সম্পর্ক

সম্পর্ক

আমার বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি আম্মু’র সাথে ঢাকা থাকি , আর আমার বাবা থাকেন কানাডায়। আমার বাবা কানাডায় যাওয়ার পরে অন্য একজন মহিলা কে বিয়ে করেছে। বিয়ে করার কারণ হিসেবে দেখিয়েছে তার একাকিত্ব কে। আব্বু কানাডা যাওয়ার আগে আম্মু কে বলে যায়, যত দ্রুত সম্ভব কাগজ ঠিক করে আমাদের নিয়ে যাবেন। আব্বু দেশে এসেছিলো তবে আমাদের নিতে আসে নাই, আব্বু এসেছিলো আম্মু কে ডিভোর্স দিতে। আম্মু একটা এনজিও তে চাকুরী করে মুটামুটি বেতনে। আম্মু খুবই আত্ম-সন্মান বোধ সম্পন্ন মানুষ।

আম্মু – আব্বুর ডিভোর্সের বিষয় টা বেশির ভাগ মানুষ জানতে পেরেছে আমার নানু বাড়ির মানুষের কাছ থেকে। আম্মু এই বিষয় টা নিয়ে কারো সাথে কথা বলে নাই। নানু আর মামা খুবই রাগারাগি করেছিলো আমাদের বাসায় এসে, আর আম্মু কে বলছিলো শফিকের এই সিদ্ধান্ত আমাদের কেন জানাস নাই? আমাদের জানানে শফিক কোন ভাবেই পারতো না তোকে ডিভোর্স দিতে। কত বড় সাহস! মেয়ে আছে সংসার আছে, আর সে কিনা কোন এক খারাপ মহিলার পাল্লায় পড়ে, তোকে ছেড়ে দেয়! ওকে বুঝতে হতো, আর ভালো কথায় না বুঝলে, এমন ব্যবস্থা করতাম দেশ থেকে বের হতে পারতো না। আর তোর শাশুড়ী কি বলে,তার এত গুণের ছেলের বিষয়ে? এই সব কথার মাঝ খানে আম্মু মামাক থামিয়ে দিয়ে, নানু কে এক কথায় বলে দেয়, মা তোমাদের শফিকের কথা বলে কোন লাভ হতো না, তোমরা কেউ কিছু করতে পারতে না, কারন শফিক অন্য একজনের সাথে, ওকে জড়িয়ে ফেলেছে।

আর সেখানে আমি কেন ওর সাথে জোর করে থাকবো?আমি কি ওর করুণার পাত্র হয়ে, ওর সাথে থাকবো?আর একটা মানুষ আমার সাথে থাকতে চায় না, তখন তার সাথে থাকতে চাওয়ার মতো অপমানের লজ্জায় আর কি হতে পারে? আর আমি অথর্ব কেউ না, আমি আমার জীবনে একা চালাতে পারবো। তখন নানু আম্মু কে, আরো বেশি করে বকা দিয়ে চলে যায়। আর যাওয়ার সময় বলে যায় এত বেশি বুঝ বলেই তোমার জীবনটা এমন হলো,কারো কোন কথার মূল্য নাই তোমার কাছে। আমার নানুর বসার সবাই আম্মু কে একটু সামঝে চলে।কারণ আম্মু খুবই রাগি আর নিজের মতো করে চলে।

আমার দাদি খুবই দুঃখ পায় আব্বু’র এই আচরণে। দাদি আমাদের সাথে থাকতো। আব্বু- আম্মুর ডিভোর্সের পরে দাদি গ্রামের বাড়িতে চলে যায়।যাওয়ার আগে আম্মু কে বলে যায়, মা জলি,মানুষের সাথে মানুষের বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক হয়। আমরা পাশের বাসার মানুষ কে খালা বলি মামা বলি কেন? কারণ আমরা তাদের সাথে একটা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করি, সবাই রক্তের সম্পর্কের হয় না। আমরা তার পরেও তাদের জন্য মায়া অনুভব করি।আমরা তাদের ভালো মন্দে কষ্ট পাই।

মা তোমার সাথে আমার ছেলে যে অন্যায় করেছে তার কোন প্রতিকার আমার হাতে নাই। ছেলে মেয়ে বড় হলে তাদের নিজের জগৎ হয় তখন তারা তাদের মতো চলে সেখানে মা – বাবার কিছু করার থাকে না।শোন মা, শফিকের বৌ হিসাবে আমি তোমার মা হয়েছিলাম। আজ যদি শফিক আর তোমার মধ্যে ডিভোর্স না হয়ে শফিক মরে যেতো, তবে কি হতো? আমি তোমার শাশুড়ী মা’ই থাকতাম। আর আজ শফিক বেঁচে থাকার পরেও আমি তোমার কেউ না। শোন মা কোন সম্পর্ক শুধু কাগজ দিয়ে হয় না। হয় মন দিয়ে। তোমার আর আমার সম্পর্ক হলো মা আর মেয়ের। আমাদের সম্পর্ক সারাজীবন ধরে থাকবে। তুমি, আমি আর টুনটুনি আমরা এক আত্মা। তুমি আমার মা। তখন আম্মু আমার দাদি কে বলে, আম্মা আপনি ইচ্ছে করলে আমার সাথে থাকতে পারেন।

দাদি আম্মুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, না জলি আমি এখানে থাকলে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হবে, মানুষ দশ কথা বলবে, আর শফিক আমার ছেলে সে আমার সাথে যোগাযোগ করবে, আর আমার মাধ্যমে টুনটুনের সাথে যোগাযোগ করবে, এগুলো তোমার চোখের সামনে হবে তখন তোমার ভালো লাগবে না। আর ছেলের অন্যয়ের জন্য এই সাজাটা আমার প্রাপ্য ছিল। আমি এখানে থাকলে শফিক নিজে তার নতুন সংসার নিয়ে বিজি থাকবে, সেই সাথে মা আর মেয়ের দায়িত্ব তোমার কাঁধে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকবে।আমি তোমার জায়গায় থাকলে, শফিক কে বলতাম, তার মেয়ে সে তার কাছে নিয়ে যাতে, তার পর আনন্দে কাটাক জীবন। বাচ্চা’র দায়িত্ব বাবা – দু’জনের।পরের দিন দাদি গ্রামের বাড়ি চলে যায়।

দাদি’কে আমি আর আম্মু ট্রেনে তুলে দিতে যাই।দাদি চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। আমার দাদিও আম্মু ‘ র মতো শক্ত মনের মানুষ। দাদি গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার একমাস পরেের কথা,একদিন রাতে আব্বু আম্মু কে কল দেয়, আমার সাথে কথা বলার জন্য না, আমার সাথে প্রতি সপ্তাহে দু’দিন আব্বুর সাথে কথা হয়। আম্মু, আব্বু’র কল আসলেই আমাকে মোবাইল দিয়ে দূরে সরে যায়, আর কখনো জানতে চায় না আব্বু’র সাথে আমার কি কথা হয়েছে তা। আব্বু সব সময়ই কথার একটা পর্যায় এসে জানতে চায় টুনটুন তোমার আম্মু কেমন আছে?ঠিক তখনই আমার রাগ হয়, আমি বলি ভালো, আর রাখি বলে কল কেটে দেই।

আব্বু’র কল দেখে আম্মু আমাকে ডেকে দেয়, আমি রিসিভ করার সাথে সাথে আব্বু আমাকে বলে টুনটুন তোমার আম্মু কে মোবালটা দাও তো মা, আমি নিজে থেকেই বলি আম্মু তোমার সাথে কথা বলবে না। তখন আব্বু নরম গলায় বলে টুনটুন জলিকে ফোন টা দাও। আমি আম্মুর কাছে মোবাইল টা নিয়ে যাই আর বলি আম্মু আব্বু তোমাকে চাইছে। আম্মু একটা কথাও না বলে মোবাইলটা নিয়ে আব্বু কে বলে, শফিক জলি বলছি, আমি একটু দূরে দাড়িয়ে ছিলাম। আব্বু’র কথা আম্মু শুধু শুছিলো কিছু বলছিলো না, একবার শুধু বলেছিলো হু আমি শুনছি, শেষ কথাটা আম্মু বলে ঠিক আছে আমি আম্মা কে কল দিয়ে বলবো, বলেই কলটা কেটে দেয়।আমি রেগে আম্মু’র কাছে জানতে চাই আম্মু তুমি কেন আব্বু’র সাথে কথা বললে?

আম্মু হেঁসে বলে টুনটুন শোন, তোমার আব্বু’র সাথে আমার রাগ,অভিমান বা অন্যকোন ধরনের আবেগের সমপর্ক আর নাই। আমি কল রিসিভ না করলে তোমার বাবার মনে হতো আমি এখনো তার জন্য কষ্ট পাই! টুনটুন তোমার বাবা আমার জীবনে আর কোথাও নাই। আমি দৌড়ে আমার রুমে চলে আসি, আমি অনেক ক্ষন কান্না করি। আমি মনে মনে ভাবতাম, আমার আব্বু এসে একদিন আমার আম্মু’র কাছে মাফ চাইবে। তার পর আম্মু আব্বু কে অনেক বকা দিবে, তার পর আবার আমরা একসাথে থাকবো। আজ আমি আবারও বুঝতে পারছি, আমার আব্বু আছে, আম্মু আছে, কিন্তু আমরা আর কখনো এক পরিবার হবো না। আব্বু আমাদের সংসারটা নিজের হাতে ভেঙ্গে ফেলেছে যা আর জোড়া লাগবে না।

পরের দিন আম্মু দাদি কে কল দেয় এবং অনেক ক্ষন কথা বলে, এক সময় আম্মু দাদি কে বলে আম্মা সফিক আপনাকে নিয়ে টেনশনে আছে, আপনি নাকি শফিকের কল রিসিভ করেন না? আম্মু দাদু কে আব্বু’ র কল রিসিভ করার কথা বলে, আর বলে আম্মা আপনি কল রিসিভ না করলে টুনটুনের বাবা আমাকে আবার কল দিবে, এটা আমার ভালো লাগবে না। আপনি কল রিসিভ করে ওর সাথে কথা বলে আপনার যা বলার বলে দিয়েন। দাদু প্রতিদিন এবার করে আমাকে কল দেয়, কথা বলে। আম্মু’র সাথেও কথা বলে। আমারা আগে ছুটির দিনে বেড়াতে যেতাম নানু বাড়িতে এখন খুব বেশি যাই না।

নানু বাসায় গেলেই নানু, মামি আর মামা শুধু আব্বু কে নিয়ে আজেবাজে কথা বলে, আর আমার সামনেই বলবে তুই চাকরি করিস বলে কি হয়েছে টুনটুন কি তোর একার মেয়ে? শফিক কে বলবি টুনটুনের সমস্ত খরচ পাঠাতে, তোর একটা ভবিষ্যৎ নাই? মেয়ের পেছনে সব খরচ করলে তোকে কে দেখবে? আর তোর কি এমন বয়স? তুই কি সারাজীবন একা থাকবি নাকি? নানু এই কথা বলার সাথে সাথে আম্মু রেগে যায় আর বলে, আম্মা আমার ভুল হয়েছে তোমাদের কাছে আসা, এর চাইতে বাসায় থাকা ভালো। তখন নানু চুপ হয়ে যায়।আমারও এই সব কথার জন্য নানু বসায় আসতে ইচ্ছে হয় না। তার পরেও আসি,কারন আমাদের খুব বেশি কোথাও যাওয়ার যায়গা নাই। আব্বু – আম্মু’র ডিভোর্সের পর থেকে আমাদের কে সবাই একটু এড়িয়ে চলে। আর আমার মামীর রান্না আমার খুব ভালো লাগে।

ডিসেম্বর মাস আমার পরীক্ষা শেষ।বাসায় একা-একা থাকি মন খারাপ করে। আজ আম্মু রাতে খাওয়ার সময় আমাকে বলল টুনটুন চল আমরা কোথাও বেড়াতে যাই। আমি খুশি হয়ে উঠলাম আম্মু বলল টুনটুন আমি এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছি বলো তো কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়?আমি আর আম্মু এক সাথে বসে প্ল্যান করছি কোথায় যাওয়া যায়,চিটাগং, কক্স বাজার, সিলেট, সাজেক, আম্মু হঠাৎ করে আমাকে বলল টুনটুন তোমার দাদু বাড়ি গেলে কেমন হয়? আমি আম্মু’র কথায় অবাক! আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম আমি আম্মু’র গলা জড়িয়ে ধরে শুধু বললাম আম্মু তুমি অনেক অনেক ভালো।

পরের দিন আমি আর আম্মু দাদি’র জন্য আর আমার জন্য শপিং করলাম। তার পরের দিন আমরা দাদু বাড়ির রওনা হলাম। আমরা কিন্তু কেউ দাদি কে জানাই নাই দাদু বাড়িতে যাওয়ার কথা। আমি আর আম্মু যখন দাদু বাড়ির গেইটে রিক্সা থেকে নামছি তখন আমাদের এক গ্রামের চাচু আমাদের দেখতে পায়, চাচু এসেই আম্মা’র ব্যাগ রিক্সা থেকে নামিয়েই গেইটে ধুমধাম ধাক্কা দিতে লাগলো আর দাদি কে ডাকতে থাকলো আর বাহির থেকেই বলতে লাগলো চাচী গেইট খোলো তাড়াতাড়ি।

আম্মা আর আমি চাচুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। দাদি গেইট খুলে চাচু কে কিছু বলতে গিয়েই আমাদের দেখলো। দাদি শুধু আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো আর বলল, টুনটুন, আমি দৌড়ে দাদি’কে ধরে ফেললাম।আমার মনে হচ্ছে দাদু কাঁপছে এখনই পরে যাবে।আমার দাদি খুবই শক্ত মনের মানুষ। আজ সেই দাদিও একটু পর পর চোখ মুছছে আর বলছে, জলি মা, তুমি আমার মেয়ে না, তুমি আসলেই আমার মা, একমাত্র মা’ই বুঝতে পারে সন্তান কি চায়? আজ তুমি আমার সব কষ্ট দূর করে দিলে।আমার জীবনে আর কোন কষ্ট নাই। আমার মা আমাকে ত্যগ করে নাই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত