ভোর ৪:৫০ রিয়াদ হাত ধরে টেনে আমাকে বিছানা থেকে উঠাল আমার নাকি আজ পরিক্ষা। ঘুমে দু চোখ যেন খুলতে ই চাইছে না। তারপরও রিয়াদের ডাকে উঠতে ই হল আমাকে। হাতমুখ ধোয়ে পড়তে বসলাম।
আজ ৬ বছর আমাদের বিয়ের। খুব অল্প বয়সে ই আমার বিয়ে হয়ে যায় ১৬/১৭ বছর বয়সে। পড়ালেখার খুব খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে তা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব না। কারণ আমি ছাড়াও আরো চার টা বোন আছে আমার। আমি ২য়। বড় বোনেরও বিয়ে হয়ে যায়। দেখতে অনেকটা ভালো ছিলাম বলে আমার শাশুড়ি আমাকে পছন্দ করে বিয়ে দিয়ে আনেন। আর তেমন কোনো দাবি দাওয়া ছিল না।
বিয়ের পর পর ই শহরে চলে আসি। আমার ননদ দেবররা সেখানে থেকে পড়াশোনা করে। দিন শেষে ঘরের সব কাজ কর্ম করে যখন আমার ননদ সাথীকে পড়ার টেবিলে পড়তে দেখতাম তখন কেন জানি আনমনে হারিয়ে যেতাম। অথবা তার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতাম। সেটা রিয়াদ হয়ত খেয়াল করে। এক সন্ধ্যায় হাত ধরে বলে পড়ালেখা করবে আবার? আমি তখন কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। যেন খুব গোপনে লুকিয়ে থাকা কোনো ইচ্ছার ছটফটানি টা হয়ত কেউ দেখতে পেয়েছিল তখন। কিছু না বলে শুধু চোখের পানি ফেলে ছিলাম। আর বলতে হয় নি।
পরদিন থেকে ই আমার পড়ালেখা শুরু কোনো রকম এসএসসি টা পাস করে ছিলাম বিয়ের আগে সে নতুন কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। সব কাজ শেষ করে অনেক কষ্ট হত সবকিছু ম্যানেজ করতে তবুও রিয়াদ যখন দিন শেষে একবার বুকে জড়িয়ে নিত তখন আর কিছু ই থাকত না। সব কষ্ট ই যেন পানি হয়ে যেত। বুকে জড়িয়ে বলত, জানো তো আমারো খুব ইচ্ছে ছিল অনেক পড়াশোনা করার কিন্তু হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় আর হয়ে উঠেনি। সংসারের সবার দায়িত্ব আমার উপর। তাই সব ছেড়ে বাবার ছোট ব্যবসা টায় আবার হাল ধরলাম।
যখন দেখলাম তোমার খুব পড়ালেখার শখ। তখন কেন জানি আমার ইচ্ছাটা তোমার মাঝে দেখতে পেলাম। ভাবলাম আগামী সন্তানের বাবা মা কি দুজন ই কম শিক্ষিত হবে? এটা কি মানা যায়। বাবা না হয় পারেনি মা তো পারতে ই পারে তাই না !! আমি তখন লজ্জায় ওর বুকে মুখ লুকাই। কি বলে আমার লজ্জা লাগে না বুঝি। এভাবে ই শুরু হয়। পড়ালেখা আর সংসার। বিয়ের তিন বছর পরও যখন আমাদের কোনো সন্তান নেই তখন কম কথা শুনতে হয় নি আমার।
অথচ রিয়াদ ই সন্তান নিতে মানা করে। এখন না পরে, এখন নিলে পড়ালেখার ক্ষতি হবে। সামনে পরিক্ষা। আমার থেকেও যেন তার টান বেশি। ইন্টার শেষ করে অনার্স শেষের দিকে আমার। শাশুড়ি সরাসরি না বললেও অনেক আকার ইঙ্গিতে আমাকে অনেক কথা ই বুঝিয়ে দেন। পাশের বাড়ির বিয়ের ২ বছরের মাথায় কুল জুড়ে ফুটফুটে বাচ্চা। আমি রিয়াদ কে বলি অনার্স শেষ হতে চলল এখন বেবি নেই। কোনো সমস্যা হবে না আমার পড়ালেখার। সব পারব সামলাতে।
রিয়াদ ধমক দিয়ে মানা করে শেষ যখন তাহলে শেষ হয়ে যাক। আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই। সব হবে।
সবার কথা শুনতে যেও না। আমার স্ত্রী কে আমি ঐ জায়গায় দেখতে চাই যেখানে আমার স্বপ্ন ছিল। সেই আসন টায় দেখতে চাই আমি। আর কিছু বলতে পারতাম আমি। এই মানুষটার কথা গুলো শুনে শুধু ভালোবাসা না ভক্তি সম্মান শ্রদ্ধা সবকিছু মন থেকে আসত। ভাবতাম সব মেয়ে যদি এমন একটা জীবন সঙ্গি পেত। এভাবে রাত জেগে চা খাইয়ে ভোরে বিছানা থেকে টেনে তুলে আমার মানুষটা আমাকে এগিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আলসেমি লাগত কাজকর্ম করে কিন্তু সে ছাড় দিত না কিছু তে ই।
আজ অনার্সের রেজাল্ট। রাত থেকে ই কেন জানি ভালো লাগছিল না। সকালে কোনো রকম উঠে রিয়াদ কে নাস্তা বানিয়ে দেই। সে কাজে চলে যায়। কেমন জানি অবসাদ লাগছিল। কলেজ থেকে হঠাৎ ফোন আসে এখনি কলেজে যেতে হবে। রিয়াদকে ফোনে বলে শাশুড়ি কে জানিয়ে কোনোরকম চলে গেলাম। কলেজ যেতে ই ম্যাডামের ধমকে আমার মেরুদন্ড সুজা হয়ে গেল। বলেছিলাম তোমাকে আরো ভালো করে পড়। না শুনলে না আর একটু হলে যেত সব। নিজেরও খেয়াল নেই পড়াশোনারও নেই। (ম্যাম)
ম্যাম এমন বলছেন কেন? সব শুনে যেন কান্না পাচ্ছিল। রিয়াদের কথা খুব মনে হল আমার নয় তাঁর ইচ্ছা স্বপ্ন কি আমি পূরণ করতে পারিনি এসব ভাবতে ই যেন আরো জোরে কান্না আসল। তখন ই ম্যাম মার্কশীট টা হাতে দিলেন। পুরো শহরের মাঝে রেকর্ড সিজিপিএ নিয়ে আমি ২য়। সামন্যের জন্য ১ম হতে পারিনি তাই এমন বলছেন। এটা শোনার পর কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। হাসিকান্না সব মিলে একাঁকার। সাথে এই কলেজে প্রভাষক হিসেবে জয়েন করতে পারব। আমার যেন আর বলার কোনো ভাষা নেই। শুধু রিয়াদকে ফোন করে কলেজ আসতে বললাম, এরপরে আর মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল তখন একটা রুমে ডাক্তার চেকআপ করছে। সামনে আমার সহপাঠী আর টিচার। জানালেন আমি মা হতে চলেছি। তখন কিছু বলার আগে আবারো আমি অনেক কান্না করলাম। আল্লাহ এত এত সুখ একসাথে আমার জন্য রেখেছেন তা আমার ভাবনার অতীত। রিয়াদ আজ কত যে খুশি হবে শুনলে। কিছুটা দূর্বল লাগছিল। শুয়ে ছিলাম। মেসেজ আসল ৫ মিনিট আসছি পৌছে গেছি। এই ৫ মিনিট যেন পার হচ্ছিল না। এক একটা মিনিট যেন কয়েক ঘন্টা সমান লাগছিল।
হঠাৎ কারো কাছ থেকে শুনলাম রিয়াদ এক্সিডেন্ট করেছে ট্রাকের নিচে চাপা পরে স্পট ডেথ। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি অজ্ঞান হয়ে যাই তখন ই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি রিয়াদে কাফনে মুরানো শরীর। আমার বুকটা যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। সব ই তো ঠিক ছিল কেন এমন হল। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। প্রিয় মুখটার এমন নিরবতা। নিজের সন্তান কে দেখাতো দূর সে যে পৃথিবীতে আসছে তার খবর টা পর্যন্ত দিতে পারলাম না। এমন অভাগী আমি।
খুব কষ্ট হয় যে আমার তোমাকে ছাড়া একা একা থাকতে খুব কষ্ট হয়। মাঝরাতে কেঁদে উঠি তোমার কথা ভেবে হঠাৎ স্বপ্নে দেখি তুমি বলছ, আমার স্বপ্ন আমার ইচ্ছাতে তুমি আছো তাহলে আমি একা কোথায়..! তারপর আমি অন্ধকারে খুঁজে বেড়াই তোমাকে। সন্তান কে বুকে নিয়ে তোমার স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষায় আমি। শুধু অন্ধকারে একটু বেশি কষ্ট হয় রিয়াদ। একটু বেশি কষ্ট হয়। এভাবে একা থাকার তো কথা ছিল না।