বৌ ভাতের পর বাড়ি এসে আর শ্বশুর বাড়ি যেতে চাইছে না নীরা।বাড়ির সবার কথা উপেক্ষা করছে সে ।কারো কোনো কথা কানে তুলছে না।বাবাকে সরাসরি বলে দিয়েছে,তোমার যদি আমার ভরণ পোষণের দায়িত্ত্ব নিতে সমস্যা হয় তাহলে আমি চাকরি করবো। নীরার বাবা তাকে একবারের জন্যেও বুঝাতে আসেনি।তার মা অনেক বুঝিয়েছে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য।আসলে নারী জাতিটাই এমন।তারা মনে করে একবার বিয়ে হয়ে গেছে মানে সেখানেই তাঁর জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে।নীরার মা তাকে বলছে__মা,বিয়ের পর স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল স্থান।যতই তুমি বড়লোকের মেয়ে হও না কেন কেউ তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। নীরা অবাক হয়ে যায় তার মায়ের কথাগুলো শুনে।যে মা তাকে প্রতিবাদ করতে শিখাতেন সেই মা আজ বলছে যেন স্বামীর সংসার করে।সে একটু শান্ত হয়ে বলে__মা ,তুমি কি জানো আমি কেন যেতে চাইনা?
__না,আমি জানিনা আর জানার দরকারও নেই।শুধু একটা কথাই মাথায় রেখো।যে বাড়িতে লাল শাড়ি পরিধান করে ঢুকেছিলে সেই বাড়ি থেকে সাদা কাপনের কাপড় পরিধান করে বের হবে। নীরা এবার একটু রেগে যায়।মাত্র তিনদিন আগে বিয়ে হয়েছে। এখনও সব মেহমান বাড়ি থেকে যায়নি।এরই মধ্যে মেয়ে বলছে সে আর শ্বশুর বাড়ি যাবে না।কেউ এটা পর্যন্ত শুনছে না সে কেন এই কথাটা বলছে।দাদী,নানীদের জ্ঞান দেওয়া শেষ হচ্ছে না।একেজন তাদের জীবনের দুঃখের গল্প জুড়ে দিচ্ছে তাকে বুঝানোর জন্য যে কতটা কষ্ট করেও তারা সংসার করেছে।এতজনের কথার মধ্যে নীরা সেই কথাটাই বলতে পারলো না কেন সে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।অবশ্য নিয়েছে বললে ভুল হবে।সে সিদ্ধান্ত টা নিতে বাধ্য হয়েছে।
নীরার ইচ্ছে ছিল সে পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।গরীব,অসহায় মানুষদের সাহায্য করবে।কিন্তু তার বাবা হঠাৎ করেই বিয়ের কথা বলে।ছেলে খুব ভালো চাকরি করে।ভালো পরিবার।তিনি ভেবেছেন উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলের কাছে বিয়ে দিলে মেয়ের পড়ার ইচ্ছাও পূরণ হবে।আর বিয়ের কাজটাও তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।নীরার বাবা আনোয়ার হোসেন তাঁর সামর্থ অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব সবটাই মেয়ের বিয়েতে দিয়েছেন। মেয়ের সুখের জন্য টাকা পয়সার কথা ভাবেননি। যখন যা প্রয়োজন তার অধিক খরচ করেছেন।ছেলে পক্ষের সকল শর্ত মেনে নিয়েছেন।খু্ব ধুমধাম করে বিয়ে হয় নীরা ও আকাশের।কিন্তু বিয়ের রাতেই ঘটে যায় নীরার জীবনের সবচেয়ে বাজে ঘটনাটি।তাকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার প্রথম মুহূর্ত গুলো খুব ভালোই চলছিল। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় অশান্তি।নীরার শাশুড়ি সেলিনা বেগম এসে বলেন__কি গো!তোমার বাবার তো লেপ, তোষক,বালিশ এসব দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু এখন তো এসব কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।
নীরা বুঝতে পারে না এসব কি বলছে।কারণ তার বাবা তার বিয়ের জন্য বরকে কি কি দেবে সেটা তাকে জানানো হয়নি।এসব দিবে জানলে সে বিয়ে করতো না। নীরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সেলিনা বেগমের দিকে তাকায়।তিনি বলেন বলেন__তোমার বাবাকে এখনই ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করো তাহলেই বুঝবে।নীরা তার বাবাকে ফোন দিলে তিনি বলেন,বিয়েতে মেয়ের সুখের জন্য অনেক কিছুই দিতে হয়।তুমি উনাদেরকে বলো আমি যাদেরকে জিনিসগুলোর জন্য অর্ডার দিয়েছিলাম তারা একটু দেরি করছে।আমরা তোমাকে আনতে যাওয়ার সময় সব নিয়ে যাবো।
নীরা আশ্চর্য না হয়ে পারেনা। তার বাবার মত একজন মানুষ নিজের মেয়ের সুখের জন্য এমন কাজ করছেন!
নীরা তার বাবার বলা কথাটাই গিয়ে সবার সামনে বলে।তখন তার শ্বাশুড়ীর মুখভঙ্গি এতটা বাজে হয়েছে যা সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনা।কেউ তাকে কিছু বলে না।সবকিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।সে বাসর ঘরে ঢুকে যায়।সে খাটের উপর বসে বসে শুধু কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো নিজের মন থেকে ভুলানোর চেষ্টা করছে।এমন সময় আকাশ ঘরে ঢুকে।নীরা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়।আকাশকে সালাম করে।আকাশ খাটের উপর বসেছে।নীরা তখনও দাঁড়িয়েই আছে।আকাশ তাকে কিছুই বলছে না।অবশেষে সে নিজেই গিয়ে আকাশের পাশে বসলো।আকাশ চোখ রক্তবর্ণ করে তার দিকে তাকায়।যেন খাটের উপর বসাটা কোনো মস্তবড় অপরাধ।এমন অপরাধ আর কিছু হতে পারে না।নীরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।সরল দৃষ্টি তবে সেই দৃষ্টিতে রয়েছে হাজারও প্রশ্ন।আকাশ তাকে খাট থেকে উঠে দাঁড়াতে বলে।নীরা তাই করে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।আকাশ বলে__তোমার বাবা মা যেদিন সবকিছু দেবে সেদিনই খাটে উঠবে।
__বাবা বলেছে আমাকে নিয়ে আসলেই সব নিয়ে আসবে।
__আচ্ছা,তাহলে যখন নিয়ে আসবে তখন দেখবো।ততদিন নিচেই ঘুমাও।
কথাটা শেষ করে আকাশ শুয়ে পড়ে।নিমিষেই ঘুমিয়েও পড়ে।হয়ত ঘুমায়নি।নীরাকে অগ্রাহ্য করার জন্যই ঘুমের ভান ধরেছে।নীরা সারারাত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কাটায়।মানুষ কি করে এতটা খারাপ হতে পারে সেটাই তার পুরো ভাবনা জুড়ে রয়েছে।আর রয়েছে ভবিষ্যতের চিন্তা।এভাবেই কেটে যায় তার শ্বশুর বাড়ির প্রথম ও শেষ দিন।
নীরা দুইদিন ধরে তার বাড়িতে আছে।এই দুদিনে অনেকে তাকে অনেক ভাবে বুঝিয়েছে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কোনো ভেজাল না করার জন্য।নীরা কারো সাথে কথা বলেনি।আজ বিকেলে তার শ্বশুর,শাশুড়ি এসেছে তাকে নিতে।নীরার মা তাকে সবার সামনে নিয়ে যায় যেন কিছুই হয়নি।সবাই কথা বলছে।ভালো মন্দ কথা।নীরার বাড়ির সবাই তাদের খুব আপ্যায়ন করছে।অনেক্ষণ কথা বলার যখন তাদের যাওয়ার সময় হয় নীরা তার বাবার দিকে তাকায়।সেই দৃষ্টিতে রয়েছে অনেক অনেক আশা।অনেক ভরসা।তার একমাত্র আশ্রয়ের স্থান হচ্ছে এটা।সবাই কিছু না কিছু বলছে কিন্তু নীরা শুধুই ভাবছে তার বাবা কি বলবে।কারণ তাঁর কথার উপরই নীরার পরবর্তী জীবন নির্ভর করছে। নীরার বাবা অনেকক্ষণ পর বলেন__আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থাকবেন।এখন আপনারা আসতে পারেন। আকাশ ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে।তবুও চুপ করে থাকে। সেলিনা বেগম বলেন__নীরা,মা এসো।
__নীরা কোথায় যাবে? আনোয়ার হোসেনের এই কথা শুনে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ে।
__কেন? আমাদের সাথে!
__নীরা কোথাও যাবেনা।
যে বাড়িতে লেপ,তোষক দিতে পারিনি বলে আমার মেয়েকে নিচে ঘুমাতে বলা হয় সেই বাড়ির নিচু মনের মানুষদের কাছে আমি আমার মেয়েকে দেওয়ার কোনো ভরসা পাইনা। আমি কোনো ফকিরের কাছে নিজের মেকে বিয়ে দেইনি।খুব ভালো পরিবার,শিক্ষিত পরিবার দেখে বিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু আমি বুঝতেই পারিনি শিক্ষিত আর টাকা পয়সা থাকলেই মানুষের মন মানসিকতা উঁচু হয়না।আপনারা আসতে পারেন।আমি আমার মেয়েকে আর যেতে দেবো না।
নীরার বাড়ির সবাই এতক্ষণে বুঝতে পারে কেন সে যেতে চায়নি।এখন তারা নিজেরা নিজেদের দোষ দিচ্ছে।
আকাশ বহুবার বুঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু নীরা তাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি।সরাসরি বলে দেয় যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
আনোয়ার সাহেব নিজের ঘরে আধো আলোতে বই পড়ছেন।নীরার তাঁর কাছে গিয়ে খেতে আসতে বলেই চলে যাচ্ছিল। তখনই তার তিনি নীরাকে ডেকে নিজের কাছে বসায়।নীরা চুপটি করে বাবার পাশে বসে।আনোয়ার সাহেব বইটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলেন__মা,আমরা জীবনে নিজেরা ভালো থাকার জন্য অনেক কিছুই করি কিন্তু সবকিছুতে ভালো হয় না।সব যদি ভালো হত তাহলে পৃথিবীতে সবাই সুখী হতো।আমরা অনেক সময় অনেক কিছু পছন্দ করি আবার তা ভুল প্রমাণ হতেও দেখি।এতে এটা বলতে পারিনা যে আমি ভুল করেছি আসলে জে জিনিসটা আমি পছন্দ করেছি সেটাই ভুল ছিল।
নীরা নিচের দিক থেকে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে__বাবা,তুমি ভেবো না ।আমি কখনো তোমাকে দোষ দেবো না।তুমি তো আমার জন্য ভালোটাই চেয়েছিলে হয়তো মানুষগুলোই মুখোশধারী ছিল।তাও আমি গর্বিত তোমার মত বাবা পেয়ে।নীরার অনুভব করে তার হাতের উপর কয়েক ফোঁটা পানি পড়েছে।তার বুঝতে বাকি রইলো না তার বাবা কাদছে।নীরা সঙ্গে সঙ্গে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে।