্ত কয়েকটা আঁচড় ছাড়া আর কিছুই আঁকতে পারিনি। শূণ্য ইজেলের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি। রাতের পর রাত নিঝুম নিস্তব্ধতায় শব্দ খুঁজে কাটিয়েছি। কাপের পর কাপ চা ফুরিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি জমে গিয়ে মুখটাকে করে তুলেছে বেখাপ্পা বীভৎস। শুকিয়ে গিয়ে শরীরের এমন হাল হয়েছে আঙুল দিয়ে পাঁজড়ের প্রত্যেকটা হাড় গোনা যায়। মেডিকেলের স্টুডেন্টরা আমার নাগাল পেলে লাখ টাকার কঙ্কালও অবলীলায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও আমার মাথায় ধুন্ধুমার কোনো আইডিয়া দানা বাঁধেনি। হাজার খুঁজেও আঁকার মত এমন কোনো বিষয় আমি পাইনি যা বোদ্ধা সমাজকে পুরো বাকরুদ্ধ করে দেবে। গত দশ মাস ধরেই আমি পেইন্টার্স ব্লকের অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি। দুঃখিত। ভুল বললাম। কথাটা প্রেজেন্ট নয় পাস্ট টেন্সে হবে। পড়ে ছিলাম। অন্তত কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও কথাটা প্রেজেন্টই ছিল। কিন্তু এখন সেটা অতীত। আমার রাহুর দশা কেটে গেছে। আমি আর পেইন্টার্স ব্লকে পড়ে নেই। অবশেষে প্রায় দশ মাস পর আমি আবারও ছবি আঁকতে চলেছি।
অনেক খুঁজাখুঁজির পর তুলিটাকে পাওয়া গেল। বহু বছরের ব্যবহারে বিস্কুট রঙের তুলিটাতে ছোপ ছোপ কালসিটে পড়ে গেছে। আশ্চর্য! তুলিটাকে দেখতে ঠিক চুলে পনিটেইল করা একটা খুদে বালিকার মতো লাগছে। অন্তত আমার চোখে সেরকমটাই মনে হচ্ছে। চোখে মুখে দশ মাসের অবহেলার বেদনা গুমোট মেঘের মত জমে আছে। মসৃণ কাঠের শরীরটা শিশু সুলভ অভিমানে ষোড়শী বালিকার মতোই ফুলে ফুলে উঠছে। অবশ্য পুরোটাই আমার কল্পনা। এমন অলীক কল্পনায় আমার নিজেরই হাসি পেয়ে গেল।
তুলিটার মান ভাঙাতে আমাকে খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা বাড়তি আঙুলের মতো আমার হাতে ঝুলে গেল। আসলে সেটাও তো আমারই মতো ক্যানভাসে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মুখিয়ে আছে। তো, মান-অভিমানের পর্ব শেষ। এবার আমার কাজে নামার পালা। এমনভাবে ছবিটাকে আঁকব বিস্ময়ে সমালোচকদের ভেতরটা পর্যন্ত নড়ে যাবে। ছবিটার রঙ, অভিব্যক্তি, কম্পোজিশন- সবই যে দর্শক মনে একটা চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে দেবে এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
অবশেষে আমি ছবিটা আঁকতে শুরু করলাম। বিষয়বস্তু অবশ্য আগে থেকেই ঠিক করা। আমি ওয়াটার কালারে সিদ্ধহস্ত। এই ছবিটাও ওয়াটার কালারেই আঁকব। প্রথমেই আলাদা একটা কাগজে হরেক রঙের আঁকিবুকিতে দেখে নিলাম কোন রঙটা আমার ছবির জন্য জুতসই। এই ব্যাপারটাই একটু সময় সাপেক্ষ। রঙের ব্যাপারটা ঠিক হয়ে গেলেই বাকি কাজটা একেবারে সুড়সুড় করে নেমে যাবে।
যদিও বর্তমান যুগ অ্যাবস্ট্র্যাকশনের যুগ। চারিদিকেই বিমূর্ত শিল্পের ছড়াছড়ি। আধ-খেঁচড়াভাবে কোনোমতে তুলির কয়েকটা আঁচড় দিতে পারলেই হলো, ছবি আঁকা হয়ে যায়। শখের সমালোচকগুলোও তেমনি। ওরাও এই আধ-খেঁচড়া ছবিগুলোর গায়ে মডার্ণ আর্টের তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। ভাবখানা এমন, বোঝা গেল তো আর্ট, বোঝা গেল না তো মডার্ণ আর্ট। মাঝে মাঝে আমার হাসিই পায়। আবার কিছুটা ভয়ও লাগে। এই করেই না আবার শিল্পটা ধ্বংস হয়ে যায়। প্রকৃতিকে ভেঙেচুরে বিকৃত করে আধুনিক শিল্পীরা যে কি আনন্দ পায় সেটা কেবল মাত্র তারাই বলতে পারবে। আমি বরাবরই বাস্তবতার অনুরাগী। ছবি আঁকার শুরুর দিনগুলো থেকেই আমি রিয়্যালিজমের সঙ্গে একেবারে আঠার মত সেঁটে আছি। আধুনিক শিল্প বোদ্ধারা অবশ্য অনেকদিন আগে থেকেই রিয়্যালিজম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু রিয়্যালিজমের আবেদন যে কোনোদিনই পুরনো হবে না আমার এই ছবিটা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে ছাড়বে।
আমার আঁকা ছবি লাখ টাকায় বিক্রি হবে এমন আকাশ-কুসুম চিন্তা আমার নেই। আমি শুধু চাই তুলির ব্যবহারে আমার দক্ষতা যে কতখানি লোকে সেটা জানুক। অবশ্য ভেতরে ভেতরে সেরকম একটা আশাও যে লুকিয়ে নেই সেটা কিন্তু আমি একবারও জোর দিয়ে বলছি না। ছবিটা শেষ করতে আমার মোট তিন দিন সময় লাগল। এই তিন দিনে আমি আমার স্টুডিও থেকে খুব একটা বেরুইনি। যে উদ্যম নিয়ে আমি এই ছবিটা এঁকেছি, আমার মতো অগোছালো আর অলস প্রকৃতির মানুষের পক্ষে সেটাকে একটু অস্বাভাবিকই বলতে হবে। ছবির কাজ হয়ে যাওয়ার পরেও এখানে-ওখানে একটু-আধটু তুলির ছোঁয়া লাগাতেই হয়। সেটা শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেল।
অবশেষে তৃতীয় দিন ঠিক সন্ধ্যায় পাকাপাকিভাবে আমার ছবির কাজ শেষ হলো। কাজের উত্তেজনায় পেশিগুলো দপদপ করছে। একটু বিশ্রামের জন্য পেশিগুলো যেকোনো মুহূর্তে বিদ্রোহ করে বসতে পারে। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে আমি ছবিটার দিকে তাকালাম। ওহ মাই গড। এক কথায় অসাধারণ। আমি আজ নিজেকেই অতিক্রম করে ফেলেছি। এমন একটা ছবি যে কখনও আমার পক্ষে আঁকা সম্ভব সেই সম্পর্কে আমার নিজেরই কোনো ধারণা ছিল না। নিজেকে আজ দারুণ তৃপ্ত বলে মনে হচ্ছে। এতদিনের এই যে এত পরিশ্রম সেটা জলে যায়নি। দেখার মতো একটা ছবি হয়েছে। যেই দেখবে সেই এক বাক্যে মেনে নেবে, ভেতরে প্রকৃত শিল্পী সত্তার তাগিদ না থাকলে কারও পক্ষেই এমন ছবি আঁকা সম্ভব নয়। আমি তন্ময় হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার সৃষ্টিতে আমিই মুগ্ধ।
পুরো ব্যাকগ্রাউণ্ডটাই নীলচে বেগুনী। যেন বাজ পড়ার পর এক খণ্ড নীলচে বিদ্যুৎ শিখা আলগোছেই ক্যানভাসে আঁটকে গেছে। তাতে কিছুটা ধূসর ছোপ। ধূসর আর নীলের অদ্ভুত কম্বিনেশন ছবিটাতে ভয়াল এক আবহ ফুটিয়ে তুলেছে। সেইসাথে পুরো ক্যানভাস জুড়েই বিষাদের একটা কোমল স্পর্শও ছড়িয়ে আছে। ছবিটাতে এলোমেলো ভাবে কিছু আসবাব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেসবের মধ্যেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে একটা মেয়ের লাশ। ভয়ার্ত চোখ দু’টো যেন টিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওপাশে একটা পুরুষের অস্পষ্ট অবয়ব। লাশের চোখ দু’টো শূণ্য দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। উফ! সত্যিই অসাধারণ কম্পোজিশন। আমার নিজেরই নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ছবিটা একবার কোনো প্রদর্শনীতে লটকে গেলে অনেকদিন ছবিটার প্রশংসা মানুষের মুখে মুখে ঘুরবে। ছবিটা এতটাই বাস্তব আর এতটাই জীবন্ত যে, পুরো দৃশ্যটাই দর্শকের মনে ঘ্যাঁচ করে গেঁথে যাবে। বলা যায় না কেউ হয়তো চড়া দামে ছবিটাকে কিনেও নিতে পারে।
অবসাদে আমার পুরো শরীরটাই ভেঙে পড়তে চাইছে। আমি ধপ করে মেঝেতেই বসে পড়লাম। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলতেই আপনা-আপনিই আমার ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। একদম হুট করেই আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এখনও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। কাজের উত্তেজনায় ব্যাপারটা আমার খেয়ালই ছিল না। শুধু এই একটা গাফিলতির কারণেই আমার এতদিনের কষ্টটা মাটি হয়ে যেতে পারে। সামান্য একটা ভুল। যেটা আমার মতো দক্ষ শিল্পীর নামের পাশে বড্ড বেশি বেমানান। আমার সমস্ত কাজেই থাকবে নিপুণ শৈল্পিক ছোঁয়া। নিঁখুত মুন্সিয়ানার ছাপ।
আমি ঝট করে উঠে পড়লাম। আর চট করে ইজেলটাকে পাশ কাটিয়ে পেছনে চলে এলাম। পেছনে চলে আসতেই ভক করে গা গুলানো একটা গন্ধ এসে আমার নাকে আছড়ে পড়ল। এতক্ষণ যেটা আমি টেরই পাইনি। ভ্রু কুঁচকেই আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শেষ রক্ষা বোধহয় হলো না। ইশ! ব্যাপারটা যে কেন আগেই খেয়াল করলাম না? আমি থপ করে সেখানেই বসে পড়লাম। এখন আর কিছুই করার নেই। গন্ধটা ছড়িয়ে পড়েছে।
তিন দিন। বেশ অনেকটা সময়। অন্তত একটা লাশ পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়ানোর জন্য সময়টা যথেষ্টরও বেশি। না, কেউ আমাকে দোষ দিতে পারবে না। একরকম বাধ্য হয়েই আমাকে খুনটা করতে হয়েছে। চোখের সামনে বাস্তবতা না থাকলে ছবিটা কিভাবে বাস্তবসম্মত হতো? তাই শুদ্ধ শিল্পের খাতিরে আমাকে খুনটা করতেই হয়েছে। একটু যে কষ্ট হয়নি তা নয়। কষ্ট তো একটু হবেই, হাজার হলেও লাশ হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটা তো আমারই ঔরসজাত সন্তান।