আমার যখন বিয়ে হয় আমি অনার্স প্রথম বর্ষ শেষ করেছি। পরীক্ষা শেষে ছুটি ছিল। সেই ছুটিতে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। আমি বাসার ছোট মেয়ে। আম্মার আদরের ছিলাম। আম্মা তেমন কাজ করতে দিতো না। বাসায় সহকারী থাকতো সবসময়। ফলে কাজ তেমন শিখিনি। একটু বড় হবার পর একদিন রান্না করতে চাইলে আম্মার উত্তর ছিল, সারাজীবন এইসব কাজ করতেই হবে। তাই আমার ঘরে থেকে কাজ করে কষ্ট করার দরকার নাই। সময় হলে সবাই শিখে যায়। তুই পড়াশোনা কর।
এই ফাঁকে বলে রাখি আমি পড়ায় চরম ফাঁকিবাজ ছিলাম। যদিও এমন এক স্কুলে পড়তাম যে ফাঁকি দেয়ার কপাল হয়নি। কপাল ছিল বিরাট খারাপ। বিয়ের হল বিশাল সংসারে। সাত ভাইবোন, শ্বশুর শাশুড়ি আর তিনজন সহকারী বাসায়। আমি বাড়ির বড় বউ। শাশুড়ি মায়ের পরিপাটি গোছানো সংসার। অতিথি মেহমান থাকে। আমি জানে বাঁচলাম। পড়তে হবে না আর। সংসার করবো আরাম করে। ওদের ভাতের হাড়ি দেখে মহাখুশী। এই বিশাল হাড়িতে ভাত রাঁধবো! কিসের পড়া কিসের লেখা! শিকেয়তোলা থাক!!
কিন্তু আমার কপাল খারাপ। বিয়ের মাসটা ক্লাস ছুটি ছিল। ক্লাস খুলতেই পতি আদেশ দিল কাল থেকে ক্লাসে যাও। কি জ্বালা! আমি বললাম আমার পড়ার সময় কই? কত কাজ বাসায়! কঠিন কন্ঠে নিরস উত্তর, এসব কাজ করার জন্য মানুষ আছে বাসায় তিনজন। তুমি আসার আগে সব হোত। এখনো হবে। তোমাকে এসব করার জন্য আনা হয় নাই। টুকটাক যা পারো করবা। না পারলে নাই। কিন্তু পড়া শেষ করতেই হবে। বুঝলাম। আমার কপাল খারাপ। পরদিন থেকে ক্লাস শুরু। অফিস যাবার আগে রেডি হতে বলল। ক্লাসে নামিয়ে দিয়ে অফিস যাবে। অগত্যা রেডি হলাম।
রিক্সায় বসে একটা এনাউন্সমেন্ট দিল। শোন, আমি কোন “হাউসওয়াইফ” নিয়ে সংসার করবো না। তোমাকে চাকরি করতে হবে। আমি টাকা চাই না। আমার কাছ থেকে টাকা নিও। কিন্তু চাকরি করতেই হবে। যে কোন চাকরি। আমি চাই তোমার নিজের একটা পরিচয় থাকুক। আর আমার মৃত্যুর পর যেন তোমাকে কারো দরজায় দরজায় না হাঁটতে হয়। আমার তখন বয়স কম ছিল। জীবন, বাস্তবতা, এসব নিয়ে জ্ঞান অনেক কম ছিল। তাই সেদিন কথাগুলোর মর্ম বুঝি নাই। একটা বয়সে এসে যখন বুঝলাম তার ওই এনাউন্সমেন্টের মর্ম, আমি সেদিন বুঝেছিলাম আমি কতটা ভাগ্যবতী। একজন পুরুষ কতটা বাস্তববাদী আর উদার হলে এভাবে বলতে পারে!
মাস্টার্স শেষ করলাম তার ধাক্কাধাক্কিতে। পাশ করার পর চাকরি করতে চাইনি। কারন তখন গুডলি ছোট। আমার কোলে। প্রথম বাচ্চা। ভীষণ আদরের। মাস্টার্স পরীক্ষার বিশদিন আগে ওর জন্ম। তাকে রেরেখে চাকরি করতে তখনো মন সাসায় দিদিতো না। তবু নানাভাবে বুঝিয়ে এপ্লাই করতে বলতো। গুডলির চারবছর বয়সের সময় চাকরি নিলাম একটা কলেজে। দীর্ঘদিন চাকরি করেছি তিনটা বাচ্চাসহ। এখন পরিষ্কার বুঝি আমি কিছুই করতে পারতাম না যদি তার পূর্ণ সহযোগিতা না থাকতো।
যেদিন থেকে চাকরি করছি, সকালে ঘুম থেকে উঠে যাবতীয় সব কাজে সাহায্য করে আসছে। আমি প্রাইভেট চাকরি করেছি। ছুটি নিতে অসুবিধা থাকতো সবসময়। বাচ্চাদের যেকোন প্রয়োজনে সে-ই ছুটি নিতো। দেরি করে অফিস যেতো। মেয়ের এসএসসির পুরোটা সময় ছুটি নিয়ে তার দেখাশোনা করেছে। বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে পারে আমার চেয়ে ভালোভাবে এবং করেও। আজঅবধি খুব ভোরে আমার আগেই উঠে বাচ্চাদের সকালের কাজগুলো কিছু কিছু করে রাখে। বাচ্চাদের ফ্লাস্কে পানিভরা টিফিনভরা আমার খাবার রেডি করা ইত্যাদি চাকরি করাকালীন সময়ে সামাজিক নানান দায়িত্ব থেকে আমাকে আড়াল রাখতো খুব সাবধানে। মাঝে যখন চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি তখনো সে খুব একটা খুশি হয়নি। বরং বললো, সারাদিন ঘরে বসে কি করবা, একা লাগবে। মন খারাপ লাগবে।
তার এবং আমার তিনমেয়ের অনুপ্রেরণা আমি আবার চাকরি শুরু করি। মেয়েরা মায়ের বাইরের কাজের বিষয়টাও শিখে নিয়েছে বাবারই মাধ্যমে হয়তো। তাদের পূর্ণ সহযোগিতায় কাজ করে যেতে পারছি। এই মানুষটার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার আজকের অবস্থানে আসার পেছনে অবদান তারই সবচেয়ে বেশি। আমার শনিবারের স্বাধীনতাও তার অবদান। আমি তার কাছে মানুষ। নারী নই।
আজকে নারী দিবস। আমি এই দিবসে বিশ্বাসী না। মানবতায় বিশ্বাসী। আমাদের আসলে একটা বিষয় মনে নিতে হবে। নারী পুরুষের ভেদাভেদ, বৈষম্য যতদিন থাকবে, পুরুষ যতদিন নারীকে তার পূর্ণ মর্যাদা না দিবে, তাকে সাহায্য না করবে ততদিন সমাজ এগুবে না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাঝেই সমাজে পরিবর্তন আসবে।