জুবাইদা আগুনে তাঁর বিয়ের শাড়ি পুড়তে দিয়ে হাসছেন। আগুনের উজ্জ্বলতায় তাঁর সেই হাসি রক্তিম দেখাচ্ছে। আশিক ধোঁয়া দেখে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢোকে। আগুন নেভাতে নেভাতে ভাবে, এসব মা’র আবার নতুন কোনো ফন্দি নয়তো?
আম্মা, সরো সরো।’ জুবাইদা আলমারি থেকে কাপড় বের করে লাগেজে রাখছে দেখে আশিকের মাথায় কিছু আসে না। তারপর মনে পড়ে একটু আগে সেই তো বলেছে, ‘আম্মা, অনেক হয়েছে। এবার চলে যাও। ব্যাগ গুছিয়েছো?’ মা সেসময় মাথা নাড়লেন। সে আবারও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘একটু পর গাড়ি আসবে। তুমি কিনা.. আচ্ছা ঠিক আছে। ভেতরে যাও। রেহানা তোমাকে গুছিয়ে দেবে। রেহানা..’ কাজের মেয়ে রেহানা যেতে উদ্ধত হলে জুবাইদা থামিয়ে দেন। ‘আমি করে নেবো। তুমি যাও। রান্না করে নাও।’
জুবাইদা ব্যাগে কাপড় রাখতে রাখতে চোখের কোণের শেষ কান্নাটুকু মুছে নেন। ছেলের কথায় তাঁর এই ঘরে আসার পর থেকে এখনও তাঁর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। এই শরীর আগে কখনও এতটা কাঁপেনি। এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও তাঁর শরীর ততটা দুর্বল হয়নি। তাঁর এই হাতগুলো একসময় খুব সুন্দর করে চারিদিকটা সাজিয়েছিল।
আশিকের বাবার সাথে খুব সুন্দর করে এখানে সংসার করেছেন। আশিকের বাবা আমজাদের মৃত্যুর মাত্র দুই বছর পার হয়েছে। কিন্তু তাঁর সাথে জুবাইদা ছিলেন দীর্ঘ ত্রিশটি বছর। তবু তিনি তৃপ্তি পাচ্ছেন না। উনার আগে নিজে মরলে কী হতো? জুবাইদার চোখের কোণ থেকে দুই ফোঁটা পানি পড়ল। পানিগুলো গাল বেয়ে নিচে পড়ছে না। যেন মস্তিষ্কে পৌঁছচ্ছে, আর চারিদিকটা ক্রমে শীতল করে দিচ্ছে। আজ তিনি আর কোনো হট্টগোল করছেন না। তিনি বুঝে ফেলেছেন। আশিক তাঁকে রাখতে চাচ্ছে না। কালরাত তিনি ওকে বলেছেন, ‘আমার নাতি-নাতনির মুখ না দেখে আমি যেতে চাই না আশিক।’
সে বলেছে, ‘তুমি দেখতে পাচ্ছ না, তোমার ছেলের বউ প্রেগন্যান্ট? ও এখন তেমন কোনো কাজ করতে পারে না। তোমার কী হবে বলো।’ ‘কেন? রেহানা আছে না?’ ‘একটু আগে কী বলেছি? ও তেমন কাজ করতে পারে না। রেহানার সবগুলো করতে হবে। তোমাকে রেহানা কীভাবে সময় দেবে? তাছাড়া জেবা তো বলেছে তোমার খেয়াল রাখবে। ওর শ্বশুরবাড়িতে আছেই বা কে? আর তোমাকে কি আমরা দেখতে যাব না?’ ছেলের ইঙ্গিত বুঝতে জুবাইদার সমস্যা হয়নি। কিন্তু আর কতদিন নানা অজুহাতে ওকে ঠেকিয়ে রাখবেন? আশিক চায় না, তিনি এখানে থাকুক। তাই হোক। তিনি আর থাকবেন না। মেয়ে জেবার কাছে চলে যাবেন।
একটু আগে তিনি আলমারির জিনিস নিতে গেলে চোখ যায় লাল কিছুর উপর। তিনি শাড়িটি তোলে নেন। এটি তাঁর বিয়ের শাড়ি। আমজাদ দামী এই শাড়িটি তাঁকে নিজ হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন। জুবাইদার তরুন মনে তখন সে কী লজ্জা! তিনি দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। আমজাদ তাকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছেন। কারণ তাঁদের বিয়ের সময় তাঁদের কোনো আপনজন ছিল না। বিয়েটা তিনি স্বেচ্ছায় করছেন। আমজাদ উন্মাদ এক প্রেমিকের মতো তাঁকে তাঁর এই বড় বাড়িতে তুলেছেন। চারিদিকটা দেখে জুবাইদার মন জুড়িয়ে গেল। তাঁর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। অবশেষে পাশের এই লোকটি এবং এই স্বপ্নের বাড়িটি তাঁর।
আমজাদ এই বাড়ির একমাত্র সদস্য তাঁর মায়ের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। জুবাইদার কিছুটা খারাপ লাগে। মহিলা যদি না থাকতেন, তবে এই পুরো বাড়িতে একা স্বামীর সাথে সেই থাকত। ঘরময় তিনি ছোটাছুটি করে স্বামীর কাছে নানা আবদার করত। মাঝে মাঝে চাকরগুলোকে ছুটি দিয়ে তিনি দুনিয়ার সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখতেন। কিন্তু ইনার সামনে এসব করা সম্ভব নয়। আমজাদ বউয়ের মুখভঙ্গি বুঝলেন। তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার যাই ইচ্ছা হয়, তা করতে পারো। আম্মা তো বেশিরভাগ সময় তাঁর ঘরেই বসে থাকেন।’ সংক্রামক রোগের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ছড়ানো। জুবাইদার বিব্রতভাব আমজাদের মাঝে ছড়াতে দেরি লাগেনি। মা যেমনই হোক, তিনি একজন মানুষ। তার সামনে বউয়ের সাথে যেমন-তেমন মজা করা যায় না। বউ অহেতুক কিছু করলে মা যে চোখে তাকায় তা আমজাদের ভালো লাগে না।
জুবাইদা এখনও হাসছেন। সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আশিকও এখন এমনটাই মনে করে। কিন্তু একটি ব্যাপার ভিন্ন। ওর বাবা তার মাকে অন্য এক বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলেন। আর আশিক তাঁকে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঠাচ্ছে। তাঁর যাওয়ার পর আবারও এই বাড়ি প্রেমে উন্মাদ দুটো তরুণ-তরুণীর প্রেমলীলার সাক্ষী হয়ে থাকবে। জুবাইদা কাঁপা হাতে ওই শাড়িটি মেঝেতে ফেলে দিলেন। তাঁর আগরবাতি জ্বালানোর ম্যাচটা ড্রয়ার থেকে হাতে নিয়ে তিনি শাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। ধাও করে আগুনের শেষ শিখা উঠে মিলিয়ে যাওয়ার আগে আশিক ধোঁয়া দেখে তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢোকেছে।
গাড়ি আসায় দারোয়ান ডাকছে। আশিক নির্বাক হয়ে দেখে মা নির্বিঘ্নে বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে। তার কিছু করার নেই। ওর ছোট্ট মেয়ে ‘হিরা’ দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিস্মিত চোখে দাদিকে দেখছে। দাদুকে সে পাত্তা দেয় না। উলটো দাদু পাত্তা পাবার জন্যে মরিয়ে হয়ে উঠত। কিন্তু দাদু তো কখনও এমন করেনি। আজ ওর এতো কাছ আছে। অথচ দাদি ওকে কোলে নিচ্ছে। হিরা মুখ বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। হয়তোবা এই অভিমান দেখে দাদু ওকে কোলে নেবে। কিন্তু দাদু ওর সামনে দিয়েই বাড়ি থেকে বেরুলেন।
চার বছর বয়সী হিরা ফুঁসে উঠে ঘরে চলে গেল। দাদুর সাথে সে আর কখনও কথা বলবে না। দাদু ভালো না। জুবাইদা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। গাড়িতে স্টিয়ারিংয়ের সামনে এক বৃদ্ধলোক বসে আছেন। এই একই বৃদ্ধ ড্রাইভার একদিন তরুণ জুবাইদাকে তার স্বামীর সাথে এদিকওদিক নিয়ে গিয়েছেন। আমজাদের মা’কেও ইনি দিয়ে এসেছেন। গাড়ি বদলেছে। কিন্তু লোকটির যান্ত্রিক মুখ বদলায়নি। বিয়ের পরদিনই লোকটিকে আমজাদ আদেশ দিয়েছিলেন, চোখ সোজা সামনের দিকে রাখবে। পেছনে তাকাবে না।
পেছনে জুবাইদা স্বামীর বুকে মাথা রেখে খিলখিল করে হেসে উঠেন। আশিকও কি এই ড্রাইভারকে একই কথা বলেছে? জুবাইদা পেছনে ফিরে তাকান। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে হয়তো আরেক মায়ের মনের ভেতর আর্তনাদ করে উঠেছিল। তিনি টের পাচ্ছেন, কেমন এক লম্বা শিকল তাঁকে আঁকড়ে ধরে ঝনঝন আওয়াজ করে তাঁর যাওয়াতে তীব্র প্রতিবাদ করছে। তাঁর যেতে হবে। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। এটিই তাঁর নিয়তি।
তিনি গাড়িতে বসার পর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আশিকের কথা তাঁর কানে ঢুকছে না। হয়তোবা বলছে, আমি তোমাকে দেখতে যাব। ভালো থেকো। তিনি আবারও মৃদু হাসলেন। আশিক ভ্রূ কুঁচকায়। মায়ের মাথা ঠিক নেই। জুবাইদা তার দিকে তাকাচ্ছেন না। ওদিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। লোকটি এখনও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। তাঁর বয়স হয়েছে। জীবন দেখেছেন। তাঁর কানের বাধা মানা ছাড়া উপায় নেই।