খেলাঘর

খেলাঘর

৩ মাস পর বাসায় ফিরে দিয়া দেখলো খুব খারাপ অবস্থায় পড়ে আছে বাসাটা। চারপাশে ধুলাবালি, মাকরশার জাল এ একাকার হয়ে গিয়েছে। কেমন একটা গা ঝিমঝিম করা পরিবেশ। এইরকম জায়গায় আহান তাকে রেখেই কাজ আছে বলে বেড়িয়ে যেতে পারলো! কিছুটা ভয়ে ভয়ে বাসার ভিতরের দিকে এগুছিলো দিয়া। হঠাৎ কারো ডাকে চমকে উঠে পিছনের দিকে তাকালো সে-

‘কে?”

“আমি আপা, এই বাসায় আগে কাম করতাম। ভাইজান আমাকে আইজকে থেকে আবার আইতে কইছে।”

“আপনি কি আমিনা খালা?”

-“জ্বি আপা, আপনে কেমনে আমারে চিনলেন?”

” শাশুড়ী মায়ের মুখে আপনার অনেক কথা শুনেছি। আমাকে চিনেন আপনি?”

” না আপা তবে বুঝবার পারছি আপনি কিডা।”

“কে বলেম দেখি?”

“আমাগো আহান ভাইজানের বউ। অনেক মিষ্টি দেখতে আপনে।”

“হাহাহা..হ্যা, ঠিকই ধরেছেন। আপনি আসায় ভালোই হয়েছে। আমার একটু ভয় ভয় লাগছিল। আর সবকিছু গোছাতেও হবে।”

“আপনি বসেন আপা আমি সব ঠিক কইরা দিতেছি।”

” না না, একসাথেই করি চলেন তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।”

“আইচ্ছা।”

২ ঘন্টা পর বাসায় ফিরল আহান। বাসায় ঢুকে অনেকটা অবাক হলো এতো তাড়াতাড়ি সবকিছু চকচকে পরিষ্কার গোছালো দেখতে পাবে ভাবে নি সে। পিচ্ছি মেয়েটা তাহলে বুঝা যাচ্ছে অনেক কাজের। আহানকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে আহানের কাছে ছুটে আসলো দিয়া। ওর শাড়ির আঁচল কোমরে গুজা, ধুলো-বালি আর কালিতে লেপ্টে আছে সারা শরীর, কাপড়-চোপড়।

“আপনি এসে গেছেন। আমার কাজ শেষ প্রায়। এখন শাওয়ার নিয়ে এসেই রান্না সেরে ফেলবো। আপনার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে?”

কথা বলার সময় দিয়ার সামনের কাটা চুলগুলো বার বার চোখের উপর এসে পড়ছিল। কালিমাখা হাতেই সে চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিলো। এতে করে কালির ছাপ পড়ে অদ্ভুত দেখতে লাগলো দিয়ার মুখ। হাসি পেল খুব আহানের কিন্তু তা চেপে রেখে বিরক্তির ভাব নিয়ে বললো –

“আমি বাইরে খেয়ে এসেছি। তুমি নিজের টা ভাবো।” তারপর দিয়াকে এড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো আহান। পরক্ষণেই তার মনে হলো এরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি। মেয়েটা এতো খাটাখাটুনি করেছে। বাইরে থেকে ওর জন্য খাবার কিছু নিয়ে আসা উচিত ছিল।

আহানের ব্যবহারে চোখে জল চলে এলো দিয়ার। ছেলেটা এমন কেন? কেন এমন করে সবসময় ওর সাথে তা দিয়া ভেবে পায় না। অনেক স্বপ্ন, আশা নিয়ে আহানকে বিয়ে করেছিল সে। বিয়ের ২ মাস হয়ে গেলো তবুও আহান তাকে একবারের জন্যও কাছে টেনে নেয়নি। সবসময় এমন ব্যবহার করে যেমন দিয়াকে তার সহ্য হয় না।

রাত ১০ টা, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় এসে নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে আহান। দিয়া আস্তে আস্তে এসে বিছানার অন্য পাশে বসলো। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার আহানের সাথে। কিন্তু কথা বলার সাহস করে উঠতে পারছে না ঠিক। কেমন একটা ভয় ভয় লাগে আহানকে। এই বুঝি এমন কিছু বলে উঠবে যাতে কষ্ট পাবে দিয়া। কতোদিন মন খুলে কারো সাথে গল্প করা হয় না। এভাবে আর কতো? দম বন্ধ হয়ে আসছে দিয়ার।

“আপনি কী ব্যস্ত? ”

“কেন কিছু বলবে?”

“না মানে.”

“মানে মানে কী? বলো কী বলবে আমি শুনছি।”

“আচ্ছা আপনি কী কখনো সুখে কান্না করেছেন?”

“মানে?”

“আমার না খুব সুখে কান্না করতে ইচ্ছে হয়। শুনেছি অনেক সুখে নাকি মানুষ কাঁদে। ওই অনুভূতি টা আজও বুঝা হলো না।”

“সুখ অথবা দুঃখ কিছুতেই আমি কাঁদি না। তোমার বয়স কম আবেগ বেশি তাই এইসব ভিত্তিহীন কথা বলছো। কাজের কোনো কথা থাকলে বলো নয়তো ঘুমাও। ”

আহানের কথায় মুখ-কালো করে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো দিয়া আর মনে মনে ভাবতে লাগলো
“এই ছেলেটা কী কখনোই আমার মন বুঝবে না?একটু ভালবাসবে না? একসাথে বসে সুখ-দুঃখের গল্প করবে না?”

“ও একটা কথা আমি এখানকার কলেজে তোমার এডমিশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তুমি কাল থেকেই কলেজ যাওয়া শুরু করে দিতে পারো। আর কী কী বই ও অন্যান্য জিনিসপত্র লাগবে তা নিজে কিনে নিও। আমার ড্রয়ারে টাকা রাখা আছে তুমার যখন যা লাগে নিয়ে নিও।”

কোনো উত্তর দিলো না দিয়া। রাগ হচ্ছে ওর ভিষণ। বিয়ে করা বউকে ভালবাসার খবর নেই উনি আছেন পড়াশোনা নিয়ে। কোন কুক্ষণে যে ছেলেটাকে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিলো এটা ভেবে আরও রাগ বাড়তে লাগলো নিজের ও আহানের প্রতি। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো দিয়ার। আহানকে জিজ্ঞেস করল –

“আচ্ছা, তিতলি কে?” দিয়ার মুখে এই নাম শুনে চমকে উঠলো আহান।

“তুমি এই নাম কোথা থেকে পেলে?”

“একটা চিঠি এসেছে আপনার নামে। তিতলি নামের কেউ একজন পাঠিয়েছে। ”

“কোথায় চিঠিটা?আগে বলোনি কেন?”- একরকম উতলাভাব নিয়ে বললো আহান। দিয়ার মনে গিয়ে আঘাত করলো ব্যাপারটা। কে তিতলি? ওর জন্য এতো উতলা হচ্ছে কেন আহান!!

” ড্রয়ারে রেখেছিলাম।”

আহান দ্রুত উঠে গিয়ে চিঠিটা খুললো। তারপর একবার চিঠিটাতে চোখ বুলিয়ে চিঠিটা প্যাকেটে রাখতে রাখতে দিয়াকে বললো –

“আমাকে এক্ষুনি বেড়োতে হবে। ফিরতে কয়েকদিন লাগতে পারে তুমি সাবধানে থেকো।”

“এতো রাতে কোথায় যাবেন?”

“ফিরে বলবো “- বলে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো আহান।

দিয়া দৌড়ে গিয়ে বেলকনিতে দাড়ালো। গাড়ি নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে যাচ্ছে আহান। এতোটা উতলা হতে আর কখনো দেখেনি দিয়া তাকে। এক অজানা কষ্টে চারিপাশ এলোমেলো লাগছে দিয়ার কাছে।  কে এই তিতলি??” এই একই প্রশ্ন বার বার দিয়ার মনে এসে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে মনটাকে। নানান বাজে চিন্তা আর নিজের প্রিয় কিছুকে হারানোর ভয় জাগিয়ে দিচ্ছে মনে।

টানা ৪ ঘন্টা ড্রাইভিং করার পর আহান একটি ঢাবার সামনে এসে গাড়ি থামালো। রাত অনেক হয়েছে রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। তার উপর কিছুটা ঘুম ঘুমও পাচ্ছিল আহানের। তাই একটু বিশ্রাম ও চা-নাস্তা করার জন্য ঢাবায় এসে থামলো। একজন মধ্যবয়স্ক লোক ঢাবাটা পরিচালনা করছিলেন। একপাশে আগুনের মধ্যে কয়েকটি মুরগি গ্রিল এ রুপান্তরিত হওয়ার জন্য ঝুলছে। অপরপাশে কয়েকজন লোক বসে চা-রুটি খাচ্ছে। সবাই আহানের দিকে অবাক চাওনির সাথে তাকিয়ে আছে। আহান সোজা এগিয়ে গেল দোকানির দিকে।

“এখানে একটু বসা যাবে?”

“জ্বি সাহেব, বসেন ” বলে লোকটি একটি ছোট ছেলেকে ডেকে বললেন –
“অই দেখ তো সাহেব কী খাবেন।”

আহান শুধু চা দিতে বললো। ঘুম কাটার জন্য চা খাওয়াটা প্রয়োজন।

“কোথা থাইকা এসেছেন সাহেব?”- একটু দূরের টেবিলে বসে থাকা একজন লোক আহানকে জিজ্ঞেস করলেন।

“ঢাকা থেকে। ”

“তা এদিকে এতো রাইতে কোথায় যাইবেন। ”

“বেলাপুর যাব। এখান থেকে আর কতোটুকু রাস্তা?”

“সে তো মেলা দূর। এদিকে সোজা যাইতে ৩/৪ ঘন্টার রাস্তা। তারপর প্রধান সড়ক ছাইরা ডাইনে কাঁচা রাস্তা দিয়া যাইতে হয়। মেলা ভিতরে গিয়ে বেলাপুর পাইবেন।রাস্তাটা অনেক খারাপ। এলাকাটাও তেমন সুবিধার না।”

“ও ধন্যবাদ। ”

” তা আপনি কী সাংবাদিক নাকি?”

” কেন?”

” না হেইখানে তো অনেক সাংবাদিকরা যায়। বেলাপুরের পুরুনো সেই জমিদার বাড়ির নানান জিনিস জানবার লাইগা। তয় কেউ একলা একলা যাওয়ার সাহস করে না। এই আপনারে প্রেত্তম দেখলাম একলা যাইতেছেন। ”

লোকটার প্রথম কথায় আহান তেমন গুরুত্ব না দিলেও এবারের কথায় হঠাৎ মনে ভয় হতে শুরু হলো তার। এলাকাটা কী এতোটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে যে কেউ একা যায় না! তাহলে তিতলি সেখানে নিরাপদ আছে তো? মেয়েটা কী একা একাই এখানে চলে গিয়েছে নাকি কাউকে সাথে নিয়েছে? কিছুই তো জানে না আহান। যোগাযোগ করার মতো কোনো ফোন নাম্বার ও জানা নেই আহানের। যে নাম্বার ছিল সেটা অনেক আগ থেকেই বন্ধ করে রেখেছিলো তিতলি। না আর এখানে বসে সময় নষ্ট করা যাবে না। এই ভেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল আহান।

“আরে সাহেব চায়ের দাম টা তো দিয়া যান।”- পিছন থেকে ছোট্ট ছেলেটি ডেকে বললো। আহান দ্রুত চায়ের দাম মিটিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। আহান প্যাকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো দিয়ার নাম্বার।

” তুমি এতো রাতে? ঘুমাও নি?”

“ঘুম আসছে না। আপনি কোথায় হঠাৎ করে এভাবে চলে গেলেন? ”

” আমি তো বললাম কাজ আছে ফিরে গিয়ে বলবো। তাহলে জেগে আছ কেন? ঘুমাও। পরে কথা বলবো। ”
বলে ফোনটা কেটে দিল আহান।

দিয়া কিছু একটা বলতে গিয়েও বলার সুযোগ পেল না। দিয়া জানে আহান নিজে থেকে তাকে কখনো কল দিবে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া সে কখনো কল দিয়ে দিয়ার সাথে কথ বলে না। দিয়া বেশি কল দিলেও বিরক্ত হয়। তাই দিয়াও আর যখন তখন কল দেয় না। কিন্তু আজ কিছুতেই দিয়ার মন শান্তি পাচ্ছে না। ঘুমও আসছে না। কেন এমন হয়ে গেলো তার জীবন! তাই শুয়ে শুয়ে ভাবছে।

আহান রাস্তা ঠিকমতো চিনে না। অনেক আগে একবার এসেছিল আর আসা হয়নি। তার উপর রাতের বেলা রাস্তা-ঘাট আরো চেনা যায় না। আগের লোকটার কথা অনুযায়ী ৩ ঘন্টা গাড়ি চালানোর পর রাস্তার পাশে কোনো দোকান-পাঠ খোলা পেলে সেখানে জিজ্ঞেস করে করে রাস্তা খুঁজে সামনে এগুতে লাগলো আহান। তবে যার কাছেই জিজ্ঞেস করছিল তারাই অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল আহানের দিকে। এতে আহানের মনের মধ্যে থাকা ভয়টা আরও বেড়ে যাচ্ছিল।

অবশেষে প্রধান সড়ক ছেড়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঢুকলো আহান। সকাল প্রায় হয়ে এসেছে। পূর্বের আকাশে অল্প অল্প করে সূর্যকিরণ দেখা দিচ্ছে। চারিপাশে ধানের ক্ষেত। কয়েকজন কৃষককেও মাঠে কাজে আসতে দেখা যাচ্ছে। এমন দৃশ্য অনেকদিন দেখা হয়না আহানের। ইচ্ছে হচ্ছে গাড়ি থামিয়ে একটু প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কিন্তু এখন এসবের সময় নেই। একবার তিতলির কাছে পৌছে যাওয়া হউক তারপর দুজনে মিলে একসাথে প্রকৃতির সব সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।

গাড়ি আরেকটু সামনে এগুতেই দেখা দিল বিপত্তি। রাস্তাটা বেশ সরু তার মধ্যে একটা একটা বড় গাছ পড়ে আছে রাস্তাটার অর্ধেক অংশ জুড়ে। এখন কীভাবে সামনে এগুবে আহান। গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে কারো দেখা পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ পর একজন লোককে এদিকে আসতে দেখা গেলো। আহান লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো –

“এখানে রাস্তায় গাছ পড়ে আছে কেন?”

“ঝড়-তুফানে পড়েছে কেউ উঠায় নাই। হাঁটা-চলার রাস্তা তো আছে সাহেব আমাগে কোনো অসুবিধা হয়না।”

” কিন্তু আমি গাড়ি দিয়ে সামনে এগুবো কী করে?”

“কোথায় যাইবেন আপনি? ”

“বেলাপুর।”

” ও বেলাপুর তো এখান থাইকা খানিকটা দূরে। হাইটাও যাইতে পারবেন না।”

“আপনি গাছটা সরানোর ব্যবস্থা করুন।”

” আমি বয়স্ক লোক আমার গায়ে কী আর এতো জোড় আছে সাহেব। আর অন্যরাও নিজের কাম রাইখা আপনার কাম করবো কিনা বুঝতাছি না।” “আপনি লোক নিয়ে আসুন বলুন যত টাকা চায় পাবে। গাছটা যাতে তাড়াতাড়ি সরানো হয়।” টাকার কথা শুনে লোকটার চোখ-মুখ চকমকিয়ে উঠলো।

“আইচ্ছা সাহেব আমি ব্যবস্থা করতেছি আপনি চলেন আমার লগে। এইখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন এইটা কেমন দেখায়। ক্লান্ত দেখাইতেছে আপনেরে। এই গরিবের বাড়িতে একটু বিশ্রাম লইতে গেলে খুশি হইমু।”

” না তার প্রয়োজন নেই। আমি এখানেই ঠিক আছি।”

” না সাহেব চলেন একটু চা-নাস্তা করাইতে পারলে আমি হমু।”

মাথাটা বেশ ধরেছে। একটু চা হলে ভালো হয়। এই ভেবে আহান লোকটির কথায় রাজি হয়ে লোকটির সাথে এগুতে লাগলো।

” সাহেব কী জমিদার বাড়িতে যাইবেন?”

“হুম।”

“একটু সাবধানে যাইয়েন। ”

“কেন?”

“জায়গাটা আর আগের মতো নাই। কিছুদিন আগেও সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘইটেছে।”

“কী ঘটেছে?” – কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল আহান। লোকটা যেই ঘটনাটা বলতে যাবে, তখনি সামনে একজন যুবক এসে দাড়ালো।

” কী চাচা, উনি কে?”

“এই যে সলিল মিয়া, একদম ঠিক সময়ে আইসা পড়ছো। এই সাহেব মেলা দূরের শহর থাইকা আইছেন। কিন্তু রাস্তায় গাছ পইড়া থাকনের লাইগা আর সামনে যাইতে পারতেছেন না। আমি তো তোমার কাছে যাইবার লইছিলাম ভালা হইছে তুমি আইসা পড়ছ। গাছটা সরানোর একটা ব্যবস্থা কইরা দেও না বাপ। উনি তোমাগো মজুরি দিয়া দিবেন।”

” শহরের সাহেব আমাগো গ্রামে আইসা বিপদে পড়ছেন আর আমরা টাকা নিয়া সাহাইয্য করুম এ কেমন কথা কইতাছেন চাচা। আমি ব্যবস্থা করতাছি আপনে উনারে নিয়া একটু চা-নাস্তা করান।”

“ধন্যবাদ, একটু তাড়াতাড়ি করলে উপকার হয়।” পাশ থেকে কথাটা বললো আহান।

” আপনে চিন্তা কইরেন না সাহেব জলদিই কইরা দিমু। আপনে কিছু জিরাইয়া লইন।”

কৃতজ্ঞতা সরুপ হাসি দিয়ে লোকটিকে বিদায় জানালো আহান। সারারাত নির্ঘুম কাটলো দিয়ার। সকালবেলা ঠিকমতো হাটতে পারছে না। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখলো আমিনা খালা নাস্তা তৈরি করে রেখেছেন।

“আহান ভাইজান কাইল এতো রাইতে কই গেলো আপা?”

“জানিনা।”

“অহ”

“আচ্ছা খালা তুমি তিতলি নামের কাউকে চিনো?”

“না আপা আমি ঠিক চিনি না তয় ভাইজান আর বড়-আপার মুখে এই নামটা কয়েকবার শুনছিলাম মনে হইতাছে।”

“অহ আচ্ছা।”

” আপনি কি আইজ কলেজে যাইবেন আপা?”

” তুমি কলেজে যাওয়ার কথা কীভাবে জানলে?”

” ভাইজান কাইল ড্রাইভার সাবরে বইলা গেছিলো আপনারে কলেজে নিয়া দেওনের কথা। সেই সকাল বেলা আমারে কইলো কখন যাইবেন জিজ্ঞেস কইরা জানাইতে।”

দিয়া কী করবে বুঝতে পারছে না। আহানের কী উচিত ছিলো না কলেজে প্রথম দিন ওকে নিয়ে যাওয়া? এ শহরের তেমন কিছুই চিনে না, জানে না সে। কী করে একা একা সব করবে। কী আর করা স্বামী যখন পাশে নেই একাই করতে হবে। ঘরে সারাদিন বসে থাকলে আরও মন খারাপ হবে। তার চেয়ে বরং কলেজ থেকে ঘুরে আসা যাক।

” আমি রেডি হয়ে আসছি তুমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো।”

” আইচ্ছা আপা।”

আহান উঠানে বসে চা-মুড়ি খাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই প্রচুর বৃষ্টি শুরু হলো। আবারও আটকা পড়ে গেলো আহান। প্রায় ১ ঘন্টা হয়ে গেছে সেই লোকটার কোনো খবর নেই। যদিও বয়স্ক কৃষকের পরিবার আহানের আদর – আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখে নি তবুও আহান মনে শান্তি পাচ্ছে না। এখন যদি উড়ে গন্তব্য স্থানে চলে যাওয়া যেত। এমনটাই ভাবনা আসছে আহানের মনে।

“দেখেন ত সাহেব একটু আগে সূর্য চমকাইল আর এখন তার উল্টা রুপ। প্রকৃতির খেল বুঝা বড় দায় আমাগো লাইগা।”

” এখনো কী গাছটা সরানো হয় নি?”

” সরানো হলেও এই বাদলের দিনে কাচা রাস্তা দিয়া গাড়ি নিয়া যাইতে পারবেন বইলা মনে হয় না।”

“ও মাই গড।”

হালকা আকাশি রঙের সেলোয়ার-কামিজ পড়েছে দিয়া। দিন দিন তার সাজ-সজ্জা যেমন অনেকটাই সাদামাটা হয়ে গেছে। হবেই না বা কেন কার জন্যই বা সাজবে? কাছের মানুষটাই তো ফিরে তাকায় না।

কলেজটা বাসা থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা। গাড়ি থেকে নেমে আনমনে হাটছে দিয়া। এখানের কোনদিকে কী কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘুম হয়নি তাই মাথাটাও একটু ঘুরছে। আজকে কলেজে আসা বোধয় ঠিক হলো না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আহানের নাম্বার ডায়েল করলো দিয়া। কিন্তু নাম্বারটা আনরিচেবল বলছে। কোথায় চলে গেলো আহান। একবারও খুঁজ নিল না। কেন যে এসব বার বার আশা করে দিয়া এটা ভেবে আবার নিজের উপরই বিরক্ত হয়।

হঠাৎ করেই মাথাটা একটু বেশিই ঘুরতে লাগলো দিয়ার। পড়ে যাচ্ছে যাচ্ছে এমন অবস্থা, এমন সময় পিছন থেকে একটা ছেলে দিয়াকে ধরে ফেললো।

“আরে আপনি অসুস্থ নাকি? আরেকটু হলেই তো পড়ে যাচ্ছিলেন।”

” না না আমি ঠিক আছি। ধন্যবাদ। ”

” ঠিক আছেন বলে তো মনে হচ্ছে না। আসেন একটু বসে পানি খাবেন।”

দিয়া ক্যাম্পাসের একপাশে রাখা একটি বেঞ্চে বসলো। ছেলেটি তার জন্য পানির ব্যবস্থা করে আনলো। চোখে-মুখে জল ছিটানোর পর কিছুটা ভালো লাগছে
দিয়ার।

” আপনি কোন ডিপার্টমেন্ট? ”

“অর্থনীতি।”

“আরে আমিও তো অর্থনীতি।”

“ও, ভালো। ”

“কোন ইয়ার আপনি? ”

“নিউ ফার্স্ট ইয়ার।”

“আরে আমিও তো সেইম।”

“ও, আমি আসলে কলেজ প্রথম এসেছি কিছুই চিনি না। একটু সাহায্য করলে উপকৃত হতাম।”

“কেন নয়, আমার সাথে চল আমি সব দেখিয়ে দিচ্ছি। সরি তুমি বলে ফেললাম। আমারা তো একই সাথের তাই।”

“ইটস ওকে।”

” আচ্ছা তোমার নাম টাই তো জানা হলো না।”

” দিয়া।”

“ওয়াও আমি আদি। দিয়া- আদি হাহাহা,,, মানে তোমার নামটা উল্টো করলে আমার নাম হয়ে যায়। ”

“হুম”

২ ঘন্টা ধরে বৃষ্টি চলছে। থামার কোনো নামই নেই। না আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আহান বৃষ্টির মধ্যেই বেড়িয়ে পড়লো।

“আরে সাহেব কী করতেছেন। এমন দিনে যাইতে পারবেন না।” পিছন থেকে বয়স্ক কৃষক ডেকে বললেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত