কাগজের নৌকো

কাগজের নৌকো

সিঁথি কোমরে হাত দিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় সে ছেলে? কতো বড় সাহস তাকে প্রেমপত্র দিয়েছে! ঈশান আপনমনে হেঁটে আসছিলো। সিঁথির রুদ্রমূর্তি দেখে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কাছে এসে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?”

“কী হয়েছে মানে? তুমি আমাকে প্রেমপত্র দিয়েছ কেন? ছিঃ কী সব কথা! দেখাই বাবাকে? দেখাই শায়লা ফুপুকে?”

“তুই এমন করিস না। বোঝার চেষ্টা কর…”

“কী বুঝব?” সিঁথির চোখমুখ লাল।

ঈশানের মনে হলো সিঁথি এখনো যথেষ্ট বড় হয়নি। বাচ্চাই আছে। বোঝার হলে প্রথমেই বুঝতো। সে বলল, “কাউকে বলিস না। ভুলে যা ওটার কথা।”

“তুমি আর আমার সামনে আসবে না বলে দিলাম।” ঈশান মাথা নিচু করে বলে, “আচ্ছা।”

“রাস্তায় দেখা হলে তাকাবেও না।”

“আচ্ছা!”

তারপর থেকে ঈশান সাহসা সিঁথির সামনে পড়ে না। দূর থেকে দেখলেও সরে যায়। কয়েকদিন পর সিঁথির মনে হলো সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে না। এভাবে ঈশান ভাই এর সাথে রাগ করে থাকলে সে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। ঈশানের সাথে রাগ করে তাদের বাড়িতেও যাওয়া হচ্ছে না। শায়লা ফুপু, রাত্রী আপা কারো সাথে কথাও হচ্ছে না। তারচেয়ে ঈশান ভাইকে মাফ করে দিলেই হয়। একটা ভুল করে ফেলেছে বেচারা।

এক বিকেলে সিঁথি ঈশানদের বাড়িতে গেল। সিঁথিদের বাড়ির পরের গলিতে ঈশানদের বাড়ি। অনেকখানি জায়গা নিয়ে বাড়িটা করা। একতলা ইটের দালান। পেছনে কয়েক রকমের গাছ। সামনের দিকে ফুলের গাছ। শিউলি, হাস্নাহেনা, টগর, সন্ধ্যামালতির বাহার চারদিকে। সিঁথি গেট খুলে ঢুকে দেখল কেউ নেই। হাস্নাহেনা ফুটে আছে গাছভর্তি। সে গাছের নিচে গিয়ে ফুল কুড়াতে বসে গেল।

ঈশানের কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হয়েছে। সে মাত্রই খেয়েদেয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছে, তখন সিঁথিকে দেখল। পাগলাটে মেয়েটা পিঠময় খোলা চুল ছড়িয়ে বসে বসে ফুল কুড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের বাড়িতে এসেছে মানে রাগ কমেছে মহারানীর। ঈশান পায়ে পায়ে হেঁটে গাছের কাছে যায়। সিঁথি খেয়াল করেনি তাকে। গাছের মোটা ডাল ধরে জোরে ঝাঁকুনি দেয় ঈশান। একগাদা ফুল ঝরে পড়ে সিঁথির মাথায়। সিঁথি উঠে দাঁড়িয়ে দুইহাত প্রসারিত করে ঝরে পড়া ফুলের স্পর্শ নেয়। নাক টেনে বুকভরে সুবাস নেয়। ঈশান জিজ্ঞেস করে, “আমাদের বাড়িতে আসলি যে?”

“কেন আমার আসা মানা নাকি?”

“তা না।”

“তুমি আমাকে চকলেট দাও না কেন এখন আর?”

“তুই তো নিষেধ করেছিস।”

“আচ্ছা নিষেধ তুলে নিলাম। কাল থেকে দেবে। আমি স্কুল থেকে আসার সময় যেন পেয়ে যাই চকলেট। কিন্তু হ্যাঁ, ভুলেও আর প্রেমপত্র দেয়ার চেষ্টা করবে না। এবার কিন্তু সেটা সোজা শায়লা ফুপুর হাতে যাবে। মনে থাকবে?”

“থাকবে।”

ঈশানদের বাড়িতে রঙিন টিভি এসেছে। সিঁথিদের বাড়িতে এখনো সাদা কালো টিভি। সিঁথির আনাগোনা তাই এবাড়িতে বেড়ে গেছে ইদানিং। টিভি দেখা শেষ হলে সে প্রায়ই ঈশানের ঘরে ঢোকে। গল্প করে, তার অগেছালো টেবিল গোছায়, ভালো খাতা কলম, সুন্দর ডায়েরি পেলে আত্মসাৎ করতেও ভোলে না। একদিন মুখ গোমড়া করে সে ঈশানের ঘরে ঢোকে। “কী হয়েছে?” জিজ্ঞেস করতেই কাঁদো কাঁদো স্বরে বিরাট কাহিনী বলে। কাহিনীর সারমর্ম, তার বান্ধবীরা মিলে নৌকায় ঘুরতে যাবে, তাকে তার বাবা দেয়নি যেতে।ঈশান সিঁথিকে নিয়ে তাদের বাড়িতে যায়। ঈশান অনেকটা ঘরের ছেলের মতোই। সিঁথির বাবা তার সাথে যেতে দিতে রাজি হয়।

নৌকা যখন নদীর মাঝ বরাবর পৌঁছায়, তখন বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকোটা দোল খায়। সিঁথি জড়িয়ে ধরে ঈশানের হাত। নৌকো দুলতেই থাকে। ঈশানের গায়ের সাথে আরও লেপ্টে যেতে থাকে সিঁথি। বাড়ি ফেরার পথে রিশকায় বসে সিঁথি বলে, “ঈশান ভাই, বন্ধবীদের সাথে এলে আমি ভয়ে মরেই যেতাম। তুমি ছিলে বলে মনে হচ্ছিলো কিছু হবে না। পরেরবার এলেও তোমার সাথেই আসব। কেমন?” “আচ্ছা!” সব ভালোই চলছিলো, হঠাৎ একদিন সিঁথিদের বাড়িতে একগাদা লোক আসে। তাকে দেখেশুনে অনামিকা আঙুলে চমৎকার একটা স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়ে যায়। কথাও প্রায় পাকাপাকি হয়ে যায়, পরের মাসে বিয়ে।

খবর শুনে ঈশানের মাথায় দুটো আকাশ ভেঙে পড়ে। সে অনেকক্ষণ ঠাঁয় বজ্রাহতের মতো বসে থেকে অতিকষ্টে মুখে কথা জুগিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করে, “এখনই কেন? সিঁথি মাত্র ক্লাস টেনে পড়ে মা!” শায়লা ছেলেকে বোঝায়, “অনেক ভালো ফ্যালিমির ছেলে। পড়াশুনা শেষ করে বাবার ব্যাবসা দেখাশুনা করছে। দেখতে বেশ! এমন ছেলেকে মানা করে দেবে নাকি? পরে এত ভালো সম্বন্ধ না পেলে?” কয়েকদিন সিঁথি আসে না বলে ঈশান তাদের বাড়িতে যায়। জিজ্ঞেস করে, “যাস না কেন এখন?” সিঁথি লাজুক গলায় বলে, “মা বলেছে ক’দিন পর বিয়ে। এখন এত ঘোরাঘুরি না করতে।”

সিঁথির সাথে আরো দুটো কথা বলে কাজের অযুহাতে উঠে পড়ে ঈশান। মেয়েটা কখনো তাকে ভালোই বাসেনি। তাই অমন আগ্রহ নিয়ে বিয়ে করে নিচ্ছে। সে সেদিন নৌকা ভ্রমনের পর একপ্রকার ধরেই নিয়েছিল সিঁথিও তাকে ভালোবাসে। মনে মনে নিজেই নিজেকে বোঝায়, ভালোবাসা কি এত সোজা নাকি যে যার তার সাথেই হয়ে যাবে! ঝুম বৃষ্টি নামে সেদিন। ঈশান ভাবে ভালোই হলো। ভিজে ভিজে বহুদূর হেঁটে যায় সে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তার মনের ভার কমিয়ে দিয়ে যায় অনেকটা।

রাতে জ্বর আসে ঈশানের। দু’দিন পর তাকে দেখতে আসে সিঁথি। শাড়ি পরেছে আজ। দু’চোখে কাজল টানা। চুল বেনী করে লাল ফিতে লাগিয়েছে। ঈশান চোখ ভরে দেখে তাকে। ঈশানের পাশে বসে অনেকক্ষণ গল্প করে সিঁথি। বিয়ে হওয়াটা যেন খুব আনন্দের ঘটনা। সিঁথির বিয়ের সময়টা তাদের বাড়িতে থাকতে হয় ঈশানের। সিঁথির ভাই নেই। একা সব কুলিয়ে উঠতে পারে না তার বাবা। গায়ে হলুদের কাজকর্ম সেরে ঈশান বাড়ি ফেরে অনেক রাত করে। প্রচন্ড মাথাব্যথায় মাথা ছিঁড়ে আসে তার। ঘুমের ঔষধ খেয়েও ঘুম আসতে চায় না। ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন মাথায় উঁকি দিয়ে যায়। একবার মনে হয় সিঁথি এসেছে। তাকে ডাকছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই।

বিয়েবাড়ির লোকজন আস্তে আস্তে মাঝরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে। আলোগুলো নিভতে থাকে একে একে। সিঁথি সুযোগ বুঝে চুপিসারে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। অন্ধকার মাঝরাতে অন্য কোনোদিন হলে সে অজ্ঞান হয়ে যেতো বোধহয়। আজ ভয় হয় না। শীতল বাতাসের ঝাপটা এড়িয়ে খালি পায়ে দৌড়ে যায় শূন্য রাস্তা দিয়ে। ঈশানদের বাড়িতে পৌঁছায় সে। দরজা ভেতর থেকে তালা দেয়া। সে পেছনের দেয়াল টপকে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। আগেও এই দেয়াল কতো টপকেছে খেলার ছলে! তবে শাড়ি পরে আজ কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে ওপাশে নামে সে। চোখা ইটে পায়ের চামড়া ছিলে যায়। হাতে ব্যথা পায়। তবে গায়ে লাগছে না যেন কিছু। মনের ব্যথার কাছে এসব কিছুই না। জানালায় অনেকক্ষণ টোকা দেয়ার পর উঠে দরজা খুলল ঈশান। ভীষণ অবাক হয়েছে সে। বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু। সিঁথি একদৌড়ে ঈশানের ঘরে ঢুকলো। ঈশান ঢুকল পিছু পিছু। সিঁথি কাঁদছে। তার শরীর থেকে ফুলের ঘ্রাণ আসছে। সিঁথি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “ঈশান ভাই আমি বিয়ে করব না।”

“কেন করবি না?”

“আমি থাকতে পারব না বিয়ে করে। ওই লোকের সাথে আমি কেমন করে থাকব সবাইকে ছেড়ে?”

“পাগলি, সবাইকেই তো বিয়ে করতে হয়। বিয়ের পর ঠিকই থাকতে পারবি।”

“কিন্তু আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে যে…”

“এখন হচ্ছে, পরে ঠিক হয়ে যাবে।”

“ঈশান ভাই, একটা কথা বলি?”

“বল।” মনে আছে তুমি আমাকে একটা প্রেমপত্র দিয়েছিলে?” ঈশান লজ্জা পেয়ে বলল, “সেটা এখন মনে পড়ল কেন?”

“তুমি লিখেছিলে আমাকে বিয়ে করতে চাও! এখন করবে?”

“তুই পাগল হয়েছিস?”

“না। তোমাকে বিয়ে করলে আমি এখানেই থাকতে পারব সবার সাথে।”

“ওহ এজন্য!”

“না শুধু এজন্য না।”

“তাহলে?”

সিঁথি উঠে এসে ঈশানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না ঈশান ভাই, একটুও থাকতে পারব না।” ঈশান অতিকষ্টে মুচকি হাসলো। বলল, “পারবি। তোর হবু বরটা অনেক ভালো রে। আমি কথা বলেছি তো। সে তোকে খুব ভালোবাসবে। অনেক ভালো রাখবে। দেখিস।”

“তোমার চেয়েও ভালো? আমাকে তোমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে?”

“হ্যাঁ বাসবে। এখন যা, এত রাতে এলি কোন সাহসে তুই? কেউ দেখেনি?”

“নাহ। আমি কি চলে যাব?”

“নয়তো কী?”

“তোমার সাথে আবার দেখা হবে কবে?”

“এখানে এলেই দেখা হবে।”

সিঁথি চলে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎ দৌড়ে এসে জাপটে ধরল ঈশানকে। ঈশানের শরীর কাঁপতে শুরু করল। সিঁথি ঈশানের বুকে মুখ গুঁজে বলল, “আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন ঈশান ভাই?” ঈশান কাঁপা গলায় বলল, “বিয়ের আগে সব মেয়েরই কষ্ট হয়।” সিঁথি অনেক বলতে চেয়েও বলতে পারলো না, আমার শুধু তোমার জন্য কষ্ট হচ্ছে, অন্যরকম কষ্ট। যেটা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। ঈশানের অস্থির অস্থির লাগছে। সে কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। সিঁথি যখন তাকে ছেড়ে দিল, সে অকস্মাৎ সিঁথির কপালে গাঢ় করে চুমু খেলো।

সিঁথির পুরো শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। সে আর একটি কথাও বলল না। চুপচাপ হেঁটে গেল। ঈশান বাইরের গেট খুলে দিল। সিঁথি সোজা চলে গেল বাড়িতে। একটা বারও পেছন ফিরে তাকালো না। ছয় বছর পর ঈশান কানাডা থেকে ফিরেছে সবে আজ। এসেই লম্বা ঘুম দিয়ে উঠেছে বিকেলবেলা। তখন বাড়ি লোকে লোকারণ্য। বসার ঘরে গিয়ে চমকে গেল সিঁথিকে দেখে। সে আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে। গায়ের রঙ কাচা হলুদ বর্ণ, ক্যাটক্যাটে শুকনো থেকে একটু মোটা হয়েছে। স্বর্ণের ছোট গহনাগুলো ঝিলমিল করছে ওর গায়ে। ঈশান হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছিস?”

“এইতো…তুমি?”

“ভালো।”

“তোমার একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গিয়েছিল।”

“কী?

“তোমার ঘরে চলো” ঈশানের ঘরে ঢুকে হাতের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করল সিঁথি। ডায়েরিটা দেখে চমকে গেল ঈশান। এই ডায়েরিতে সে সিঁথির ছোট ছোট ঘটনাগুলো, তার অনুভূতিগুলো লিখে রাখতো। এটা তো হারিয়ে গিয়েছিল!

সিঁথি বলল, “হারায়নি এটা। আমি দুষ্টুমি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পড়া হয়নি তখন। পড়েছি অনেক পরে। যখন আর কিছু করার ছিল না।” সিঁথি মাথা নিচু করে ফেলল। ঈশান স্পষ্ট দেখতে পেল তার চোখে পানি। ঈশান শুকনো গলায় বলল, “এত আগের কথা কি মনে রাখতে আছে পাগলি! ভুলে যা সেসব। এখন তোর সংসার আছে, একটা মেয়ে আছে।” “তুমি যখন আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলে আমি তখন জানতামই না ভালোবাসা কী। যখন জেনেছি তখন থেকেই বুঝেছি আমি কী হারিয়েছি। আচ্ছা, তোমার কষ্ট হয় না ঈশান ভাই?”

ঈশান অন্যদিকে ঘুরে বলল, “নাহ।” সিঁথি কান্নামেশানো মুখে হেসে বলল, “তুমি মিথ্যেবাদী। সবসময় মিথ্যেই বললে। তুমি বলেছিলে ও আমাকে তোমার চেয়ে বেশি ভালোবাসবে। কিন্তু বাসেনি। তোমার মতো ভালোবাসতে কেউ পারেনি, পারবেও না।” সিঁথি কথাটা বলেই দৌড়ে চলে গেল ঘর থেকে। পেছনে ফিরে তাকালো না আর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত