ভাইয়া তার প্রেমিকা না ভালোবাসার মানুষ’টার বিয়েতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আমি খুব দামি একটা পারফিউম এগিয়ে দিয়ে বললাম এটা লাগিয়ে নিতে। বান্ধবীর কাছ থেকে গিফ্ট পেয়েছিলাম এটা আমি। কারণ পানজাবী টা বেশ পুরনো। তাও সেটা ইতি আপু মানে ভাইয়ার সেই মানুষটার ই দেওয়া। লাস্ট পরিষ্কার করে ২ বার পড়া হয়ে গেছে অপরিষ্কার না লাগলেও কিছুটা ভ্যাপসা গন্ধ আছে।
পারফিউমটা লাগিয়ে দিলাম। তখন ই ভাইয়া বলল, কিরে কাঁটা গায়ে নুনের ছিটে দিতে এসেছিস। আমি কোথায় কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছি। বরং তুমি ই ইতি আপুকে নুনের ছিটা দিতে যাচ্ছ তাও আবার তাঁর দেওয়া পান্জাবী পড়ে। বলতে ই ভাইয়া ওপাশ ফিরে গেল। চুল ঠিক করে যাওয়ার জন্য রওয়না হল। আমি পারফিউম টা নিয়ে দরজার পাশে আসতে ই দেখলাম ভাইয়া হোচট খেল। সাথে সাথে ভাইয়ার জুতো টা ছিড়ে গেল ঠুশ করে। আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, দেখ ভাইয়া সব কিছু বাধা দিচ্ছে তোকে যাস নে।
শুধু শুধু ঐ মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার কি দরকার সামনে গিয়ে। ভাইয়া কিছু না শুনে জুতো টা পাল্টে এই গরমেও সু পড়ে বের হয়ে গেল। আমি টাকা জমিয়ে ভাইয়ার জন্য একটা শার্ট কিনেছিলাম। ভেবে ছিলাম ভাইয়াকে এটা দিব পড়ে যাবে আজ। কিন্তু ঘরে এসে যখন দেখলাম ভাইয়া সেই পানজাবী টা বের করে রেখেছে তখন কেন জানি শার্ট টা দিলাম না। ভেবে রাখলাম ভাইয়ার জন্মদিনে দিয়ে দিব। ঠিক দেখেছিলাম পানজাবী টা হাতে নিয়ে প্রায় এক ঘন্টা জানলার পাশে দাড়িয়ে ছিল। হয়ত স্মৃতি গুলো উঁকি দিচ্ছিল মনের কোনে। আবছা মেঘের মত যেন সব স্মৃতি হৃদয় আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল।
একসময় যে মানুষটা পুরো আকাশ ছিল আজ সেই মানুষটা মেঘের মত মনে হচ্ছিল হয়ত। হয়ত মনে প্রচন্ড ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল সব। আমার মনে আছে বেশ কয় মাস আগে ভাইয়া কে দেখতাম একটা বাক্সে টাকা জমিয়ে রাখতে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়া ই সব এখন। টিউশন কোচিং করিয়ে কোনো রকম আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। নিজের বলতে এই বাড়িটা বাবা রেখে গেছেন। ভাইয়ার টাকা জমানোটা আমার কাছে বেশ হাস্যকর লেগেছে। কারণ মেয়েরা এরকম করে ছেলেদের করতে দেখিনি। যদিও ভাইয়া কেন জমাচ্ছে জানি না। তবে এর আরো কয়েক দিন পর ভাইয়ার হাসি হাসি মুখ টা দেখে জিজ্ঞেস করলাম। কি ভাইয়া এত খুশি কেন?
তখন ই ভাইয়া, সব লজ্জার মাথা খেয়ে ছোট বোন কে বলল আগামী পরসু ইতি জন্ম দিন। যে ভাইটা আমার, কারো সাথে তেমন একটা ফ্রি না একটু লাজুক ইনট্রোবার্ট টাইপের। সেই ভাইটার মুখে এরকম কথা শুনে অনেকটা অবাক হয়ে ছিলাম আমি। আমার সাথে এরকম বা এসব নিয়ে কোনো কথা ই কখনো বলেনি। জানিস আরিফা, ইতির না খুব ইচ্ছে ওকে আমি একটা শাড়ি উপহার দেই কিন্তু জানিস তো সব সামলাতে গিয়ে কিছু ই হয় না। ইতি রিকশায় ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করে। ভাবছি এই টাকা দিয়ে একটা শাড়ি নীল একটা শাড়ি কিনব ওকে জন্মদিনে দিব। সারা বিকেল রিকশায় ঘুরবো আর ওর পছন্দের ফুচকা আর টঙ এর চা থাকবে সাথে।
জানিস তো আরিফা কয়দিন আগে ইতি কাঠের চুড়ি পছন্দ করেছিল। আমি কিনে দিতে পারিনি রে। চুড়ি কিনে দিলে কি হবে। বিকেলে মায়ের ঔষধ আনতে পারব না যে। ভাবছি সেই চুড়িগুলোও কিনে দিব। ভাইয়ার কথা গুলো শুনে কেন জানি চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল আমার। চোখের সামনে ই যেন দেখছিলাম মধ্যবিত্ত মানুষের স্বপ্ন গুলো এত বড় হয় না। তারা তাদের এই মধ্যবিত্ত ছোট ছোট স্বপ্ন গুলোতে সুখ খোঁজে বেড়ায়। যেন ভাইয়া না আমি ই ভাইয়া কথা গুলো মন থেকে বুঝে নিচ্ছিলাম। ভাইয়া গুনে দেখল ঠিক ১৫০০ টাকা আছে পুরো। সে দিন ভাইয়ার মুখে যেন প্রান খুলা হাসির উচ্ছ্বলতা দেখেছিলাম আমি। আর খুব করে চাই ছিলাম এই হাসিটা যেন সারা জীবন অমলিন থাকে। জানুয়ারির ঠিক ১২ তারিখ ভাইয়া রেডি হয়ে বেড়িয়েছে। ভাবসাব দেখে ঠিক বুঝলাম আজ হয়ত সেই বিশেষ দিন।
আমি মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেও এড়িয়ে চলল আমাকে। আমিও নাস্তা করে কলেজের জন্য রেডি হয়ে গেলাম। আর বার বার মনের মধ্যে ভাইয়ার সেই ভূবন ভুলানো হাসিটাই ভাসছিল সামনে। কলেজে ক্লাস করছিলাম। হঠাৎ হালিমা আন্টির ফোন দেখে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে রিসিভ করে যা শুনলাম। তা শুনে কিভাবে আমি বাসা অব্দি এসেছি বলতে পারব না। মা’র হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট টা বেড়ে গেছে সাথে প্রেসারটাও। মাকে দেখে কিরকব বুঝতে পারছিলাম না। কোনো কিছু না ভেবে ভাইয়া কে ফোন দেই। মাত্র এক ঘন্টা আগে বেড়িয়েছে। ফোন পেয়ে যেন পাগলের মত ছুটে আসল। হাসপাতালে নিয়ে গেলাম মাকে।
ডাক্তার মেডিসিন আর কিছু ইনজেকশন আনতে বলল। আমি মায়ের পাশে বসা ছিলাম। ভাইয়া আনতে গেল। মাসের শেষ দিকে ভাইয়ার হাতে প্রেসক্রিপশন টা দেখে যেন কেঁপে উঠল মন টা। একটু পরে ই সব নিয়ে এসে হাজির হল। দেখলাম। ভাইয়ার গায়ে নতুন শার্ট টা যা পরে আজ বেড়িয়েছিল। মা কে একটু ভালো লাগছিল। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে একটু দূরে গিয়ে বললাম, নীল শাড়িটা কেনা হয়নি তাই না ভাইয়া? ভাইয়া কিছু মুখ লুকিয়ে বলল, দূর পাগলি। মা থেকে বাকি সব বড় হয়ে গেল নাকি। না মা থেকে কিছু ই বড় হতে পারে না জানি। তবে একটু একটু জমানো খুশি গুলো কেন সৃষ্টিকর্তা বাস্তবতার যাতা কলে পিষে ফেলেন এই মধ্যবিত্ত মানুষের।
এসব কষ্ট বলার নয় বলা যায়ও না। এসব মনে ই মাটি চাপা দিতে হয়। মা একটু সুস্থ হয়ে বাড়িতে আসলেন। সবকিছু স্বাভাবিক চলেও ভাইয়াকে আর আগের মত দেখতে পেলাম না আর। সেই হাসিটা ঐ একদিনের জন্য ই হয়ত ছিল। বিকেলে শখ করে নুডলস বানলাম। ভাইয়া মেকারনি নুডলস টা খেতে খুব ভালোবাসে। ডিম আর মুরগির মাংশ দিলাম তাতে। নুডলস ঠিক ই ভালো লাগল তবে বাধ সাধল মাংসে। এই মাংস কোত্থেকে এল তা নিয়ে একটা ঝগড়া প্রায় অবস্থা। কারণ মাকে সবে মাত্র হাসপাতাল থেকে আনা হয়েছে। ঘরে তেমন কিছু ই নেই। দরকারি জিনিষ ছাড়া। আমি কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিলাম ভাইয়া আজ তোর জন্মদিন ভুলে গেছিস। মা অসুস্থ না হলে ঠিক পায়েস রান্না করে দিত।
তুমি মোরগপোলাও খেতে খুব ভালোবাসো তাই আমি টিউশনি থেকে টাকা জমিয়ে আজ আনিয়ে ছিলাম। তোমার জন্মদিনে রান্না করে খাওয়াব বলে। কিন্তু ভাইয়া, মাংস টা একটু কেটে মায়ের ডাকে এই রুমে চলে আসি। ফিরে এসে দেখি বিড়াল প্রায় সাবাড় করে নিয়েছে শুধু বাটিতে যে অল্প রেখেছিলাম তা দিয়ে তো আর মোরগপোলাও হবে না। তাই নুডলস রান্না করলাম। ভাইয়া, ঠাশ করে একটা চড় মারল আমায়। তোকে কে বলেছে এসব করতে। তুই ছোট তোর কত ইচ্ছা থাকতে পারে তা পূরণ করতে পারি না আমি। বড় ভাই হয়ে কতটা খারাপ লাগে আমার বলতে পারব না। আর তুই কিনা এততত সববব করছিস আমার জন্য বলে ই ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরল।
আমি ভাইয়াকে ধরে কেন এত কান্না করছিলাম জানি না। তবে বলেছিলাম, ভাইয়া তোর নীল শাড়ি না কেনার মত এত কষ্ট হয় নি আমার একেবারে ই না। বিশ্বাস কর একটু কষ্ট হয়নি যখন ঐ হাসি মুখ টার কথা মনে করি তখন খুব ইচ্ছে করে সেই হাসি মুখ টা দেখতে ভাইয়া। কিন্তু আমার ভাইয়ের সেই হাসি টা যে পাই না একেবারে ই পাই না। বলে আরো জোড়ে কান্না করতে লাগলাম। পৃথিবীর এই ভালোবাসা গুলো ই সবচেয়ে নিঁখাদ হয়। ভাইবোনের ভালোবাসা। বাকি সব ফিঁকে।