মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল এলে যখন দেখলাম, সরকারি মেডিকেল কলেজের অপেক্ষমানদের তালিকায় একদম শেষের দিকে আমার নাম, শুরুতে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কি করে সম্ভব এটা!
যেখানে আমার ক্লাসের সেকেন্ড বয়, ফোর্থ গার্ল থেকে শুরু করে নয়, দশ , চোদ্দতম অনেকেই সরকারি মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়ে গেছে আর আমি ফার্স্ট হয়েও কিনা ওয়েটিং!
মানতে পারছিলাম না। কোনমতেই মানতে পারছিলাম না। শুরুতে সব কিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হলেও একসময় ভুল ভাঙ্গলো। না,সেটা স্বপ্ন ছিলো না। বিশাল বড় এক ঝাকি খেয়ে যেন আমি বাস্তবে ফিরে এসেছিলাম সেদিন। বুঝতে পেরেছিলাম, আবেগ- ইমোশনের দুনিয়ায় আমি আর নেই। এখন থেকেই জীবনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
সেই সময়টাতে ঠিক কি করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম জানি না তবে এরপর চারটা ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম এবং প্রতিটাতেই মেধা তালিকায় স্থান করে নিতে পেরেছিলাম। সে সময় আমার প্রথম পছন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আব্বা আম্মার ইচ্ছায় তখন ভর্তি হলাম ঢাকা ডেন্টাল কলেজে।
কিন্তু ক্লাস শুরু হবার কয়েকমাস পরেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি, বিশাল বড় ভুল। ডাক্তারি পড়াশোনা আমার ভালো লাগছে না। একদমই না। প্রথম প্রফ পরীক্ষা আসতে আসতে আমি পুরোপুরি বুঝে গেলাম ডাক্তারি পড়াশোনা আমার জন্য নয়। এতো পড়া, এতো ক্লাস, এতো পরীক্ষা, এতো সিনসিয়ার থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কপাল চাপড়ালাম। অনেক হা হুতাশ করলাম। কিন্তু ততোদিনে এখান থেকে বের হবার পথ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে।
দাঁতে দাঁত চেপে ডেন্টাল কলেজের পাঁচ বছর পার করলাম। কেউ বিশ্বাস করবে কি না জানিনা তবে সেই পাঁচ বছর হলো আমার জীবনের সব চাইতে ওর্স্ট মোস্ট ফাইফ ইয়ারস। এতো পড়াশোনা, ক্লাস আবার সেসব নিয়ে স্বার্থপরতা, দলাদলি দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
কলেজ ছেড়ে চাকরিতে যোগদানের পর একটু একটু করে নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা জন্মালো। চিকিৎসা দেবার পর রোগীদের হাসিমুখ দেখলে বেশ ভালো লাগে। আরও বেশি ভালো লাগে যখন কেউ আমার দক্ষতা নিয়ে প্রশংসা করে। এভাবে একটু একটু করে যখন ভালোবাসা তৈরি করছি ঠিক সে সময়েও মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ি।
প্রায় প্রতিদিন তিরিশ চল্লিশ টা রোগী দেখা একজন ডেন্টাল সার্জনের জন্য সহজ নয়, ভয়ংকর ব্যাপার। কেননা একজন এমবিবিএস ডাক্তার শুধু ব্যবস্থাপত্র দিয়ে কাজ শেষ করতে পারলেও একজন ডেন্টাল সার্জন সেটা পারে না, ব্যবস্থা পত্রের পাশাপাশি কামলার মত পরিশ্রম করে কাজও করে দিতে হয়।
তবে এটাও সত্যি যারা বিশেষজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার তাদের চেয়ে আমার পরিশ্রম অনেক অনেক কম। তাই আজ এতোদিন পর এসে আমার নিজের মধ্যে যেন কিছু বোধোদয় হল। আমার সাথে আসলে অতো অতো পরিশ্রমের ব্যাপারটা ঠিক যায়না।
আমি ঘুরতে পছন্দ করি, লেখালেখি পছন্দ করি, আবৃত্তি, গান কিংবা ছবি আঁকতে পছন্দ করি। আর তার চেয়েও বেশি পছন্দ করি অলসতা।একজন বিশেষজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার হলে দিনের বেশিরভাগ সময় শুধু হাসপাতালে রোগী নিয়ে থাকতে হতো। তখন এই কাজ গুলো করে অলসতা করার সময় আমি কখনোই পেতাম না।
তাই এখন প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করি ঠিক সেই সময়ে সরকারী মেডিকেল কলেজে সুযোগ না পাওয়াটা আমার জন্য কত বড় একটা ব্লিসিং ছিল। এইজন্যই আল্লাহ্ হলেন উত্তম পরিকল্পনাকারী ( সুরা আন ফাল ) আমাদের মনের ইচ্ছা, অভ্যাস, চাহিদা সবকিছু তিনি জানেন আর সেই অনুযায়ীই সবকিছু পরিকল্পনা করেন।
দশ বছর পূর্বে যে জিনিসটা না পাওয়ার জন্য কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলাম, আজ ঠিক সেই জিনিসটা না পাওয়ার জন্যই বলি আলহামদুলিল্লাহ। আবার ঠিক একই ভাবে আজ যে জিনিসটা না পাবার জন্য কাঁদছি, হয়তো দশ বছর পর এটার জন্যেও বলব, আলহামদুলিল্লাহ। ভাগ্যিস, আল্লাহ্ দেননি!
কাজেই কোন কিছু চেয়ে না পেলে ধৈর্য্য ধরুন, হয়তো না পাওয়ার মধ্যেই আছে কল্যাণ। আর সৃষ্টিকর্তা তো সবই জানেন। “অতঃএব তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে? ( সুরা আর রাহমান )