আমার দাদুঠাম্মা

আমার দাদুঠাম্মা

অনেক বছর ধরে চেষ্টা করে করে শেষে একটা চাকরি পেলাম, পেলাম বললে আমার চেষ্টার সাপেক্ষে বড় ছোট করা হয়; বলা ভালো লাভ করলাম। পোষ্ট অফিসে চাকরি! রবি ঠাকুরের পোষ্টমাস্টারের মতো একেবারে ধ্যাধধেরে গাঁয়ে গিয়ে পড়লাম। কী করি! অনেক কষ্টে পাওয়া চাকরি, ছাড়তে তো পারি না! জামাকাপড় গুটিয়ে পাটিয়ে চলে এলাম একদিন। হোটেল, রেষ্টুরেণ্ট কিচ্ছু নেই। থাকার জায়গা বলে পোষ্ট অফিসের চাতাল। অবশ্য ভেতরে থাকলেও হতো, কিন্তু যা ইঁদুর আর আরশোলা, চাতালে একটু কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে থাকা বরং বেশী নিরাপদ।

তবে সেটাও দরকার হলো না। গ্রামের লোক বেশ ভালো। একটু খোঁজ লাগাতেই মণ্ডলবাবু বলে একজন ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে এসে বললো-“এঁজ্ঞে, আমারই একটা বাড়ি আছে। দু’টো ঘর আর বারান্দা! বন্যার সময় বসতবাড়িটা জলে ডুবে যায় কিনা, ওদিকটা একটু উঁচু তাই ওখানে খড়টর রাখি। আপনি চাইলে একটা ঘরে থাকতে পারেন!”

শেষে গোলাবাড়িতে থাকবো! কিন্তু কিন্তু করতে লাগলাম। কিন্তু সেটাও ওই এক দু’মিনিট। ভাড়াটা শোনার পর আর কিছু সমস্যাই থাকলো না। এই ভাড়াতে যে ভূতের বাড়িও ভাড়া পাওয়া যায় না!
সেদিন দুপুরটা মণ্ডলবাবুর বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করলাম। এরাই এখানকার মধ্যে একটু বড়লোক গোছের। মণ্ডলবাবুর দুই মেয়ে! একজন বিধবা, আরেকজনের সামনের মাসে বিয়ে। যত্ন করে খাওয়ালো দুজনে। খুব ভালো লাগলো! এরা কী ভালো! যৎসামান্য মাইনেতে বাড়িভাড়া দেয়, তার উপর ঘরে ডেকে খাওয়ায়!

একটুখানি কাজটাজ বুঝে নিয়ে মণ্ডলবাবুর সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। সঙ্গে কালু বলে একজনকে ডেকে এনেছেন মণ্ডলবাবু। ঝাড়াঝাড়ি করতে হবে তো!

তালা খুলে ঢুকতেই একঝাঁক বাদুর উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। ওরে বাপরে! গল্পের বইয়ে তো পড়েছি এইসব পুরোনো বাড়িতেই ভূত থাকে, তারা সব বাদুর হয়েই ঘুরে বেড়ায়! দুবার রাম রাম বলে পা দিলাম ঘরের মধ্যে!

-“এই হলো গে আপনার ঘর!”- কান অব্দি হেসে বললেন মণ্ডলবাবু।

আমিও উত্তরে হেঁ হেঁ করে একটা হাসি উপহার দিলাম।

-“যা কালু! বাবুর ঘরটা সাফ করে দে! ওইদিকে বালতি আছে দু’টো! জল ভরে দিস রাতের মতো! কাল জলের ড্রাম আনিয়ে দেব! হেঁ হেঁ, কোনো অসুবিধে হবে না তো আপনার?”

আর অসুবিধে! এমনিও তো আর সোনার চামচ মুখে জন্ম নয় আমার! এত কম ভাড়ায় কোনো উপদ্রব ছাড়া ঘর যে পেয়েছি তাই খুব!

কিছুক্ষণের মধ্যেই সাফসুতরো করে জল এনে দিয়ে চলে গেল কালু। বলে গেল কাল আবার আসবে! মণ্ডলবাবুও বিদায় নিলেন রাতের নেমন্তন্ন করে। ভালোই হলো! রাতে আর রান্না করতে হবে না! কাল একটা ছোট গ্যাস আনানোর ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন মণ্ডলবাবু। নিজেই দুটো করে ফুটিয়ে নেব!

ঘরে ছোট একটা চৌকি আছে। সেখানে বিছানা পেতে দিয়েছে কালু। বালতির জলে হাত পা ধুয়ে বিছানায় এসে বসলাম। সন্ধে হয় হয়, তবে রোদ আছে এখনো! চারপাশ থেকে ঘরে ফেরা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। হাতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। আজকের মতো মোমবাতি জ্বেলে নিতে হবে! এমনিও নাকি এখানে বেশীরভাগ দিনই লোডশেডিং থাকে। সারাদিনের ধকল, বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া…
ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এল।

.
-“এটা আবার কে?”
-“ওই মণ্ডলের ভুঁড়ি মটকাতে না পারলে আমার নামও সনাতন নয়! ছোঁড়া দুটো দিন শান্তি করে থাকতেও দেবে না! একবার একে পাঠাবে একবার ওকে…”
-“যত বুড়ো হচ্ছো বেশী আবোলতাবোল বকছো তুমি! ভুঁড়ি আবার মটকানো হয় নাকি! ঘাড় মটকানো হয়! আর হলেই বা কী! আমরা কি কারোর ঘাড় মটকাই নাকি! আমরা নিরামিষ ভুত!”

কারা যেন কথা বলছে। স্বপ্ন দেখছি! ওরা কারা! কেমন কথা বলছে গ্রাম্য টানে!
আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার! চারপাশ নিঃঝুম! প্রথমে খানিকক্ষণ বুঝতেই পারলাম না কোথায় আছি কেন আছি। আস্তে আস্তে মনে পড়লো সব! সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, রাত পেরিয়ে যায়নি তো! মণ্ডলাবাবুদের কি খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল!

-“তুমি কে বাচা?”
চমকে উঠলাম! সত্যি না স্বপ্ন!
-“কে বাবা তুমি?”
নাঃ! সত্যি!
ঘাবড়ে গেলাম। ভেতর থেকে ঘরের দরজা লাগিয়েছিলাম! কে কথা বলছে!
ঢোঁক গিলে বললাম-“আমি অম্লান বোস! আপনারা কারা?”
-“অ! অম্ল!”- ঠাকুমা ঠাকুমা গলায় উত্তর এল।
-“না না অম্লান!”
-“ওই হলো বাচা! যাই অম্ল তাই অম্লান! তা একেনে কী করচো?”
-“আপনারা?”
এবার একটা বুড়ো গলায় উত্তর এল-“আমরা ভুত! মানুষ মরে গিয়ে যে ভুত হয় সেই ভুত!”

আঁতকে উঠলাম। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। অজ্ঞান হয়ে যাব মনে হচ্ছে! কোনোরকমে বললাম-“মা -মানে?”
-“কেন বাচা! ভুত বলে কোনো জিনিসের নাম শোনোনি?”

আমি তখন বৈশাখের দুপুরের মতো ঘামছি, পৌষের রাতের মতো কাঁপছি! কোনোরকমে বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলাম-“রাম রাম রাম রাম রাম রাম…”

হেঁ হেঁ করে হাড় হিম করা হাসি শোনা গেল এক বৃদ্ধের। বৃদ্ধাটি হাসতে হাসতে বললো-“ওসব ভজে লাভ নেই বাচা! সকালবেলা উঠে আমরাও ওসব ভজি! স্বর্গলাভ করতে হবে কিনা! এই যে আমার উনি, এতদিন তো মরা বলতেন, পাপী ছিলেন কিনা! এই এদ্দিনে রাম বেরিয়েচে মুখে!”

ভয় পাব নাকি অবাক হব নাকি হাসবো নাকি কাঁদবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কী আজব ভুত রে বাবা! রামনাম করে! এরা তাহলে ভালো ভুত! একটু সাহস করে বললাম-“তা আপনারা আমার কাছে কেন?”

এবার গলা খাঁকারি দিল বৃদ্ধ। গম্ভীর গলায় বললো-“আমাদেরও তো সেই একই প্রশ্ন! তুমি এখানে কী করতে?”
-“এই যে আমি এখানে চাকরি করতে এসেছি! মণ্ডলবাবু ভাড়া দিয়েছেন আমাকে!”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ভেংচে উঠলো বৃদ্ধ। বললো-“হুঃ! মণ্ডলবাবু! ওই হারা নাকি বাবু!”
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর বৃদ্ধ বললো-“তা শোনো বাপু, তোমাকে যেই ভাড়া দিয়ে থাকুক, আমাদের সোজাসাপটা কথা শুনে রাখো! কাল সন্ধের মধ্যে, আহা, মানে তোমাদের গুনতিতে কাল সকালের মধ্যে এ ঘর খালি করে দেবে! এ ঘরে আমরা থাকি! অন্য কাউকে এখানে সহ্য করবো না আমরা!”

ইসস! এত ভালো জায়গা পেয়েছিলাম! সেটাও কিনা ভুতের জন্য ছেড়ে দিতে হবে! এতক্ষণ কথা বলতে বলতে ভয়টাও চলে গেছে বেশ। কাঁচুমাচু করে বললাম-“ইয়ে, দাদুঠাকমা, বলছিলাম যে, ভুতই যখন তখন আর বাড়িঘরে মায়া বসিয়ে লাভ আছে! মানে একটা অশ্বত্থ কি শ্যাওড়া গাছ দেখে…”
-“চোপরাও বেয়াদব!” – হুঙ্কার শুনে আমার হাত পা আবার পেটের মধ্যে ঢুকে গেল ভয়ে।
[19/12, 11:14 PM] Anjana Sahu: কোনোরকমে কিটিমিটি করে চোখ বন্ধ করে বললাম-“স্য- স্যরি!”
হি হি করে হেসে উঠলো ঠাকুমা ভুতটা। তারপর দাদু ভুতকে উদ্দেশ্য করে বললো-“গালাগাল কোরো না! তাতে আমাদেরই দেরী হবে স্বর্গে পৌঁছতে!”

দাদু ভুত খানিকটা ভাবনায় পড়লো মনে হলো, বললো-“বেয়াদবটা কি গালাগাল?”
-“নিশ্চয় গালাগাল!”- সুযোগটা কাজে লাগালাম-“চার অক্ষরের গালাগাল!”
-“বটে? এ ছেলে তো ভয়ডর বেশ কম পায়!”- বেশ তারিফ শোনা গেল দাদুর গলায়।

এতক্ষণে বেশ ইণ্টারেষ্টিং লাগছে সমস্তটা। এরা ভুত, এরা স্বর্গে যেতে চায়, তাই এরা গালাগাল দিতে চায় না! মুখে বললাম-“তা আপনারা গালাগাল দিতেই পারেন! আজকাল ছ’ বছরের বাচ্চাও গাল দিয়ে কথা বলে, বারো বছরের বাচ্চাও প্রেম করে, আর আপনারা মানুষ না হয়েও দু’টো গাল দিতে পারবেন না মন খুলে?”

-“না রে বাচা!”- দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ঠাকুমার ভুতুরে নাকে। বললো-“আমাদের যে একনো অনেক পুণ্যি সঞ্চয় করতে হবে! এখন খারাপ কথা বলে পাপের দিকে বোঝা বাড়ালে চলবে বল!”
-“এত কথায় কাজ নেই! তুমি বাপু এসো কাল সকালের মধ্যে! আমরা এখানে নিরালায় সাধনভজন করি, সেসবে বাধা আমি সহ্য করতে পারবো না!”

এতক্ষণে এদের ব্যাপার স্যাপার বুঝে গেছি মোটামুটি। শেষ চালটা চাললাম। সতর্ক গলায় বললাম-“বলছিলাম কী দাদু, আপনাদের পুণ্য দরকার, তাই তো! তা একজন ঘর খোঁজা একা মানুষকে ঘরে ঠাঁই দেওয়াটা কত বড় পুণ্যের কাজ বলুন দেখি!”
-“দেখো বাচা! ওসবে ভুলিও না! তোমরা আজকালকার মানুষের বাচ্চাগুলো খুব চালাক! খুব কথার প্যাঁচ তোমাদের! এমনি করে বলে থাকতে শুরু করবে আর তারপর আমাদের নিরালায় ভগবান স্মরণের বারোটা বাজাবে!”
-“ছি ছি!”- অন্ধকারেই নিজের দু’কান মললাম। ভুত যখন দেখতে পেল নিশ্চয়!-“কী বলছেন এসব! আমি সারাদিন ঘরেই থাকবো না! সন্ধেবেলা আসবো! একটু রান্না করবো, একটু বই পড়বো, ব্যস! বিরক্ত কেন করবো!”
-“মানেই তো হট্টগোল! তুমি বাপু এসো!”
ওঃ! এরা তো আচ্ছা ভুত! কিছুতেই মানতে চায় না। শেষবারের মতো চেষ্টা করলাম-“তার উপর চাইলে আপনাদের গীতা কোরান পড়েও শোনাতে পারি! চাইলে মোবাইলে কীর্তন গান শোনাতে পারি, ঠাকুরের ছবি দেখাতে পারি!”

এবার খানিকক্ষণ ফিসফাস! নিজেদের মধ্যে প্রাইভেট আলোচনা করছে। চুপ করে বসে আছি রায়ের অপেক্ষায়। খানিকক্ষণ পর ঠাকুমা বললো-“তুই কী খাস? কী রান্না করিস?”

একটুও দেরী না করে উত্তর দিলাম-“খাই তো সবই! কিন্তু মা কালীর দিব্যি, এই ঘরে সাত্ত্বিক খাবার রান্না করবো! মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন মোট্টে ছোঁয়াবো না!”

-“তুই মাখা মাখা করে আলু পোস্ত পারিস?”- এটা দাদুর গলা!
-“আঃ! যেই বলেছে খাওয়ার কথা অমনি না!”- ধমকে উঠলো ঠাকুমা! তারপর আমার উদ্দেশ্যে বললো-“আমরা পুণ্যকামী ভুত কিনা! আমরা চুরি করে খাই না! আর নিজেরা তো আর রান্না করতে পারি না! তোর দাদু খুব ভালোবাসতো মাখা মাখা করে আলু পোস্ত খেতে!”
হেসে উঠলাম। বললাম-“তোমরা আমাকে থাকতে দিলে আর এটুকু করবো না আমি!”

ভোরের প্রথম কাকটা ডেকে উঠলো বাইরে। তাকিয়ে দেখলাম খুব হালকা, খুব হালকা একটা আলো ছড়াচ্ছে বাঁশবাগানে। পূর্ণিমাচাঁদের আলো নাকি আসবো আসবো করা সূর্যের আলো বোঝাই যায় না ভালো করে না দেখলে!

-“চলো, সন্ধে হচ্ছে! ভজনটুকু সেরে ফেলি!”- ঠাকুমা বললো দাদুকে।

সন্ধে! এরা কি সকালকে সন্ধে বলে! তাই হবে হয়তো!
বললাম-“বেশ দাদুঠাকমা! আমি আরেকটু ঘুমিয়ে নি! সন্ধেবেলা, মানে তোমাদের সকালে আমি তোমাদের গীতা পড়ে শোনাবো!”
-“বেশ বেশ! শোন বাচা, আমরা কিন্তু দেরী করে উঠি ঘুম থেকে। তোদের হিসেবে রাত ন’টার আগে কিন্তু ঘুম ভাঙে না আমাদের!”

শুরু হলো চাকরিজীবন। সকালে দাদুর ডাকে ঘুম ভাঙে। উঠে দু’টো মুড়িটুড়ি খেয়ে অফিস আসি। বিকেলে ফিরে নিজের পড়াশোনা, গান শোনা, সিনেমা দেখা যা কিছু ইচ্ছেমতো কাজ করি! রাতের দিকে দাদুঠাকুমার ঘুম ভাঙলে তখন গল্প করি, ঠাকুমার রেসিপি মেনে রান্না করি, ধর্মগ্রন্থ পড়ে শোনাই! শেষে একসময় ঠাকুমা বলে-“আহারে! বাচার হাই উঠছে! ঘুম পেয়েচে! আজ শুয়ে পড়, কাল আবার বাকিটা শুনবো!”

বেশ কাটছে দিনগুলো। মণ্ডলাবাবু প্রায়ই আসেন অফিসে, বোধহয় এখনো ওই বাড়িতে আছি কিনা তাই দেখতে। তা বলে কোনোদিন ভুল করেও সন্ধের পর ওই বাড়িতে যান না মণ্ডলবাবু। কেন যান না, কেন সেদিন নেমন্তন্ন করে গিয়েও খাওয়ার জন্য ডাকতে আসেননি বেশ বুঝি এখন। কিছু বলিনি অবশ্য আমি মণ্ডলবাবুকে!

বেশ শীত পড়েছে এদিকে। তুলে রাখা জলে তো হাতপা ঠেকানা যায় না! হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে হাঁচি ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। গলা, নাক, চোখে অসম্ভব জ্বালা! হু হু করে জল পড়ছে চোখ দিয়ে। গলায় যেন শুকনো হাওয়া দিয়ে বারবার শুকিয়ে দিচ্ছে কেউ। এসেই শুয়ে পড়লাম বিছানায়। জ্বরও আসছে মনে হচ্ছে! মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। কতদিন হয়ে গেল বাড়ি যাইনি! ছুটি কবে পড়বে! ডিসেম্বরে! কেজানে! কতদিন আছি এখানে? দু’মাস! না, চারমাস…কতদিন…

-“ও বাচা! অমনধারা করচিস কেন? ওরে ও অম্ল!”
খুব কষ্ট করে চোখ খুললাম। টিমটিম করে বাল্ব জ্বলছে একটা। কেউ নেই চারপাশে।
-“অ বাচা অম্ল!”
ঠাকুমার গলা। কোনোরকমে বললাম-“আজ আর কিছু পড়তে পারবো না গো!”
-“ছাড় তো বাচা! তুই এদিকে এত জ্বর নিয়ে পড়ে আচিস! তোরা তো ওষুধবিষুধ সব খাস, আনিসনি সাথে কিছু?”
-“না গো ঠাম্মা! কে জানতো এরকম জ্বর হবে? তোমাদের এখানে হাসপাতাল আছে? বা কোনো ডাক্তার?”
-“ডাক্তার এক আছে! তা সে তো আদ্দেকদিন মদ খেয়ে উলটে থাকে! ওর কাছেই ওষুধ নেয় লোকে! ভিজিট পঞ্চাশ টাকা আর ওষুধের দাম!”
জ্বরের মধ্যেও হাসি পেল। ভুতেরাও এত খবর রাখে! হেসে বললাম-” দাদু কই?”
-“এখনো ওটেনি সে ভদ্দরনোক! সেই মানুষজন্ম থেকে অভ্যেস! কিছুতেই তাড়াতাড়ি উঠতে পারেন না কিনা!”

আজ আর খিদেটিদে পাচ্ছেনা! খেতে ইচ্ছেও নেই। মাথা ঝিমঝিম করছে। ছোটবেলার মতো গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে। কথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম-“তোমরা কতদিন ধরে এখানে আছো গো ঠাকমা?”
-“তা প্রায় পঁচিশ বছর! তখন তো এখানে শুধু গোয়াল ছিলো একটা। এখানেই থাকতে লাগলাম। তারপর তোদের মণ্ডলের ইচ্ছে হলো এখানে দু’ ঘরের একটা বাড়ি করবে! কাউকে বলিস নে, ও আসলে ভেবেছিলো বুড়ি মা টাকে এখেনে পাঠিয়ে দেবে। তা আমরা তেমন করতে দিলে তো! এমন ভয় দেখালাম যে এখন ও মাকে মাথায় করে রাখে!”- হি হি করে হেসে উঠলো ঠাকমা! তারপর বললো-“তারপর একজনকে ভাড়া দিয়েছিলো মন্ডল। ইস্কুল মাস্টার! তাকেও বলেকয়ে ভাগিয়ে দিল তোর দাদু! তারপর এলি তুই! তুই রয়ে গেলি আমাদের সাথে!”

বেশ ভালো লাগছে শুনতে। বাচ্চাদের মতো করে বললাম-“কতদিন হলো তোমরা ভুত হয়েছো?”

-“সেসব অনেকদিন আগের কথা!”- দাদুর গলা শোনা গেল। তার মানে দাদু উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। খানিকটা কাছে এসে বললো-“আমি ছিলাম নারাণগঞ্জের জমিদার! তোর ঠাকমা জমিদারগিন্নী! কী রূপ ছিলো সে আর তুই কী জানবি! তোদের মতো ময়দামাখা চেহারা না! একেবারে পাকা গমের মতো রঙ!”
-“যাঃ! ঢং!”- লজ্জা পেল ঠাকুমা।

বেশ লাগছে আমার। বললাম-“তুমি বলো তো দাদু! তারপর কী হলো?”

-“তারপর আর কী! আমি ছিলাম অত্যাচারী জমিদার! আর তোর ঠাকমা ছিলো সাক্ষাৎ দেবী অন্নপূর্ণা! আমার লেঠেলের দল ছিলো। ডাকাতি করতে বেরোতাম রাতে। আর তো ঠাকমা লোককে খাবার দিত, আমাকে লুকিয়ে পয়সা দিত, আশ্রয় দিয়েছে কতজনকে! আমাকে মানা করতো তোর ঠাকমা, তখন কান দিইনি!”

মনে হচ্ছে একটা পুরোনো দিনের সিনেমা দেখছি। ঝিমঝিম ভাবটা আরো বাড়ছে। যেন সব ঘটনা সামনে ঘটতে দেখছি। জড়িয়ে জড়িয়ে বললাম-“তারপর?”
-“তারপর! একসময় জীবন শেষ হলো! তোর ঠাকুমা আগে গেছিলো! পুণ্যবতী! স্বর্গে ঠাঁই পেল! আর দু’বছর বাদে আমি যখন মরলাম আমার জায়গা হলো নরকে! একা একা কী কষ্টে কেটেছে কতদিন! তারপর একদিন দেখি তোর ঠাকমা চলে এসেছে নরকে। জিজ্ঞেস করে জানলাম ও আমার জন্য এসেছে। আমার সঙ্গে পাপ ভাগ করে নিতে এসেছে।”
-“এরকম চেঞ্জ করা যায়?”- অবাক হয়ে বললাম আমি!
-“কেন যাবে না!”- মুখ খুললো ঠাকুমা -“তোরা যেমন সুপার ফাষ্টের টিকিট কেটে লোকালে যেতেই পারিস, অথচ লোকালের টিকিট কেটে সুপার ফাষ্টে যেতে পারবি না ঠিক তেমন ব্যাপার এটা! স্বর্গ থেকে ইচ্ছে করলে নরকে আসা যায়, কিন্তু নরক থেকে স্বর্গে যাওয়া যায় না!”

ঠাকুমার ট্রেন সংক্রান্ত জ্ঞান দেখে বেশ ভালো লাগলো। এত খবর রাখে! বললাম-“তারপর?”

ঠাকুমা বলে চললো-“তারপর! নরকযন্ত্রণা! সে কী অসম্ভব সব কষ্ট! কত বছর যে নরকযন্ত্রণা সহ্য করেছি জানিনা ঠিক! একদিন চিত্রগুপ্ত মশাই ডাকলেন আমাদের মতো পুরোনো আত্মাদের! ”
-“চিত্রগুপ্ত!”- চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। চিত্রগুপ্তর নাম শুনে উড়ে গেল সেটা।
-“হ্যাঁ! নাম শুনিসনি?”
-“হুঁ!”- ছোট্ট উত্তর দিলাম।
-“তা সেই চিত্রগুপ্ত আমাদের সব্বাইকে ডেকে বললো- ‘শুনুন অসভ্যগণ, আমরা বর্তমানে পাপী আত্মাবিস্ফোরণের সমস্যায় ভুগছি। তুলনামূলক বিচারে দেখা গেছে এখনকার পাপীদের তুলনায় আপনারা অনেক বেশী পুণ্যবান ছিলেন। তাই যমরাজা একটা সুযোগ দিতে চান আপনাদের। তাতে আমাদেরও জায়গা ফাঁকা হবে, আপনারাও ভালো থাকবেন! যেটা করতে হবে সেটা হলো, আপনারা পৃথিবীতে গিয়ে পুণ্যসঞ্চয় করবেন। বিভিন্নজন বিভিন্নসময় বিভিন্ন জায়গায় থাকবেন। কে কীভাবে পুণ্য সংগ্রহ করবেন তা একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। সব পাপ ধুয়ে গেলে আপনারা স্বর্গে প্রবেশের সুযোগ পাবেন।’- সেই থেকে আমরা পৃথিবীতে। তা তাও প্রায় পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল!”- অনেকটা একনাগাড়ে বলে থামলো ঠাকুমা। আমি এখনো শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু বলার মতো অবস্থা আর নেই। পৃথিবীটা কি দুলছে! ভূমিকম্প! কেজানে! চারপাশটা কেমন যেন আঁধার আলোয় মেশা! এটা কি নরক? সামনে কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে? চিত্রগুপ্ত?
-“অ বাচা! অ অম্ল…ওরে অ বাচা…হ্যাঁগা, বাচা যে কথা বলে না…”

দু’টোদিন কীকরে কাটিয়েছি জানিনা আমি। দিনের বেলা কালু এসে আমাকে জ্বরে বেহুঁশ দেখে খবর দিয়েছিলো মণ্ডলবাবুকে। প্যারাসিটামল এনে দিয়েছে ওই মদ খাওয়া ডাক্তার। যখন যখন খুব জ্বর আসছে তখন তখন ওই খেয়ে কমাচ্ছি! ঠিকঠাক ডাক্তারও নেই একজন এখানে! দিনে দুধ দিয়ে গেছিলো কালু। সেটাই খেয়ে শুয়ে পড়বো বলে উঠে দাঁড়ালাম। গরম করতে হবে!

-“ও অম্ল! বাড়ি গিয়ে একবার ডাক্তার দেখিয়ে আয় না বাচা!”
ঠাকুমা উঠে পড়েছে। হেসে ফেলে বললাম-“অত ভেবোনা গো ঠাকমা! তোমরা মরেও তো দিব্যি আছো! তোমাদের দেখে আমার মরার ভয় চলে গেছে!”
-“ছি বাচা! অমন বলে না! অনেক অপেক্ষা করে তবে জেবন পায় স্বর্গের আত্মারা। মরবো বলতে আছে! তুই বরং যা! গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আয়!”
-“চিন্তা কোরোনা গো!”- হাসতে হাসতেই বললাম আমি।
-“তুই যাবি কিনা বল!”- বেশ একটা অভিমান মেশানো, জোর করে অনুরোধ করা গলা।
-“আচ্ছা পাগল তো! আমার কিছু হয়নি গো!”
-“তুই কী করে জানলি? তুই কি ডাক্তার নাকি? ওপাড়ার মুখুজ্জেদের মেয়েটা ক’দিনের জ্বরে মারা গেল, এই হাতুরেটা কিছু বোঝে নাকি! তুই যা তো বাপু, একদিন ডাক্তার দেখিয়ে আয়!”

নিঃশব্দে হাসতে হাসতে গ্যাসটা ধরালাম আমি। নিজেকে কেমন একাকার হয়ে যাওয়া ব্রম্ভাণ্ড মনে হয় মাঝে মাঝে। জীবনের একুলওকুল সবদিকে যোগাযোগ আমার।

জ্বরটা ছেড়ে গেল। কিছু হয়নি তেমন। ক’টাদিন কষ্ট দিয়ে নিজেই বিদায় নিয়েছে। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে ক’দিন। ছুটিও আছে তিনদিন। আজ নেটে দেখে দেখে আলুপোস্ত রান্না করেছি বেশ করে। দাদু খেতে চেয়েছিলো সেদিন। দাদু উঠলেই বেশ একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে এটা দিয়ে। খুশি খুশি মনে ট্রেনের টিকিটটা বুক করছি, ঠাকুমা বলে উঠলো-“আঃ! কী সুন্দর গন্ধ! তুই কী সুন্দর রান্না শিখে গেলি রে! তোর বউ তো তোর মতো রান্না জানা স্বামী পেয়ে ধন্য হয়ে যাবে!”
হেসে উঠলাম জোরে। বললাম-“তোমার মতো একটা বউ খুঁজে দাও না ঠাম্মা! পাকা গমের মতো রঙ…”
-“মরণ!”
আবার হেসে ফেললাম আমি।
বললাম-“দাদুকে ডাকো তো! একটা স্পেশাল জিনিস আছে!”

-“ওই যে, আসছেন!”
পায়ের আওয়াজ তো শোনা যায় না! তবে এখন ওরা জেগে থাকলে ওদের নিশ্বাসপ্রশ্বাস শুনতে পাই আমি। দাদু যে জেগেছে সেটা নিজেও টের পেলাম। হাসিমুখে বললাম-“দাদু! তোমার জন্য কী করেছি বলো তো আজ!”
-“কী করেছিস রে? আঃ! গন্ধটা তো খাসা! তুই আলুপোস্ত করেছিস আমার জন্য! বেশ বেশ! যাবার আগে তোর হাতে খেয়ে যাবো! একটু সরষের তেল ছড়াস ওপর থে…”
-“যাবার আগে মানে?”- কথার মাঝে বলে উঠলাম আমি।

কেউ উত্তর দিচ্ছে না! আমি আবার বললাম-“তোমরা কোথায় যাবে?”
-“আমাদের এবার যেতে হবে রে অম্ল!”-বলে উঠলো ঠাকুমা। -“আমাদের আবার অন্য জায়গায় যেতে হবে! ”
-“কেন? এখানে থাকলে কী প্রবলেম?”
-“তুই বুঝবি না বাচা! আমরা বুঝতে পারি! আমাদের এবার পৃথিবীর অন্য জায়গায় যেতে হবে!”
-“কে যেতে বললো তোমাদের?”- একটু যেন কষ্ট হচ্ছে।
-“কেউ না বাবা!”- এবার মুখ খুললো দাদু-“আমরা সবাই আত্মা! ভগবানের অংশ! আমরা সব নির্দেশ বুঝতে পারি। তোরাও আমাদের মতোই ভগবানের নির্দেশ পাস! কিন্তু মানুষ তো, শুনিসনা অনেক সময়!”

কী বলবো আমি! কষ্ট হচ্ছে কেমন! পারলে জোর করে ধরে রাখতাম। কিন্তু যাদের চোখেই দেখতে পাইনা তাদের আটকাবো কী করে!

বললাম-“আর আসবে না কখনো?”
-“না! এখানে আর না! এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে কবে সব পাপ ধুয়ে যাবে, কবে স্বর্গে চলে যাবো!”
-“হুঁ!”- ভালো লাগছে না আমার।
-“শোন না, অম্ল, একটা কাজ দিয়ে যাবো তোকে, করবি?”
-দাদুর গলা শোনা গেল খুব কাছ থেকে।
-“বলো!”
-“শোন অম্ল, সামনের বাঁশবাগানের ঈশান কোণে একটা বট গাছ আছে। ওর তলা থেকে উত্তর দিকে দশ পা হাঁটবি। তারপর সেখানে খুঁড়বি! তিনঘড়া মোহর আছে ওখানে। এই গাঁয়ে একটা হাসপাতাল করতে হবে বুঝলি! এখানের লোকের বড় কষ্ট! ওই টাকাটা দিয়ে একটা হাসপাতাল করতে হবে তোকে, পারবি না?”

-“কার টাকা দাদু?”- অবাক হয়ে বললাম।

-“পাপের টাকা রে! তখনকার রাজার প্রজাদের রক্ত চোষা টাকা! তুই পারবি না এখানকার লোকের একটু সুবিধা করতে?”

-“পারবো দাদু!”- ধরা গলায় বললাম আমি। ভীষণ মন কেমন করছে। কোনোরকমে কান্না সামলে বললাম-“ঠাম্মা!”
-“হ্যাঁ বাচা!”- ঠাম্মারও কি মন খারাপ! হবে নিশ্চয়! ভুতেরা কাঁদতে পারে? কেজানে!

-“আর কখনো দেখা হবে না?”
-“কেন হবে না বাচা! আমরা তো সবাই এক! সবাই সেই এক ভগবানের অংশ! তুই মনে মনে কথা বলতে চাইবি, দেখবি সাড়া পাচ্ছিস!”

শুকনো একটা হাসি এল মুখে। কী অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটলো জীবনে! খারাপ লাগাটুকু সরিয়ে বললাম-“চলো, তোমাদের খেতে দিই!”

তারপর থেকে অনেকদিন কেটে গেছে। সেদিনের পর থেকে আর দাদুঠাকুমার সাড়া পাইনি! আমি বিয়ে করেছি। ওই গ্রামেই নিজে একটা বাড়ি করেছি। সেখানেই মাকে আর বউকে নিয়ে থাকি। ভালোই আছি আজকাল। হাসপাতালের কাজ ভালোই এগোচ্ছে! অনেক ঘুরতে হয়েছে আমাকে, তবে শেষমেশ আমার কথা শুনেছে সবাই! গ্রামের লোকজনও খুশি! মাঝে মাঝে দাদুঠাকুমার কথা মনে পড়ে। তবে মন খারাপ করি না! ভালো লাগে ওদের কথা ভাবতে। মনে মনে বলি-“তোমরা চিন্তা কোরো না! আমি ভালো আছি! তোমরাও ভালো থেকো খুব!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত