খুব সাধারণ একটা পারিবারের ছেলে আমি। বাবা ছিলেন সরকারি হাই স্কুলের একজন কেরানি। মা সংসারের দেখভাল করতো। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট। ভাইয়া সবার বড়, তার পর আপু, তার পর আমি। পরিবারের ছোট সন্তান হওয়ায় বাবা মা আমাকে একটু বেশিই আদর করতেন। তবে বাবার চোখের মনি ছিলাম আমি। ভাইয়া আর আপুও আমাকে খুব বেশি ভালোবাসতো। তবে মা আমাকে একটু বেশি শাসন করতো। আর আমি ছিলাম ভিশন দুষ্টু প্রকৃতির। এই দুষ্টুমির জন্য মায়ের কাছে যে কতো বকা খেয়েছি, কিন্তু বাবা আমাকে কখনো বকা দেননি। আমি যখন দুষ্টুমি করতাম বাবা তখন হেসে হেসে বলতো ছেলেটা একদম আমার মতো হয়েছে , ছোট বেলায় আমিও এভাবে দুষ্টুমি করতাম। মা তখন বাবার কথা শুনে রাগি ভাব নিয়ে বলতো, ছেলেটাকে এভাবে আস্কারা দিলে আদরে বাঁদর হয়ে যাবে একটু শাসন করো ছেলেকে। বাবা তখন মায়ের কথা কর্ণপাতই করতেন না।
আমি যখন অনেক বেলা হয়ে যাওয়া শর্তেও ঘুম থেকে উঠতাম না। তখন আপু এসে আমার কানটা ধরে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে দিত। আর বলতো, এতো বেলা করে ঘুমানো ভালো না ভাই, প্রতিদিন প্রতিদিন স্কুলের দেরি হয়ে যায় এর জন্য। মা তো আর সাধেই তোকে বকা দেয় না। আমি তখন মুখ ভেংচি দিয়ে বলতাম, ঘুম না ভাংলে আমার কি দোষ। পারলে ঘুমকে বকা দাও। ভাইয়া যখন ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরত আমার প্রিয় চকোলেটে আনতে কখনো ভুলতো না। ভাইয়া যদি একটা টি শার্ট কিনতো। তো আমার জন্যেও সেই টি শার্ট এর কালারের সাথে ম্যাচিং করে টি শার্ট কিনে আনতো। মা আমাকে যতটা না বকা দিত তার থেকে বেশি ভালোবাসতেন, কিন্তু সেটা তো আর তখন বুঝতাম না।
আমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়তাম মা তখন নিজের খাওয়া দাওয়া ভুলে গিয়ে আমার কাছে পড়ে থাকতেন। রাতে ঘুমাতেন না সরাটা রাত আমার পাশে ঘুমহীন চোখে বসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বাবা যখন স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরতেন। বাড়িতে ফিরেই আমার কাছে এসে আমার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলতেন। “”আমার সারাদিনের কষ্ট এখন দূর হয়ে গেছে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারটায় টাকার অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব ছিল না। বাবা কখনো মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না। মা যদি বাবার উপর রাগ করে থাকতো বাবা তখন মায়ের রাগ ভাঙাতেন। মা কখনো বাবার কাছে বেশি আবদার করতেন না। বাবার দেওয়া কম দামি শাড়িটাও হাসিমুখে গ্রহণ করতেন। মায়ের তৈরি করা ফতুয়াটা পড়ে বাবা স্কুলে যেতেন।
আমার আবদার কখনো বাবা ফেলতেন না। আমার সাইকেল চালানোটা খুব সখের ছিল। তাই বাবাকে বলি আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিতে। বাবা তখন বলেছিলেন, সাইকেল চালাতে গিয়ে যদি তুই পড়ে গিয়ে ব্যথা পাস। থাক এতো ছোট বয়সে সাইকেল চালাতে হবে না। আমি এর জন্য অনেক কান্না করেছিলাম। কিন্তু ঠিকই বাবা আমাকে আমার জন্মদিনে একটা নতুন সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। আমি সাইকেলটা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। এখন থেকে আমিও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাবো। আমার বন্ধুদের কে গিয়ে বলতে পারবো আমারো নতুন সাইকেল আছে। কিন্তু আমি তো সাইকেল চালাতে পারি না। বাবা তখন বললেন, আরে চিন্তা কিসের প্রতিদিন সকালে আমি তোকে সাইকেল চালানো শিখাবো। আমি তখন আনন্দে বাবাকে জড়িয়ে ধরি। এর পর থেকে প্রতিদিন সকালে বাবা আমাকে সাইকেল চালানো শেখাতে নিয়ে যেতেন।
আমি যখন সাইকেলে উঠে বসতাম বাবা তখন আমাকে ধরে থাকতেন। আর একটা সময় ছেড়ে দিয়ে বলতেন,
বাবা ভারসাম্য রেখে চালিয়ে যা ভয় পাস না। প্রথম প্রথম দু একবার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে হাত পা কেটে অবদি গেছে। আমি যখন কেটে যাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতাম। তখন আমার চোখ দিয়ে যতটা না জল ঝরতো ,তার থেকে দ্বিগুণ জল বাবার চোখ দিয়ে ঝরতো। আর মা তখন বাবাকে বকা দিয়ে বলতেন, কি দরকার ছিল সাইকেলটা কিনে দেওয়ার। এর পর আমি ধিরে ধিরে সাইকেল চালানো শিখে যাই। বাসা থেকে যখন সাইকেল নিয়ে বের হতাম, তখন মা কাছে এসে বলতো, “”একদম জোরে চালাবি না। রাস্তার এক সাইড দিয়ে যাবি।
আমি তখন হেসে বলতাম, আর বলতে হবে না আমি সাবধানেই চালাবো। বাবাও তখন এসে বলতো, মা যেভাবে বললো সেভাবেই চালাবা। এর পর আলতো করে আমার গালে চুমু খেয়ে বলতেন, সাবধানে যেও। বাবা মা ভাইয়া আপু এতোগুলো মানুষের ভালোবাসায় নিজেকে খুব পরিপূর্ণ মনে হতো। ভালোবাসায় ঘেরা একটা পরিবার, খুব সুখি মনে হতো নিজেকে। কিন্তু জীবন বড় অদ্ভুত, কখন যে জীবনের উপর দিয়ে ভয়ঙ্কর ঝর বয়ে যাবে সেটা বোঝা বড় কঠিন। আমাদের ভালোবাসার পরিবারটার উপর দিয়েও বয়ে যায় একটা ভয়ঙ্কর ঝর। যেই ঝরটা আমার পরিবারটাকে শেষ করে দেয়।
সেই ঝরটা বয়ে যায় সেদিন যখন দুপুরের দিকে বাবার ফোনে একটা কল আসে। আমার বোন নাকি পাশের এলাকার একটা ছেলেকে বিয়ে করে তার বাসায় গিয়ে উঠেছে। সেই বাসা থেকেই ফোনটা করা হয়। ফোনটা রাখতেই বাবা ধপ করে বসে পড়েন। বাবার কাছে গিয়ে যখন মা জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে কোন খারাপ কিছু, বাবা কোন কথা বলছিলেন না মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে ছিলেন। মা যখন আবার বাবাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “”কি হলো বলছো না যে কি হয়েছে। বাবা তখন মাথাটা নিচু করেই উত্তর দিলেন। “”কি ভাবে পারলো ও এই কাজটা করতে, মা তখন খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, এই বলো না কি হয়েছে, কে কি করেছে। কোন খারাপ কিছু ঘটেছে কি। বাবা তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, রায়হান কে ফোন দাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে বাসায় ফিরতে বলো। আমাদের পাশের এলাকায় যেতে হবে। আমিও চুপচাপ উঠোনের এক কনে বসে সবটা দেখছিলাম।
মা তখন বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “”পাশের এলাকায় কেন যাবে? বাবা তখন বললেন, সেখানে গিয়েই না হয় বুঝতে পারবে। এর পর ভাইয়া বাসায় ফিরলে আমরা সবাই মিলে সেই ছেলেটার বাসায় যাই। গিয়ে দেখি আপু আর ওই ছেলেটা পাশাপাশি বসে আছে। অনেক লোকজন তাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তখনও কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি ঘটেছে, আপু কেন এই বাড়িতে এসে বসে আছে।এর পর বাবা আপুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকার পর জিজ্ঞেস করলেন, “”কেন করলি এমন, এমনটা কি না করলেই হতো না। কি দোষ ছিল আমাদের, ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি।
আপু চুপচাপ মাথা নিচু করে বাবার কথা শুনছিল। ওখানে থাকা লোকজন তখন বলাবলি করছিল, “”আজকাল কার ছেলে মেয়েদের পারিবারিক শিক্ষা বলতে কিছু নেই। আরো অনেক কথাই বলছিল। বাবা তখন আবার জিজ্ঞেস করলেন, “”কি রে কথা বল, আমি তো তোর বাবা আমাকে তো জানাতে পারতি। এভাবে আমাকে কেন ছোট করলি। আপু তখন মাথাটা উঁচু করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো, “”যা করেছি ঠিক করেছি, আমি ওকে ভালোবাসি তাই বিয়ে করেছি, আর আমি ছোট খুকি না যে সবকিছু বলে করতে হবে।
বাবা অপুর ওমন কথা শুনে কিছুটা পিছিয়ে গেলেন। মা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কান্না করছিলেন, ভাইয়া তখন আপুকে চর মারার জন্য হাত উঠালে, বাবা সাথে সাথেই ভাইয়ার হাতটা ধরে ফেলেন।
তার পর বললেন, ওকে কিছু বলিস না, দোষ তো ওর না, দোষটা তো আমার? তুই ঠিকি বলেছিসরে মা তুই তো এখন বড় হয়েছিস। তোর ভালো মন্দ এখন তুই ছাড়া আর কে দেখবে। আমার ভালোবাসায় হয়তো ঘাটতি ছিল। আমাকে ক্ষমা করে দিসরে মা। তুই আমার মেয়ে ছোট থেকে তোকে খুব যত্ন করে বড় করে তুলেছি, বাবা হিসেবে তোর কাছে আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। এটাই চাই তুই সারাটা জীবন ভালো থাক।
আমি তখন একভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি, আমি তখন আমার হাসিখুশি বাবাটাকে চোখের পানি ঝরতে দেখছিলাম। আমি ও নীরবে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলাম। মা তখন আপুর কাছে গিয়ে কান্না করতে করতে বললেন, “”দশ মাস দশ দিন হাজারো কষ্ট সহ্য করে তোকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলাম। বুকের দুধ খাইয়ে তোকে তিল তিল করে বড় করে তুলেছিলাম, আর আজ তার সেই প্রতিদান দিলি। বাবা তখন মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওকে আর কিছু বলো না, চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই। এর পর আমরা বাড়িতে ফিরে আসি, বাড়িতে ফিরে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, সেইদিন প্রথম আমি বাবাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। সেদিন এর পর থেকে বাবাকে কখনো আমি আর হাসতে দেখি নাই। আমার কষ্ট হতো আমি বাবার কাছে গিয়ে বলতাম, “”বাবা আপু আর আসবে না।
বাবা তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন, জানি না রে বাপ, তোর আপু তো এখন আর আমাদেরকে নিজের কেউ ভাবে না। এভাবে কেটে যায় একটা মাস, কেমন যেন হয়ে যায় আমাদের সুখের সংসারটা। ভাইয়াও ঠিক মতো বাড়িতে থাকতো না। আমার জন্য আর চকোলেটেও কিনে আনতো না। মাও ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতো না। নীরবে শুধু কান্না করতেন। কিন্তু ঝর আরেকটা আসা বাকি ছিল তখনো। হুট করে একদিন ভাইয়াও একটা মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে এসে উঠে। বাবা তখন বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিলেন। ভাইয়া আর মেয়েটা তখন বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়, ভাইয়া তখন মেয়েটাকে বাবাকে সালাম করতে বলে। তার পর বাবাকে উদ্দেশ্য করে ভাইয়া বললো, ” বাবা ও হচ্ছে রিয়া আমরা আজ বিয়ে করেছি।
বাবা তখন অবাক হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছিলেন। আমি বাবার পাশেই বসে ছিলাম। মাও তখন রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাবা তখন বসা থেকে উঠে সজোরে ভাইয়ার গালে একটা চর মেরে বললেন, বিয়ে করে এই বাড়িতে কোন সাহসে ঢুকেছিস। আমরা তো তোর কেউ না, তোরা দুই ভাই বোন আমাকে শেষ করে দিলি। আমি আর তোদের আমার সন্তান হিসেবে ভাবি না। আজ থেকে তোর সাথে আমাদের আর কোন সম্পর্ক নেই। এ বাড়ি থেকে এখনি বের হয়ে যা। ভাইয়া তখন আর কিছু না বলে মেয়েটাকে সাথে করে নিয়ে যখন বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো, আমি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ার হাতটা ধরে বললাম, ভাইয়া যেও না তুমি।
ভাইয়া তখন এক ঝাটকায় তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। আমি তখন পড়ে যাই আমার ঠোট দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। মা দৌড়ে এসে আমার ঠোঁটে হাত চেপে ধরে। আর তখনই তাকিয়ে দেখি বাবা মাটিতে পড়ে আছে। আমি আর মা দৌড়ে বাবার কাছে যাই। কাছে গিয়ে দেখি বাবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সাথে সাথে মা চিত্কার করে উঠেন। আমি বাবা বাবা বলে ডাকতে থাকি, কিন্তু বাবার কোন সাড়া শব্দ নেই। এর পর বাবাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। বাবাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি আর মা ওটির সামনে বসে থাকি, মায়ের চোখে অঝোরে জল পড়ছিল, আমি তখন মায়ের চোখের জলটা মুছে দিয়ে বললাম, কেঁদো না মা বাবার কিছু হবে না। আমার বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। মা তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। হাসপাতালে থাকা দু একজন নার্স এসে মাকে স্বান্তনা দিতে থাকেন।
কিছুক্ষণ পার ডাক্তার ওটি থেকে বের হয়ে মায়ের কাছে এসে বললেন, আপনার স্বামী ব্রেন্টস্ট্রক করেছেন, চব্বিশ ঘণ্টা না পেরোনো অব্দি কিছু বলতে পারবো না। ওনাকে এখন আই সি ইউ তে নিয়ে যাওয়া হবে। এখন আল্লাহর উপর ভরসা রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এই বলে ডাক্তার চলে যায়। কথাটা মা কেমন যেন হয়ে যায়, মনে হচ্ছিল যেন একটা পাথরে মূর্তি হয়ে গিয়েছে। আমি তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করি,
আচ্ছা আন্টি ব্রেন্টস্ট্রক কি?
নার্স তখন বললেন, ও কিছু না বাবা তোমার আব্বু সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে, চব্বিশ ঘণ্টা রেস্ট এর মধ্যে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে । আমি আর মা একভাবে বসে আছি। গভীর রাত পুরো হাসপাতালে আমি মা আর দুজন নার্স আর একজন ডাক্তার ছাড়া আর কেউ নেই। থমথমে পরিবেশ, বাবার জন্য তখন খুব চিন্তা হচ্ছিল । আমার মন বলছিল তখন বাবার খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে। রাত আনুমানিক সাড়ে চারটার দিকে জানতে পারি বাবার জ্ঞান ফিরেছে, আমি আর মা তখন গিয়ে আই সি ইউ এর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু আমাদেরকে কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। ডাক্তার বলছিল,””এখন রোগীর কাছে গেলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু বাবার কাছে যাওয়ার জন্য আমার মনটা ছটফট করতে থাকে। আমি তখন ডাক্তার আঙ্কেল এর হাতটা চেপে ধরে কান্না করতে করতে বলি, “”আঙ্কেল একটা বার আমাকে আমার বাবার কাছে যেতে দেন, একটা বার বাবার কাছে যেতে চাই, প্লিজ আঙ্কেল। ডাক্তার আঙ্কের তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।
“”আচ্ছা ঠিক আর কিছুক্ষণপর বাবার কাছে যেও। এখন তোমার বাবাকে একটু চেকাপ করতে হবে। আর চেকাপ এর সময় ওখানে যে ডাক্তার ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না। তুমি বরং ওইখানটায় গিয়ে বসো। মা কোন কথা বলছিলেন না। জীবন্ত একটা লাশ হয়ে দাঁড়ি ছিল মা। কিছুক্ষণ পর আমাদেরকে বাবার কাছে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। আমি দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াই, বাবার মুখে কি যেন মুখোশ এর মতো দেওয়া। আর বাবার মাথায় কি সব তার এর মতো লাগানো। আমি তখন পাশে থাকা নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলি, “”আন্টি বাবার মুখে ওই মুখোশটা কেন দিয়ে রেখেছেন, নার্স তখন বললেন, ওইটা মুখোশ না বাবা, ওইটা অক্সিজেন মাস্ক। ওইটার মাধ্যমে তোমার বাবা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
আমি আর মা বাবার পাশে গিয়ে বসি । আমি তখন বাবা বলে ডাক দেই, দেখি বাবার হাতটা নড়ছে। বাবার তখন জ্ঞান আছে, বাবা হাত দিয়ে অক্সিজেন মাস্কটা খোলার চেষ্টা করছিল। ওখানে থাকা নার্স তখন বাবার অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দেয়। বাবা তখন ইশারায় তার হাতের উপর আমার হাতটা রাখতে বললেন। আমি তখন একটা হাত দিয়ে বাবার হাতটা ধরলাম। আর একটা হাত দিয়ে বাবার কপালে হাত বুলাতে থাকি। বাবা তখন আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলার চেষ্টা করছিলেন। আমি তখন বাবার মুখে কাছে গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম বাবা কি বলতে চাইছে। বাবা তখন ফিসফিস করে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, আর হয় তো তোর মাথার উপর গাছ হয়ে ছায়া দিতে পারবো নারে বাপ। আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। জীবন নামের সাইকেলটা যে এখন থেকে তোকে একাই চালাতে হবে।
আমি আর থাকবো না তোকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। তবে একটা কথা মনে রাখিস, জীবন নামের সাইকেল থেকে কখনো ভারসাম্য হারিয়ে ফেলিস না। তোর মাটা বড্ড একা হয়ে গেল, মাটাকে আগলে রাখিস। কখনো কষ্টদিস না ওকে। তোর ভাইয়া আর আপুর খোঁজ খবর নিস। তার পর বাবা একটু থেমে থেকে আবার বলতে থাকলেন। ওদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে জানিস, কিন্তু কতটা অভাগা আমি, জীবনের শেষ মূহুর্তে ওদের পাশে পেলাম না। তবে তুই কখনো তোর মাকে কষ্টদিস না। ভালো থাকিস আমার কলিজাটা। এই বলে বাবা চুপ হয়ে যায়। ডাক্তার তখন এসে বললেন, আপনারা এখন তাহলে একটু বাইরে গিয়ে বসেন, উনাকে এখন একটু রেস্ট নিতে দিন। সকালে আপাদেরকে আবার উনার কাছে আসার অনুমতি দেওয়া হবে।
আমি আর মা তখন বাইরে গিয়ে বসলাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। আমি সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু সকাল হতেই যেন সব শেষ, ডাক্তার আই সি ইউ থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “”অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওনাকে বাঁচাতে পারলাম না, আই এম স্যরি। এই বলে ডাক্তার ওখান থেকে চলে গেলেন। আমি তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা কন্ঠে বললাম, “”মা ডাক্তার আঙ্কেল এগুলো কি বলে গেলেন, বাবা নাকি বেঁচে নেই। ডাক্তার আঙ্কেল এগুলো মজা করে বললেন তাই না মা।
কিন্তু মা কোন কথা বলছিলেন না। শুধু বিরবির করে কি যেন বলছিলেন। আমি তখন দৌড়ে বাবা কাছে যাই, “”বাবা ও বাবা উঠো না বাবা, ডাক্তার বললেন তুমি না কি আর নেই এসব মিথ্যা তাই না বাবা। কিন্তু বাবার কোন সাড়া শব্দ নেই কারণ বাবা যে আমাকে ছেড়ে মাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন । আমি তখন বাবা বাবা বলে চিত্কার করে কাঁদতে থাকি। এর পর বাবার লাশটা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসি। পুরো বাড়ি ভরতি মানুষে ভরে যায়। উঠোনের একটা কোনে বাবার লাশটা রাখা হয়। মা বারান্দার এক কর্নারে চুপচাপ এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন।
আমি বাবার পাশে বসে আছি। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বলছে, “” আহারে কতো ভালো একটা মানুষ ছিল,এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে কে জানতো। অথচ এরাই একদিন বাবাকে নিয়ে কতো বাজে কথা বলেছে। আর আমার বাবাটা মুখ বুজে সহ্য করেছিল এদের বলা বাজে কথা গুলো। এর পর বাবাকে গোসল করিয়ে কাফোনের কাপড়ে জড়িয়ে খাঁটিয়ায় নিয়ে শোয়ানো হয়। বাবাকে তখন খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল, কতো সুন্দর ভাবে ঘুমিয়ে আছে। আমি তখন হাতটা দিয়ে বাবার মুখটা স্পর্শ করে বলি, “”বাবা ও বাবা একটা বার চোখটা খোলো না। আমাকে একটাবার বাপ বলে কলে তুলে নাও না বাবা। পাশে থাকা মুরুব্বিরা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, “” আহারে এতটুকু বয়সে ছেলেটা এতিম হয়ে গেল, কাদিস না বাজান, তুই এভাবে কাঁদলে যে তোর বাবার আত্মা কষ্ট পাবে, ধৈর্য ধর।
কিন্তু আমি তো ছোট্ট একটা ছেলে বাবাকে ছাড়া কি ভাবে থাকবো। এর পর জানাজা সম্পন্ন করে আমার বাবাটাকে ওই অন্ধকার কবরের মাঝে চিরদিনের মতো রেখে আসি। আমার খুব কষ্ট হতো, ভাইয়া আর আপুকে তখন প্রচন্ড ভাবে, ঘৃণা করতে থাকি। আপুর কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু আপু আসেনি, ভাইয়ার খোঁজ জানতাম না। মনে মনে ভেবে নেই যদি কোনদিন ওরা আমার মুখোমুখি হয়, তবে একটা কথাই জিজ্ঞেস করবো, “”কেন খুন করেছিলি আমার বাবাটাকে, তোরা খুনি, আমার বাবার খুনি। আমার বাবাকে কেন কষ্ট নিয়ে মরে যেতে হলো বল , আমি চিত্কার করে সেদিন ওদের কাছে জবাব চাইবো। বাবাকে ছাড়া খুব একা হয়ে পড়ি আমি, মা শুধু কান্না করতেন। আর আমি বাবার কবরের পাশে গিয়ে একভাবে বসে থাকতাম।
বাবাহীন ভালোবাসার রাজ্যটা এক ধুসর মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যায়। কিছুদিন পর মাকে নিয়ে বাড়িটা ছেড়ে নানুবাড়িতে পারি যমাই। মাও কেমন যেন হয়ে যায়, ঠিক মতো কারো সাথে কথা বলতেন না। সবসময় বির বির করে কি যেন বলতেন। আমি মায়ের কাছে গিয়ে যখন দাঁড়াতাম মা তখন একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো কিন্তু কথা বলতেন না। একটা পর্যায়ে গিয়ে মায়ের অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে যায়। আর মাও আমাকে একা করে দিয়ে চিরদিনের মতো চলে যান না ফেরার দেশে। পুরোপুরি এতিম হয়ে যাই আমি। এর পর আস্তে আস্তে নানুবাড়ি থেকে বড় হতে থাকি। জীবন নামক সাইকেল নিয়ে সময়ের পথে একা চলতে শুরু করি।
আজ বিশটা বছর পর আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার চিরচেনা সেই বাড়িটার উঠোনে। যেই বাড়িটাতে রয়েছে আমার হাজারো স্মৃতি। যেই বাড়িটাতে রয়েছে আমার বাবা মাকে ঘিরে হাজারো স্মৃতি। স্মৃতি গুলো যেন আমার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাড়ির উঠোন জুড়ে আগাছায় ভোরে গেছে, দেয়ালের রঙটা চটে গেছে। অথচ এই বাড়িটা একটা সময় হাসিতে খুশিতে পরিপূর্ণ ছিল। আর আজ সেই বাড়িটা বিশটা বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আমি তখন চিলেকোঠার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। চিলেকোঠার দরজাটা ঘুণে ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। চিলেকোঠার এক কোনে আমার সাইকেলটা পড়ে আছে। আমার সাইকেল, আমার বাবার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। এতগুলো বছর এখানে অযত্নে ধুলোমাখা অবস্থায় পড়ে আছে। চোখে জলটা তখন টলমল করছিল।
আমি তখন আস্তে আস্তে সাইকেলটার কাছে যেতে থাকি। সাইকেলটার কাছে গিয়ে যখন বসলাম মনে হচ্ছিল যেন আমার বাবা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তখন সাইকেলটার উপর হাত বুলাতে থাকি তখন মনে হচ্ছিল যেন আমি আমার বাবাকে স্পর্শ করেছি। আমার চোখের জল সাইকেলটার উপর গিয়ে পড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পর আমি চিলেকোঠা থেকে বের হয়ে আসি। চিলেকোঠা থেকে বের হয়ে তখন আকাশের দিকে মুখ করে চোখটা বন্ধ করে বলতে থাকি। “”এই দেখো বাবা তোমার কলিজাটা আবার তোমার ভালোবাসার নীড়ে ফিরে এসেছে। আমাকে এসে একটাবার জড়িয়ে ধরবে না বাবা। আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে বলবে না, যে এতগুলো বছর কোথায় ছিলিরে বাবা তোকে ছাড়া যে আমি খুব কষ্টেছিলাম।
জানো বাবা তুমি আমাকে বলেছিলে না যে জীবন নামের সাইকেল থেকে যেন কখনো ভারসাম্য না হারাই। দেখ বাবা আমি ভারসাম্য হারাইনি। কারণ তোমার দেওয়া আত্মবিশ্বাস যে আমার সাথে আছে। প্রতিটা মানুষের জীবনে সফলতার পিছনে একজন মানুষ থাকে। আমার জীবনের সেই মানুষটা তুমি বাবা। আজ আমি সফলতা অর্জন করতে পেরেছি বাবা। আজ আমি গর্বিত বাবা, তোমার সন্তান হিসেবে আজ আমি গর্বিত। খুব ভালোবাসি তোমাকে বাবা, আই লাভ ইউ সো মাচ বাবা।