কোমড়ে বেল্ট বেঁধে সবে প্যান্টের জিপারটা আটকাতে যাচ্ছি অমনি বিছানা থেকে ঘোর জড়ানো একটা কন্ঠ এগিয়ে এলো, “সেক্সুয়াল এবেলিটি ইজ নট ব্যাড বাট পারফর্মেন্স আরেকটু জোরদার; আশা করাই যেত। পরেরবার থেকে ডিউরেশনের দিকও লক্ষ্য রাখবেন।”
কথা শেষ হতেই খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো মেয়েটা। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। এরপর আর কীই বা বলার থাকে? খানিকটা যে লজ্জা পাইনি তা কিন্তু নয়। আমি গলা নামিয়ে দ্রুততার সাথে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি!কয়েক পশলা বৃষ্টিতে কাঁদা প্যাঁচপ্যাঁচে গোটা শহর। ফুঁসে ওঠে ড্রেনের জল। হাঁটু অব্দি নোংরা। পথঘাট ডুবে একাকার। বিদঘুটে পরিবেশের সৃষ্টি। হঠাৎই একটা কাকা গলা ফাটাতে ফাটাতে কার্নিশে এসে পড়লো। বেজায় চেঁচাচ্ছে।কাকটা ভিজে চুপচুপে। এতোটাই ভিজে গেছে যে ভালোভাবে উড়তে পারছে না। ওখানেই তাকিয়ে ছিলাম। ততক্ষণে মেয়েটা লাল বিকিনিটাতে স্বশরীর এঁটে নিয়েছে। ফর্সা শরীরটাতে লাল কাপড়টা যেন মাখোমের মত চেপে বসেছে। তাকানো যায়না সেদিকে। শরীর ঝাঁঝিয়ে ওঠে; দৃষ্টি পিছলে পড়ে তাতে। তালগোল পাকিয়ে যায় চোখের ভেতর।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়াল মেয়েটা। এরপর বারান্দার রেলিংএ মুখ ছুকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বাইরে চেয়ে আছে। বৃষ্টির ছাট রেলিং ছুঁয়ে ওর মুখে এসে পড়ছে। ফোঁটা গুলো ঘাড় বেয়ে এঁকেবেঁকে নিচের দিকে তরতর করে ছুটছে।চুল গুলোও ভিজছে। মেয়েটার সেদিকে খেয়ালই নেই। অদ্ভুত বিষয়! কেন যেন ওর দিকে তাকাতেই পারছি না। তাকালেই আশ্চর্য রকম ভাবে গতরাতের উল্লাসঘন মূহুর্তের দৃশ্য গুলো চোখের ভেতর ফুটে উঠেছে। অচেনা অজানা একটা মেয়ের এমন গভীরতম স্পর্শ বিব্রত বোধের সৃষ্টি। উপরন্তু আমার দক্ষতা নিয়েও ওমন সম্মুখে কাটাকটা কথা। মৃদু মাথা দুলিয়ে; চোখবুঁজে জিভ কাটলাম। ছিঃ ছিঃ! “আপনি এতোটাও সহজ নন যেটা এই মুহূর্তে আমি ভাবছি।এতো চুপচাপ থাকেন কী করে বলুন তো?আদৌতেও এতোটা ইনোসেন্ট কী?”
আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলাম। বললাম,
“ টেবিলের উপর গ্লাস চাপা দিয়ে বিল রেখে এসেছি। আপনি এবার আসতে পারেন।”
“তাড়িয়ে দিচ্ছেন?” এবারও চুপ করে রইলাম।আবার বললো,
‘‘এতো বড়ো বাড়িতে আপনি একাই থাকেন? কাউকে দেখছি না যে।”
মেয়েটার চারিত্রিক পরিবেশ ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। প্রস্টেটিউট দের এতোটা কিউরিসিটি দেখানোর ঠিক না।যে কাজের জন্য আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ হলে পাওনা বুঝে বিদেয় হওয়া জরুরি, এর থেকে বেশী কিছু কী আছে? এতোটাও গায় পড়া স্বভাব এদের মানায় না। বাড়িতে এনে কোনো ফাঁদে পড়লাম কিনা কে জানে? সন্দেহ বিষয়টা এতো কোমল হয় আগে জানতাম না।
“হ্যাঁ’ একাই।তবে দুপুর রেঁধে দিয়ে যায় বিন্তি।”
“বিন্তি?”
“কাজের মেয়ে।”
“ তো আপনার দম বন্ধ হয়ে আসে না। আমি হলে তো কবে মরে ভূত হয়ে যেতাম। আমি একা একা থাকতে পারি না।আমাকে কথা বলতেই হবে।দেখেন না কেমন বকবক করছি।ও ভালো কথা,একটা প্রশ্ন করতে পারি? ”
“জি। বলুন।”
“আমার উপর রাগ করেননি তো?” আমি ভ্রূকুটি করে কৌতুহল দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালাম।
“ না মানে।এইযে; আপনার সেক্সুয়াল বিষয়গুলো বাড়াবাড়ি ভাবে উপস্থাপন করলাম।এতে আপনি রাগ করেনি তো?”
কিছুই বললাম না। দৃষ্টি ঘুরালাম বাইরের দিকে। বৃষ্টিটা মোটামুটি ধরেছে।মেয়েটা কিন্তু এবার যেতে পারে। আকাশে ঘনমেঘ জমে আছে আবার বৃষ্টি আসার শংকা। সুতরাং এখনই যাওয়া উচিত।
“কী বলছেন না কেন? রাগ করেছেন কী?”
“না।রাগ করিনি। বৃষ্টি থেমে গেছে, এবার বোধহয় যেতে পারবেন।”
“বাপরে! এতো তাড়া আপনার? অনন্ত এক কাপ চা? আচ্ছা আপনাকে করতে হবে না। আমিই করে আনছি। কিচেনটা দেখিয়ে দিন। স্পেশাল টি। বৃষ্টির জলে লেবু চা। কখনো খেয়েছেন?”
“চা তেমন পছন্দ নয়।”
“ আজ তো আপনার পছন্দ হতেই হবে। ওয়েট! কিচেন টা যেন কোথায়?আহ্ হা,বলুন না।”
মেয়েটা বাড়াবাড়ি রকমের একগুঁয়ে প্রকৃতিস্থ। কথাবলার ধরনেরই তা প্রকাশ পায়।তবে হ্যাঁ! ওর কথার মধ্যে একধরনের মোহ আছে।সত্যিকার অর্থে বোধহয় সকল নারীর মধ্যেই সেটা বিদ্যমান। যেটা উর্মিলার মধ্যেও ছিল। উর্মিলা! বুকটা ছলাৎ করে উঠলো।একটা ধনুকের ফলা এফোঁড়ওফোঁড় করে গলার মধ্যে বিঁধে পড়লো। পাঁজরের দেয়ালে হৃৎপিণ্ডের দাপাদাপি বৃদ্ধি পাচ্ছে।ওই একটা নাম।খোব ঘৃণা হিংস্রতা জগতের যত নিকৃষ্ট তকমা সব এই ওই একটা নামকেই ঘিরেই।
“কী বলছি নিয়ে চলুন, কিচেন টা কোথায়? অদ্ভুত লোক আপনি। হারিয়ে যাওয়ার বাতিক আছে দেখছি।?”
“না মানে,আচ্ছা চলুন।”
আজ আবার বৃষ্টি! সন্ধ্যা থেকে শুরু আর এখন সকাল। আমার কাছে সকালের বৃষ্টি ভালো লাগে।এই ভালোলাগার স্পেসিফিক কোন কারণ নেই।সেই ভালোলাগা থেকেই মেয়েটাকে আজ খুব করে মনে পড়ছে। কেন মনে পড়ছে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বারবার নৃশংস অতীত স্মৃতি গুলো মস্তিষ্কের বালুচরে আছড়ে পড়ছে বারবার। বালুচর শব্দটা এখানে কতটা যুক্তিযুক্ত আমার জানা নেই।হুট করেই মাথা আসলো। উর্মিলার চলে যাওয়ার পর এই ‘হুট হাট’ শব্দগুলোর সাথে বেশ পরিচিত হয়ে পরেছি।এই যেমন আজ আবার হুট করেই ওই মেয়েটার কথা মনে পড়ছে।
মোবাইলটা বারকয়েক হাতে তুলেছিলাম মেয়েটাকে আবার ফ্লাটে ডাকব বলে। কিন্তু না। পারেনি।অজানা এক দ্বিধাবোধ কাজ করছে ব্রেনে।কী ভাববে মেয়েটা? যদিও শারীরিক কোনো চাহিদা থেকে নয় নিতান্তই কথা বলার খাতিরে। কিন্তু ও এটা বিশ্বাস করবে কী? উর্মিলার চলে যাওয়ার পর বিষন্নতার ভুবনে জরিয়ে গিয়েছিলাম। ঘরদোর অন্ধকার করে বসে থাকতাম।চোখ বন্ধ আর খোলার পার্থক্য ছিল না। খাবারদাবারের অনিয়ম নিত্যসঙ্গী।ভুলেই গিয়েছিলাম বাইরের জগত। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমুল পরিবর্তন এসেছে। একা একা থাকায় বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। নিরিবিলি থাকতে চাইলেও বোর হয়ে যাচ্ছি। অদ্ভুত অনূভুতি।নারী জাতি বড়ো রহস্যময়।প্রকৃতি,পরিবেশ বদলাতে জানে। আমি কী সেই রহস্যের জালে জড়িয়ে যাচ্ছি? গেলেও ক্ষতি আছে কী?
যদিও প্রফেশনাল প্রস্টেটিউট মেয়েদের নিয়ে এতো কিছু ভাববার অবকাশ নেই। নিতান্তই ভালোলাগা আর শারীরিক আসক্তি ব্যতিত অন্য কিছু নয়। সে যাই হোক।আমি তো তাকে পারিশ্রমিক দেব। কাজটা শরীর কেন্দ্রীক হোক কিংবা না হোক। তবুও মনটা কেমন সায় দিচ্ছে না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কল করে বসলাম। ওপাশে কয়েকবার ঘড়ঘড় শব্দ করে ফোনটা রিসিভ হলো।
“হ্যালো! কে বলছেন?”
চুপ করে আছি।আমার এই চুপ করে থাকার অভ্যাসটা বদ অভ্যাসে রুপ নিয়েছে।এই স্বাভটা অনেকেরই পছন্দ নয়। আমার নিজেরও ভালো ঠেকছে না।কেমন বগরুটে বোকা কিসিমের। ওপাশ থেকে কয়েকবার ‘হ্যালো হ্যলো’ বলা হয়ে গেছে ততক্ষনে।আমি বললাম,
“আজ আরেকবার আসতে পারবেন কী?” মেয়েটা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ও আপনি? তো এতো দিন পরে মনে পড়েছে তাহলে?”
“ চিনেছেন কী?”
“ সন্দেহ আছে? আপনি সেই নিশ্চুপ আর ভীতু স্বভাবের ভদ্রলোক,তাই তো?” এরপর আমার বাড়ির ঠিকানা, ফ্লাট নম্বর প্রভৃতি হরহর করে বলে গেল।আর শেষে বললো,“ জাষ্ট আধাঘণ্টা অপেক্ষা করুন চলে আসছি।”
বলেই কলটা কেটে দিয়েছে। মনে মনে আশ্চর্যই হলাম।মেয়েটার মধ্যে ভিন্নতা আছে। অবাক হওয়ার বিষয় গুলোর অন্ত নেই। বিচক্ষণতার পরিচয়ে দিয়েছে প্রথম দিনেই।জীবনে ভালো কিছু করতে পারতো।সব ফেলে এ পথটাকেই বেছে নিয়েছে কেন? এমন প্রশ্ন করা আমার কর্ম নয়।প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতা আছে।যে যেভাবে ভালো থাকে সেভাবেই জীবন লিড করতে চায়।যেমনটা উর্মিলা করেছে। স্বাধীনতা খুঁজতে তিনবছরের বৈবাহিক জীবনকে থামিয়ে দিয়েছে মুহূর্তেই।মুক্তি নিতে চেয়েছে আমার থেকে; এবং তা করেছেও।
হয়তো মেয়েটাও এই পেশাতেই জীবনের স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছে।ব্যক্তিগত নিজস্বতায় কারো হস্তক্ষেপ আমার ও পছন্দের বাইরে। সুতরাং এই বিষয়ে কৌতুহল দমানোই উত্তম।আমার কী? ডোর বেল বাজতেই বুঝলাম চলে এসেছে।দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললাম। হ্যাঁ! অপরিচিত মুখ নয়। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে। “এইরে! একেবারে ভিজে গেছেন। ভেতরে এসে চেঞ্জ করে নিন।” “সামনে থেকে না সরলে ভেতর আসব কিভাবে?”
আমি পাশকেটে জায়গা করে দিলাম।ভিজে পায়ের ছাপ ফেলে ভেতর চলে এলো।ভেজা জুতোয় পচপচ শব্দ হচ্ছে।কানে বিশ্রী রকমের বাঁধছে। দরজা লক করে ফিরে এলাম। ততক্ষণে ওয়াশরুমে চলে গেছে। মাঝেমধ্যে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে মূর্খ মানব হিসেবে মনে হয়। এই মূহুর্তে যেটা বোধ হচ্ছে। মেয়েটার নাম পর্যন্ত জানিনা। নির্বোধ! নির্বোধ। মস্তবড় নির্বোধ। যাই হোক! আজ জেনে নেয়া যাবে।