আমার পাঁচ বছর বয়স থেকে শুনে আসছি,আমার মা নেই। আমি যাকে এতোদিন মা ডেকে আসছি সে আমার সৎ মা।আমার আড়াই বছর বয়সে নাকি মা মারা গিয়েছিল। সৎ মা আমাকে যখন শাসন করতো তখন আমার দাদি আমার সৎ মাকে বলত,মা মরা মেয়েটাকে এভাবে মারিসনা রেনু।আল্লাহর গজব পড়বে তোর ওপর। দাদির কথায় মা আরো শাসন বাড়িয়ে দিতেন। আর দাদির সাথে ঝগড়াঝাটি শুরু করে দিতেন। জ্যাঠি মা, আমি কখন ওকে পরের মেয়ে ভাবলাম বলেনতো।ওরতো আগের মায়ের কথাও মনে নাই। যখন থেকে ওর বুদ্ধি হচ্ছে তখন থেকে ও আমাকে নিজের মা হিসেবে জেনে আসছে।দোহাই লাগে, আপনি আমার মেয়েটার মাথায় এসব ঢুকিয়ে দিবেন না।
দাদি তখন বলতেন, এসব শুকনো দরদ দেখাসনা আমার সামনে।আমি সবি বুঝি রেণু। বয়সে তোর অনেক বড় বুঝলি,তাই বুদ্ধিও বেশি।সেদিন দাদির কাছ থেকে শিখলাম বয়সে বড় মানে বুদ্ধিও বেশি। মা তখন দাদির সাথে না পেরে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে কেঁদে কেঁদে কিসব জানি বলতেন। কারো সৎ মা এভাবে সতীনের সন্তানের জন্য কাঁদে আমার জানা ছিলোনা। আমি অসুস্থ হলে মা না ঘুমিয়ে লাইট নিভিয়ে দিয়ে আমার মাথার পাশে বসে থাকতেন।না ঘুমিয়ে আমার সামনে শুইয়ে ছটফট করতেন।আমাকে বেশি বেশি তার স্পর্শ দিতেন। দোয়া-দরুদ পড়তেন। আমার দাদি বলতো সৎ মা কখনো আপন হয়না।আমাকে যখন শাসন করতেন তখন থেকে আমার দাদির কথাটা ঠিক মনে হতো।
মায়ের একটা ছেলে হয়েছিল, নাম অয়ন।সে সারাক্ষণ আমার নাম ধরে ধরে ডাকতো।নীরা নীরা বলে আমার পিছু পিছু ঘুরত। তখন আমার দাদি বলতো, দেখেছিস কি বেয়াদবি শিখাচ্ছে ছেলেকে।সাড়ে চার বছরের বড় তাও নাম ধরে ডাকা শিখাচ্ছে।এসবে না ভাইবোনের মধ্যে পরক করা শিখাচ্ছে। অথচ আমি দেখতাম অয়নকে মা আমাকে নাম ধরে ডাকার কারণে কতো ভয় দেখাতো।তাও অয়ন নাম ধরে নীরা বলে ডাকত। সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু ঘুরত।আমার সাথে খেলতে চাইত।আর আমি তাকে এড়িয়ে চলতাম। দাদির সাথে পাড়া পড়শীরাও আমাকে বলতো, নীরা,তোকে তোর মা দেখতে পারে?
আমি কি বলব তখন বুঝতে পারতামনা। কিন্তু আমার দাদি এবং চাচীরা বলতো মা নাকি আমাকে দেখতে পারেনা। পড়শীরাও বলতো, আহারে মা মরা মেয়ে,সতীনের মেয়ে সতীনে দেখতে পারলেও আর কতো পারবে।যতোই সে মরে যাক,তাও সতীনতো। তারা কেউ কেউ এতিম ভেবে আমাকে আদর করে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতেন। ধীরে ধীরে আমি আর অয়ন একই ছায়ার আশ্রয়ে বড় হতে লাগলাম। বয়সের ব্যবধান সাড়ে চার বছর।ও সবসময় আমার আশেপাশে থাকার চেষ্টা করতো।আর আমার ওকে পরপর লাগতো।ওর ছোটখাটো দুষ্টামিকে আমি খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নিতাম।মা অয়নকে আমার অভিযোগ শুনে মারতেন।
একদিন অয়ন মায়ের মার খেয়ে আমি ঘুমন্ত অবস্থায় চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দেয়।মা প্রতিবারের মতো অয়নকে পিটাল।আমার চুলগুলো ছিলো অনেক সুন্দর। মা চুলগুলো আছড়িয়ে দিতে অনেক পছন্দ করতেন।চুইংগাম লাগানোর ফলে আঠারোতে এসে মাথা ন্যাড়া করতে হলো। পড়শীরা বলল,এসব নাকি মায়ের দোষ।ভাইকে পরক করা শিখিয়ে ফেললো। তাই এসব করেছে। ওদের কথাগুলো আমার বিশ্বাস হতোনা।তবে কথাগুলো পছন্দ করতাম।ওরা বলত,সৎ মা ভালো চাইলেও আর কতো চায়।
অয়ন আর মায়ের প্রতি আমার কোন টান ছিলো আমি বলতে পারবোনা। মা অসুস্থ হলেও কোনদিন তার পাশে শুইয়ে থাকিনি।তাঁকে স্পর্শ করিনি।তবে মোনাজাতে সর্ব প্রথম সৃষ্টি কর্তার কাছে তার সুস্থতা চাইতাম। একদিন ভোরে মা রান্না ঘরে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলেন।সেদিন মায়ের জন্য প্রথমবার কাঁদলাম।তার একমাস আগেই মায়ের লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছিল।এবার ডাক্তার জানালো বাঁচার সম্ভাবনা পাঁচ পার্সেন্ট।মায়ের সিরোসিসটা ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে অনেক আগে।
অয়নকে সেদিন প্রথমবারের মতো আমি কাছে টেনে নিলাম।মাথায় হাত ভুলিয়ে বললাম,সৃষ্টিকর্তা আছে ভরসা কর,ভাই। অয়ন একদম আমার কাছে চলে আসলেন।গা ঘেঁষে বসলেন। ওর হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শোনলাম। দুজন সারাক্ষণ মায়ের পায়ের নিচে পড়ে রই। মা অসুস্থ হওয়ার পর একটিবার মনে হলোনা উনিতো আমার সৎ,নিজের কেউ নই।আড়াই বছর থেকে যার স্পর্শ পেলে আমার অসুখও ভালো হয়ে যায়, যে আমার অক্সিজেনের মতো।যা আমার বাঁচার জন্য খুব দরকার।
সে হঠাৎ এভাবে নিরব হয়ে গেলো।যার অক্সিজেনকে মনে হতো নিজের অক্সিজেন, তার মুখেও অক্সিজেন মাক্স।
তিনদিন পর মায়ের অক্সিজেন মাক্স খোলে ফেললেন। মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের দরকার নাই আর।উনি চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অয়ন অনেক ভয় পেয়ে গেলো।আমাকে জড়িয়ে ধরে মা মা বলে সে কি কান্না। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা তৃতীয় বিয়ে করলেন। অয়ন আমাকে বললো, আপু তোরও আমার মা’কে পরপর লাগতো তাইনা? এই মা’কে আমার মা মনে হয়না।আন্টি আন্টি লাগে।বাবার কি দরকার ছিলো বুড়ো বয়সে আরেকটা বিয়ে করার।
ভাই পরপর কেন লাগবে বল?তোর মা আমার মা আর এই মা সবাইতো বাবার বাম পাঁজরে থাকে? মানুষ যতোই আমাদের ভুল বোঝাক,সৎ মা বলে বলে চিল্লাক।ওরা কিন্তু বাবার বাম পাঁজরে একদম মিলেমিশে থাকে।সারাজীবন ওরা ওখান থেকে আমাদের ভালো চাইবে। আর তাই বাবাকে দিয়ে তারা আমাদের ভালো থাকাটা পূরণ করছে।বাবা তাদের ইচ্ছে পূরণ করতে আমাদের এই মাকে বিয়ে করল। যে আমাদের খারাপ দেখলে শাসন করবে,বকবে, মারবে এবং অসুস্থ হলে ঠিকই মাথায় হাত রাখবে। ভাই আমার একদম কাছে এসে বসলো। বলল,আপু তাও তোর কাছেই আমি আমার মায়ের গন্ধ পাই।আমাদের মায়েরা কতো মিলেমিশে থাকে,তো তুই আর আমি কেন এতো দূরে দূরে রই? আমাদের পরকটা কোথায়?
আমি চুপ হয়ে রইলাম।এই পরকতো আমি করিনি। সমাজ পরক সৃষ্টি করে দিয়েছিল, তুই আমার কেউ না।তাই আমিও ভুলে গিয়েছিলাম তোর আর আমার মা আলাদা হতে পারে তবে বন্ধনটা এক রক্তের।আমি কেন সে রক্তের কথা ভুলে সমাজের কথাকে পাত্তা দিয়েছিল সে কথা আমি নিজেও জানিনা।