—- আংকেল, আপনার কাছে কি একটা সিগারেট হবে? বাসস্ট্যান্ডে নেমেই বাসের জন্য অপেক্ষারত একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের কাছে প্রশ্নটি ছুঁড়ে মারলো রিমি। প্রশ্নকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে একেবারেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন ভদ্রলোক। মাথায় স্কার্ফ জড়ানো মার্জিত পোশাক এবং মার্জিত চেহারার একটি মেয়ের মুখে এরকম কথা শুনলে যে কারোরই চোয়াল ঝুলে পড়তে বাধ্য। তিনি থতমত খেয়ে বললেন,
—– না মানে, ইয়ে মানে আমি তো সিগারেট খাই না! রিমি যেনো খুবই আশাহত হলো এমন ভঙ্গিতে সেই মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়ে রিকশায় উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো।
আজ এই নিপাট ভদ্রলোককে বোকা বানিয়ে যারপরনাই আনন্দ পেলো রিমি। আসলে মানুষকে বোকা বানানোটা তার হবি থেকে ধীরে ধীরে নেশায় পরিনত হয়ে গেছে। প্রতিদিন অন্তত একজনকে বোকা বানাতে না পারলে আজকাল তার খাওয়া পর্যন্ত হজম হতে চায় না। লোকটা হয়তো বাড়িতে গিয়ে তার বউ-ছেলে-মেয়েদের ডেকে এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বলবে আর খুবই চিন্তিত হয়ে বলবে– “এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একেবারেই উচ্ছন্নে গেছে!” এটা ভেবে খুশিতে রিমি রিকশায় বসে গুন গুন করে গান গাইতে লাগলো আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে বাসায় পৌঁছাতেই রিমির মা বেশ খুশি খুশি মনে বললেন,
—– ইমনের বাবা এসেছিলেন। তোর ভাইয়ার সাথে কথা বলে তোর আর ইমনের এনগেজমেন্ট এর তারিখ ঠিক করে গেছেন। রিমি লাজুক হাসি দিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
আসলে এ যুগের মেয়ে হয়েও প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিল না রিমি। তাই বাবা-মায়ের উপরেই তার বিয়ের ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিল। কিন্তু বছর দু’য়েক আগে এক রোড একসিডেন্টে রিমির বাবা ওপারের জগতে চলে যান। বাবার মৃত্যুর পরে তার অফিসে রিমির ভাই রওনকের চাকরি হওয়াতে তাদের সংসার খরচ চালানো নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সমান সমান ভাবে চলে যাওয়া মধ্যবিত্তের জীবন যাপন চলছিলো। কিন্তু বাবার অবর্তমানে রিমির বিয়ের দায়িত্ব মা আর ভাইয়ার উপরে পড়াতে তারা খুবই চিন্তিত ছিলেন। রিমিকে তো একদিন মা বলেই ফেললেন,
—— এই যুগে তোর জন্য ভালো ছেলে খোঁজার চেয়ে ঢের ভালো হয়– তুই ই তোর বরকে খুঁজে নে। রিমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলেছিলো,
—— আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। আমি জানি আমার মা আর আমার ভাইয়া বেস্ট ছেলেটিকেই আমার জন্য খুঁজে নেবে।
এরই মধ্যে একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পরে মা বললেন, বাবার কলিগ ইমরান আহমেদ নাকি তার ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন। বুয়েট থেকে পাস করে বের হয়েই খুব ভালো একটা চাকরি পেয়েছে সে। তিনি আরো বলেছেন, তার ছেলের পড়াশুনার পেছনে নাকি রিমির বাবার অনেক অবদান আছে। ব্যাংক থেকে একটা লোন তোলার ব্যাপারেও তিনি তাঁকে সাহায্য করেছেন। রিমির বাবার কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই টাকা ধার নিয়ে ছেলের পড়াশুনার খরচ চালাতে হয়েছে। তিনি নাকি অনেক আগে থেকেই মনে মনে তার ছেলের জন্য রিমিকে পছন্দ করে রেখেছিলেন। এখন তার ছেলের খুব ভালো একটা চাকরি হওয়ার সাথে সাথেই তিনি রিমিদের বাসায় এসেছেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
এরপর এক বিকেলে ইমন, তার মা, তার বড় ভাই-ভাবী আর ছোটবোন আসলো রিমিদের বাসায়। আগে ইমনের ছবি দেখলেও আজই তাকে প্রথম সামনা-সামনি দেখলো রিমি এবং মুগ্ধ হয়ে গেলো। এ যেনো রূপকথার কোন বই থেকে কোনো এক রাজপুত্র চলে এসেছে তার সামনে। এখন সে মানুষ হিসেবে ভালো হলেই হয়– মনে মনে ভাবলো রিমি। আজ রিমির এনগেজমেন্ট। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরে হালকা সাজে ড্রইংরুমে এসে বসলো সে। সোফায় বসা মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখে ভীষণ ভাবে চমকে উঠলো রিমি। কোথায় যেনো দেখেছে… কোথায় যেনো দেখেছে… ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো তার। হ্যা, এই ভদ্রলোককেই তো সেদিন বাসস্ট্যান্ডে বোকা বানিয়েছিলো- তার কাছে সিগারেট চেয়ে। মানুষকে বোকা বানানোর মজা এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবো মনে হচ্ছে।
-মনে মনে ভাবলো সে। তিনিই সম্ভবত তার হবু শ্বশুর মশাই। রিমির মতো তিনিও নিশ্চয়ই এখনি রিমিকে চিনে ফেলবেন আর সিনেমাটিক স্টাইলে ভেঙে দেবেন রিমির এনগেজমেন্ট এবং বিয়ে। কারন, রিমির যেই পরিচয় সেদিন পেয়েছেন তিনি, এরকম মেয়েকে কেউ-ই নিজের ছেলের বৌ করে ঘরে তুলতে চাইবেন না। ওইতো ধীরে ধীরে তিনি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এবার নিশ্চয়ই ঘোষণা দিবেন যে, আমার মতো মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে দেবেন না– মনে মনে ভাবলো সে। অপরাধীর ভঙ্গিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলো রিমি। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ডায়মন্ডের আংটি বের করে রিমির পাশে এসে বসলেন ইমনের বাবা ইমরান আহমেদ।
—– তোমার হাতটা একটু দেখি তো মা বলে রিমির অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দিয়ে আস্তে করে তার মাথায় হাত রেখে বললেন,
—— দোয়া করি মামণি, মহান আল্লাহ তোমাকে আজীবন সুখে-শান্তিতে রাখুন। আমাদের সবাইকে নিয়ে তুমি খুব ভালো থাকো তার কন্ঠে এতোটাই আন্তরিকতা আর ভালোবাসা মিশে ছিলো যে, রিমির কাছে মনে হলো আজ অনেকদিন পরে সে তার বাবাকে পাশে পেয়েছে, তার মাথায় যেনো তার বাবার পবিত্র আশির্বাদের ছোঁয়া পেলো এরপর রিমির হবু শ্বশুর মশাই গলা খাঁকারি দিয়ে একটু জোরেশোরে ই বললেন,
—— আমার বৌমা হয়ে একবার আমাদের বাসায় এসে নাও, তারপর যতো খুশি সিগারেট তুমি খেতে পারবে রিমির শ্বশুর মশাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই রুমের সবাই অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো। তার মানে সেই ঘটনাটি উনি আগেই সবাইকে বলেছিলেন! রিমি তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো– জীবনে আর কোনো দিন কাউকে বোকা বানাবে না। ঠিক তখনই রিমির হবু শ্বশুর মশাই হাসতে হাসতে বললেন,
—- শোন মা, তোমার বাবার মোবাইলে আমি তোমার অনেক ছবি দেখেছি। আর মানুষকে আবোলতাবোল কথা বলে বোকা বানানোটা যে তোমার একটা হবি, সেটাও তোমার বাবা আমাকে বলেছিলেন। তাই সেদিন বাসস্ট্যান্ডে তুমি কিন্তু আমাকে মোটেই বোকা বানাতে পারোনি, বরং বোকা হয়ে যাওয়ার অভিনয় করে উল্টো তোমাকেই আমি কেমন বোকা বানালাম!
যেখানে মাত্র কিছুক্ষণ আগে রিমির মনে হয়েছিলো, এই বিয়েটাই হয়তো ভেঙে দিবেন উনি, সেখানে এরকম সাদা মনের হাসি-খুশি একজন মানুষ কতো সহজে নিমিষেই রিমির জীবনে এক মুঠো সুখ এনে দিলেন। চোখের কোনায় একফোঁটা আনন্দঅশ্রু নিয়ে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া আদায় করলো রিমি। বাবাকে আজ খুব মনে পড়ছে তার। মনে হচ্ছে, এখানেই কোথাও আছেন তিনি। আর রিমির কানের কাছে যেনো বলে যাচ্ছেন তাঁর প্রিয় বই থেকে নেয়া প্রিয় সেই উদ্ধৃতি–
—– দেখলি তো রিমি, জীবন সহজ নয়, আবার জটিলও নয়। জীবন জীবনেরই মতো। আমরাই একে সহজ করি, আবার আমরাই একে জটিল করি ঠিক সেই মুহূর্তে রিমির মনে হলো- জীবন সুন্দর! বড় ই সুন্দর!!