আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। মা কিছু খাবে ? মা মাথা নেড়ে না বলেন। মায়ের নাকে রাইসটিউব পড়ানো। অক্সিজেন চলছে। ক্যাথিটার লাগানো আছে। কে বলবে আমার মা একদিন সেরা রুপসী ছিলেন। দিদিমা বলতেন রানুর পা দুধে রাখলে পা আর দুধ আলাদা করা যায় না। আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার ছোটবেলায় কর্তা’মার অনুরোধে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ছোট মা আমায় দেখলেই বলতেন ” নাড়ু খাইবা! “বরিশালের নারিকেলের নাড়ু। খুব সোয়াদ। সৎমা বলে যে মানুষের একটা ভীতির ব্যাপার আছে।
আমি সেসব জানতাম না। প্রায় দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি একাই শিশু ছিলাম বাড়িতে। এরপরে আমার দুটি ভাই একটি বোন হয়েছে। ছোট মায়ের পেট থেকে। বয়সে আমি বড় হবার কারণেই হোক আর বাড়ির বড়ছেলে হবার কারণেই হোক। ভাইবোনেরা আমাকে খুব ভক্তি করে। ওরা দাদা বলতে অজ্ঞান। আমিও প্রতিদিন একবার ওদের না দেখলে উতলা হয়ে যাই। আমাদের বাড়িতে প্রচুর দাসদাসী না থাকলেও সচ্ছল পরিবার। ভাই দুজন ভাল চাকরি করছে। বোনটার ভাল বিয়ে দিয়েছি। নর্থ ক্যালকাটায় থাকে।
বাবা মারা গেছেন দশ বছর আগে। মারা যাবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বলেছি, ‘ বাংলাদেশে চলুন। উনি রাজি হননি। যতোদিন সুস্থ্ ছিলেন শুধু দেশের কথা বলতেন। আমাদের নাকি পাঁঁচ বিঘে জমির উপরে বাড়ি আছে। দুটো পুকুর, বাগান সহ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সব ছেড়ে এসেছেন। না এসে নাকি উপায় ছিল না। পাক সেনাবাহিনী তখন পুরো দেশটায় তাণ্ডব চালাচ্ছে। পঁচিশে মার্চের ভয়াবহতার পরেই বাবা ঢাকা থেকে মাকে নিয়ে কোনমতে পালিয়ে বাড়ি চলে আসেন। বাবার বয়স তখন সাতাশ, তাগড়া যুবক। এই বয়সী মানুষদের দেখলেই গুলি। রাস্তাঘাটে চেকপোস্ট চেকিং এ আরো বিপদ। প্যান্ট খুলে দেখাও। তুমি হিন্দু কি মুসলিম। তারপরেও ছাড় নেই চার কলিমা বলো। বাবা এসব দেখে দ্রুত ঢাকা ছাড়েন। সাথে আমার রুপসী মা।
আমাদের বাড়ি ছিল নাটোরের সিংড়া উপজেলার নলডাঙ্গা গ্রামে। বনলতার দেশ। মা নাকি নিজের দেশে এসে হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। প্রতিদিন গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পুকুরে নাইতেন। এই পুকুর বাড়ির পেছনে। বড় বড় আম গাছ গলাগলি করে ছায়া হয়ে আছে। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। আর বাড়ি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তাই কেউ এই নিয়ে কিছু বলতেন না। বাবা মাঝেমাঝে সময় কাটাতে সামনের পুকুরে ছিপ নিয়ে বসতেন। পাশাপাশি আরো কয়েকঘর হিন্দু, মুসলিম থাকায় বাবার মেশার লোকের অভাব হত না।
একদিন নরেশ পাল এসে বাবাকে বললেন ” গোবিন্দ চলে যাচ্ছি। পারলে তুমিও চলে যেও। অবস্থা সুবিধার না। ” বাবা নাকি খুব অবাক হয়েছিলেন। ঘরে এসে কর্তা’মাকে বলতেই উনি মরা কান্না জুড়লেন। “তুই আইজই কলিকাতা যা। কি আছে এই পোড়ার দ্যাশে? আমি আগেই কইছিলাম। এইহানে থাহোন যাইবো না। নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে ঘর বাঁধা যায় বাবার মাথায় আসেনি। কর্তা’মার ভাইয়েরা কলকাতা থাকে। কখনো সেখানে বেড়াতেও যাওয়া হয়নি। বাবা নরম মানুষ পরে গেলেন বিপদে। রাতে ঘুম হয়না। পাশে মা অঘোরে ঘুমান। উনি নিরবে জেগে কাটান। আর জাগেন কর্তা মা । হাতে বেঁতের ঝুড়ি। ঝুড়িতে চিড়ে গুড়। বাড়ির দলিল। একটা সাদা থানে জড়ানো গোপন কিছু। কখন না জানি দেশ ছাড়তে হয়।
একদিন সন্ধ্যেয় মা পুকুরে নাইতে গেছেন। এমন সময় মুসলমান প্রতিবেশী ওসমান মির্ধা এলেন। উনি বাবার চে বয়সে বেশ বড়। এসেই বলেছিলেন “গোবিন্দ এখুনি এই টুপি লুঙি পড়ো। পেছনের দরজা দিয়ে সোজা উত্তরে হাঁটবে। হালতির বিলে নৌকা বাঁধা আছে। সেখানে আশেপাশের গ্রামের আরো কয়েকজন আছে । তাদের সাথে বর্ডার পার হবে। তারপর তোমার পথ তুমি দেখবে। বাবা, দ্রুত কর্তা’মার কাছে গেলেন। সব শুনে উনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ” এইসব, আমাদের সবকিছু দখল করার ধান্দা। দূরে নিয়া তোরে মেরে ফেলবে। আমি জীবন থাকতে তোরে একলা যাইতে দেবো না।”
এমন সময়ে কিছু গুলির শব্দ ভেসে আসে। আর কিছু আর্তনাদ। কর্তা’মা বাবার হাত ধরে হিঁচড়ে পেছনের বাগান দিয়ে চলে গেলেন। জলমাখা শরীরে আমার মা চেয়ে চেয়ে দেখেছিলেন। একজন কেউ যাবার সময় তার নাম ধরে একবার ডাকেনি পর্যন্ত। মা ঘরের পালঙ্কের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ। কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। অনেক শব্দ। জোরে জোরে শব্দ দরজায় লাথি। মা সিন্দুকের তালা খুলে রেখে , বাইরে এসে পেছনের পুকুরে ডুব দিলেন। এর তেরোদিন পরে মা পাশের গ্রামের পালবাবুর পরিবারের সাথে কলকাতায় আসেন।
মা আসার দুদিন পরেই বাবা দেওঘর তাদের কোন আত্মীয় বাড়ি চলে যান। মা নিজের গহনা বিক্রির টাকায় এ বাড়ি কিনেছিলেন। এই বাড়িতেই আমার জন্ম। কর্তা’মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, মায়ের ছোঁয়া খাননি। সারাক্ষণ বলতেন ” পাতকী, মহা পাতকী। তোর নরক বাস নিশ্চিত।” মা কখনো প্রতিবাদ করেছেন এমন দেখিনি। রান্নার ঠাকুর ছিলো। তবে বাবা খাওয়ার সময় মা দু’বেলা উপস্থিত থাকতেন। ছোটমাকে নির্দেশ দিতেন। কখন কী দিতে হবে। প্রতিদিনের নিয়ম মুখস্ত হবার কথা । তবুও দুজনেই এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন। আজ হঠাৎ বাংলাদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে মাকে যখন বললাম, মায়ের ধূসর ঠোঁটেও যেন কথা ফুঁটলো। আমি কান এগিয়ে দিলাম। মা বললেন ‘ ওসমান, ওসমান। ‘
আমি চমকে উঠি। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা মনে হতেই ‘কর্তা’মাকে দেখেছি। ওসমান নাম ধরে বকাবকি করছেন। ‘ রুপ, রুপ, রুপই সব খাইলো। রুপের লাগিন আইজ আমরা দ্যাশ ছাড়া। কথাগুলো বড্ড কঠিন। মা সারাদিন ছোটমায়ের ছেলেপুলেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তার কাছে জিজ্ঞেস করে কোন লাভ নেই। একদিন কাউকে না পেয়ে ছোট’মাকেই বললাম – ছোট মা কর্তা মা সারাদিন এমন করে কেন? উনি বললেন ” অনেক বড় বাড়ি, পুকুর, বাগান সব মুসলমানেরা দখল করে নিয়েছে তো ! তাই কর্তা’মা রাগারাগি করে । তুমি কিছু মনে নিওনা। নাড়ু খাইবা ! বরিশালের নারিকেলের নাড়ু ! ”
কি মনে করে বহুদিন পরে বাবার আলমারি খুলি। কেমন একটা বাবা বাবা গন্ধ নাকে জড়িয়ে ধরে। তসর, মটকার পাঞ্জাবী সব থরে থরে সাজানো। বাবা খুব সৌখিন ছিলেন। বেঁচে থাকলে আরো কতো পাঞ্জাবি হোতো। আমি ড্রয়ারটা খুলি, বেশ কিছু টাকা একটা রুমালে বাঁধা। একটা আংটি। একটা খাম। বেশ কয়েকটা চিঠি। একটা খুলি। ৭৮৬ ছোট কর্তা গোবিন্দ স্নেহাশিস নিও। তুমি বাড়ি বিক্রি করতে চাইলে জানাইও, আমি বন্দোবস্ত করবো। এর মধ্যে দুই চারজন খুব অল্প দাম বলেছে। যা বলতেও লজ্জা পাই। তবে বাড়িটা বিক্রি না করাই ভাল। আশা করছি কর্তা’মাকে নিয়ে আবার নাটোরে চলে আসবে। তোমাদের পথ চেয়ে রইলাম। ওসমান মির্ধা ১২/৭/১৯৭২
ছোট কর্তা ৩০/৮/১৯৭৯ প্রণাম, ওসমান আপনার বাড়িঘর দখল করিয়া নিয়াছে। সে সকলের কাছে বলিয়া বেড়ায়, বাড়ি আপনি তাকে দিয়া গিয়াছেন। বাড়ি আপনি আসিয়া নিজে বিক্রি করিয়া যান ইহাই মঙ্গল। ছোটবৌমা কেমন আছেন? তাহার কি সন্তানাদি হইয়াছে? কর্তা’মাকে প্রণাম। নিধিরাম দাস – পূর্ব পাড়া আরেকটা চিঠি, বহুবার হয়তো পড়া। বাবাজী গোবিন্দ স্নেহাশিস রইলো। বাড়ি নিয়ে যে যাই বলুক বাড়ি তুমি আমার কাছে বিক্রি করিবে। আমি উপযুক্ত দাম দিবো। যদিও এখন এমন বাড়ির দাম খুব কম। তবুও আমি ১০০০০ দিবো। তুমি সম্মতি দিলে আমি নিজে আসিয়া চার ভাগের একভাগ টাকা দিয়া বায়না করিয়া আসিবো। আমি কথা দিতেছি, তুমি দেশে ফিরিলে পুর্বাপর দামেই বাড়ি ফিরাইয়া দিবো। বৌমা ও কর্তা’মা কেমন আছেন।
ইতি
আবুল হাসান মির্ধা।
২০/৬/১৯৭৩
আমি চিঠিগুলি বুকপকেটে নেই। আজই আমার ফ্লাইট। কলকাতা থেকে ৪৫ মিনিটের প্লেন যাত্রা। তারপরের রাস্তা হয়তো চার পাঁচ ঘণ্টা বেশি। কেন এতোদিন আসিনি ভাবতেই মনটা খারাপ লাগে। ঢাকায় সেদিন সেমিনার শেষে আমাদের ভাল ডিনার দেয়া হল। ডিনারের ব্যবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই এই দেশে সারাক্ষণ ঝড়, বন্যা , হরতাল লেগে আছে। রাতটা হোটেলে ঘুমিয়ে আমি ভোরের বাস ধরি। রাজশাহী যাব। কাল সেমিনারে বাংলাদেশি এক অফিসারের কাছে এমনই শুনেছি। আমাকে নামতে হবে নাটোর। সেখান থেকে সিংড়া।
ঢাকা ছাড়তেই অবাক হই। এতো সবুজ চারিদিকে? রাস্তার ধুলোমাখা বাতাসে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আমি বাঙালি। আমি বাংলাদেশি। পুরো সারে চারঘণ্টা জার্নি শেষে নাটোরে নামি। পরোটা আর কাঁচাগোল্লা দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নেই। এখানে ট্যাক্সি নেই। আমি একটা সিএনজি ভাড়া করি সারাদিনের জন্য। নাটোরের রাজবাড়ি বামে রেখে সিএনজি ছুটে চলে। বাতাসে আমের বউলের গন্ধ। আমার দেশের গন্ধ। বড় বড় মহিষের গাড়িতে ধান নিয়ে যাচ্ছে কৃষক। দুদিকে শুধু আম গাছের সাঁড়ি।
খুঁজে খুঁজে একসময় আমি ঠিকই নিজের গ্রামে আসি। কি সুন্দর ঘুঘু ডাকা গ্রাম। টিয়ের সবুজের ছড়াছড়ি। গ্রামের মাথায় স্কুলের সামনে সিএনজি থামলো। সুন্দর দোতালা স্কুল, পাশেই একটি মহাবট গাছ। প্রান্তরের মতো খোলা মাঠ। আমি নামতেই একজন জিজ্ঞেস করলো। আপনি কোন বাড়ি যাইবেন? নাকি স্কুল ইন্সপেকশনে আসছেন? আমি যাবো পরেশ ভট্টাচার্যের বাড়িতে। অবশ্য উনি বেঁচে নেই। গোবিন্দ ভট্টাচার্য আমার বাবা।
– আপনে ঠাহুর বাড়ি যাইবেন? দান করতে আসছেন বুঝি?
– বুঝলাম না ঠিক। আপনি আসলে কি বলতে চাইছেন।
আসেন আমার সাথে। আম বাগানের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। বাতাসে দেশের ঘ্রাণ। আমার বুক হু হু করে ওঠে। একতালা একটা হলুদ দালানের সামনে এসে লোকটা থামে। ঢুকতেই একটা বড় সাইনবোর্ড। তাতে বড় বড় করে লেখা। ” রাধারানী আশ্রম ” আমি চমকে উঠি। চোখ আর বাঁধ মানে না। এতো বড় সম্মান কে দিয়েছে আমার মা’কে! আশ্রম দেখাশোনা করেন এক মধ্যবয়স্ক মুসলমান। লোকটি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে। হাকিম বাই উনি আশ্রম দেখতে আসছে। লোকটি এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে। খুব খুশি হলাম। ঢাকা থেকে এসেছেন বুঝি?
” আমি এসেছি কলকাতা থেকে। আমার বাবার নাম প্রাণগোবিন্দ চৌধুরী। ” লোকটির নিজেকে সামলাতে অনেকক্ষণ লাগলো। তারপর নিজ থেকেই বলল ” আপনার নাম কি ভাই? ” আপনার জন্মের কথা শুনেছি। চোখে দেখিনি।
আজ যদি আব্বা সুস্থ্য থাকতেন ! উনার চোখ যেন স্নেহের মায়া ছড়াচ্ছে। উনি আস্তে বলেন – এই আশ্রম আমার বাবার গড়া। আমার বাবার নাম ওসমান মির্ধা। চলেন আমাদের বাড়ি যাই। তুমি আমার বার বছরের ছোট। . তোমাকে তুমি বললে কি রাগ করবে?
– না, খুব খুশি হবো। আপনারা ক’ভাইবোন?
– আমরা তিন ভাই। আমাদের বোন নাই।
খাঁটি দুধের পায়েশ হাতে একজন মেয়ে আসে। দাদাজানরে বলেছি আপনে আসছেন। উনি আপনের সাথে কথা বলতে চায়। যুবক’টি আনমনে হেঁটে আসছে । শর্ষে খেত পেরিয়ে। সে কিছু শুনতে এসেছে। একটু মাটির গন্ধ নিতে এসেছে । একটা চায়ের দোকান। এলোমেলো কয়েকটা বেঞ্চ। কয়েকজন আধাবয়সী লোক চা খাচ্ছে। ছেলেটা তাদের পার হয়ে যায়। ডানে একটা মস্ত পুকুর শান বাঁধানো। ছেলেটা সেদিকে যায়। দুটি কচি আমপাতা কচলে নাকের সামনে নেয় ঘ্রাণ শোঁকে। তারপর ঘাটলায় বসে। যেন কতো পরিচিত।
কিষাণ, স্কুলে যাওয়া নাকে শিঁকনি ওয়ালা শিশু। বুকে সদ্য সুপারি জাগা বালিকা । সবাই উৎসুক হয়ে ছেলেটিকে দেখে। দুজন নতুন গোঁফ ওঠা চ্যাংড়া কৌতুহল ধরে রাখতে পারে না। বাইসাব কই যাইবাইন। কুন বাড়িত আইছুইন? আমি কলকাতা থেকে এসেছি। ওসমান মির্ধার বাড়ি যাবো। ও আপনে মির্ধা বাড়ি যাইবেন? আসেন নিয়া যাই। যুবক তবুও ওঠে না। বসে থাকে। একসময় বিরক্ত হয়ে একজন উঠে যায়। মির্ধা বাড়িতে খবর দেয়। একজন সাহেব আইছে কইলকাতা থাইকা। বইসা আছে চধরি বাড়ির পুরাণ ঘাটলায়। তারো কিছু পরে। এক বৃদ্ধ আসে। একা হাঁটতে পারে না। তাকে ধরে নিয়ে আসে তার যুবক নাতি। দাদাজান শইল খারাপ অইবো । নারে আমি বালা আছি। বহু বচ্ছর এমন বালা থাহি নাই।
যুবক চোখ তুলে তাকায়। বাবা আমি ওসমান মির্ধা তুমি কি আমারে খুজো? না, আমি একটা পরিচয় খুঁজি। যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক বৃদ্ধ। সেই চোখ সেই নাক। সেই তাকানোর ভঙ্গি। আমার নাম অনিমেষ চৌধুরী। বৃদ্ধ তার কাঁপা হাত বাড়িয়ে যুবকের গাল ছুঁয়ে দেন। চোখ থেকে ঝরে পরে গরম লবণাক্ত পানি। অনেকটা সময় কেটে গেছে। মুখোমুখি বসে আছে দুই মহাকাল। বৃদ্ধ বলছে যেন এক নতুন বাণী, নতুন সংগ্রাম, নতুন বিপ্লব তার কণ্ঠে রাতের তারার মতো খসে খসে পড়ছে। যুবক শুনছে।
প্রাণ গোবিন্দ ছিলো আমার চেয়ে বয়সে ছোট। দেখতে ছিলো কার্তিক ঠাকুরের মতো। বড় কর্তা গোবিন্দরে ছোট রাইখাই চইলা গেলেন। গোবিন্দ মস্ত বিদ্যান হইলো। গ্রামে আইতো কম। ওর শখ মাছ ধরা। একদিন দেখি সানাই বাজে। গোবিন্দ বৌ নিয়া আইলো। দেইখা চক্ষু জুড়ায়। দুইজনে ঘাটলায় বইসা থাকতো। একদিন রেডিওতে একটা বক্তৃতা হোনলাম। শরীরে লোম খাঁড়াই গেলো। গেরামে কেমনে জানি মানুষ দুই ভাগ হইলো। গোবিন্দরে কইলাম ‘দাদাঠাকুর তুমি চইল্যা যাও। গোবিন্দ চোখ তুলে কয়। তুমি যাওনা ক্যান ওসমান!
গেরাম থাইকাই বুনকা বুনকা ধোঁয়া দেহা যায়। নষ্ট রেডিওতে সবাই ব্যাটারি ভরে। একদিন গ্রামে মিলিটারি আইলো। সব যুবক পোলাপানরে ধইরা নিয়া গেলো। গাড়িতে টেনে তুললো মেয়েদের। একসময় তারা চৌধুরী বাড়িতেও ঢুকলো। তারা অনেকক্ষণ ছিলো। কিন্তু কি পাইছিলো। জানিনা তয় কী খুঁজছিলো জানি। তারা চইলা যাওয়ার ম্যালা পরে। মাঝরাইতে আমি ঘাটলায় গেলাম। আমি জানতাম। আমি সব জানতাম বৃদ্ধ কাঁদে। তার চোখ থেকে ঝরে পড়ে নোনা জল। ঠাইরেন সাতদিন আমার ঘরে আছিলো। তানারে আমি বোরকা পরাই রাখছিলাম। উপায় ছিলো না। একদিন দোফরে ডাকি কইলাম, ঠাইরেন গরম লাইগলে বোরকা খুলি থোন। ঠাঁইরেন চুপ করি থাহে। গাল বাই পানি পড়ে। আমি হাত দিয়া মুছাই নাই। আমি তানারে পরদিনই যাওয়ার ব্যবস্তা করি। তিনি আমার চোখে মায়ের মতোন।
বৃদ্ধ কাঁদে। যুবক আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ঘুঘু ডাকা গ্রাম পিছে ফেলে, হিজলের বন ছাড়িয়ে হেঁটে যায়। তার মা যদি জিজ্ঞেস করে ‘ কী আনলি? ছেলেটি আজ গর্বভরে উত্তর দিতে পারবে। আমি এনেছি মা। অনেক অনেক কথা আর সম্মানের সোনালি রোদ এনেছি আমার গায়ে মেখে। তুমি আমায় ছুঁয়ে দাও মা। মা আজ সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলবো, তোমার নিজেকে আর সরিয়ে রাখার দিন নেই মা! তুমি লজ্জা নও তুমি আমাদের গর্ব।