গ্রামের মেয়ে তিশা । বেশ গরিব ওরা । তিশা কিন্তু ভীষণ সুন্দরী । যেমন ফর্সা গায়ের রং , তেমনি চেহারা । প্রতিবেশীরা বলে “তুই বড়ো হয়ে নিশ্চয়ই একট্রেস হবি “। তিশার মা বলে “মাইয়া যদি শহরে গিয়া চাকরানীর কাম পায় তাইলেই খুশি হমু , একট্রেস হওয়া লাইগবোনা “। তিশার মনে অনেক আশা । যেমন প্রতিটি বাঙালি ছেলে ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে একদিন নায়ক অথবা গায়ক হবে ।
অনেক কষ্টে মা ওর স্কুলের খরচ জোগাড় করেন । নুন আনতে পান্তা ফুরায় । গ্রামের লাইব্রেরির করিম চাচা তিশাকে খুব স্নেহ করেন । উনার বাসায় ল্যাপটপ আছে । তিশা উনার বাসায় গিয়ে মাঝে মাঝে ইন্টারনেটে ইংরেজি শিখে । ঐ করিম চাচার এক ভাই ঢাকায় ফরেন মিনিস্ট্রিতে কাজ করেন ।ছোটোখাটো চাকরি । ছুটিতে গ্রামে এসে তিশার ইংরেজি শুনে বললেন ” আমাদের স্যার বেলজিয়াম এ ফার্স্ট সেক্রেটারি হয়ে যাচ্ছেন । উনার দরকার “মেইড সারভেন্ট “। তুই যাবি তিশা ? “মেইড সারভেন্ট ” মানে তো চাকরানী । তবু ও যাবে তিশা । এক পায়ে খাড়া । ফার্স্ট সেক্রেটারির স্ত্রী রাজি হলেন তিশার ইংরেজি শুনে ।
মাকে ছেড়ে বেলজিয়াম এ চলে এলো তিশা । ব্রাসেলস এর এটোমিক টাওয়ার এ উপরে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে খোঁজে বাংলাদেশকে । চীৎকার করে বলে : “হয়তো তোমার পাবো দেখা , যেখানে ঐ নত আকাশ চুমছে বনের সবুজ রেখা ” । ছোট্ট দেশ বেলজিয়াম । সপ্তাহে একদিন যখন ছুটি পায়, শপিং মল এ যায় । সেখানেই পরিচয় হলো তুষার এর সঙ্গে ।I বাঙালি ছেলে , এবারই পাশ করে বেরুবে ব্রাসেলস ইনভার্সিটি থেকে । এতো সুন্দর কথা বলে।
তারপরে বাংলা সিনেমায় যা হয় তাই হলো । দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে গেলো । লেক এর পারে যখন দুজন বসে থাকে কথা আর শেষ হয়না । ওদের কথার ফুলঝুরিতে লেক এর হাঁসগুলি লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যায় । তুষার ওকে প্রস্তাব দিলো বিয়ের । তিশা বললো “না না “। তুষারকে বলি বলি করে আর বলা হয় না ও কি কাজ করে । যদি তুষার মুখ ফিরিয়ে চলে যায় ! আগামী কাল তুষার ডিপ্লোমা পাবে । ওর আব্বা বড় একটি পার্টি দিচ্ছেন । বললো : কালকে এস না আমাদের বাসায় । আমার আব্বা আম্মার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব ।
-কালকে পারবোনা । কালকে আমার অন্য কাজ আছে ।
তুষার মনে একটু ব্যথা পেলো । ওর জীবনের এতো বড় একটি দিন অথচ ওর মনের মানুষটি কাছে থাকবেনা । করুন মুখে চলে গেলো । তিশা কিভাবে বলবে যে আগামী কাল ওকে দূতাবাসের একটি পার্টিতে ওয়েট্রেস এর কাজ করতে হবে । ও তো চাকরানী , মালিক যা বলবে তাই করতে হবে । পরের দিন তুষারের জীবনে এক বিশেষ দিন । কনভোকেশন এর ড্রেস পরে এলো পার্টিতে । কোনো একসময় কিচেনে ঢুকলো । ও নিজের চোখ কে বিশ্বাস করলো পারলো না । বাবুর্চির পাশে তিশা দাঁড়িয়ে আছে ।
-তিশা , তুমি এখানে ?
– তুষার, তুমি এখানে ?
এটাতো আমাদের বাসা । আমার আব্বা এম্বেসেডর । চলো চলো তোমাকে আমার আব্বা আম্মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি । না না আমি যাবো না । লজ্জায় একদম ছোট হয়ে গেলো তিশা । ও একজন মেইড সারভেন্ট আর তুষার এম্বাসেডর এর ছেলে !!!! ও তো কোনো দিন একথা বলেনি । ছেলেকে খুঁজতে মা ঢুকলেন কিচেনে ।
-মা মা এই হলো আমার তিশা । ওর কথা আমি তোমাকে অনেকবার বলেছিলাম । বরণ করে নাও তোমার হবু পুত্রবধূকে । মা বললেন :
-ও তো একটি মেইড সারভেন্ট । কেন মা ? তুমিই তো শিখিয়েছিলে মানুষ আর মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই । তোমার কাছ থেকে শিখেছি সব কাজকেই সম্মান করতে হয় ।
-তাই বলে চাকরানী ? চাকরানী কি মানুষ নাকি ?
তীরের মতো কথাটি বিঁধল তিশার বুকে । ছুটে বেরিয়ে গেলো পার্টি থেকে । দুদিন ধরে প্রচন্ড বরফ পড়ছে বেলজিয়ামে । চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ । অনেক রাতে দূতাবাসে পুলিশের ফোন শুধু বেজেই চলেছে ।
কোনো এক নির্জন গ্রামে বরফের নিচে দুটো তরুণ-তরুণীর দেহ পাওয়া গেছে । পকেটে বাংলাদেশের আই ডি । স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরে গেছে মুখ দুটি । ছেলেটির এক হাত মেয়েটির হাতে । মেয়েটির ঠোঁট ছেলেটির কানের কাছে । হয়তো বলতে চেয়েছে :„ঐ সুদূরের গাঁয়ের মাঠে আ’লের পথে বিজন ঘাটে , হয়তো এসে মুচকি হেসে ধরবে আমার হাতটি একা“ । তিশা আর তুষার কোন এক অচিনপুরে চলে গেছে যেখানে চাকরানীরাও মানুষ ।