বস্তি

বস্তি

মেঘে ঢাকা নিশীথে জরিনা পলাশের বুকে মাথা দিয়ে বলে, “আব্বা-আম্মারে নিয়া যাইবা না।” পলাশ এক হাত দিয়ে জরিনারে আরেকটু শক্ত করে কাছে টানে।চোখে নানারকম স্বপ্ন নিয়া পলাশ বলে, “আব্বা-আম্মারে এখন নিলে কই রাখুম,কউ? আমরা তো ব্যাবসাটা গুছায় আবার আসুম। তখন নিয়া যামু।” জরিনা কিছু বলে না।শ্বশুর শ্বাশুড়ির প্রতি জরিনার খুব মায়া।এ যুগে এমন দেখা যায় না।

পরের সকালে পলাশ আর জরিনা বের হয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্য।পেছন থেকে পলাশের বাপ-মা অনেক্ষণ ধরে তাকায় থাকে।সারাজীবন দিনমজুরি করে কাটায় দিসে দুজন। একমাত্র পোলা পলাশরে মানুষ করতে পারে নাই বইলা তাদের অনেক কষ্ট।কিন্তু তারা চায় না পোলা তাদের দিনমজুর হোক।তাই ভিটামাটি বন্ধক দিয়া পোলা আর পোলার বউরে ঢাকায় পাঠাইছে।একটা ব্যাবসা পাতি কিছু করার লিগা। পলাশ আর জরিনা ঢাকায় আইছে রজবের ভরসায়।রজব ভালো মানুষ।ঢাকা শহরে অনেকদিন যাবত থাকে।পলাশের বাপরে ওই কইছে, পলাশরে ঢাকায় পাঠায় দেয়ার জন্য।কিছু টাকা দিলে একটা ব্যাবসা পাতি দাঁড়া করায় দিবো। লঞ্চ থেকে নাইমা রজবের কাছে আসতে আসতে ভালোই দেরি হইয়া গেছে।বিকালের দিকে রজবের কাছে ওরা পৌছায়।রজব থাকে মিরপুরের এক বস্তিতে।বস্তি সম্পর্কে পলাশদের কোন ধারনা নাই।

পলাশরে দেইখা রজব দৌড়ায় আসে।বুকে জড়ায় নেয়।জরিনার দিকে তাকায়া বলে, “তোমার চেহারা অনেক মিষ্টি, মা।” রজবের বয়স বেশি। মেয়েদের প্রতি তার কোন টান নেই।আত্নীয়র সম্পর্কের নারীদের জন্য রজব আলী,বয়স ষাট জান দিয়ে দিতে পারে। রজব আলী পানের শেষ পিকটা ফেলিয়ে দিয়ে বলে,”আজকে তোরা আমার বাড়িতে থাক।কালকে একটা রুমে দুইজনরে উঠায় দিমু।মাসে পনেরো শ টাকা দিবি।আর ব্যাবসা নিয়াও কালকে আলাপ হবে।” পলাশ রজব আলীর একবারে কাছে গিয়ে বলে,”চাচা,আশি হাজার টাকা আছে আমার কাছে।তোমার কাছে রাখো। ” রজব আলী নিতে চায় নাই,তবে পলাশের জরাজরিতে রাখে।হারায় গেলে এই টাকা রজব আলীরই আবার দিতে হবে।

এই আশি হাজার টাকারে ঘিরা জরিনা -পলাশের অনেক স্বপ্ন। পলাশের বাপের টাকা।পলাশরা ভাবে এই টাকা ঠিক মত লাগাইতে পারলে ওরা একদিন সুখে থাকতে পারবো।তিন বেলা খাইতে পারবো।বছরে একবার না,সপ্তাহে একবার কইরা মাছ খাইবো, মাংস খাইবো,ভাল পোলাও খাইব।মেলার দিন ঘুরতে যাইতে পারবো।সবার মত জরিনাও নাকে, কানে অলঙ্কার পরবো।পলাশের বাপ -মা গ্রামে বুক উচা কইরা চলতে পারবো।চায়ের দোকানে পলাশের বাপরে সবাই দাম দিবো।ঘড়ের বন্ধক ছুটাইতে পারবো।এই টাকাগুলোর প্রত্যকটা পয়সা ওদের শুধু স্বপ্নই দেখায় গেছে।সুখে থাকার, ভাগ্য পরিবর্তনের।

সকালে বাথরুমে গিয়া দেখে জরিনা সেখানে বিশাল লাইন।কিন্তু কিছু করার নাই, অপেক্ষা করতে হবে। হাত মুখ ধুয়ে জরিনা পলাশরে কয়, “আমারে ঢাকা ঘুরাবা না?” পলাশ কয়,”ঘুরামু বউ।সব কিছু একটু ঠিক কইরা নেই।এরপর তুমি আর আমি মিলা অনেক জায়গায় ঘুরুম।প্রথমে যামু চিড়িয়াখানায়।বাঘ দেখার আমার অনেক ইচ্ছা।” পলাশের কথায় জরিনার চোখ জ্বলজ্বল করে।জরিনার মনে হয় তারা চিড়িয়াখানায় ঘুরছে।হরিণ দেখে জরিনা লাফাচ্ছে।সামনাসামনি জরিনার হরিণ দেখার স্বপ্ন সেদিন থেকে জন্ম হয় যেদিন জরিনার চাচাতো ভাই ওরে বলছিল,”তোর চোখগুলা হরিণের মত।”

সকালের পর পলাশ রজব আলীর সাথে বের হয়।কি কাজ করা যায় এসবের খোজে।ততক্ষণে জরিনা পুরা বস্তিটা ঘুইরা দেখে। সবার চোখে মুখে একটা দুখখ। খেটে খাওয়া মানুষ সব।কারো কারো মুখে হাসি তবে সেই হাসি কেমন যেন ফ্যাকাসে।হাসার জন্যই হাসছে।মনের হাসি এটা না, জরিনা বুঝে। কিছু চুলে রঙ করা পোলারা জরিনারে দেইখা কি যেন বলে।জরিনা তাদের কথা ধরতে পারে না তবে এইটুকু বুঝে বাজে কিছুই কইছে। আরেকপাশে দুই পরিবারের ঝগড়া লাগে।জরিনা কিছুক্ষণ দাঁড়ায়া দেখে।মুখের ভাষা এতো খারাপ, জরিনাদের গ্রামে কখনও ও শুনে নাই।

তবে সব কিছুর মাঝেই একটা ব্যাস্ততা আছে।আছে একটা চঞ্চলতা। একটা কিসের যেন অপেক্ষা। ক্ষুধা নিবারনের নাকি ভাগ্যে পরিবর্তনের? জরিনা বোঝে না।তবে জরিনা এটা বুঝে পলাশ আর জরিনা এখানে আসছে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের গঠনের জন্য।” বিকালের একটু আগে রজব আলী আর পলাশ বস্তিতে ফিরতে থাকে।ঠিক করছে, পাশের এলাকায় যে স্কুল আছে সেইখানে আগামী সপ্তাহ থেকে পলাশ ফুসকা বিক্রি করবো।আর জরিনা একটা গার্মেন্টসে কাজ করবো। এই এক সপ্তাহ পলাশ ফুসকা-চটপটি বানানো শিখবে আর জরিনারে নিয়া ঘুরবে।টাকা তো আর পুরাটা লাগতাছে না ব্যাবসায়।বউ ঘুরতে চাইছে একটু ঘুরাইলে সমস্যা কি?

বস্তির গলির মুখ দিয়া ঢুকার সময় পলাশ দেখে কিছু মুখ ঢাকা পোলাপাইনকে বের হয়ে আসতে।ওদের কেমন জানি সন্দেহজনক লাগছিল।দশজনের মত ছিল ওরা।সবার মুখই ঢাকা। এরা বের হইতে না হইতেই পলাশ দেখে ধোঁয়া। ধোঁয়ার পরিমান অনেক।হঠাৎ পলাশের কানে আসে, “আগুন!আগুন!” মানুষের চিৎকার বেড়েই চলে।পলাশের বুকে ধুক করে উঠে।জরিনা! পলাশ ধোঁয়ার ভেতরেই দৌড় দেয়।পলাশের পেছনে রজব আলী। চারদিকে ছোটাছুটি। কেউ কেউ পানি মারে।কিন্তু এতো আগুন কি আর পানিতে নিভে?জরিনা ঘুমোচ্ছিল, রজব আলীর বাসাতেই।আগুন লাগার পর পরই বাহিরে এসে দেখে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। জরিনা ভয়ে কেঁদে দেয়।এই সময় মানুষটা কই?পলাশ কে এখন ও কই পাবে?এখানে তো জরিনাকে কেউ চিনে না।

পলাশ কোন দিকে না তাকিয়ে দৌড়েই চলে।জরিনা ভয় পাচ্ছে, পলাশ বোঝে।রজব আলীর বাসার সামনে আসতেই দেখে ওড়না মুখে জরিয়ে জরিনা কান্না করছে।পলাশকে দেখতে পেয়েই এসে জরিয়ে ধরে।খুব ভয় পেয়েছে জরিনা। রজব আলী দেখে সে যেই বাসায় থাকতো সেখানে আগুন লেগে গেছে।রজব আলী এক কথার মানুষ। জান যাবে,তবুও আমানত রক্ষা করবে।পলাশের রাখা টাকা তার বাচিয়ে আনতেই হবে।রজব আলী এই আগুনের মধ্যেই ঘরে ঢুকে যায়।কিন্তু টাকা বাচানো সম্ভব হয় না।

রজব আলী আহত অবস্থায় বের হয়ে আসে।হাতে কালো, ছাই হয়ে যাওয়া ব্যাগ।পলাশ দেখে ব্যাগে উঁকি মারছে তাদের আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া,স্বপ্ন। এই টাকার উপরে তারা ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে চেয়েছিল।ঢাকায় এসেছিল।দিনমজুর থেকে ব্যাবসায়ী হতে চেয়েছিল।পারলো না।এটা ভাগ্যের দোষ নাকি জুলুম পলাশ জরিনা বুঝলো না।
পলাশ আর জরিনার মত হাজার হাজার ছোট ছোট,স্বপ্ন গুলো আগুনে জ্বল-পুরে ধোঁয়ার সাথে উড়ে গেল।
গরীবের চোখের পানির ক্যান, কিডনিরও দাম নাই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত