“আমি যেদিন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে প্রথম কলেজে ভর্তি হই তারপরের দিনেই আমার বিয়ে হয়ে যায়।বিয়ের পর প্রথম তিনমাস খুব ভালো ছিলাম।যাকে বিয়ে করেছিলাম সে বললো আর লেখা পড়া করার দরকার নেই।তুমি যখন আমার সংসার করবা তখন আর পড়ালেখা করে কি হবে?আমি তো ভালো চাকরি করি।সবসময় আমার আশেপাশে থাকবা।তার এই কথার উপর ভিত্তি করে আর লেখাপড়া করি নি।
বাঙালি নারীদের স্বামীই ধর্ম,স্বামীই কর্ম।তিন মাস পর টের পেলাম তার ক্যান্সার।শুধু আমি না সে,তার পরিবার,আমার পরিবার সবাই টের পেলো।বিয়ের আগেই তার ক্যান্সার ছিল।তবে কেউ তা টের পায় নি।তারপর শুরু হলো যুদ্ধ।আশায় ছিলাম সে ভালো হবে।আমার আত্মীয়-স্বজন সবাই বললো ছেড়ে চলে আসো।ওখানে আর থাকা উচিত নয়।কিন্তু এতোদিন যাকে ভালোবেসেছি তাকে ছাড়তে পারবো না।বাবা-মা ও বললো থাকো ওখানেই।থাকলাম। আমার শ্বশুর বাইরে থাকে,শ্বাশুড়ি হেল্থ এর জব করে।সব মিলিয়ে ওর দেখাশোনা সব আমার কাঁধে।আমাকে হারানোর খুব ভয় পেতো সে।একটু চোখের আড়াল হলেই কাছে ডেকে বলতো, ‘তুমি কার সাথে ফোনে কথা বললা?’
-‘আমি আবার কার সাথে কখন কথা বললাম?’
-‘তুমি আমাকে ছেড়ে যাবা তাই না?’
আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছি কখনো তাকে ছেরে চলে যাবো না। সে আমার হাতের রান্না ছাড়া কারো হাতের রান্না খেতে পারতো না।শুক্রবার শ্বাশুড়ি মায়ের ছুটির দিন থাকলে যদি তিনি রান্না করতেন তাহলে তা খেতো না।বলতো- ‘আমার মিষ্টির রান্না চাই।মিষ্টির রান্না খাবো।’ শ্বাশুড়িমা যদি কখনো বলতেন এটাই মিষ্টির রান্না,সে রেগে গিয়ে বলতো ‘আমি মিষ্টির রান্না চিনি।ওর রান্নার স্বাদ, গন্ধ সব চিনি।’
তখন আবার আমাকে রান্না করতে হতো। তার জন্য একটু গোসল ও করতে পারতাম না।মেয়ে মানুষের গোসলে একটু বেশিই সময় লাগে।কিন্তু সে পাঁচ মিনিট হতে না হতেই ঘর থেকে চিল্লাচিল্লি শুরু করতো।তাই তাকে গোসল করিয়ে বাথরুমের এক সাইডে চেয়ার দিয়ে বসিয়ে রাখতাম।তারপর আমি তার সামনে গোসল করতাম।গোসল শেষে দু’জনে এক সাথে ওযু করে নামাজ পরতাম।তাকে ভাত খাওয়ায় দিতাম। আমিও খেতাম। সে সারাদিন প্রায় ঘুমোতো।কিন্তু রাত হলেই জেগে থাকতো।সারাদিনের এতো ধকল সামলিয়ে রাত হলেই আমার চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম এসে থামতো।কিন্তু সে আমায় ঘুম থেকে তুলে বলতো,
-‘মিষ্টি?আমার না ঘুম আসছে না।আসো গল্প করি।’ রাত জেগে জেগে আমি ঘুম চোখে টোনাটুনির গল্প করতাম।অবশ্য আমি কখনো গভীর ঘুমে থাকলেও সে ডাকতো না বাথরুম পেলেও একা একা যাওয়ার চেষ্টা করতো কিন্তু পারতো না। পরে যেতো।এক রাতে আমাকে কাছে টেনে বললো,
-‘মিষ্টি আমি না থাকলে তুমি বিয়ে করবে না কথা দাও।’
আমি তখন মজা করে বললাম,’বিয়ে করবো না কেন?আমি এখনই বিয়ে করবো।তুমি থাকতেই বিয়ে করবো।’ ও রেগে গিয়ে বললো,’তোমার সবেতেই ফাজলামি তাই না?কথা দাও আমায়।’ তখন তার হাতে চুমু কেটে বলেছিলাম- ‘ তাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না।তার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়।’ সে যেদিন আমাদের ছেরে চলে গেলো সেদিন সবাই ভেবেছিল আমিও মারা গেছি।নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না এখন।পড়তে গেলে,খেতে গেলে,ঘুমোতে গেলে সব সময় তার স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়। ভাবলাম বসে থেকে লাভ কি এইচএসসি পরীক্ষাটা দেই।”
এতো টুকু বলে থামলো মিষ্টি নামের মেয়েটা।আমি আমার একটা আন্টির সাথে তার মাদ্রাসায় এসেছি।সে ও পরীক্ষার্থী।বিদায়ের টাকা দেবে।মিষ্টি নামের মেয়েটা একদিন ও ক্লাস করে নি।পড়াশোনাও করতে পারে নি এতো চাপে।আজ প্রথমবার তার সহপাঠীদের দেখছে। তার গল্প শুনে সবাই চুপ হয়ে আছে।আমি ভেবেছিলাম মেয়েটা কাঁদবে।কিন্তু অদ্ভুদ।সে কাঁদছে না।তার চোখ হলুদ হয়ে আছে। তারপর আমি আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“ভাইয়ার মৃত্যুর কয় মাস হলো?”
-“এই তেইশ তারিখ এলে পাঁচ মাস হবে।জানো তো?ওর খুব শখ ছিল একটা সরকারি চাকরি করবে।ওর মৃত্যুর পরের দিনেই ওর চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আসে।একটা সরকারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে।কিন্তু ভাগ্যে নেই।”
-“কি আর করবা আপু।সব তো সবার ভাগ্যে জোটে না।।”
-“হ্যাঁ,জানো?খুব কপাল করে একটা শ্বশুরবাড়ি পেয়েছিলাম।কখনো মনে হয় নি আমি তাদের ঘরের বউ।সবসময় মনে হয়েছে আমি তাদের মেয়ে।কিন্তু কপালো জুটলো না।”
-“এখন কি করবে ভাবছো?”
-“পড়ালেখা টা শেষ করে একটা ভালো চাকরি।তবে আত্মীয়রা বিয়ের কথা বলছে।বাবা-মাও বিয়ের চাপ দিচ্ছে।এই এক সপ্তাহ আগে বাবা একটা ছেলে এনেছিল আমাকে দেখাতে।বাবাকে যা যা বলেছি কখনো ভাবি নি আমি মিষ্টি এসব বলতে পারবো।বাবাকে বলেছি হয়তো আমায় বিয়ে দিয়ে তারা খুশি থাকতে পারবে।কিন্তু আমি না।বাবা-মা থেকে সবার সামনে খুব হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করি।”
-“মা তো।যতই অভিনয় করো বুঝে যাবে ”
-“মানুষ সর্বদা সুযোগের স্বদ ব্যবহার করে।এখন ফুফাতো ভাইরা আমাকে বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছে।”
-“সময় নাও।তুমি বিয়ে করলে কাহিনী দুরকম হতে পারে।এক.হয়তো তুমি ভাইয়াকে ভুলে একটা সুন্দর জীবন পাবা।দুই.ভাইয়ার স্মৃতি সবসময় তাড়া করলে আর যাকে বিয়ে করেছো তাকে ভালো না বাসতে পারলে সুখ পাবা না। ”
-“আমাকে এখন আমার ভাইয়েরা পরামর্শ দিচ্ছে যে আমাকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করতে।আমি যাকে ভালোবাসি তাকে নয়।”
-“যদি এমন কাউকে তুমি বিয়ে করো যাকে তুমি ভালোবাসো তাহলে তার হাল্কা কেয়ার গুলোও বিরাট মনে হবে।আর যদি এমন কাউকে বিয়ে করো যাকে তুমি ভালোবাসো না তাহলে তার প্রচুর কেয়ার গুলোকেও ন্যাকামো লাগবে।”
মিষ্টি আপু আর কিছু বললো না। খানিক পর বললো,
-“ওকে যে কথা দিয়েছি।কিভাবে বিয়ে করবো?সেদিন খুব অসুস্থ হয়ে গেছি।প্রেসার একদম লো।ডক্টর আঙ্কেল আমায় বললো আমি বাঁচতে চাই কি না।আমি বলেছি পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে চায়।আমিও চায়।আঙ্কেল টা বললো যদি বাঁচো তাহলে একটা সুন্দর জীবন নিয়ে বাঁচো।এভাবে নয়।”
-“আপু আমরা ভাবি মা না থাকলে বাবা মারা গেলে আমরা কিভাবে বাঁচবো।কিন্তু কি জানো?আমরা বাঁচি।সময় আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।সময় নাও।পড়াশোনাটা করো।ভাইয়ার মৃত্যুর বছর ঘুরুক।তারপর বিয়ে করো।আমরা বাঙালি।যখন বিয়ে করবে না তোমার চরিত্রে দাগ লাগাতেও কারো সময় লাগবে না।”
-“তা ঠিক।”
রুজি আন্টি আর তার বান্ধবীরা বাইরে গিয়েছিল।তারপর রুমে এসে রুজি আন্টি মিষ্টি আপুর নাম্বার নিলো।আমারো খুব ইচ্ছে হলো মিষ্টি আপুর নাম্বার নিতে।থাক না।কিছু কিছু মানুষের স্মৃতি এমনিই মনে থাকে। মিষ্টি আপুর মুখ ঢাকা ছিল এতোক্ষণ। খুব ইচ্ছে করছিল তার মুখটা দেখতে।কিন্তু এতো শত কথা বলেও তাকে এই কথাটা বলতে পারি নি। আচ্ছা?মিষ্টি আপু কি আমায় ভুলে যাবে?একদিনের পরিচয়ে কাউকে কেউ মনে রাখে না।আমি যদি কখনো বড় হই,সেদিন মিষ্টি আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে একটা গল্প লেখবো।গল্পের নাম হবে “সুখী দম্পতি”। মিষ্টি আপুর হাতটা ধরে বললাম,”যাই আপু।”
-“তোমার নাম তো জানা হলো না।”
-“কেমি।”
-“তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “ভালো থেকো।চোখের মেডিসিন গুলো ঠিক মতো নিও।নিজের খেয়াল রেখো।”
আচ্ছা গ্রামের ঝোপঝার গুলোর আড়ালে কতশত গল্প লুকিয়ে।ক’জন তা জানে? মিষ্টি আপু সুখে থাকুক।