– আচ্ছা আপনি কি একটু পর ঘুমিয়ে পড়বেন?
পাশের সিট থেকে কথাটা ভেসে আসতেই মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখটা সরিয়ে সেইদিকে তাকালাম। তারপর ম্লান হেসে বললাম,
– উম না, জার্নিতে ঘুমাতে পারি না। তাছাড়া আমি জার্নির আগে ঘুমিয়ে নিই। বিশেষ করে রাতে হলে।
– আমিও আপনার মতই জার্নিতে ঘুমাতে পারি না। আরে জার্নিতে কেউ ঘুমায় নাকি? কত কিছুর দেখার বাকি। গাছের ছুটাছুটি, মাঝে মাঝে রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলোতে আশেপাশে টা একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া। তারপর চলন্ত গাড়ি থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারার গতিবেগ লক্ষ করা। এই না হলো জার্নি, মানুষ যে কিভাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যায় বুঝতে পারি না। আমার তো বাপু ঘুম আসবেই না। চাইলেও আসবে না। পাশের সিটে যে বসে আছে তিনি একটা মেয়ে। কথার ভাব দেখে মনে হচ্ছে বেশ চঞ্চলা। আবছা আলোতে চেহারা ভালো করে বোঝা না গেলেও মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে থাকা আলো এসে এক ঝলক চেহারাটা দেখিয়ে দিচ্ছে। বেশ সুন্দরই মনে হলো। মেয়েটার কথায় আবারও একটু হাসলাম। তারপর বললাম,
– সবাই হয়তো আপনার মত ভাবে না তাই ঘুমিয়ে পড়ে। আমার কথা শুনে মেয়েটা একটু হাসলো। তারপর বললো,
– কিন্তু এটা ভাবা উচিত, প্রতিটা মানুষেরই ভাবা উচিত। জীবন আর কয়দিন বলুন? এইটুকু সময়ের মাঝে যদি প্রকুতির অপরূপ সৌন্দর্য্য না দেখলো, তবে কখন দেখবে? কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটার হাস্যউজ্জল মুখটা যে নিমিষেই মলিন হয়ে উঠলো সেটা গলার স্বরেই বুঝলাম। চাঞ্চল্যকর মানুষের হুট করেই এমন পরিবর্তন বেশ বেমানান লাগে বটে। মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো। কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিনের আলোতে যতটুকু বুঝতে পারছি কিছু একটা বলতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে, হয়তো সংকোচবোধ করছে। অবশেষে যখন দেখলাম মেয়েটা কিছুই বলছে তখন নিজেই প্রশ্ন করলাম,
-কিছু বলবেন? বললে বলতে পারেন। আমার কথা শুনে মেয়েটা মনে হয় সংকোচবোধ টা কাটিয়ে ফেললো। তবুও আটকা আটকা গলায় বললো,
– যদি কিছু মনে না করেন তবে জানালার…
কথা শেষ না করলেও বুঝলাম মেয়েটা জানালার সাইটের সিটটাই বসতে চায়। কিন্তু পরে আমি কি বলবো না বলবো সেই ভেবে এতক্ষণ বলতে পারছে না।
– ও এই কথা? জানালার সাইটের সিটে বসবেন? তা বসুন না। আমার কোনো সমস্যা নেই।
– না আপনার সমস্যা না থাকলে আমি সিট থেকে উঠে দাড়াতেই মেয়েটা আর কিছু বললো না। বসতে বসতে বললো,
– জানালার সাইটে না বসলে জার্নিটা ঠিক জমে না। কিন্তু আপনার তো অসুবিধে হলো মনে হয়।
– না সমস্যা নেই। আর তাছাড়াও আমার মত আমি এতটাও রোমান্টিক না। আমার কথা শুনে তিনি ভারী গলায় বললেন,
– আছিই বা কয়দিন বলুন, যে কয়টা দিন আছি একটু দেখে নিই সবটা।
– কোন দেশে যাচ্ছেন?
মেয়েটা উত্তর দিলো না, তার পরিবর্তে একটু মিহি কণ্ঠে হাসলো। ভারী অদ্ভুদ মেয়ে কিন্তু, এই ভালো এই মুখটা ভার করে ফেলছে। আমি আর আগ্রহ দোখালাম না। পরে আবার ভেবে না বসে উপকারের সুযোগ নিয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করছি। আমার আবার একটা অদ্ভুদ শখ আছে। লম্বা জার্নিতে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে কোনো এক বিশেষ গান না শুনলে ঠিক ভালো লাগে না। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। গান ছেড়ে চোখটা বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে আধা শোয়া অবস্থায় আছি। একটা গানই বার বার চলছে। তবুও ভালো লাগে গানটা।
– ঘুমিয়ে পড়লেন? মিউজিকের ফাকে কথাটা কানে আসতেই গানটা বন্ধ করে দিলাম।
– না, ঘুমাইনি। কিছু বলবেন?
– না কিছু না, ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছেন তাই….
– না ঘুমাইনি।
– গান শুনছেন বুঝি?
– হ্যাঁ, তা আপনার জার্নি কেমন লাগছে?
– বরাবর যেমন লাগে ঠিক তেমনই।
– তা যাচ্ছেন কোথায়?
– বগুড়া, আপনি?
-নওগাঁ।
– তা কি গান শুনছেন? গানের নামটা বললাম। তারপর মেয়েটা বললো,
– শুনিনি কখনো।
– শুনে দেখবেন, খারাপ লাগবে না।
– ইয়ারফোনটা সেয়ার করেও কিন্তু শোনা যায়। এবার একটু ইতস্ত হয়ে বললাম,
– দুইটোই নিন না। সমস্যা নেই।
– কেন ভয় পাচ্ছেন বুঝি? নাকি সংকোচ?
– কোনোটাই না।
– তাহলে দিন, একসাথে শুনি।
বেশকিছু সময় পেরিয়ে গেলো। আর কেউ কোনো কথা বললাম না। অনেকক্ষণ পর মেয়েটা আবার প্রশ্ন করলো,
– আচ্ছা ধরুন, আপনি যদি শোনেন যে আপনার পাশের সিটে কেউ ছিলো না। মানে আমি বলতে চাচ্ছি এই সিটের টিকিট কেউ কাটেইনি, তখন কেমন লাগবে? কথাটা শুনে একটু হাসলাম। মেয়েটা বেশ রসিক বলতে হয়। হাসতে হাসতে বললাম,
– ধরে নিবো ভুতের সাথে জার্নিটা করলাম।
আমার উত্তরে মেয়েটাও একটা মিহি কণ্ঠে হাসতে লাগলো। সিরাজগঞ্জ এসে আধাঘণ্টা যাত্রা বিরতি চললো। আমিও একটু খেতে নেমেছি। বাসে উঠার সময় খাওয়া হয়নি। যাওয়া সময় প্রশ্ন করেছিলাম,
– আপনার কিছু লাগবে?
– না। আমার কিছু লাগবে না।
আমি আর কথা বাড়াইনি। নির্দিষ্ট সময় শেষ যখন বাসে উঠলাম তখন দেখি মেয়েটা নেই। হয়তো কিছু কিনতে গেছে। যা আমাকে বলতে পারেনি। কিন্তু একটু পর যখন বাসের সুপারভাইজার এসে সবাইকে দেখি গিয়ে বললো সবাই এসেছে গাড়ি ছাড়ো। কিন্তু তখনই দেখলাম মেয়েটা এখনও আসেনি। কথাটা সুপারভাইজারকে বলতেই ভ্রু কুচকে তাকালো একবার। তারপর বললো,
– এখানে কেউ নেই। এই সিটের টিকিট যে কেটেছিলো সে আসেনি।
– আসেনি? কিন্তু আমি তো…
কথাটা আর শেষ করলাম না। শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেলো। আসেনি? কিন্তু আমি তো দেখলাম। যদিও পরিষ্কার দেখতে পাইনি তবুও কথা তো বলেছি।
– আচ্ছা, আপনারা কল করেন না? যাত্রী না আসলে?
– হ্যাঁ তা করি। এই টিকিট যে কেটেছিলো তাকেও ফোন করেছিলাম যখন তিনি আসছিলো না।
– কি বললো?
– যাত্রী ফোন ধরেননি। এক মহিলা ধরেছিলো। আর বললো, যাত্রী যাবে না।
– কারণ জানতে চাইছেন? যদিও এত প্রশ্ন করা মোটেও ঠিক না। আর করা উচিতও না। কিন্তু একটা কৌতুহল চেপে বসেছে।
– তিনি মারা গেছেন।
কথাটা শুনেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসলো। বুকটা ধর করে উঠলো। মারা গেছেন ! কিন্তু আমি যার সাথে এতক্ষণ কথা বললাম? তিনি কে? মনে পড়লো, বাস ছাড়তে তিরিশ মিনিট দেরি হয়েছিলো। কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে বলেছিলো, একজন যাত্রী আসেনি। তবে কি তিনিই সেই যাত্রী? হবে হয়তো। মেয়েটার মিহি গলার হাসিটা কানে বাজছে। তার সাথে মনে পড়ছে, আচ্ছা ধরুন, আপনি যদি শোনেন যে আপনার পাশের সিটে কেউ ছিলো না। মানে আমি বলতে চাচ্ছি এই সিটের টিকিট কেউ কাটেইনি, তখন কেমন লাগবে?