জীবদ্দশায় এই প্রথম কোন পুরুষ তার কার্য উসল না করেই টাকার অফার করছে। ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। আবার বলছেন কিনা আমার জীবন গল্প শুনবেন। এবার কিন্তু আপনাকে নিয়ে সন্দেহের জাল ছড়াচ্ছে। জানেনই তো স্বভাব এবং স্বাভাবিকতা একটু হসকালেই সন্দেহ গাঢ় হয়। এই মুহূর্তে যেটা আমাকে ভীষণভাবে আক্রান্ত করছে। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ দুচারটে চড় থাপ্পড় সহজাতক বিষয়, কিন্তু ভদ্রতা দেখলে ভয় পাই। চমকে উঠি। আতংক ঘিরে ধরে।”
মেয়েটা দম লাগানো কলের মতো একটানা কথা গুলো বলে গেল। যেন কলের পুতুলের আর মুখস্থ করা কথা। মন্ত্রমুগ্ধ মত শুনলাম। বললাম,
“ গল্প শোনা ভদ্রতার ঠিক কোন পর্যায়ে?”
“এভাবে বলবেন না, শুধুমাত্র এই বিষয়টা নয় আমি আপনার সমগ্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলাম এবং একটি শব্দে তা বেঁধে ‘ভদ্রতা’ উপাধি দিয়েছি।”
“এই দুদিনেই আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রপ্ত করতে পেরেছেন কী?”
“মানুষ চেনা দশ সেকেন্ডের বিষয়। অপূর্ব কিছুই নয়। আর এই চেনাটাকেই কাজে লাগিয়ে আমাদের ব্যবসা করতে হয়।সত্যি কথা বলতে লজ্জা নেই।”
ভেতর থেকে একটা হাপিত্যেশ হুরমুড়িয়ে উঠলো।মেয়েটা দুদিনের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমার ভেতর অব্দি পৌঁছে গেছে অথচ উর্মিলা তিন বছরেও আমায় বুঝতেই পারলো না। একই তো নারী জাতী! একই তো শারীরিক গঠন! তবুও ফারাক বিস্তর মনের। অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত সব নিয়মকানুন।
আজ এই মেয়েটার চোখ দুটোয় ভিন্নতা লক্ষ্য করলাম। আগেও হয়তো ছিল খেয়ালই করিনি। এক পোঁচ সবুজের ছোঁয়া। যেন কোন শিল্পী পরম মমতায় তার সারাজীবনের শৈল্পিকতার দক্ষতা ফুটিয়ে তুলেছেন চোখ জোড়ায়। নিখুঁত হাতের কারুকার্য। ঢুলুঢুলু চোখের নিষ্পলক দৃষ্টি শতসহস্র বার অনূভবের আঘাত দিয়ে যায়। না,নাহ্! এতোটাও মুশড়ে পড়া ঠিক হচ্ছে না। নাছোর হৃদয়টাকে আজকাল বাগে আনা বড় মুশকিল।
“আপনার নামটা?”
“ টনক নড়েছে তাহলে।” বলেই সেই মশৃন পরিশুদ্ধ মনমাতানো হাসি। ইস্! এতো মায়াবী!এতো মায়াবী! ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে চারপাশের পরিবেশ। তন্দ্রা আচ্ছাদনে কোমল ঘুমের আহ্বান। নিংড়ে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্তে। হাসির রেসে ফুলে ফেঁপে উঠছে সমস্ত মুখের আদল। ঠোঁট ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে কলকল শব্দ। মাতিয়ে দিচ্ছে আমাকে।
এই মুহূর্তে মেয়েটা যে শাড়ি পরে বসে আছে,ওটা উর্মিলার। পিত্তরঙের শাড়ি। এই রঙটা উর্মিলার বেশ পছন্দের। ও কে এ রঙটায় দারুন মানাতোও। গায়ে পাটে পাটে বিছিয়ে রইতো। চকচক করতো উর্মিলার সমস্ত শরীর জুড়ে। চোখ ফেরানো যেত না। সম্মোহন শক্তি বলে আটকে রাখার ক্ষমতা তার ছিল উর্মিলার। কিন্তু সেই সব ভাবনার সামর্থ্য বা ইচ্ছে কোনটাই আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। তার বদলে ঘৃণা জন্মেছে। ঘৃণা! কেমন নিরেট অসহনীয় ব্যাকুলতা দিনকে দিন ঘিরে রেখেছিল আমাকে। বেরিয়ে আসতে চাইছি জাল ছিঁড়ে।আমি কী পারবো।হ্যাঁ পারবো। দিব্বি পারবো। ভুলে থাকার পথেই তো হাঁটছি। আবার বললাম,
“কী বলছেন না যে। নাম কী আপনার?” মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
“ নূপুর।”
বলেই উঠে আমার পাশ ঘেঁষে বসল। একটা আঙুল তুলে আমার কপালে রেখে ধীরেধীরে নিচে নামাতে লাগল। ধীরে… ধীরে,
চোখ থেকে নাক, নাক থেকে ঠোঁট, ঠোঁট থেকে কণ্ঠনালীতে নরম স্পর্শের মশৃন রেখায় টেনে টেনে বললো,
“জীবন গল্প শুনবেন? আমার জীবন গল্প। শুনে কী লাভ? অনেকেই শুনতে চায়,এই নোংরা জীবনের গল্প। বলিও।কী লাভ হয় তাতে? কোন লাভ নেই। এখন শুধু আপনি আর আমি। আর কিচ্ছু নয়। আর কিচ্ছুটি নয়।”
শেষ কথা গুলো চাপা ঘন নিঃশ্বাসের আর্তরবে উচ্চারণ করল।
মাদকতা,হ্যাঁ মাদকতা! এ মাদকতা ব্যতিত কিছুই নয়। শ্বাসরুদ্ধ হবার যোগাড়। নিজ প্রশ্বাসের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। শিরদাঁড়ায় দিয়ে এঁকেবেঁকে একটা শিরশিরে শিহরণ তরতরিয়ে উপর দিকে উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত শিরায়, উপশিরায়। উপচে পড়ছে আকুলতা। উস্কে দিচ্ছে বাসনা। হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এসেছে। নাহ্! নাহ্! এক থাবায় থামিয়ে দিলাম চাঞ্চল্যকর আঙুল টাকে। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত করে বললাম,
“লাভ ক্ষতির হিসেব বহুদূর।আমিতো শুধু গল্পটাই শুনতে চেয়েছি।”
“আমার সম্পর্কে আপনার এতো কৌতুহল ভালো ঠেকছে না কিন্তু।”
‘‘ক্ষতি আছে?”
“নাহ্! আপনা সাথে কথা বলে পারা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।লেবাস দেখে বোঝার উপায় নেই আপনি এতো কথা জানেন।”
“আহ্ দেরি করেছে কেনো, বলুন…”
“শুনবেন? তবে শুনুন।”
এতক্ষণে আমার নিঃশ্বাসের দ্রুততা সমন্বয়ে এসেছে। শারীরিক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকতা ফিরেছে।ঝড় উঠেছিল তার স্পর্শে। ঝড়! তোলপাড় চালিয়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এতোটা জড়িয়ে যাচ্ছি কীভাবে? আমি কী উর্মিলা আর এই মেয়েটাকে গুলিয়ে ফেলছি। উর্মিলার নামটা এর পাশে মানায় না। সমাজের নিকৃষ্ট ঘৃণিত মানুষরাও উর্মিলার থেকে শত শতগুণ উঁচুতে। মেয়েটা স্থির হয়ে বসে বলতে শুরু করলো।
“একদিন মধ্যরাতের ঢাকায় এক বড় মাপের ফটোগ্রাফারের বিছানায় যাবার প্রস্তাব নাকোচ করার দায়ে আমাকে চরিত্রহীনা উপাধি বহন করতে হয়েছে। আমাকে চরিত্রহীনা বরে রটিয়ে দিয়েছে আমার সমাজে। মডেলিং এর সমস্ত আকাঙ্ক্ষার উপর থুথু ছিটিয়ে ফিরে এসেছি সেই রাতেই। ঘৃণায় লজ্জায় বিষিয়ে উঠেছিল আমার সমস্ত সত্তা। লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলাম ততটা সম্ভব।
ঘটনাটি কিছুদিনের মধ্যেই ফেটে পড়ে সমগ্র পাড়ায়। মিথ্যাটায় আমেজ যোগে আরো মুখরোচক করে তুলেছে সবার কাছে। মুখে মুখে চর্চিত হতে থাকে আমার বানোয়াট গুণকীর্তন। আমার দম বন্ধ আসতে লাগলো। পরিবার সমাজের মিছে দায়ের অভিযোগে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। মুখ দেখাতে পারছিলাম না। আত্মহনন ছিল একমাত্র পথ কিন্তু না,আমি তা পারিনি। জীবনের মায়া বড় মধুর। এই জীব আমি স্বেচ্ছায় দিতে পারিনি। কেন? আমি তো কোন ভুল করিনি।
শেষে একদিন তো বাবা মুখের উপর সমস্ত সার্টিফিকেট গুলো ছুড়ে দিয়ে চিরদিনের মতো বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। জন্মের কান্না কেদেছিলাম সেইদিন। এখন আর কান্না পায় না। সম্ভবত পাথর জাতীয় কিছু একটা হয়ে গেছি। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। লাভ হয়নি। কোন লাভ হয়নি। জানেন তো? মেয়েদের গায়ে একবার কলঙ্কের কাঁদা লাগলে হাজার ঘষলেও কাজে আসে না। নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে।
ক্ষুধার জ্বালা কখনো হয়তো অনুতাপ করেনি। করেছেন? আমি করেছি। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে; পরিবার ছাড়া একটা মেয়ে কদিনই বা সম্ভ্রম বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ক’দিনই বা টিকে থাকতে পারে ক্ষুধার তৃষ্ণা আড়াল করে। কী আর করার? ব্যাস নেমে পরেছি নিজের রুটিরুজির জন্য। প্রথম প্রথম ঘৃণা হতো। লজ্জা আসতো। কিন্তু এখন.. এইযে বললাম পাথর। পাথর হয়ে গেছি। এখন আর হাত পাততে হয় না। খেতে পাচ্ছি। রাজকীয় খাবার। বিলাসবহুল বাড়ি পাচ্ছি। আরাম আয়েশের কমতি নেই।” সবুজ চোখে জোড়ায় বিষন্নতা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। কাঁদছে? না কাঁদছে না। ওটাকে কান্না বলে না। সমাজে প্রতি ঘৃণা দরদরিয়ে নামছে। নিকৃষ্ট জীবনের অভিপ্রায়।আমি বললাম,
“ এসবে শান্তি পাচ্ছেন?”
“অশান্তির কিছু দেখছেন কী?”
“ঠিক তা না।”
“তো?”
“ আপনার শিক্ষা আছে,চাইলেই অন্য কোথাও থামিয়ে দিলো আমাকে।
“ এই চুপ করুন তো। মুখে ওমন বড় বড় বুলি আওড়ানো গেলেও করাটা সহজ নয়। ইংরেজি তে একটা প্রবাদ আছে, ‘ easy to say but difficult to do.’ প্রবাদ মিথ্যা নয়। আপনি দেবেন আশ্রয়? নিশ্চয়ই না।
আমি চুপ করে গেলাম। উত্তর নেই।
“এবার আপনি বলুন, এই একা থাকার অঙ্গীকার কী?পরিবার কোথায়? ”
মেয়েটার কথা শেষ হতে না হতেই আমার উরু কাঁপিয়ে মোবাইল বেজে উঠল। হন্তদন্ত হয়ে প্যান্টের জেব থেকে মোবাইলটা হাতে তুলে দেখি স্ক্রিনে ভেসে আছে উর্মিলার নম্বর। আমি দ্রুত রিসিভ করলাম।ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
“হ্যালো বাবা, কোথায় তুমি? তোমাকে প্রচুর মিস করছি। জানো বাবা? আম্মু আমাকে আজ অনেক বকা দিয়েছে। আমার মন ভিশন খারাপ।”
আবেগটা গলার কাছে জেঁকে বসেছে। কথা বলতে পারছিলাম না। নিজের মেয়ের মুখটা চোখের ভেতর ভেসে উঠলো। মুহুর্তেই ভুলে গেলাম অতিত বর্তমান ভবিষ্যত। উর্মিলার প্রতি দুর্বলতার স্থান শুধুমাত্র ‘আয়রা’। মেয়েটাকে নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা হয় আজকাল। উর্মিলি ছোট্ট মেয়েটাকে নির্যাতন করছে না তো? মেয়ে বাবার সম্পর্কের মধ্যে দুরত্ব তৈরি করা নিশ্চয়ই নির্যাতনের সামিল।
“কেন মামনি! তোমাকে বকা দিয়েছে কেন?”
“ তোমার কাছে আসতে চেয়েছি তাই। আম্মুকে এতো বুঝালাম,এতো বুঝালাম কিন্তু কিছুতেই শুনলো না। আমি তোমার কাছে যাব। কিন্তু আম্মু কিছুতেই তোমার কাছে নিবে না”
ঠিক একই মুহুর্তে ওপাশ থেকে আরো একটি কন্ঠ শোনা গেল। উর্মিলার কন্ঠ। গলায় প্রচন্ড বিভৎসতা এনে বলছে,
“আয়রা তুমি কার সাথে কথা বলছো?”
“বাবা”
“ কীহ? কোন সাহসে আমার মোবাইলে তুমি হাত দিয়েছো? ফোন রাখ বলছি।এদিকে দেও… দেখি। দেও বলছি।”
আমি আর কিছু শুনতে পেলাম না। অনেকবার হ্যালো…! হ্যালো…! বলেও লাভ হলো না। প্রচন্ড রাগে গাঁয়ে লোম গুলো খাড়া হয়ে উঠল। আছড়ে ফেললাম মোবাইলটা। আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আছে। খেয়াল নূপুর তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা। আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাবে অমনি চিৎকার করে চেঁচিয়ে উঠলাম।বললাম,
“ চলে যান আপনি,এই মুহূর্তে চলে যান।”
মেয়েটার পরিস্থিতিটা বুঝে উঠতে কিছুটা সময় নিলো। চেহারায় বিরক্তি এনে উঠে দাঁড়ালো। প্রকোষ্ঠ থেকে একটা অনুতাপ শান্ত করে দিলো আমাকে। শুধুশুধু এর ওপর রাগ দেখানো আমার মোটেও উচিত হয়নি। আমি নিজে ডেকে এনেছি। খারাপ লাগল। ততটা সম্ভব শান্ত গলায় বললাম,
“ দুঃখিত! আমার মাথার ঠিক নেই।কিছু মনে করবেন না। আপনি এখন চলে যান”
বলেই বুকপকেটে হাতড়ে একহাজার টাকার একটা কড়কড়ে নোট সামনে এগিয়ে দিলাম। মেয়েটা তার অপূর্ব চোখ দুটো দিয়ে কিরকম একটা দৃষ্টি ছুড়ে দিল ঠিক বুঝলাম না। আমি ঝলসে যাচ্ছি। মনে হলো রাজ্যের সব অপরাধ নিজের ঘাড়ে এসে ঠেকেছে তাতে। নিজের অপরাধবোধের পরিধি নির্নয় করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তখনই মেয়েটা রুঢ় কন্ঠে দৃঢ়তার সাথে বললো,
“ কারো দয়ায় বেঁচে থাকলে এই পেশায় আসবার কোন প্রয়োজন ছিল না। চরিত্রহীনা হতে পারি কিন্তু ভিক্ষুক কিংবা করুনার পাত্রী নই। ভালো থাকবেন। আশাকরি ভবিষ্যতে অকারন ডেকে এনে অপমান অথবা ভদ্রতা দেখাবেন না। এতে শ্রদ্ধাবোধ নয় উল্টো সন্দেহ হয়। ভালো থাকবেন।”
বলেই আমার হাতটা ঠেলে ফিরিয়ে দিলো। নিরুপায় আমি চেয়ে রইলাম। মেয়েটা দ্রুত পায়ে হেঁটে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। নাহ বেরুতে পারলো না এর মধ্যেই ঘরে আরেক জনের প্রবেশ। বিন্তি! বিন্তি কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে চাওয়াচাওয়ি করে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। মনে কৌতুহল জন্মেছে ওর। নূপুর বেড়িয়ে গেল। আমার কেমন যেন ঠেকছে। আয়রার জন্য খারাপ লাগছে। আজ বিকেলে একবার আয়রাকে দেখে আসব।