কাকতাড়ুয়া

কাকতাড়ুয়া

— হাসান সাহেব ভাল আছেন তো আপনি? শুনলাম আপনার বোনটা নাকি হোস্টেলে থাকে? খেয়াল রাখেন তো ঠিকঠাক?

হাসানের গায়ে হঠাৎ কাঁটা দিয়ে উঠলো। এমন শীতল কন্ঠ সে আগে কখনো শোনেনি। কে এই লোক? আর হাসানের বোনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে কেন? হাসান মোবাইল কান থেকে সরিয়ে চোখের সামনে আনলো। নাহ এই নাম্বার চেনে না সে।

— হ্যালো কে বলছেন?

হাসানের কথার উত্তরে হাড় হিম করা হাসি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাওয়া গেল না। হাসানের গলা শুকিয়ে গেল হাসি শুনে। এ যেন মানুষের হাসি না। এ যেন হায়েনার হাসি। এতটাই জঘন্য এই হাসির সুর। কয়েক মূহুর্ত পর হাসির শব্দ থেমে গেল ফোনের ওপাশ থেকে। তারপরে আবারো সেই শীতল কন্ঠ।

— আমি? আমাকে চিনবেন না। আমার কোন নাম নেই। তবে আপনি আমাকে কাকতাড়ুয়া বলে ডাকতে পারেন। নামটা পছন্দ হয়েছে আপনার?

হাসান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কেউ কি তার সাথে মজা করছে? কিন্তু এভাবে ফোন করে কে তার সাথে এমন মজা করবে তা হাসান বুঝতে পারলো না। তাই এবার কড়া কন্ঠে বললো,

— কে আপনি? মজা করার আর জায়গা পাননি? সোজা ভাবে বলুন কে আপনি?

হাসানের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবারো সেই হায়েনার মত কুৎসিত হাসি ভেসে এলো ফোনের অপর পাশ থেকে। এবং আগের মতই কয়েকমূহুর্ত পর হাসি থেমে গেল।

— হাসান সাহেব মজা তো আমি করছি না। তবে আপনার ই-মেইলে একটা ভিডিও দিয়েছি। ভিডিওটা দেখে মজা পাবেন। রাখছি এখন, তবে পরে আবার যোগাযোগ করবো। নামটা মনে আছে তো আমার? কাকতাড়ুয়া, হা হা হা হা।

হাসানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল কাকতাড়ুয়া নামের লোকটা। হাসানের ভ্রু কুঁচকে গেল। তার ই-মেইলে কিসের ভিডিও দিয়েছে বললো? দেরী না করে হাসান ল্যাপটপ ওপেন করলো। ই-মেইলে সত্যিই একটা ভিডিও এসেছে। যে পাঠিয়েছে তার ই-মেইল এড্রেসে কাকতাড়ুয়ার ইংরেজি নাম দেয়া।

— এই তুমি যে ওইদিন ভিডিও করেছিলে ওই ভিডিও এখনো আছে? থাকলে দাও একটু দেখি।
— নাহ ওই ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছি। তোমাকে তো বললামই ডিলিট করে দিব।
— সত্যিই ডিলিট করেছো তো? নাকি আবার ওই ভিডিও দেখিয়ে পরে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবা?

তানিয়ার কথায় আবির কিছু বললো না। শুধু মুচকি হাসলো। তারপর তানিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

— আমাকে বিশ্বাস করো তো তুমি?
— হ্যা অনেক বিশ্বাস করি।
— তাহলে এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকো। আমি যাচ্ছি এখন।
— সাবধানে বের হবা। দারোয়ান দেখলে কিন্তু ধরা পড়ে যাবো আমি। তখন আর আসতে পারবা না হোস্টেলে।

তানিয়ার কথা শেষ হতেই তানিয়ার কপালে একটা চুমু বসিয়ে দেয় আবির। তারপর মুখে কাপড় বেঁধে জানালা ঘেষে বেড়ে উঠা জলপাই গাছ বেয়ে অবলিলায় নিচে নেমে যায়। নিচে নেমে আবির তানিয়ার ঘরের জানালার দিকে তাকায়। তানিয়া তখন জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে সে। তারপর অন্ধকারে হারিয়ে যায়। তানিয়া অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। তারপর আবার বিছানায় ফিরে যায়। তার রুমমেট তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আবিরের কথামত নিজের ফোন বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যায়।

হাসান ক্রমাগত কাকতাড়ুয়ার নাম্বারে ফোন দিতে থাকে। ওপাশে ফোন বাজছে, কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। ঘরে এসি চলছে, কিন্তু হাসান ইতিমধ্যেই ঘেমে অস্থির হয়ে গেছে। কাকতাড়ুয়ার দেয়া ভিডিওটা দেখে হাসানের মাথার ভেতর সবকিছু উলটপালট হয়ে গেছে। চোখ থেকে অঝর ধারায় বর্ষন হচ্ছে। মাত্র দেড় মিনিটের এই ভিডিওতে কি এমন আছে যা দেখে হাসানের এই অবস্থা? অবশেষে কাকতাড়ুয়া ফোন রিসিভ করলো। হাসান সাথে সাথে চিৎকার করে বললো,

— কাকতাড়ুয়া প্লীজ আমার বোনের এই ক্ষতিটা করোনা। আমি তোমার পায়ে পড়ছি। প্লীজ তুমি কি চাও বলো।

হাসানের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবারো সেই হায়েনার হাসির শব্দ শোনা গেল। এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর শোনাচ্ছে সে হাসি।

— হাসান সাহেব এতটুকু দেখেই এই অবস্থা? আমার কাছে পুরো ত্রিশ মিনিটের ভিডিও আছে। একেবারে ক্লিয়ার, ডিএসএলআর দিয়ে ভিডিও করেছি। দেখবেন নাকি পুরোটা? পাঠিয়ে দেই ই-মেইলে? হাসানের কান ফেটে যাওয়ার অবস্থা হচ্ছিল। এসব শোনার আগে মৃত্যু হলে কি ভাল হতো না হাসানের?

— না না আমি দেখতে চাই না। প্লীজ এমনটা করো না। তুমি যা চাও তাই পাবে।

এবার ওপাশ থেকে হাসির শব্দ আসলো না। একেবারে শুনশান নিরবতা অপর পাশে। বেশ কিছুক্ষন এই নিরবতা চললো। তারপর হঠাৎ সেই কুৎসিত হাসি।

— হা হা হা, দেখবেন না? এত কষ্ট করে বানালাম জিনিসটা। না দেখলে কেমন হয়? তাছাড়া আপনি নিজেই তো একসময় এসব বানাতেন। এখন কি বানান না আর?

কাকতাড়ুয়ার কথা শুনে হাসান চমকে গেল। এতটাই চমকে গেল যে গলা দিয়ে কথাই বের হচ্ছিল না তার। অনেক কষ্টে সে বললো,

— মানে? কি বলতে চাও তুমি? হাসান উত্তরের অপেক্ষায় থাকে। প্রতিনিয়ত হাসানের মনে ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। তার আদরের বোনটার কিছু হলে সে মারা যাবে।

— আহা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? চামেলি, নিশি, তানহা, অধরা আর তামান্নার কথা মনে পড়ে? ওদের কয়েকটা ভিডিও আপনার কাছে আছে বোধহয়। ভিডিওগুলো লাগবে আমার। হাসান এবার চমকালো না। কাকতাড়ুয়া তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েই খেলতে নেমেছে। হাসান আজ আটকে গেছে চরম এক ফাঁদে। যেখানে বলির পাঁঠা তার আপন বোন

— কি… কি বলছো এসব? আমার কাছে কোন ভিডিও নেই। আমি অমন ছেলে না। এবার ওপাশ থেকে একটা গর্জন শুনতে পেল হাসান। এটা হয়তো কাকতাড়ুয়ার হাসির শব্দ। তবে হাসানের কাছে এটা গর্জনের মত মনে হলো।

— তাই নাকি হাসান সাহেব? আচ্ছা আপনাকে পুরো ভিডিওটা দিয়ে দিচ্ছি। তারপর পাঠাবো আপনার বাবাকে। তারপর চিন্তা করছি আমার কিছু বন্ধুদের শেয়ার করবো। কি বলেন? হাসান আঁতকে উঠলো। তার আদরের বোনটার কিছু হতে দিবে না সে। জীবন দিয়ে হলেও সে তার বোনটাকে রক্ষা করবে।

— না না কাকতাড়ুয়া, আমি ভিডিও দিব। সবগুলো ভিডিও দিব। কিভাবে পাঠাতে হবে বলো?
— হাহাহাহা। এইতো লাইনে এসেছেন। একটা ঠিকানা দিচ্ছি। কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিন আপনার ল্যাপটপটা। আমার এক বন্ধু হালকা হ্যাকিং জানে। তাই যদি ভিডিওগুলো কোথায় কপি করে রাখেন তাহলে ধরা খেয়ে যাবেন। আর জানেনই তো ধরা খেলে কি হতে পারে। রাখছি তাহলে কেমন। আমার নামটা মনে আছে তো?

— হ্যা মনে আছে।
— কি নাম আমার?
— কাকতাড়ুয়া।

— এই সেদিনের ভিডিওটা তো ডিলিট করোনাই। এখনো আছে দেখলাম তোমার মোবাইলে।

তানিয়ার কথা শুনে আবির কিছুটা চমকে তাকালো আবির। তারপর মুচকি হেসে বললো,

— এই দেড় মিনিটের ভিডিও থাকলেই কি আর না থাকলেই কি? আবিরের কথার উত্তরে আবিরের গলা জড়িয়ে ধরে তানিয়া বললে,

— এই ভিডিও অন্য কেউ দেখলে কি ভাববে জানো? ভাববে আমার বিয়ের আগেই সব করে ফেলেছি। কিন্তু শুধু আমরাই জানি যে আমরা এখনো কিছুই করিনি।
— কিছু করিনি বলে কি তোমার আফসোস হচ্ছে? তাহলে চলো আজকেই বিয়ে করি। তাহলে আর কোন বাঁধা থাকবে না।

— হুহ বাবা মাকে না জানিয়ে বিয়ে কিভাবে করবো?
— হুম তাও তো একটা কথা। তাহলে আগে তোমার বাসায় জানাও। তার আগ পর্যন্ত এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাদের হোস্টেলে এসে তোমার কপালে চুমু দিতে হবে। একথা বলে আবির হাসে। তানিয়া আবিরের মুখ চেপে ধরে বলে,

— এই আস্তে, রুমমেট জেগে গেলে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে।
— জেগে যাক। জেনে যাক সবাই তোমাকে কতটা ভালবাসি আমি।
— ইহ আসছে আমার ভালবাসা দেখাতে। তোমাকে বললাম তোমার ফ্যামিলির একটা ছবি দেখাতে। তা তো দেখাও না।
— দেখবা আমার ফ্যামিলির ছবি? আচ্ছা দেখাচ্ছি।

একথা বলে আবির তানিয়াকে একটা ছবি দেখায়। ছবিতে আবিরের পেছনে একজন মাঝবয়সী পুরুষ এবং মাঝবয়সী মহিলার পাশে একটা মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে।

— এই মেয়েটা কি তোমার বোন?
— হ্যা। ( দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
— নাম কি ওর?
— অধরা ইবনাত অরিত্রী।
— কিসে পড়ে ও?
— গতবছর রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে ও।
— ওহ আমি দুঃখিত আবির।

একথা বলে তানিয়া আবিরকে জড়িয়ে ধরে। আবির তাকিয়ে থাকে কড়িকাঠের দিকে। ফ্যান চলছে তার আপন গতিতে। একটা শব্দ তৈরী হচ্ছে এর ফলে। ক্যাচ ক্যাচ ক্যাচ ক্যাচ।

— হাসান সাহেব আপনার ল্যাপটপটা তো পেলাম। এবার আরেকটা কাজ করা বাকি আছে। আমাকে ওই কাজটা করে দিলেই আপনার বোনের ভিডিওটা ডিলিট করে দেয়া হবে। হাসান গত তিনদিনে কমপক্ষে দুই হাজার বার তার বোনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার বোনের ফোন বন্ধ ছিল। হোস্টেলের ম্যানেজারের নাম্বারটাও বন্ধ। তিনদিন চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। আজকে আবার কাকতাড়ুয়া তাকে ফোন দিয়ে কথাগুলো বললো।

— কি করতে হবে বলো। সব করবো আমি। শুধু বলো ভিডিওটা ডিলিট করে দিবে তুমি।
— অবশ্যই দিব। আমাকে বিশ্বাস করুন। বিশ্বাস করা ছাড়া আপনার এখন কিছুই করার নেই।
— আচ্ছা কি করতে হবে বলো।
— আপনাদের ঘরে তো ফ্যান এবং এসি দুটোই আছে।

এসি বন্ধ করে দিবেন প্রথমে। তারপর আপনার ঘরের দরজা বন্ধ করবেন। এরপর একটা মজবুত দড়ি ফ্যানের সাথে বাঁধবেন। তারপর দড়ির অপর প্রান্ত আপনার গলায় প্যাচিয়ে ঝুলে পড়বেন। কাকতাড়ুয়ার কথা শুনে আবির চমকে উঠলো। এ কোন সাইকোর সাথে কথা বলছে সে? কিন্তু এখন কি করবে সে? এছাড়া অন্য কোন উপায় কি তার হাতে আছে? গত দশ বছরে করা সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত আজ হয়তো করতে হবে তাকে।

— কি বলছো তুমি এসব? মাথা ঠিক আছে তোমার?
— আচ্ছা আপনার বাবার ইমেইল এড্রেসটা দেখুন তো ঠিক আছে কিনা। abdulgofur231@gmail ঠিক হয়েছে তো?
— প্লীজ কাকতাড়ুয়া এমনটা করো না। তুমি যদি চাও আমি আমার জীবন দিব। তবুও….!
— আমি আপনার মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকবো। আর হয়তো যোগাযোগ হবে না। আর যদি হয় তাহলে মনে রাখবেন বর্তমানে ভাইরাল হওয়াটা কয়েক মূহুর্তের ব্যাপার।

হাসান আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই কাকতাড়ুয়া ফোন কেটে দিল। হাসানের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল ঝরছে। তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত তার বোন করুক এটা সে কখনোই চায় না। কখনোই না। আবির ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। সে ঘুম থেকে উঠে বসলো। তারপর ফোন ধরলো,

— হ্যা তানিয়া বলো।
— ( ফোঁপাতে ফোঁপাতে) আবির আমার ভাইয়া মারা গেছে। তুমি একটু আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসবা? কথাটা শুনে আবির মুখ গম্ভীর করে রাখলো কিছুক্ষন। তারপর বললো,

— কিভাবে মারা গেল সে? তুমি থাকো আমি এক্ষুনি আসছি। আমিও তোমার সাথে যাবো। একথা বলে আবির ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালো। তার ঘরের দেয়ালে একটা ছবি আছে। ছবিতে তার বোন অধরা তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। আবির কিছুক্ষন ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

— বোন তোর জন্মদিনের উপহারটা পেয়েছিস তো? এর চেয়ে ভাল উপহার আমি আর দিতে পারবো না রে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত