আত্নপর

আত্নপর

গোমূত্র পানে করোনার প্রতিকার।’ নিউজফিডে এমন নিউজ দেখে একটু আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করলাম। একটা কলকাতা ভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল ভারতের কোন এক রাজনৈতিক নেতার বয়ান ধরে এই খবর ছাপিয়েছে। পুরো নিউজটা পড়ার পর একটা কথা মনে পড়লো-‘ মূর্খ বন্ধুর চেয়ে শিক্ষিত শত্রু ভালো।’ ধরুন আপনার জ্বর হয়েছে৷ আপনার শিক্ষিত শত্রু সমস্ত প্যারাসিটামল লুট করে বলবে,’ তোর জ্বর হয়েছে। ভালো হতে প্যারাসিটামল লাগবে। সব প্যারাসিটামল আমার কাছে। আমার দাবী মান। নয়তো তুই মরবি।’

কমপক্ষে আপনি মরার আগে জেনে মরতে পারবেন কিসের কারণে আর কিসের অভাবে আপনি মরেছেন। কিন্তু আপনার মূর্খ বন্ধু কি করবে? সে এক গ্লাস গরুর ইউরিন এনে দিয়ে বলবে,’ নে। গোমূত্র পান কর। তুই ভালো হয়ে যাবি।’ তখন আর প্যারাসিটামল এর অভাবে নয়; গোমূত্র পান করে বমি বমি করতে করতে আপনি এমনেই মরবেন। সুশিক্ষিত আর স্বশিক্ষিত এই দু’টো শব্দের মাঝে যে বিস্তর ফারাক তা জানলাম নেহার কাছ থেকে। অফিসের কাজে গিয়েছিলাম চট্রগ্রাম। ভুলে ল্যাপটপ অফিসেই রেখে গিয়েছিলাম।

দু’দিন পর যখন চট্রগ্রাম থেকে ফিরে অফিসে আসলাম। ল্যাপটপের আউটলুকে তখন মেইলের বহর। একটা একটা করে চেক করে রিপ্লাই করছি। এমন সময় একটা মেইলে এসে চোখ আটকে গেলো। নেহা আইরিশকে একটা মেইল দিয়েছে- ‘ Dear Iris, I couldn’t.’ আইরিশ হলো আমি যে কোম্পানিতে জব করি; সেই কোম্পানির হংকং অফিসের একজন এক্সিকিউটিভ। তবে জাপানি নাগরিক। মেইল ভিউ করে নিচে স্ক্রোল করলাম। দেখলাম আইরিশ মেইলের বডিতে কিছু সার্জিক্যাল মাস্কের ছবি দিয়ে- জানতে চেয়েছে এর প্রাইস কতো আর বাংলাদেশে এভিলেবল কিনা। আমি নেহাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,’ আইরিশ কি আপনাকে সার্জিক্যাল মাস্কের জন্য কোন মেইল দিয়েছিলো?’

‘ জ্বী।’
‘ আইরিশ আপনাকে কি বলে সম্বোধন করেছিলো?’
‘ ডিয়ার নেহা সান।’
‘ সান মানে কি জানেন?’
‘ জাপানিজরা সবাইকে সম্মান দিয়ে সান ডাকে।’
‘ আপনি যে ডিয়ার আইরিশ বলেছেন সেটাকি ঠিক হলো? আপনি তো অন্তত মিসেস আইরিশ লিখতে পারতেন।’
‘ স্যরি ভাইয়া। আমার সেদিন সন্ধ্যায় একটা দাওয়াত ছিলো। পার্লারে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছিলো তাই তাড়াহুড়ো করে রিপ্লাই দিয়েছিলাম।’ ‘ আপনি কি জানেন চায়না যদি বন্ধ থাকে তবে মেকাপ কেনার জন্য আপনার কাছে পর্যাপ্ত টাকা থাকবে না। দুই টাকার নাপা ট্যাবলেট বিশ টাকা হয়ে যাবে?’ নেহা কোন উত্তর দিলো না।

আমি বিরক্তি নিয়ে আবার বললাম,’ একটা দেশ করোনায় ধুঁকছে। আপনি পরে আছেন পার্লার নিয়ে। আপনি তো একবার আমাকে জানাতে পারতেন। যান সামনে থেকে যান।’ নেহা চলে যেতেই আমি উই চ্যাট বের করে আইরিশকে কল দিলাম। অনলাইনেই ছিলো। প্রায় দশ মিনিট কথা বললাম। কথা বলার পর আমার মন বেশ খারাপ হয়ে গেলো। ওর হাজবেন্ড চায়নার একটা প্রভিন্সে আটকে আছে। তিনটে সন্তান। বড় মেয়েটার বয়স আট। করোনায় আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তি। দেখা করার সুযোগও পাচ্ছে না।

এরপর দু’টো যমজ ছেলে। বয়স চার বছর। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। যতো যাই হোক; সে তো মা। কোথায় এদের পাশে দাঁড়াবো। কিন্তু তা না। আমরা পরে আছি পার্লার নিয়ে, গোমূত্র নিয়ে। নিউজফিড ভর্তি আল্লাহর গুজব আর সালমান শাহ,শাবনূর,সামিরা আর ডন নিয়ে। সাবকন্টিনেন্টের মানুষদের সাইকলোজি আসলেই সমালোচনার যোগ্য। আমাদের শরীর এখনো করোনা না ছুঁলেও; আমাদের মনকে করোনা বহু আগেই ছুঁয়েছে।

ওসাকা থেকে কোম্পানির এমডি ভিসি মিটিং ডেকেছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। সাধারণত এ ধরণের মিটিং হায়ার ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত থাকে। কি মনে করে এক্সিকিউটিভ পর্যন্ত এলাউ করেছে বুঝতে পারছিলাম না। তবে বুঝতে পারছিলাম বেশ সিরিয়াস কিছু। নেহাকে বললাম, ‘ কাজ সামলাও। আমি ভিসি মিটিং এ যাচ্ছি।’ নেহা প্রতিউত্তরে বললো,’ ভাইয়া জলদি এসেন। আমি একটু আগে বেরোবো। বান্ধবীর বিয়ে।’ আমি নেহার কমনসেন্স দেখে বেশ অবাক হলাম। হেড অফিস থেকে ভিসি মিটিং এর জন্য দেখেছে। সেটা কি আমার ইচ্ছেয় শেষ হবে?

মিটিং শুরু হয়েছে। সময় যতো যাচ্ছে ততো চাপ অনুভব করছি। মনে হচ্ছে এই মিটিং শেষ হলেই দুর্ভিক্ষ শুরু হবে। দেশজুড়ে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। খাদ্যদ্রব্য এর দাম বেড়ে যাবে। কেউ কারো সাথে কথা বলবে না। হাত মেলাবে না। প্রেমিক প্রেমিকারা দূর থেকে একে অপরকে দেখবে। ভয়ে কেউ গোলাপ পর্যন্ত ছুঁবে না। শুধুমাত্র এই একটি করোনা ভাইরাসের জন্য। মিটিং এ ব্রেক আসলো। ব্রেক অব্দি যা বুঝলাম পৃথিবী থেকে দু একটা ভারত,বাংলাদেশ,পাকিস্তান মুছে গেলে কিছু হবে না। তবে একটা চায়না ছয় মাস মিল ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখলে পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যাবে। কাপড় নয়। উলঙ্গ থাকতে হবে মানুষকে।

সামান্য সারের কাঁচামাল চায়না থেকে আসে। ওষুধের কাঁচামাল চায়না থেকে আসে। কাপড় আসে চায়না থেকে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস আসে চায়না থেকে। এতো কিছু বাদ দেই। সামান্য মাস্কটাও চায়না থেকেই আসে। তারপরও কিছু পাগল ছাগল এসে বলবে ওদের উপর আল্লাহর গজব পরেছে। গজবটা যে ঘুরে ফিরে কার উপর পরছে তা আমরা বুঝছি না। ব্রেকে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি সাইত্রিশটা মিসকল। চেক করে দেখি নেহা কল দিয়েছে। আমি কল ব্যাক করলাম। কল রিসিভ করেই নেহা বললো,’ ভাইয়া জলদি আসুন। আমি বের হবো।’

‘ আপনি কি টোটালি স্টুপিড? ‘ এমন সময় পাশে ডিরেক্টর ম্যাডাম এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন,’ কে?’

‘ ম্যাডাম। আমার এসিস্ট্যান্ট। হাফ বেলা ছুটি চাচ্ছে।’

‘ ফোনটা দেন।’

আমি ডিরেক্টর ম্যাডামকে ফোনটা দিলাম। ম্যাডাম ফোনটা নিয়ে বললেন,’ আপনি চলে যান। আর আসার দরকার নেই।’ ম্যাডাম কল কেটে দিলেন। এরপর ফোনটা ফেরত দিয়ে বললেন,’ ডিওএইচএসে সাতটা অফিস অলরেডি বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের অপজিটের বিল্ডিং এ যে অফিস ছিলো ওটাও বন্ধ হচ্ছে আজ। ম্যাডাম চলে যাচ্ছিলেন। আবার ফের‍ত এসে বললেন,’ ওখানে তো তোমার এক্সগার্লফ্রেন্ড জব করে তাই না?’

‘ ম্যাম! পারসোনাল বিষয় আমি অফিসে আনি না।’

‘ আচ্ছা! আচ্ছা! তোর ফুফু আমি। আমাকে জ্ঞান দিস না। মিটিং শুর হচ্ছে চল।’

আরো দু’ঘন্টা মিটিং চলার পর ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিলো- হোয়াইট কলার যারা আছে তারা এ মাস থেকে শুধু বেতনের বেসিকটা পাবে। যদি কোম্পানি এই ক্রাইসিস সার্ভাইভ করতে পারে তখন বেতনের বাকী অংশগুলোসহ বোনাস ও অন্যান্য আর্থিক ও অনার্থিক সুবিধা ইন্টারেস্টসহ ফের‍ত দেয়া হবে। আর যারা ব্লু কলার- তাদের সবকিছুই দেয়া হবে। তবে তিন মাসের আল্টিমেটামসহ। তিন মাস পর কোম্পানি বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

ভিসি মিটিং এর ডিসিশন অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই ছড়িয়ে পরলো। ডেস্কে এসে বুয়াকে এক কাপ চা দিতে বলাতে বুয়া রেগে উত্তর দিলো,’ বানিয়ে খান। চাকরি খাইছেন আর চা খেয়ে কি করবেন? তিন মাস পর কেন? আজকেই চাকরি খেতেন।’ বুয়াকে কে বোঝাবে কোম্পানি সার্ভাইব করতে না পারলে হোয়াইট কলার কি আর ব্লু কলার কি?

অফিস থেকে বের হয়ে তিথির অফিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পুরো বিল্ডিং এর কোথাও কোন লাইট জ্বলছে না। একটা শোকের মাতম ঘিরে আছে বিল্ডিং জুড়ে। ‘ ইউ আর দ্যা লাকি ওয়ান।’ পাশে তাকিয়ে দেখি তিথি দাঁড়িয়ে আছে। ‘ তুমি এখনও কি করছো?’ ‘ জব চলে গেছে। ভাবলাম সেই খুশীতে তোমার কাছ থেকে ট্রিট নেই। ডিনার করাও।’ ডিনার তখন শেষ পর্যায়ে। ডেজার্ট এর জন্য অর্ডার করা আইসক্রিমের শেষ চামুচটুকু তিথি মুখে পুরে বললো,’ হতে পারে এটাই শেষ আইসক্রিম। হতে পারে এটাই তোমার সাথে আমার শেষ দেখা। আমাদের শেষ ডিনার। শেষ দেখা। একটা কবিতা শোনাও। আমাদের সম্ভাব্য এই শেষ দেখা- কবিতায় শেষ হোক।’

আমি একটু হাসি। হাসতে হাসতে বিড়বিড় করে বলি সাগর ইসলামের কবিতা- ওহে ঈশ্বর, মানুষ নিয়ে সুখের ব্যবসা-বানিজ্য করা একেবারে বাদ করে দিলেন নাকী? আমি কিন্তু জীবনের খাতায় সীল মেরে দেব “সুখ লেনদেন বারণ” আর প্রেমীকার পাড়ায় হাওয়ার চিঠি প্রেরণ করে আসবো “এই সুখের মতো তুমিও এক অদৃশ্য পারফিউম, ঢুকে চিপায় পরবে কোন শারীরিক মাংসবোতলে! সাবধান।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত