যেদিন ভাইয়া আমাকে আর মাকে ঘর থেকে বের করে দিলো সেদিন কোথাও মাথা গোঁজার ঠাই ছিল না। মা সেদিন বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে তার আদরের ধন যাকে কিনা নিজে না খাইয়ে মানুষ করেছিল, যাকে জীবনেও অভাবের মুখ দেখতে দেয় নি সেই ছেলেটা আজ তার মাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলো! এমনকি আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কয়েকদিনের একটা মেয়ের জন্য তার আপনজনকে পর করে ঘর থেকে বের করে দিলো!
মধ্যবিত্ত পরিবারেই জন্ম আমার। পরিবার বলতে শুধু মাত্র মা,বড় ভাই আর আমিই ছিলাম। বাবা আমার জন্মের দুই মাস আগেই মারা যান যার ফলে বাবার আদর পাওয়াটা কপালে জুটেনি। আমার ভাই জয়নাল আমার থেকে ছয় বছরের বড়। ভাইয়া ছিলো মায়ের মতোই ফর্সা। আর আমি ছিলাম কালো, একদমই কুচকুচে কালো। যার জন্য ছোটোবেলায় কেউই আমার সাথে মিশতো না। আমার একমাত্র খেলার সাথী ছিলো আমার মা আর ভাইয়া। ভাইয়াও আমাকে খুব ভালোবাসতো। মায়ের একটা ছোট্ট ট্রেইলারিং শপ ছিলো যেটা বাবার করে দিয়ে যাওয়া। মা রাতদিন পরিশ্রম করে আমাদের দুই ভাইবোনের পড়াশোনা চালাতেন। ছোট থেকেই কোনো অভাব বুঝতে দেয় নি আমাদের। কিন্তু মা’যে নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়াতেন সেটা আমি আড়ালে লক্ষ্য করতাম।
ভাইয়ার এসএসসি পরীক্ষার সময় কোচিং,স্কুলের বেতন, আমার পড়ালেখার টাকা ইত্যাদির জন্য মা টাকাপয়সা নিয়ে খুব হিমশিম খেতো। একবার মা এক পরিচিত লোকের কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছিলো। সেই লোক মাকে একটা বাজে প্রস্তাব দেয় আর অনেক টাকার লোভ দেখায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমি সব শুনতে পেয়েছিলাম। মা সেইদিন সেই লোকের সামনে থেকে আমাকে সাথে করে টেনে বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর আর কোনদিনই কারো কাছ থেকে কিছুই নিতে চান নি। ভাইয়ার পড়ার টাকা যোগান দিতে আমার পড়াশোনা ছাড়তে হয়। ফলে আমার প্রাইমারী টপকানো হয় নি যদিও তখন ছোট ছিলাম বলে আমার পড়ালেখার প্রতি অনীহা ছিলো।
মা দোকানে আর মানুষের বাসায় কাজ করে খেটে ভাইয়াকে বিদেশ পাঠিয়েছিলো পড়াশোনার জন্য। মা চাইছিলেন না ভাইয়াকে নিজের কাছ থেকে দুরে পাঠাতে, ভাইয়ার জোরাজুরিতেই পাঠানো হয়। বিদেশ থাকা অবস্থায় ভাইয়ার সাথে আমাদের খুব কমই কথা হয়েছিলো। আর কয়েক বছর পর সেইখান থেকে ফিরে এসে ছোট একটা ব্যবসায় হাত দেয়। ছেলে ঘরে ফিরেছে বলে মা কতই না খুশি ছিলেন। আমি ছিলাম আঠারো বছরের যুবতী। আমার গায়ের রঙের কারণে বিয়ে হচ্ছিল না। সমাজের কাছে এ নিয়ে কম কথা শুনতে হয় নি। সবার কথা উপেক্ষা করে পেটের তাগিদে একটা গার্মেন্টসে কাজ করি তখন। আর মায়ের বাতের ব্যথার কারণে রেস্টে ছিলো। ভাইয়া দেশে ফিরে আসায়, ব্যবসা করায় আর আমার কম বেতনের টাকায় সংসার চলছিলো। এরই মধ্যে হঠাৎ ভাইয়া একটা বিয়ে করে নিয়ে আসে। আমি আর মা বিয়ে সম্পর্কে কিছুই জানতাম না যদি ভাইয়া মাঝরাতে তার বউ অর্থাৎ ভাবিকে নিয়ে না আসতো। মা আর আমি তাদের এমন আগমনে চমকিত হলেও ভাইয়ার খুশি দেখে কিছুই বলি নি। ভাবিকেও মেনে নিলাম।
প্রথম প্রথম ভাবি আমাদের সাথে খুব ভালোভাবেই মিলে মিশে থাকতেন। মায়ের খেয়াল রাখতেন, ঔষধপত্র এগিয়ে দিতেন। তবে আমার সাথে কথা একদম কমই বলতেন। হয়তো কালো বলে।ভদ্রতার খাতিরে যতটুকু বলার ততটুকুই বলতেন। কিন্তু সময় যতই যেতে লাগলো ততই আমার আর মায়ের সাথে ভাবি কেন যেন খারাপ আচরণ করতে লাগলো। ভাইয়াও কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেলো। আগে মায়ের সাথে বসে কিছুক্ষণ আলাপ-সালাপ করতো আর এখন মাকে অবহেলা করে সাথে আমাকেও। ভাবি মাকে খালি অবহেলা করতো আর আমাকে গায়ের রঙ ও বিয়ে নিয়ে কথা শুনাতে লাগলো। আর ভাইয়াও যেন ভাবির কথায় তাল মেলাতে শুরু করলো। আমরা যেন তাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি। সেদিন ভাইয়ার রুমের পাশ দিয়ে যেতেই শুনতে পেলাম ভাবি ভাইয়াকে বলছে,
‘ ওই বুড়িটারে এইখানে রাইখা কি হইব বলো তো? প্রতিদিন তোমার মা’র যত্নআত্তি করা আমার দ্বারা বাপু সম্ভব হয় না। আর তোমার ঐ কালা বোনের জন্য মানুষের থেকে আর কত কথা শুনুম, বিয়া ত করেই না উল্টা আমাগো ঘাড়ের উপর বোঝা বাড়াইতাছে। এক কাজ করো, বুড়িটারে ঘর থিকা বাইর কইরা দাও, সাথে ঐ কালা বোনটারেও দাও। বুড়িটা আর কতদিনই বা বাচবো? আমাদের ও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে নাকি? আমাদের ও তো পোলাপাইন হইবো, তাদের জন্যি তো জমাইতে হইবো। তাই আমার কথা শুনো, বুড়ি আর তোমার বোনটারে বাইর করো যত তাড়াতাড়ি পারো’।
ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবলেন। ভাইয়ার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়েছিল যেন সে এই প্রস্তাবে খুশি হয়েছে। ব্যাস এইটুকুই কারন আমাদের ঘর ছাড়ার। ভাইয়ার কারনে পড়ালেখাও করতে পারিনি। পারিনি বললে ভূল হবে। ছোট ছিলাম একটা অনীহা কাজ করতো পড়ালেখার উপর। জানি না আমি মা’কে নিয়ে কোথায় যাবো। কি করবো, কেমন করে একটা আশ্রয় গ্রহণ করবো। এই শেষ জীবনে এসে মা’কে এভাবে বাড়ি থেকে এভাবে বের করে দিবে কে জানতো। আমি কালো, কালো অবহেলার কারন আমাকে ঘর থেকে বের করে দিতো কোন আফসোস করতাম না৷ কিন্তু মা’কে! এটা মেনে নিতে পারিনি আমি।
সারাদিন কিছু খাইনি। সেই সকালে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে আমাকে আর মা’কে। দুইদিন পথে পথে কাটিয়েছি কাছে টাকা নেই, মায়ের মুখে একটুও খাবার উঠিয়ে দিতে পারিনি।আমি কিছু খেতে চাই না, আমার মা’কে যদি এক মুঠো ভাত উঠিয়ে দিতে পারতাম কোন দুঃখ থাকতো না আমার। ক্ষিধে লাগলে রাস্তার পাশের কল থেকে পানি খেয়েছি। মায়ের মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার জন্য হোটেলের ভেতর গিয়ে মালিকের পায়ে ধরতেও দ্বিধা বোধ করিনি আমি।
এ শহরের মানুষ বড়ই স্বার্থপর। কেউ না খেয়ে মারা গেলেও তাদের কিছু আসে যায় না। আপনি দেখবেন রাস্তার ধারের ডার্স্টবিন থেকে যখন খাবার না পাওয়া কোন শিশু অথবা বৃদ্ধ উঠিয়ে নিয়ে সেই পঁচা দুর্গন্ধ খাবার খাচ্ছে আর মানুষ সেটার ফটো তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপ্লোড দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে। অথচ তার উচিত ছিল পথশিশু অথবা বৃদ্ধ মানুষটাকে নিয়ে একবেলা পেট ভরে ভাত খাবার সুযোগ করে দেওয়া। বাড়ি থেকে বের হয়েছি তিন দিন হয়ে গেলো দিন পেরিয়ে রাতের ঘোর অন্ধকারের মধ্যে এখনও আমি আর আমার মা রাস্তার ধারে ফুটপাতেই বসে আছি। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুখ শুকিয়ে গেছে। জানিনা ভাত ছাড়া সে মাত্র কলের পানি খেয়ে কতদিন টিকতে পারবে। সে বোধহয় কোনদিন ভাবতেও পারেনি তার এতো কষ্ট করে মানুষ করা ছেলেটা তাকে এভাবে বৃদ্ধা বয়সে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
আমার অবস্থা নাই বা প্রকাশ করলাম। চুপ করে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে আছি মা আমার থেকে একটি দূরেই বসা। ভাবছি কালকে যেভাবেই হোক মায়ের মুখে খাবার তুলে দেবো দরকার হলে ভিক্ষা করবো। না হলে কারও বাড়িতে কাজ করলে অন্তত একবেলার খাবার তো দিবে এটাই না হয় মাকে খাওয়াবো। আনমনে দূরের আকাশের তারার দিকে চেয়ে ছিলাম একটা মধ্যে বয়স্ক লোক এসে বলল “যাবি এক রাইত ৫০০ দিমু।”
–মানেহ্! এক রাইত ৫০০ আপনি কি বলতে চান?
— কইতাছি যাবি আমার লগে থাকবি ফুর্তি করবি মজা লইবি সকালে আসার সময় ৫০০ নিবি।
— আপনাকে ভালো ভাবে বলছি এখান থেকে যান না হলে আমি চিৎকার করবো বলে দিলাম।
— রাস্তায় বইয়া আছে ৫০০ দিমু কইলাম তাও রাজি হইস না। না হইলি থাক বইয়া শালি। খুব দেমাগ।
তোর চেয়ে কত সুন্দর মাইয়া আছে।
লোকটা যাওয়ার পর দেখি আরেকজনের উদয় হলো। বয়স ২৭ কি ২৮ হবে। এসে বলছে ” এখানে বসে কি করেন? এতো রাত! এই জায়গা তো ভালো না। আপনার বাসা নেই?বাড়ির লোক চিন্তা করবে না?একা একা বাসায় যেতে পারবেন না হলে বলেন আমি পৌঁছে দিই।”
–আপনি কে?আর আমার কাছেই বা কি? দেখেন আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না আমি কোন জায়গায়ই যাবো না যতই টাকা দেন না কেন।
— দেখেন, চিন্তা করার কোন কারন নেই। আমি একজন পুলিশের কর্মকর্তা ভয় পাবার কোন দরকার নেই৷ পারলে আপনাকে সাহায্য করবো কোন ক্ষতি না। এখন বলেন আপনার সমস্যা কি? তারপর তাকে সব তাকে খুলে বললাম। সব শুনে তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমার মায়ের কথা বললাম তিনদিন খায় না সেটাও। জোর করে আমাদের তার বাসায় নিয়ে আসলো। প্রথমে যেতে চেয়েছিলাম না৷ পরে আর কিছু বলিনি মাকে দু’মুঠো খাওয়াতে পারলেই হয়েছে। আর কিছু চাই না।সেইদিন যে সে আমাদের তার বাড়িতে ঠাই দিয়েছে আজ দুই বছর হয়ে গেছে কোন জায়গা যেতে দেয়নি। সব চেয়ে ভালো লাগে এইটা ভেবে তার কেউ নেই দুনিয়ায় সবাই ছেড়ে গেছে এই সুযোগে যদি তার সেবা করে তার ঋণ শোধ করা যায়। তার বাসার সব কাজ আমিই করি আর মা সারাদিন বসেই থাকে ভাইয়ের কথা ভেবে মাঝে মাঝেই ডুকরে কেঁদে উঠে কিন্তু বুঝতে দেয় না আমাকে। আমি তো আর অবুঝ না।
এই দুবছর যে আমি শুধু তার বাড়ির কাজ করে গেছি তা নয় সে-ও আমাকে কিছু দিয়েছে। যখন যা লাগে এনে দেয়। সব চেয়ে বড় বিষয় যখন শুনেছে আমি পড়ালেখা করতে পারিনি। তখন থেকে প্রতিদিন সে থানা থেকে এসে আমাকে পড়াতে বসেন। নিজে পড়িয়ে দেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটাই বড় নয়, সার্টিফিকেট যথেষ্ট না এটা তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
চারবছরের মাথায় সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সেদিন আমি কি বলবো তার এই প্রস্তাবের প্রতিউত্তরে বুঝতে পারিনি৷ তবে এতোটুকু জিজ্ঞাসা করেছিলাম”আমি কালো একটা মেয়ে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান কেন?”
সে বলেছিলো এই চার বছরে এতোটুকু বুঝেছি তোমাকে বিয়ে করলে আমার জীবন অসুখের হবে না।তার একটা ভালো জীবন চাই চেহারা কোন ফ্যাক্ট না। সারাজীবন সুখের ভাগীদারি করলেই হবে। ভালোবাসি তোমায়।
ব্যাস আমি আর কিছু বলিনি৷ বিয়ে হয় আমাদের তার যতটুকু পারা যায় খেয়াল রাখতে চেস্টা করি৷ আমাদের বিয়ের সময় মা’কে অনেক হাসিখুশি দেখেছিলাম । হয়তো মা ভেবেছিলো আমার বোধহয় কোনদিন বিয়েই হবে না। কিজানি আল্লাহ কার ভাগ্যে কি রেখেছে! বিয়ের দুইবছরের মাথায় মা মারা যায়। শেষ ইচ্ছা ছিল ভাইয়াকে একটু শেষ দেখা, পূরণ হয়নি।
সব দুঃখ দুর্দশা কাটিয়ে আমার স্বামী হাসানের সাহায্যে খুললাম নাইট স্কুল যেখানে পড়ানো হয় পথশিশু আর সমাজের নিপিড়ীত মহিলাদের শেখানো হয় তাদের অধিকার আদায় করা৷ বেশ ভালোই চলছে সব। ভালোবাসি তাকে খুব, সে-ও আমাকে খুব ভালোবাসে। এভাবেই জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই দুজন। ‘জীবনের শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেন দেখেন হয়তো আপনার শেষটা আপনার ধারণার থেকেও ভালো হবে৷ উপর ওয়ালা নিশ্চয় আপনার জন্য ভালো কিছু রেখেছে।’