আমার গল্পে কাকতালীয় কোন ব্যাপার নেই। নিউমার্কেটে সুশ্রী যে মেয়েটির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম সে আমাদের পাড়ার কার্তিকদার হবু স্ত্রী শুচিস্মিতা। হবু স্ত্রী মানে গার্লফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড মানে এদের মধ্যে ইটিশপিটিশ চলতেছে। আমার যদিও কিছু যায় আসে না তবু একটা বিশ্বাস পোক্ত হয়ে গেল। এসব লোফার টাইপ ছেলেদের কপালেই এরকম সুশ্রী মেয়ে বেশি জুটে। সেদিন তাই মাথায় চিরুনি না দিয়েই বের হচ্ছিলাম। মা ডেকে বললেন, আহ! চুলগুলোর কি অবস্থা করে বেরুচ্ছিস! মাকে কি করে বুঝাই এখন এটাই চলছে। একদিনের এলোচুল যে এতটাই কাজে দিবে সেদিন ব্যাংকে না গেলে বুঝা যেত না কিছুতেই। সেকেন্ড অফিসারের পাশে সুন্দর মতন যে মেয়েটি বসে আছে সেই মেয়েটি কিছুক্ষণ ড্যাব ড্যাব চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি উপল না?
– আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?
-আমি জয়িতা। এক সাথে পড়তাম আমরা স্কুলে। চিনতে পারনি আমাকে?
এত সুন্দর মেয়ে কোনকালে আমার সাথে পড়েছে আর আমার চোখে পড়েনি এমন তো হতেই পারে না। তবু মুখের ওপর বলি কি করে, চিনতে পারছি না। হাজার হোক সুন্দর তো! জয়িতা নিজেই শুরু করলো আবার,
-আমি নতুন জয়েন করেছি। তোমার এখানেই একাউন্ট তবে?
-হুঁ
– চা খাওয়াই তোমাকে।
আমি চোখে একটুখানি ঢলা-ঘষা দিয়ে আবার জয়িতার দিকে তাকালাম। আরে! এ তো দাস পাড়ার নরেন কাকার মেয়ে। কালোর দিকেই তো গায়ের রঙ ছিল। এত সুন্দর হলো কিভাবে! জয়িতা যাই বলো না কেন বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সুবিধা একটু বেশিই। সারাদিন এয়ার কন্ডিশন রুমে থাকতে থাকতে কালো মেয়েগুলাও কেমন ধবধবে সাদা বয়লার মুরগির মতন হয়ে যায়! জয়িতা চা খাচ্ছিল, মনে হয় গলায় আটকে গেল সেটা। আমি তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ভিক্টোরিয়া রোড ধরে হাটছিলাম। আমাদের পাড়ার সাধনদা কি সব ভাবতে ভাবতে হনহন করে যাচ্ছে। ডেকে বললাম
-সাধনদা যাচ্ছ কোথায়? সাধনদা তার মোবাইল ফোন বের করে একটা নাম্বার দেখালো আমাকে।
-চিনিস এ নাম্বার?
-না তো। কেন?
-তোর বউদিকে কে যেন বিরক্ত করে খুব।
-ও!
এ শালার সাধনদার খেয়ে দেয়ে কাজ নাই কোনো। সারাদিন বউকে সন্দেহ করবে আর একে ওকে নাম্বার দেখিয়ে বেড়াবে। আমি বিরক্তি নিয়ে দ্রুত কেটে পড়লাম সেখান থেকে। সঞ্চয়দার বইয়ের দোকানে নতুন কোন বই এসেছে কিনা তার খোঁজ নিতে গিয়েই পেয়ে গেলাম শুচিস্মিতাকে। একটু গায়ে পড়েই কথা বললাম,
-এই যে শুনুন?
-জ্বী বলুন।
-ইলুশন আর হ্যালুসিয়েশন এর মধ্যে পার্থক্য কী বলতে পারেন?
-বুঝলাম না ঠিক।
-না, আসলে নিউমার্কেটে আপনার মতন সুশ্রী একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে যেদিকেই তাকাই সেদিকেই আপনি। এটাকে ঠিক কি বলা যায়? ইলুশন না হ্যালুসিয়েশন?
-ইডিয়ট।
-না! মানে! আপনি তো বউদিই!
-কি?
-ওই যে কার্তিকদা আছে না আমাদের পাড়ার। ওই আর কি
-আপনি চিনেন কার্তিককে? আর জানলেন কি করে এ ব্যাপারে?
-না, মানে…যেদিন ধাক্কা খেয়েছিলাম সেদিন তো আমার সাথে ভিমও ছিল। ভিম জানে তো।
-ওহ।
-কি বই নিবেন আপনি?
-একটা কবিতার বই। যে জলে আগুন জ্বলে। অর্ডার দিয়ে গিয়েছিলাম।
-কেরোসিন ছাড়াই?
-কি!
-নাহ! কিছু না।
তারপর বেশ কদিন কেটে গেল। মা আমার জন্য পাত্রী খুঁজে মরছে আর দেয়ালে কপাল ঠুকছে। বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজার বিড়ম্বনা। এর চেয়ে বেশি বিড়ম্বনা আর কিছুতেই নেই। এর মধ্যে আমাদের পাড়ায় বিশ্রী একটা ব্যাপার নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেল। সব কিছু ছেড়েছুড়ে সেদিন আমাদের জেলা শহরে যে নতুন লাইব্রেরি হয়েছে সেখানে কিছু বই দেখছিলাম। দেখি শুচিস্মিতা কয়েকটা পত্রিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কি যেন দেখছে। আমি এড়িয়ে যেতে চাইলাম। কোনমতে পাশ কাটিয়ে চলে আসব কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম।
-এই যে?
-জ্বী, বলুন।
-দেখে পালিয়ে যাচ্ছিলেন যে।
-কোথায়? না তো!
-আপনাদের ওদিকের ছেলেগুলাই বদের হাড্ডি।
-ওহ! কার্তিকদার কথা বলছেন? বয়সের দোষ।
আমাদের পাড়ার যে বিশ্রী ঘটনার কথা বললাম,ওটাই। কার্তিকদা সাধনদার বউয়ের সাথে ফেসে গেছে। সেই নিয়ে বিচার শালিশ, জানাজানি। শেষে শুচিস্মিতার সাথে সম্পর্কটাই ভেস্তে গেল।
-বয়সের দোষ মানে? চরিত্রের দোষ।
-সব দোষ আপনার।
-আমার মানে?
-আপনি বেচারা কার্তিকদাকে একটু আধটু প্রশ্রয় দিলেই তো এমন করতে যেত না অন্যের বউর সাথে।
-আপনিও তো বদ, আবার বাঁদরও
-সত্যি?
-হ্যাঁ।
-তবে চীনা বাদাম খাওয়াবেন?
-কি!
-ওই পার্কের দিকটায় চলুন।
শুচিস্মিতা হেসে ফেলল, চলুন। শুচিস্মিতা দশ টাকার বাদাম কিনেছে। বাদামের খোসাগুলো আমি আর শুচিস্মিতা যে বেঞ্চিতে বসে আছি সেই বেঞ্চের মাঝখানে স্তুপ করে রাখছি। কিছুক্ষণ বাদে শুচিস্মিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, জানেন মাঝেমাঝে জীবনে বন্ধুর খুব প্রয়োজন হয়। আমি বাদামের খোসাগুলো মুহূর্তেই ফেলে দিয়ে কিছুটা শুচিস্মিতার দিকে সরে এসে বলি, তবে আরো কাছে আসি?
-আপনি সত্যিই হাসাতে পারেন খুব।
-সুন্দরী রমনীরা যদি চিরকাল হাসত এমন করে!
-আপনার সাথে থাকলে না হেসে উপায় আছে?
-আপনার অসুখের জন্য ট্রিটমেন্ট এখন এটাই।
-মানুষের কত মন বুঝে চলুন আপনি! মনে মনে বলি ধুর ছাই! সব মানুষের মন বুঝে চলার অত সময় কোথায়! শুচিস্মিতাকে জিজ্ঞেস করি,
-তা পত্রিকায় কি খুঁজছিলেন?
-ও! কোথাও কোন চাকুরীর সার্কুলার হলো কিনা তাই। কার্তিকের বিরহে তো ঘরে বসে থাকলে চলবে না।
ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়ে মাসীর কাছে মানুষ।এবার একটা কিনারা করতে হবে।
-আমার মা তো কবে থেকে চাকুরী দিবে দিবে করে লোক পাচ্ছে না।
-কিসের চাকুরী?
-নাহ! থাক। আপনার পোষাবে না।
– পোষাবে, বলুন না?
-ওই, আমাদের ঘরদুয়ার দেখাশোনা করে রাখবে আর মায়ের ছেলেটাকে একটু ভালবাসবে। আমি আড়চোখে তাকাই শুচিস্মিতার দিকে। শুচিস্মিতা হাসছে চুপিচুপি।
-উপল বাবু আপনি শুধু বাঁদরই না, অসভ্যও খুব।
-তবু কেউ সভ্য বানানোর দায়িত্ব নেয়নি কোনদিন শুধু অপবাদ দিয়ে গেছে।
-উঠুন তো। সেদিন বাসায় ফিরে আসতেই মা জয়িতার ছবি সামনে দিয়ে বলল,
-মেয়েটা কত সুন্দর? নারে উপল?
-পেলে কোথায়?
-খোঁজ লাগিয়েছিলাম। পেয়েছি। তা তোর পছন্দ হয়েছে?
-চকচক করলেই সোনা হয়না মা এর ইংরেজি যেন কি শিখিয়েছিলে আমায় ছোটবেলায়?
মা দাঁতে দাঁত চেপে রেগেমেগে অস্থির। তোর কপালে বউ নেই। আমার হাড়গোড় জুরালে তবে তোর শান্তি। তার দুদিন বাদে জয়িতার ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে বাসস্টপের এক পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলাম। কোথা থেকে জয়িতা এক সুদর্শন ছেলের সাথে হাসতে হাসতে আসছিল এদিকেই, আমারই সামনে পড়ে গেল। মনে মনে ভাবলুম, চারপাশে মায়াবিনী কতই তো আছে! মায়াময়ী নেই একজনও।
-ভালো আছো জয়িতা?
-হ্যাঁ উপল। তুমি কেমন?
-ভাল।
-আমার কলিগ ইনি, পরেশ।
-ভাল।
মনটা কেমন অশান্ত হয়ে উঠে মাঝেমাঝে, কারণ ছাড়াই। শুচিস্মিতার ক্ষত নিশ্চয় এর চেয়ে বেশি।বেচারি কেমন আছে, কে জানে! ওদিকটায় গেলে কেমন হয়? ভিম নিশ্চয় চিনে শুচিস্মিতাদের বাড়ি। শুচিস্মিতা বাসায়ই ছিল। আলখাল্লা কি একটা পরে আছে পাঞ্জাবীর মতন, সাদা। ভিম সোফায় বসে আছে; কারণ ছাড়াই এদিক ওদিক তাকাতাকি করছে। বুঝে উঠতে পারছে না কিছুই। বললাম, এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম খোঁজ নিয়ে যাই আপনার
-ভালো করেছেন।
-জ্বী। সমব্যথী তো।
-আপনারও পুড়েছে হৃদয়?
-সেদিন জলের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিলেন না? সঞ্চয় দার দোকানে?
-সত্যিই আপনি পারেন।
-বলছিলাম, আপনার মাসী কোথায়?
– পুজো দিতে গেছে মন্দিরে।
-আগে জানলে, ভিমকে রেখে আসতাম দরজার বাহিরে।
-কি!
-কিছু না। উঠি আজ।
-চা খাওয়াই।
-সেদিন খেয়েছিলাম ব্যাংকে, এখনো আটকে আছে গলাতে।
-কি যে বলেন মাথা মুণ্ডু! বুঝা যায় না ছাই।
-বুঝেন না বলেই তো অকারণে গলা শুকায়।
-মানে?
-জল খাব। বেরিয়ে আসলে ভিম বলল, তুমি লাইন মারছ এখন উপল দা?
-তা কি আর হতে দিলি! ড্যাব ড্যাব চোখে কথা তো সব গিলছিলি।
তারপর কতদিন কেটে গেল শুচিস্মিতার খোঁজ নেই আর। ওদের ল্যান্ডফোনের যে নাম্বার ধরিয়ে দিল ওতে পাচ্ছি না। কার্তিকদার সাথে রাগ করে শুচিস্মিতা নিজের মোবাইল ভেঙ্গেছে। আহা বেচারি! মেয়েরা সব সময় ভাঙ্গাভাঙ্গির মধ্যেই থাকে! বিয়ের আগে হৃদয় ভাঙ্গে, বিয়ের পর ভাঙ্গে হাড়ি পাতিল। মাঝখান থেকে উপলের কপাল ফাঁটে। সেদিন সন্ধ্যায় মা জল খাবার দিয়ে বলল মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে এক মেয়ে দেখেছি, কী সুন্দর! তোর কপালে যদি এমনি কেউ জুটত! পরদিন সকাল নয়টা নাগাদ ঘুমিয়েই ছিলাম। মা তড়িঘড়ি করে ডেকে দিয়ে বলল, তোর কাছে মন্দিরে দেখা সেই মেয়েটি এসেছে। আমি বসার ঘরে এসে দেখি, শুচিস্মিতা। কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনি?
-হ্যাঁ। একটা স্কুলে চাকুরী পেয়েছি। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভিমের সাথে দেখা। ওই আপনাদের বাসা দেখিয়ে দিল। ভাবলাম সুখবরটা দিয়ে যাই।
-কিন্তু ফোনে পাচ্ছি না যে আপনাকে, কদিন ধরে চেষ্টা করছি।
-ও! ওটা নষ্ট হয়ে আছে।
-তবে তো চাকুরী পেয়েই গেলেন। আমার মায়ের কপালই খারাপ।
-একসাথে দুটো চাকুরী নিলে আপনার মায়ের খুব আপত্তি আছে বুঝি?
-তবে বের করতে বলি?
-কি?
-পঞ্জিকা। শুভ দিনক্ষণ যদি পাওয়া যায়? লজ্জাবতীর মতন হাসছে শুচিস্মিতা। আহা! কতদিন ধরে এই হাসি খুঁজছি আমি ক্লান্ত প্রাণে!