রুমান এবং রুমানা নাম দুটো তাদের দাদি রেখেছিলেন । বয়সে রুমান এক বসরের বড়ো। তবে একই বাড়িতে বেড়ে উঠে তারা কাজিনের চেয়ে বন্ধু সম্পর্কে বেশী ঘনিষ্ঠ। তাই সম্পর্কটা ছিলো তুইতোকারি। তবে কলেজের শুরুতে রুমানের কাজিন এবং বেস্ট ফ্রেন্ড, রুমানার সাথের তুইতোকারি সম্পর্কটা কখন কিভাবে তুমিতে পৌঁছে গেছে তা তারা বোঝার সময় পেলো না। আবার খুব বেশিদিন তাদের এই রঙিন স্বপ্ন বোনা স্থায়ীও হলো না।
কারন রুমানের অসুস্থ দাদি তার বড়ো বড়ভাই সুমনের সাথে তার কাজিন + বেস্ট ফ্রেন্ড + হতে পারে প্রেমিকা রুমানার বিয়ের ঘোষনা শুধু দিলেনই না,বরং এটা তার শেষ ইচ্ছা বলে ব্যক্ত করলেন। তাদের বাবাদের হুকুম তামিলের কোনো বিলম্ব হলো না। যেদিন বলা, তার পরদিন যমকালো এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হলো সুমনের অমতে এবং রুমানার কান্নার সাথে। কারন সুমন তাদের সব কথা জানতো। কিন্তু মনের কোনো এক কোনে রুমানার মত দারুণ, চটপটে, সুন্দরী মেয়ের স্থান কিছুটা ছিলো নিজের অজান্তেই। যা এনগেজমেন্টের পরে সে টের পেলো। তবে সেটা এতোটা বড় ছিলো না। হয়তো অন্য কোনো মেঘে ঢেকে যাবার মতন ছিলো। কিন্তু দাদি তা খুঁজে বের করলেন বলে সুমন তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।
আমাদের গল্পের নায়ক রুমান তখন স্কলারশিপ নিয়ে বাহিরে (তথা অস্ট্রেলিয়া) যাবার জন্য এতোটাই দৌড়ঝাঁপে ব্যাস্ত যে, এই কদিনে বাড়ির কারো ফোন তো নয়ই, রুমানার ফোন পর্যন্ত রিসিভ করেনি। কারন সে ক্যারিয়ারের বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়নি কোনো কালেই। তো সব ঝামেলা শেষ করে যখন রুমান বাড়ির পথে। তখন কি মনে করে যেনো রুমানাকে কল করলো। যা তার ৮০ উর্ধ মিসকলের বদলে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এরপর বড়ভাইয়ের নাম্বারে ফোন করলো ২৭ মিসকলের বদলে। এবং তার থেকে সমস্ত কথা শুনে গাড়ি পাল্টে ঢাকা রওনা হলো।
সে খুব ভালোভাবে জানে যে, দাদির কথার নড়চড় হয় না। এবং তিনি এসব প্রেম ভালবাসার সম্পর্কে বিশ্বাস রাখেন না। এখন বাড়িতে গিয়ে ওরও কোনো কিছুই ভালো লাগবে না। ইশ, এখন যদি কোনো কাকতাল ঘটতো! রুমানা বেশ অনেক করে বোঝাতে চাইলো পালিয়ে যাবার বিষয়ে। সুমন নাকি হেল্প করবে। কিন্তু বাসার সবার অমতে, দাদির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার কোনো পথ রুমান খুঁজে পেলো না। তাই রুমানাকে ভাগ্য মেনে নিতে অনুরোধ করলো। এরপর থেকে আবারো রুমানার ফোন বন্ধ। যদিও রুমান সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলো পালানোর বিষয়ে, কিন্তু অপর পক্ষের খবর না জানার কারণটা তাকে ভোগান্তির মাঝে ফেললো। একদিকে বিয়ের ডেট, অপরদিকে বিমানের ফ্লাইটের সময় ক্রমেই এগিয়ে আসতে লাগলো।
রুমানের জন্য সুখের বা দুঃখের বিষয় যাই হোক! বিমানের ফ্লাইটের তারিখ বিয়ের আগে পড়লো। বাসার সবার অনেক অনেক অনুরোধ উপেক্ষা করে, সে রুমানা এবং সুমনের বিয়ের এক সপ্তাহ আগে দেশ ছাড়লো। এখন সে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে “সার্দান ক্রস ইউনিভার্সিটি”তে অবস্থান করছে। বিয়ের পরের কিছুদিন রুমানার খুব ব্যাস্ত সময় চলছিলো। কিন্তু সুমন কাজে চলে যাবার পরে কেনো যেন সব খালি খালি লাগছে। যার ফলে সে কিছুটা বিষন্নতা বা একাকিত্ব অনুভব করছিলো। একটা সময়ে রুমানের কথা মনে পড়লো। কিন্তু সব তো শেষ। তাই সে নতুন জীবনের প্রত্যাসায় সেই পুরোনোকে ভোলার কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।
তাই সে কোনোভাবে রুমানের নতুন কন্ট্রাক যোগাড় করলো এবং তাকে খোঁচাতে লাগলো রুমানাকে কষ্টে ফেলার কারনে। রুমান এমনিতেই বাহিরে এসে মন খারাপ করে আছে। সারাদিন ক্লাস, পার্টটাইম জব মিলে কেটে গেলেও রাতটা তাকে খুব পোড়ায়। কোনো আপনজন তো দূরের কথা৷ মন খুলে আলাপ করার মতো মানুষ নেই এই অপরিচিত শহরে৷ তারপর আবার রুমানার শুরু করেছে ঘেনর ঘেনর৷ সে মনের কষ্টে হোক,অথবা রাগে বা ক্ষোভে এপার্টমেন্টের ছাদে গেলো সিগারেটের ধোঁয়ায় কিছু দুঃখের ভাগ বাতাসে ছড়াবে বোলে।
এদিকে আমাদের গল্পের নায়িকা সেদিন ছাদের এক কোনে মন খারাপ করে কাঁদছিলো। এবং বেশ জোরেশোরেই। রুমানের মতো ফিলিংসলেস লোকের কেনো যেন আজ স্মোকিং স্থগিত করে সেই কান্না কুমারীর খোঁজ নিতে মন চাইলো। কিছুক্ষণ কান্নার পরে যখন মেয়েটার মন মোটামুটি হালকা হলো, অথবা সে ক্লান্ত হলো। তখন সে খেয়াল করলো কেউ একজন তার পেছনে দাড়িয়ে। সোজা ঘুরে দাড়াতেই একটা মাঝারি সাইজের শ্যামলা, কিন্তু তুলনামূলক সুদর্শন যুবককে তার সামনে আবিষ্কার করলো।
দেখতে নিরিহ টাইপ মনে হচ্ছিল বলে মেয়েটি হুট করে কান্না পুরোটাই থামিয়ে দিয়ে সোজা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো : did you following me ? রুমান এতক্ষণ পেছনের থেকে মহাকান্নারত কোকড়া চুলের এই মেয়েটিকে দেখছিলো,এবং যথারীতি কোনো বিদেশীনি হবে বলে মনে করছিলো। কিন্তু সামনে থেকে তার চেহারা পুরোই ভিন্ন। যাকে কিনা রুমান বিদেশিনী মনে করছিলো, ঘোরার পরে দেখতে পেলো সে এক বাঙালি মেয়ে। এবং তার হঠাৎ প্রশ্নে ঘাবড়ে গিয়ে সোজা বাংলায় বললো: দুঃখিত।
মেয়েটার এবার প্রচন্ড রাগ উঠলো। সেও বাংলায় ঝাড়তে শুরু করলো রুমানকে। বলতে লাগলো:- মেয়ে দেখলেই পিছে লাগতে হবে। তোদের মতো বখাটের কারনে বাবা আমাকে এই অচেনা দেশে নির্বাসিত করেছ। একটা পার্টটাইম চাকরির ব্যবস্থা ছিলো, আজ সেটাও গেলো। ওদিকে বাবার পক্ষে নাকি প্রতিমাসে টাকা পাঠানো সম্ভব না। বলি এতই যখন সমস্যা, তাহলে আমাকে সে বিদেশে পাঠাতে গেলো কেনো? পাড়ার বখাটে সমস্যা করে তো পুলিশকে বলো।
তাতে নাকি সমস্যা আরো বাড়বে। নইলে সেটার সাথেই বিয়ে দিয়ে দিতো। এদিকে বাসার রেন্ট দেবার সময় এসে গেছে। এখন আমি কি করবো? এক নাগাড়ে এতোগুলো প্রশ্ন করার এবং রাগ ঝাড়ার পরে তার হুশ ফিরল। ও, এক মিনিট! আমিতো গল্পের নাইকার সাথে আপনাদের পরিচয় করাইনি। এটা হচ্ছেন সিমা রহমার। বেশ সুন্দরী, এবং মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের। কিন্তু বিদেশে স্কলার ছাড়া পড়তে এসে মহা বিপাকে পড়েছে। বাবা সাহেব হাপিয়ে উঠেছেন মেয়ের পড়ার খরচ জোগাতে জোগাতে।
আসলে এলাকার এক সরকার দলিও ক্যাডারের নজরে পড়ে গিয়েছিলো সিমা। এর হাত থেকে মেয়েকে বাচাতে বাবা বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু পাত্রপক্ষ বেশ পছন্দের পরেও বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে পারত না। সেই ক্যাডারের ঝাড়ির ফলে কেউ কেউ বিয়ের আসর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। কোনো উপায় না দেখে শেষমেশ সিমার বাবা ওকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। প্রথমে সিমা একটা রেস্টুরেন্টে কাজ পেয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ কেনো যেনো কোনো কারন ছাড়াই সিমাকে চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়া হলো।
এদিকে বাবা তাকে বাড়িতেও নিতে পারবে না সেই ক্যাডারের কারনে। আবার সমূহ বিপদ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।যাই হোক রুমান বেচারা এতোদিনে একটা মানুষ (তথা বাঙালি) পেলো কথা বলার মতো। প্রথমে সে সিমার কান্না বিষয়ক সব কথাগুলো সুনলো। রুমানের নাকি কান্না নিয়ে একটা থিউরি আছে! তা হলো: যে দুঃখের কারনে কাঁদতে পারে! সে দুঃখ ভুলতে পারে চোখের পানিতে ধুয়ে। আর কান্না করতে পারা মানুষ অন্য কাউকে কাঁদায় না। কারন সে কষ্টের মানে বুঝে। যেহেতু এই মেয়েটাও কাঁদতে পারে, তাই রুমান নতুন ঠিকানা খোঁজার আশায় এর দরজায় কড়া নাড়াবে বলে স্থির করলো।
আগেই বলেছিলাম যে রুমান স্কলারশিপ নিয়ে এসেছিলো৷ এবং এখানে আসার পরে তার একটা পার্টটাইম জব হয়েছিল। তাই সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো সিমার প্রতি। এবং বাড়িতে মাকে ফোন করে সিমার বাবার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব করলো। হয়তো সপ্তাহ খানিক বা তার কম সময়ের মধ্যেই সব কিছু ঘটে গেলো। এখন তারা এক বাসায় থাকে। তারা ভালো আছে। এরপর আর বিস্তারিত বলা হবে না।