আফসোস

আফসোস

মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে অফিসে জয়েন ডেইট আজ। অফিসে পা দেওয়ার সাথে সাথেই রফিক সাহেব বলে উঠলেন,

-মিরা তোমাকে তো চেনায় যাচ্ছে না। পাট কাঠি কিভাবে এমন বস্তা হলে?

কথাটা খুব খারাপ লাগল। বেবি হওয়ার পর বাসার সাবাই বেবিকে নিয়ে এত বিজি আমাকে কেউ এই কথা কখনো বলে নি। আমি বুঝেছি। আগের একটা ড্রেস ও হচ্ছে না। এমন কি নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না। কারণ একটু বাইরে গিয়ে নিউ ড্রেস কিনবো সে টাইম টা ও করে উঠতে পারছিলাম না৷ তাই শাড়ি পড়েই চলে আসলাম। কিন্তু কখনো খারাপ লাগে নি। বাইরে পা দেওয়ার সাথে সাথে এমন কথা শুনবো আসলে ভাবি নি। দেখলাম সবাই আমি কেমন আছি বাবু কেমন আছে জানতে চাওয়ার আগে জানতে চাচ্ছে এমন মোটা হলাম কি করে? আমি আমতা আমতা করে বললাম-

-বাবু হওয়ার আগে যে মোটা হয়ছি আর কমে নি। সাহেলা আপা এসে আস্তে আস্তে বললেন,
-বাবুর ছয় মাস না? আস্তে আস্তে ফিডার, সেরিলেক দিবি আর নিজের খাবার কমাবি। এইসব কথা শুনে নিজেরও আসলে অস্বস্তি লাগা শুরু হয়েছে। আমি কি এত বাজে হয়ে গেছি? আগে অফিসে কি টিপটপ করে আসতাম। ম্যাচিং শাড়ি ব্লাউস দুল টিপ জুতা। একটা আইডেল ছিলাম। সবাই বলত –

-এত সুন্দর করে সাজ কিভাবে? তারপর ও চুপচাপ নিজের কাজ করছিলাম। রাবিয়া এসে বলল-
-আমার বোনেরও গত মাসে সেকেন্ড বেবি হলো তোর অর্ধেক ও হয় নি। তোকে চার বাচ্চার মা লাগছে। কম খাবি এখন থেকে।

কথাটা যেন খুব কষ্ট থেকে বলছে। আর আমি সারাদিন খেয়ে খেয়ে বসে আছি। আসলে আগের তুলনায় এখন একটু বেশি খাওয়া দাওয়া হয়। বেবি খেলে আরো বেশি করে লাগে খিদা। বাসায় আসার সময় মনে মনে ঠিক করলাম এখন থেকে খাওয়া কন্ট্রোল করব। আসলেই আমি অনেক মোটা হয়ে গেছি নইলে সবাই এত বলবে কেন। বাসায় এসে মেয়ে আমায় দেখে কি খুশি। আমার বুকে এসে শুয়ে পড়ল। মুখে দুধ দিতেই পিটপিট করে তাকিয়ে খেতে শুরু করল। আহ এই যেন পরম সুখ ।

রাতুলের মামাতো বোনের বিয়ে। প্রায় বছর খানিক পর কোন প্রোগ্রামে এটেন্ট করব। মজা লাগছে। আগে তো কোন প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য সকাল থেকে রেডি হতাম। স্যম্পু করে চুল শুকানো ড্রেস এর সাথে ম্যাচ করে নেইলপালিশ। সেট, দুল, চুড়ি বের করে রাখা। ফেসপ্যাক দিয়ে রাখা মুখে। আর এখন কোথায় যাওয়া আগে কাজ এগিয়ে রাখা। বাবুর কাপড় চোপড় তারাতাড়ি শুকাতে দেওয়া। বাইরে যাওয়ার আগে একবার বাবুকে খাইয়ে নেওয়া বাইরে যাওয়ার পর আরেক বার খাওয়া নিয়ে রাখা। এক্সট্রা ডায়পার, দুই জোড়া কাপড়ের সেট, উইসপার। সব সাথে গুজিয়ে রাখা। এত কিছু পর রেডি হতে গেলে মাঝখানে আবার বাবু হাগু দিলে আবার পুরোটা পরিস্কার করা। তারপর ও রাতুল এসে বলবে

– এতক্ষন লাগে রেডি হতে? তোমাদের মেয়েদের নিয়ে কোথাও যাওয়া না।

সমস্যায় পড়লাম কি পড়ব তা নিয়ে। এখন ভারী শাড়ি গুলো পড়লে বাবু ব্যাথা পাবে কোলে নিলে আর খাওয়াতে অসুবিধা। পাতলা শাড়ি গুলো বাজে লাগছে ভারী শরীরে। আগে কেমন পেচিয়ে থাকত। আর সুতি শাড়ি পড়ে কি বিয়েতে যাওয়া যায়? তারপর ও সব পছন্দের পুতি পাথরে নেটের শাড়ি থেকে মায়ের দেওয়া একটা সবুজ কাতান পড়লাম। কিন্তু ইস ব্লাউস একটাও হচ্ছে না। কেমন যেন ক্যাটক্যাটে লাগছে সবুজ শাড়িটা গায়ে।অনেক ফোলা ফোলা হয়ে আছে রাতুল এসে বলল –

-এইটা কি পড়েছো? সবুজ হাতি লাগছে। আমার কান্না চলে এলো রাতুলের কথা শুনে। তাও টাঙ্গাইল শাড়ি পড়লাম। রেডি হলাম। চুল গুলো ভাল করে বেধে ফেললাম যাতে বাবুর গায়ে না লাগে। আয়না দাঁড়িয়ে নিজেকে আমার আমার মা মাসিদের মতো লাগছে। সাধারণ মহিলা টাইপ। অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর ও সবার এক কথা

-অবুক এত মোটা হলে কেন? খাওয়া কমাও। রাতুলের সাথে ছবি উঠতে গেলাম৷ আমার ভাইয়ে বলছে,
-আরে তুমি তো ফটো ফ্রেমে আটতেছো না। অন্য একজন বলে উঠল
-জামাইরে তো তোমার চেয়ে ছোট লাগছে।

সবাই মজা করে কথা গুলো বললেও কেমন যেন খুব খারাপ লাগছিল। রাতুলও দেখি দাত বের করে হাসছে। আমি বাবুকে নিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসে রইলাম। মা এমন কিছু বলে না। বাবুকে নিয়ে আদর করে, আমার শাড়ি ঠিক করে দেয়। টুকটাক কথা বলছে।

রাতে এসে ছবি আপলোড দিলাম ফেসবুকে অনেক দিন পর। এইখানেও শান্তি নেই। ফেসবুকের কমেন্ট গুলো যেন আরো বাজে। আন্টি লাগছে, ছোট হাতি, চালের বস্তা, লেডি হার্ল্ক। কি অদ্ভুত আমি নিজেই অবাক হচ্ছিলাম আমার বান্ধবী গুলো বলছে এইসব। খারাপ লাগল। ডিলিট করে দিলাম। আমার খারাপ লাগাটা কারো চোখেই পড়ল না৷ আমি খাওয়া কমানোর চেষ্টা করছি। এতে বাবু খাওয়ার পর আমার মাথা ঘুড়ায় উঠে। দুধের ফ্লো কমে যাচ্ছে, বাবু কান্নাকাটি করে। না, ঠিক করলাম যে যা বলুক। আমি আগে নিজের এবং নিজের মেয়ের কথা চিন্তা করব। এখন কেউ কিছু বললে হাসি মুখে উত্তর দিই। কেউ যদি বলতে আসে,

– এত মোটা হলে কেমনে, কম খাও। আমি বলি,

-চাল তো আপনার যাচ্ছে না। কিংবা জায়গা ও কম পড়ছে না আপনার। নিজেকে দেখুন আগে। শার্টের বোতাম তো ফেটে যাচ্ছে। যখন উত্তর দেওয়া শুরু করলাম কেউ আর তেমন বলে না যে যার মতো চলে। রাতে রাতুল বাচ্চাকে বুকের উপর বসিয়ে খেলছিল।

-ওমা, আমার ছোট হাতি ছোট হরিণ। মা দেখো খেয়ে খেয়ে কত্ত মোটা হয়েছে। তোমাকে কিচ্ছু দেয় না, তাই না? কথা গুলো খেলার ছলে বললেও আজ চুপ থাকলাম না৷ রাতুল কে বললাম,

-রাতুল, বাচ্চাটা কার?
-আমার।
-তো তোমার বাচ্চা জম্ম দিতে তো আমি এত কিছু করেছি। তোমার শরীরের তো কোন চেঞ্জ হয় নি। ভিতরে এত দিন কষ্ট করে আমি রেখেছি। হওয়ার পর রাত দিন আমি তাও সব করেছি। যখন রাতে আট-দশবার উঠে দুধ খাইয়েছি তখন তো তুমি ঘুমাতে আরামে।

তুমি যখন সকালে হাটতে যেতে আমি সারারাতে ক্লান্তি নিয়ে বাবুকে বুকে নিয়ে শুয়ে ছিলাম। তুমি আসার আগে নাস্তা বানিয়ে দিয়েছি। তুমি ডিম পোস আর রুটি দিয়ে নাস্তা করছ যখন আমি ভাত নিয়ে বসেছি সারারাত বাবুকে খাইয়ে ক্ষিধেতে কাহিল আমি। আমি যখন বাবুকে খাওয়ানো হিসু করে পালটানো এইসব নিয়ে দিন কাটিয়ে ড্রিপ্রেশনে দিন কাটাচ্ছিলাম তুমি তখন অফিস শেষে দিব্যি বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে বাসায় ফিরে বাবুর সাথে খেলে ঘুমাতে গেছো। 5 মিনিট কথা বলতেও আসনি। কাছে আসা তো দূরের কথা।

-আমি তোমার সমস্যা হবে ভেবে তো,
-আচ্ছা। এই যে আমি মোটা হয়েছি সারাক্ষন বলতে থাক। তাই বুঝি ভালবাস না?
-কি যা তা বলছো? এইসব কখন বললাম? ভালবাসব না কেন? এইবার আমি কান্না করেই দিলাম।
-আমি জানি, আচ্ছা আমি যদি আবার আগের মতো হয়ে যাই তুমি আমায় আবার আগের মতো ভালবাসবে? রাতুল বাবুকে রেখে কাছে এসে বলল,

-দূর পাগল মেয়ে, আমি এইসব কখনো চিন্তা করি নি। আমি তোমাকে আগের মতো ভালবাসি এখন আরো বেশি কারণ তুমি আমার মেয়ের মা। হিচকি দিয়ে কান্না করতে করতে বললাম,

– তাহলে সারাক্ষন মোটা মোটা কর কেন? আমার খুব খারাপ লাগে।
– I am sorry মিরা। আমি আসলেই বুঝিনি আমাদের সবার মজাটা তোমাকে বডি সেমিং এ ফেলছে। নিজেকে এতটা ডিপ্রেসড করে ফেলেছো তুমি ভাবছো আমি তোমাকে ভালবাসি না তুমি মোটা হয়েছো তাই। sorry মিরা আমার বোঝা উচিৎ ছিল তোমার এইসব চেঞ্জ তো বেবির জন্য। মেয়ে তখন কান্না করে উঠায় ওকে বুকে নিয়ে বললাম,

-বাচ্চার জন্য সবটা করতে রাজি। শুধু আপন মানুষ গুলোর একটু সার্পোট পেলে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠি। মেয়েরা নিজের সবটা ছেড়ে একটি প্রান নিজের মাঝে গড়ে তুলে দিনরাত শুধু বাচ্চার জন্য ধ্যান-জ্ঞান করে। কোনদিকে নিজের গ্লামার, চাকচিক্য, পারফেক্টনেজ ছেড়ে মা হয়ে উঠে তা নিজেও জানে না। কিন্তু তার জন্য কখনো কারো মনে দুঃখ থাকে না। কিন্তু বাইরে মানুষের এইসব কথায় নিজের কনফিন্ডেস টা কোথায় নামিয়ে দেয় তা একবার কেউ চিন্তা করে না বলার আগে। হয়ত আবার ওজন কমে যাবে কিন্তু যে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দাও তা হয়ত চিন্তার বাইরে।

রাতুল কিছু না বলে চুপ করে জড়িয়ে ধরে থাকে। বছর খানেক পর। আমার ওজন আপনা আপনি কমে গেছে। আজ রাবিয়া ফিরেছে মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে। ওকে নিয়েও সবাই এমন কথা বলছে। কিন্তু এই মেয়েটা জিন্স আর টপ ছাড়া কখনো কিছুতে স্বস্তি পেতো না। আজ শাড়ি পড়ে এসেছে। এইসব শুনছে। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম,

-এইসবে কান দিস না। তোর যেটাতে comfortable লাগবে তুই পড়বি। it doesn’t metter what other say. আর শোন তুই still beautiful. আর এখন আরো বেশি সুন্দর তুই। কারণ তুই এখন মা। আর মায়েরা কখনো অসুন্দর হয় না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত