আমি যখন ইরাকে বিয়ে করি তখন ও রান্না পারে না। ভাত রান্না করতে গেলেও পুড়ে ফেলতো! কীভাবে পিঠা বানাতে হয়ে তা জানবে দূরের কথা। চা অথবা কফি, কিছুই সে বানাতে পারে না তখন। তার উপর বিয়ের পনেরো দিনের মাথায়ই আমার চাকুরীটা চলে যায়! আমি পুরোপুরি বেকার হয়ে গেলাম। ছোট্ট একটা দু’রুমের বাসায় থাকতাম।টানাপোড়নের সংসার।আবার সামনে ওর পরীক্ষা।
হোস্টেলে চলে যায়। এক সপ্তাহ, মাঝে মাঝে ষোলো দিন পরপর আসতো। আমার ইরাকে যেতে দিতে ইচ্ছে হতো না। ইরারও যে হোস্টেলে থাকতে তখন ভালো লাগতো না তা ওর দুচোখেই স্পষ্ট ভেসে উঠতো। তবুও কিছুই করার ছিলো না। চলে যেতো। আমি কোনোরকম দুই বেলা বাসায় আর এক বেলা বাইরে খেয়ে চালিয়ে নিচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে হেঁটে গিয়ে ভাড়ার টাকা বাঁচাতে হতো। ইরার পরীক্ষা শেষ হবার আগে আবার আমার একটা চাকুরী হয়।
যতটুকু না ইরার কাছে এটা খুশির সংবাদ ছিলো তারচেয়ে বেশি দুঃখের। কারণ রাজশাহীতে থেকে চাকুরীটা করতে হবে। বেতন কম বেশি সমস্যা না! আমি বলেছিলাম চাকুরীটা করবো না। দেখি আর কয়েকটা দিন। কাছাকাছি কোথাও হয় কি-না। কিন্তু আমাদের যা অবস্থা ছিলো। বাজার থেকে মাছ আনলে সবজি কেনার টাকা হচ্ছে না। সবজি কিনলে লবণের টাকা। বাধ্য হয়ে রাজশাহীতে গেলাম। কাজের এত চাপ থাকতো যে সপ্তাহে একবার ফোনে কথা হতো! সেখানকার বস আবার আমার কষ্টটা বুঝে ফেললেন। বললেন রাজশাহীতে ইরাকে নিয়ে আসতে। এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করুক।
ইরা আসলো। ভর্তিও হলো। তখন আর থাকা খাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। শুধু একজন লোককে দেখতাম বাসার সামনে সবসময় দাঁড়িয়ে থাকতো। প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকার কারণে একদিন লোকটার কাছে কারণ জানতে চাইলাম। লোকটা শুধু বললো— এখানে আমার কলিজার অংশ থাকে। তাঁকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না! চমকে যাওয়ার মতোই কথা! একটা বাসা, আমি আর ইরা থাকি। এখানে আবার তাঁর কলিজা কোথা থেকে আসে? ইরাকে ঘটনটা বললাম। সে বললো চিনে না। আমারও তাই মনে হয়। একদিন বস তাঁর বাড়িতে অফিসের সবাইকে দাওয়াত দিলেন। সেহেতু আমিও গেলাম। তাঁর ছেলেকে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অবাক হলাম! বেশ অবাক হলাম! কারণ বসের ছেলেই সেই লোকটা! তারপর উনি উনার হবু পুত্রবধূকে সবার সামনে উপস্থাপন করলেন!
মেয়েটা ঠিক ইরার মতো দেখতে। চমকে গিয়ে ইরাকে ফোন দিলাম। বন্ধ বলছে! তাড়াতাড়িকরে বাসায় গেলাম। ইরাকে পেলাম না! মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিলো ওর লেখা চিঠিটা পেয়ে। সুন্দর করে লিখে গিয়েছে। আমার সাথে সে আর থাকতে পারছে না। ক্ষমা করে দিতে! পৃথিবীর কোনো ছেলে এটা মেনে নিবে না। কিন্তু আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। কার কাছে বিচার দিবো? তাঁরা ইরাকে জোর করে নিয়ে যায়নি! নিজের মনের বিরুদ্ধে চাকুরীটা করে যেতে লাগলাম। কিছুদিন পর আমার জন্য একজন সহকারী রাখলেন বস। সুন্দর হাসির গোছালো একটা মেয়ে। সহকারী হওয়ার ফলে দুজনের মধ্যে ভালই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।
এই মেয়েটা যা রান্না করে না! আর হাতের পিঠা খেলে বুঝা যায়। কী যে জাদু তাঁর হাতে। হ্যাঁ বিয়ের পরই এসব আমার খুব কাছ থেকে উপভোগ করার সুযোগ হয়েছে! তাঁকে আমি ইরার কথা বলেছিলাম। সে বেশ আশ্চর্যও হয়েছিলো। ততদিনে বসের ছেলেটা অফিসে যোগ দিয়েছে। উনি আবার বৌ ছাড়া থাকতে পারেন না! সুতরাং ইরাও সারাক্ষণ তাঁর সাথেই থাকে। তরীর হাতের চা, আর নুডুলস অফিসে একরকম বিখ্যাত হয়ে যায়! সবাই সারাক্ষণ তরীর প্রসংশাতেই মেতে থাকতো। আমাদের বিয়ের দিন সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলো। ছোট বসের সাথে ইরাও এসেছিলো!
খুব বেশিদিন তো হয়নি আমাদের প্রথম পুত্র পৃথিবীতে এসেছে। চোখের সামনে কেমন ফ্যালফ্যাল করে বড় হয়ে গেছে। তরীর আবার খুব মন খারাপ থাকে। ছোট ছোট হাত পা ওর গালে না লাগলে নাকি ঘুমই আসে না। আবারও ছেলে হলো। যদিও মেয়ে হলে আমি একটু বেশিই খুশি থাকতাম! দুজনের একসাথে অফিস করা খুব দুষ্কর হয়ে যাচ্ছিলো। তবুও তরী ছাড়েনি। ততদিনে তরীর সাথে আমার বিয়ের দশ বছর হয়ে গেছে অথচ ছোট সাহেব বাবা হতে পারলেন না! তরী মা হতে পারলো না! একদিন অফিসে একান্ত আমাকে ইরা ম্যাম ডাকলেন। ডেকে জিজ্ঞেস করলেন— আমি চলে আসাতে তুমি দুঃখ পাওনি?
আমি মুচকি হেসে জবাব দিলাম— পেয়েছি, তারচেয়ে বেশি এখন সুখে আছি। আপনার কাছে আমি সারাজীবন ঋণী হয়ে থাকবো। আপনি চলে না গেলে হয়তো কোনো তরী আমার সহকারী থেকে সহযোদ্ধা হতো না। আপনি আরো আগে চলে গেলে বেশি ভালো হতো কিনা জানি না। তবে আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে। যে যায়, সে ভালোর জন্যই যায়। এসব শুনে এক মুহূর্তেই ইরার চোখমুখ যে কেনো লাল হয়ে গেলো বুঝলাম না!