বুড়ার বুড়ি

বুড়ার বুড়ি

মেয়েটি আমার দিকে লাজুক চোখে কয়েকবার তাকিয়েছে, আমিওতো তাকিয়েই আছি। না তাকালে দেখলাম কী করে মেয়েটি যে আমার দিকে আড়চোখে তাকায়। মেয়েটির গায়ের রং শ্যামবর্ণ, ওড়না লম্বা করে মাথায় দিয়ে বসে আছে এই টং দোকানে। মেয়েটির হাতের বানানো চা অত্যাধিক সুস্বাদু হয়। আজ নিয়ে চারদিন খেয়েছি এই টং দোকানের চা। প্রথমদিন যখন রিক্সাচালককে বললাম একটি চায়ের দোকানের কাছে রাখো, চা খেয়ে নেই। তখন সে বলল,” ভাইজান আইজ অাফনারে এক সুন্দরী আফার হাতে বানানো চা খাওয়ামু, আফাডা যেমন সুন্দর চা বানায় আরো বেশি সুন্দর কইরা” এর পরের তিনবার নিজেই বলেছি, তোমার সুন্দরী আপার দোকানে নিয়ে যাও। সুন্দরী বলার কারণ হলো, মেয়েটি যদিও শ্যামবর্ণ কিন্তু মুখের দিকে তাকালে সারাদিন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হবে এমন মায়াভরা মুখ।

পরেরদিন গিয়ে খুব কষ্ট পেলাম। দোকানে বসা ছিল চল্লিশের বেশি বয়সের একজন হাড় কঙ্কাল লোক। এই লোকটি নাকি সুন্দরীর স্বামী। মেনে নিতে খুব কষ্ট হলো আমার। এমন অল্প বয়সের মেয়ের চল্লিশ উর্ধ বয়সের একটি স্বামী, মেনেইবা নেই কী করে? মেয়েটির নাম সোমা, একটু পর পর ঐ লোকটিই মেয়েটিকে সোমা সোমা বলে আদুরে গলায় ডাকছিল। ইচ্ছে করছিল লোকটির মুখ চেপে ধরে বলি, ” এই ব্যাটা তুই এমন আদুরে গলায় ডাকবি না। আমার ভিতরে কেমন করে যেন জ্বলে। ”

মাসখানেক পরে সোমার সাথে বসে ঘন্টা দুয়েক কথা বলেছিলাম, জানতে পেরেছি তার জীবনে ঘটে যাওয়া করুণ কাহিনী। মাথা নিচু করে মোলায়েম গলায় বর্ণনা করছিল তার জীবন কাহিনী আমি গরীব ঘরের মেয়ে। দশম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখা করে রেজিস্ট্রেশনের টাকা জমা দিতে না পারায় আর লেখাপড়া করা হয়নি। আমি গরীব ঘরের মেয়ে, তাই আমার স্বপ্নগুলো ছিল ছোট ছোট। অনেকটা স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে হোচট খেয়ে পড়ে যাই আমি।

আপনার দিকে কয়েকদিন তাকিয়ে ছিলাম, কেন জানেন? আপনার বাম কানে দুল দেয়া। আপনি হয়তো এক মায়ের এক ছেলে তাই কান বিধাই করেছেন, কিন্তু আমি যাকে ভালবাসতাম সে ইচ্ছে করে বিধাই করছে। আমার সামনে নাকি তার নায়ক সাজতে ভাল লাগত। তার নাম শ্রাবণ, আমার মত সেও গরীব ঘরের ছেলে। তবে তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়, সে অনেক বড় হতে চেয়েছিল। আমাকে সে রাজরানী করে রাখবে। আমাকে কোনো দুঃখ স্পর্শ করুক এটা সে চাইতো না। কেনইবা চাইবে? আমরা দুজনতো ছোট বেলার খেলার সাথী। এক সাথে খেলা করতাম, খেলা শেষ হলে সে তার গায়ের শার্ট খুলে আমার ধূলো মাটি পরিষ্কার করে দিত। আমি নাকি কালো হয়ে যাব, তার কাছে নাকি আমি সেরা সুন্দরী। একসাথে স্কুলে যাইতাম, সে স্কুলেও যাইত আবার রাতে ট্রাকের মালামাল উঠানামা করত।

ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি, আমার মনে হয় শ্রাবণের একটু চোখের আড়াল হলেই সে অস্থির হয়ে পড়ত। রাতে কাজ থেকে ফিরে আমাকে জানালা দিয়ে বিস্কুট, চিপস দিয়ে যেত। একসময় পরিবারের কাছে ধরা পড়ে যাই, সবাই বুঝে ফেলে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে। বাবা মা শ্রাবণের সাথেই আমাকে বিয়ে দিল। তখন আমার সতেরো বছর বয়স। শ্রাবণ আমাদের থাকার জন্য পাঠকাঠির বেড়া দিয়ে ঘর বানাল সেই ঘরেই থাকতাম। শ্রাবণ আগের কাজটাই করত, আমাদের সংসারে কোন অভাবও ছিল না।

কিন্তু একদিন আর শ্রাবণ বাসায় ফিরেনি। সারারাত বিছানায় বসে কাটিয়ে দিয়েছি। সকালে ওঠে অস্থির হয়ে পড়েছি। আমিও খুঁজি শ্রাবণের বাবা মাও খুঁজে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না শ্রাবণকে। অবশেষে আমার শ্রাবণকে পেয়েছি, কোথায় জানেন? কচুরিপানার নিচে। দুইদিনে শ্রাবণের লাশ ফোলে কচুরিপানার ফাঁকে ভেসে ওঠেছিল। জানেন আমি একটুও কাঁদিনি। পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাকে এসে ধাক্কা দিয়ে বলত, মারে তুই একটু কান্না কর। চিৎকার করে কান্না কর। এভাবে নির্বাক পাথরের মত বসে থাকলে কলিজা ফেটে মরে যাবি।

আমি কেঁদেছিলাম, অনেকদিন পর। যখন এই লোকটির সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয় তখন প্রতিরাতে কাঁদতাম, কেউ শুনত না। বারবার ভেবেছি, মরে যাব। তাহলে হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে না। আমি যে শ্রাবণের স্ত্রী, শ্রাবণের রাজরানী। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব কী করে? তবে স্বামী হারা অপয়াকে দেখলে তো কারো যাত্রা হয় না। প্রতিবেশীরা কানাকানি করে বলত এসব। বাবা মায়ের অভাবের সংসারেই কতদিন বসে বসে খেতে পারব? কেউ আমাকে যখন বিয়ে করতে চায়নি, যদিও চাইত অনেক টাকা যৌতুকের বিনিময়ে। তখন এই লোকটি বলেছিল, আমারতো বউ মরেছে, সোমার মরেছে স্বামি। আমি টাকা পয়সা কিছু চাই না, শুধু সোমাকে চাই ও যেন আমাকে একটু সেবা করে।

বিশ্বাস করুন লোকটি অনেক ভাল। আমাকে খুব সুন্দর করে ডাকে। ওনারও এই দোকানটা ছাড়া কোন পূঁজি নেই। তাই নিজেকে এখন আর রাজরানী ভাবি না, এই বুড়াটার বুড়ি ভেবেই আছি। তবুও লোকটি একটু ভাল থাকুক।
তবে আমি যখন বালিশে কাত হয়ে ঘুমাই, বালিশের কোণা জানে আমার কতফোটা চোখের জলে বালিশের কোণাটি ভিজে যায়। আমার চোখে শ্রাবণের লাশ ভাসে।

আমার শ্রাবণটা কখনো কারো ক্ষতি করেনি, তবে কে বা কারা আমার শ্রাবণটাকে মেরে ফেলল? কত বড় অপরাধ করেছিল আমার শ্রাবণ? মেরে ফেলার মত অপরাধ করেছিল? আমার শ্রাবণকে যখন মেরে ফেলে তখন আমার শ্রাবণটা না জানি কত কষ্ট পেয়েছে? আমার কথা চিন্তে করে হয়তো ভেবেছিল আমার সোমার কী হবে? আমার রাজরানীর কী হবে? বিশ্বাস করুন, আমি একা হলেই শ্রাবণের কথা মনে পড়ে যায়। কয়েকদিন ধরে আপনার কানের দুল দেখে আরো বেশি মনে পড়ছে।

রিক্সাচালক সামনে তাকিয়ে রিক্সা চালাচ্ছে। আমার কান্না সে দেখেনি। সোমার জীবনের করুন কাহিনী শুনে আর না কেঁদে থাকতে পারলাম না। কাল থেকে সোমার দোকানে আর চা খেতে আসব না,আমাকে দেখলেই তার শ্রাবণের কথা মনে পড়বে। আবার মেয়েটা কেঁদে বালিশ ভিজাবে। ওর একটি কথা এখনো কানে বাজে, “এখন আমি রাজরানী না, বুড়ার বুড়ি হয়ে আছি। লোকটা তবুও ভাল থাকুক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত