তিনটি মেয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। তাদের পিছু নিয়েছে একটি লোক। বয়স চল্লিশের উপরে হবে। লোকটি ছাতা মাথায় কেন মেয়েদের পিছু নিবে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কারণ এখন রোদ বা বৃষ্টি কিছুই নেই। কৌতূহল বশত আমিও লোকটির পিছু নিলাম। এই বয়সে তো আর মেয়েদের পিছু নিয়ে তাদের বিরক্ত করারও কথা না। আমি লোকটির কাছাকাছি যাওয়ার জন্য দ্রুত হাঁটছি।
লোকটির কাছে গিয়ে চিনে ফেলেছি। আমাদের এখানে প্রতিদিন সকালে একটি বাজার বসে। যারা সকালবেলা হাঁটতে যায় তারা এই বাজার থেকে বাজার করে নিয়ে যায়। আর এই লোকটি সেই বাজারের তরকারী বিক্রেতা। আমি বাজারে গেলে কোনো না কোনো তরকারী ঠিকই লোকটির কাছ থেকে কিনে অানি। তাই একটু সাহস করেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
— আঙ্কেল কোথায় যান?
— এইতো সামনে যাব একটু।
— তো রোদ নেই বৃষ্টি নেই ছাতা মাথায় কেন?
— আসলে বাবা সামনে যে তিনটি মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে সেখানকার মাঝের মেয়েটি অামার মেয়ে স্বর্ণা। ছাতা মাথায় দিয়ে যাচ্ছি যেন আমাকে না দেখে।
— আপনার মেয়ে অাপনাকে দেখলে সমস্যা কী?
— আমার মেয়ে চায় না অামি তার পেছন পেছন অাসি।
— তো যান কেন?
— বাবারে, বর্তমান যুগ খুব একটা ভালো না। তাই মেয়েটাকে নিয়ে অনেক চিন্তা হয়। তাইতো প্রতিদিন চুপ করে মেয়ের পেছন পেছন স্কুল অবদি যাই। তুমি বাবা হলে দেখবে সন্তান বাইরে থাকলে বাবার কেমন লাগে।
অামার ছোট বোনের প্রথম সন্তান মেয়ে। একদিন অামরা সবাই একসাথে খেতে বসেছি। বোনের মেয়েটিকে ঘুম পাড়িয়ে বোনটিও আমাদের সাথে খেতে বসেছে। খাওয়া প্রায় অর্ধেক হলো। এরই মধ্যে বোনটি পাশের রুমে তার মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায়। আর কিসের খাওয়া? প্লেটে ভাত রেখেই হাত ধুয়ে দৌড় দিল। বোনটি তার মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে, “এইতো মা অামি এসে গেছি, কী হয়েছে আমার সোনামনির?”
কিছুক্ষণের জন্য ভাবনায় ডুবে গেলাম। ছোটবেলা একটু কান্নার শব্দ শুনে আমার আম্মুওতো এমনি করে ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্না থামিয়েছে।
(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক প্রতিবেশী আছে। সে প্রচন্ড নেশাদ্রব্য সেবন করে। যখন তার নেশা করার জন্য দেহ মন ছটফট করে তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। নেশার টাকার জন্য প্রথমে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে ভাল মানুষ সাজে। “বাবাগো, মাগো এবারই শেষ আর নেশা করব না”
টাকা দিলে ভালো, না দিলে ঘরের অাসবাবপত্র ভাঙ্গার হুমকি দেয়। এমন কী নিজ বাবা মায়ের উপরও হাত তুলে, মারধোর করে। এলাকাবাসী মিলেও ছেলেটির অনেক বিচার শালিস করেছে। তবুও বেলা শেষে অাবার এমনই করে। বাবা একটু কঠোর হলেও ছেলেটির মা গভীর রাত অবধি এই ছেলেটার জন্যই খাবার নিয়ে বসে থাকে। এলাকাবাসী অনেক বলেছে, আপনার কারণেই আপনার ছেলে নষ্ট হবার সুযোগ পেয়েছে। ঐ মহিলার একটিই কথা, “অামার একটি মাত্র ছেলে, সে না খেলে আমার গলা দিয়ে ভাত নামে না।
“বিদেশ যদি পুত্র মারা যায়, কাক পক্ষী না জানিতে অাগে জানে মায়” গানে গানে শুনেছি অনেক বার। অামিও বিদেশ থাকি। আলহামদুলিল্লাহ, এখনো বেঁচে অাছি। আমার অাম্মু লোখাপড়া জানেন না। মোবাইলে ফোন গেলে শুধু রিসিভ করতে পারে, কিন্তু কাউকে ফোন দিতে হলে বাড়ির অাশেপাশের কাউকে বলেন ফোন দিয়ে দিতে। এতদিনের প্রবাস জীবনে যতবার অসুস্থ হয়েছি, প্রতিবার ভেবেছি অাম্মুর কাছে বলা যাবে না। কষ্ট পাবে, চিন্তা করবে আমার জন্য। অথচ তিনিই কাউকে না কাউকে দিয়ে অামার কাছে ফোন দিবে। প্রথম কথাই হবে, “বাবা তোর কী শরীর ভালো? আমার মনটায় শান্তি পাচ্ছি না কেন?”
যদি জানতে চাই অাম্মু কিভাবে বুঝো? উত্তরে বলে, “মায়ের মন, নদী আর সাগর পেরুতে কতক্ষণ?” কখনো বলে, “জানিস আমি এখন বেশি বেশি খাই, গাছের সব অাম আর বড়ই একা একা খেয়ে ফেলেছি তোকে ছাড়া। ” অাম্মুর কান্নার শব্দ আমি পাই, যতই লুকিয়ে কাঁদুক। একটি প্রবাদ বাক্য, “মায়ের চেয়ে বেশি আপন যে, সে তো ডাইনী” কারণ মায়ের মমতার কাছে পৃথিবীর সব মমতা হার মানে। “ভাল থাকুক পৃথিবীর সকল বাবা মায়ের ভালবাসা”