বৌয়ের বয়স বারো বছর। আগেই জানতাম বাচ্চা মেয়ে নিয়ে আমি বিভ্রান্তিতে পড়বো। ভুগতে হবে এক জীবন । কিন্তু পিতা মহাশয়ের সামনে দাঁড়িয়ে না বলার সাহস আমার কোনো কালেই ছিল না। অগত্যা বোকারামের মতো আমি রাজি হয়ে গেলাম।কাজী সাহেব ডেকে বিয়েও পড়িয়ে দিলেন মুরুব্বিরা। বিয়েতে আমি বললাম কবুল।এই এক কবুলেই আমার জীবন অতিষ্ঠ করে ছাড়লো। বাসর রাতে বউ সাজুগুজু করে বসে আছে খাটে।তার পাশে গিয়ে আমি বসতেই সে বললো,’এতোক্ষণে আসছেন আপনি, আমার তো ঘুম ই পেয়ে গিয়েছিলো।একা আমার কী যে ভয় লাগতেছিলো। আসুন আমরা ঘুমাই।’
কী সর্বনাশ!বউ কী বলে?বাসর রাতে ঘুমাবো। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পড়ে জেনেছি বাসর রাতে কোন বাঙালি বর-বধুই ঘুমায় না,আর আমরা ঘুমিয়ে যাবো! রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠলো। আমাকে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বললো,’কী হলো, ঘুমাবেন না? আচ্ছা না ঘুমালেও সমস্যা নাই। আপনি আমারে পাহাড়া দেন আমি ঘুমাই।’ বলে সে সাজুগুজু নিয়েই ঘুমাতে গেল। আমি কাঠ হয়ে গাধার মতো দাঁড়িয়েই রইলাম।ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে সে আবার জেগে উঠলো। উঠে বললো,’আমার সাথে একটু আসেন।’ বললাম,’কোথায়?’ বললো,’বাথরুমে যাবো।’ ‘তো আমি কেন?’
‘আমার ভয় করে। আপনাদের বাড়িতে ভূত আছে। কেমন মরার মতন বাড়ি।’ নির্বিকার আমি তার পিছু পিছু বাথরুম অব্দি যাই। গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।সে বাথরুমের খিল লাগায় না ভেতর থেকে। ওখান থেকে আবার একটু পর পর জিজ্ঞেস করে,’আপনি কী চলে গেছেন?” আমি বাহির থেকে গলা খাঁকারি দেই। মনে মনে গাল বকি। অভিশাপ দেই বাবাকে। শালার ঘটকের বাচ্চাকে এক হাত দেখে নেওয়ারও প্রতিজ্ঞা করি। বাথরুম থেকে বের হয়ে বউ আমায় বলে ,’ক্ষুধা লাগছে। আইসক্রিম খাবো।’ বেকুবের বাচ্চারে কী করার মন চায়। ক্ষুধা লাগছে তাই সে আইসক্রিম খাবে! ইচ্ছে করে বউকে জুরে সুরেই বেকুবের বাচ্চা ডেকে উঠি। কিন্তু ভয়ে শব্দটা উচ্চারণ করি না।পরে যদি শব্দ করে কান্নাকাটি শুরু করে। তখন তো আরো বিপদ হবে। আব্বা এসে আমার ঘাড় মটকে দেবেন নিশ্চিত!
আমি বললাম,’বউ, আইসক্রিম না খাইয়া পানি খাইলে চলবে না? নাইলে শরবত করে দেই?’ শুনে বউ আমার নাক কান্না শুরু করে। বলে ,’না আমি আইসক্রিম- ই খাবো। আমারে আইসক্রিম আয়না দেন। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। বললাম,’মনা, এখন যে দোকান খোলা পাওয়া যাবে না। সকালে এনে দেই।’ ‘না না সকালে না, এখন দেন। এক্ষুনি গিয়ে দোকান থেকে নিয়া আসেন।’ বলে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠে বউ। আমি দ্রুত তার মুখ চেপে ধরে বলি,’লক্ষ্মী চুপ করো প্লিজ!’ সে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কান্না শুরু করে। আমার হাতে কামড় দিয়ে মুখ ছুটিয়ে গলা ছাড়ে। আমি ফের বালিশ দিয়ে চেপে ধরি ওর মুখ ।বলি,’এই এক্ষণ গিয়েই নিয়ে আসছি আইসক্রিম, তুমি চুপ করো এখন প্লিজ!’
আমার আশ্বাস পেয়ে বাচ্চা বউ আমার চুপ করে চোখ মুছে। আমি চুপিচুপি ঘর থেকে দোকানের দিকে বের হয়ে যাই। গিয়ে দেখি দোকান সব বন্ধ। পরিচিত এক দোকানের ঝাপে গিয়ে ঠোকা দেই। অনেক্ষণ ঠোকাঠুকির পর মধ্য বয়স্ক দোকানী ঝাঁপ খুলে বলে,’হারুণ ভাই যে,আফনে বাসর রাইত থুইয়া এইহানে কী করেন?ও বুঝছি কের লিগা আইছেন।হেই জিনিস তো আমার দোহানে নাই।ফার্মেসিত যাইন।’ বলে হারামজাদা দোকানি খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে। ইচ্ছে করে ওর মুখে এক মুঠ ছাই এনে ছেড়ে দিতে। দোকানিকে এক ধমক দিয়ে বলি,’আইসক্রিম দেও এক ডজন।’ দোকানি রেফ্রিজারেটর থেকে আইসক্রিম নামিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে বলে,’ভাবীর বুঝি বিরাট গরম লাগছে! আইসক্রিম দিয়া ডইল্যা গোছল দিবাইন নি?’
আমি হারামজাদার প্রশ্নের পাল্টা উত্তর দেই না।টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরি।বাড়ি ফিরে দেখি আরেক কান্ড।বউ একা একা ভয় পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে সমস্ত বাড়ি এক করে ফেলেছে।বাসর ঘরে দেখি আম জনতার ভিড়।ভিড় ঠেলে যেই ভেতরে যাবো ঠিক তখন আমাকে দেখে আব্বা নিজের পা থেকে জুতো খুলে আমার দিকে ছুঁড়ে মারেন। তারপর বজ্র কন্ঠে রাজপথের লড়াকু সৈনিকের মতো বলেন ,’হারামজাদা কমজাত, নিজের ঘরে বউ থুইয়া মাইনষের বাড়ির চিপায় চাপায় গিয়া ঘোরস,আইজ তোর একদিন কী আমার একদিন!’ আমার প্রতি আব্বার এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ আনয়ন দেখে বেয়াদব বাচ্চা বউ আমার হি হি করে হেসে উঠে, আর আমি রাগে দুঃখে অপমানে কাঁদার ভাষাও হারিয়ে ফেলি।