আমি এবং রুম্পার একদিন

আমি এবং রুম্পার একদিন

“এক্সকিউজ মি ভাই, আপনি কী কনে পক্ষের কেউ?” বিয়ের হলে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়েছিলাম। সারারাত একফোঁটাও ঘুম হয়নি। হঠাৎ অচেনা এই মেয়েটির প্রশ্ন শুনে আমার ঘুমের ঘোর কাটলো। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর চোখ কচলাতে কচলাতে উত্তর দিলাম,

–“জি, আপনি?
–“আমি? আমিইই ধরে নিন আমি বরপক্ষ।” মেয়েটির কথায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বললাম,
–“ধরাধরি তো করতে পারবোনা। আপনি বরের কী হন সেটা বলুন।” মেয়েটি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার সামনে ঝুকে এসে নিচুগলায় বলল,

–“গার্লফ্রেন্ড হই। তিনদিন আগেই পার্মানেন্টলি ব্রেকআপ হয়েছে। বিয়ের কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার পছন্দের কালাভুনা হবে। চলে এসো। পেট ভরে খেতে পারবে”। কতবড় অপমান করল দেখেছেন? সে আমাকে সহজ সরল বোকা টাইপ মেয়ে মনে করে। আমি যে সত্যি সত্যি যে চলে এসেছি এটা সে কল্পনাও করতে পারবেনা। আর এখন দেখলেও তেমন একটা ঘাবড়াবেনা। মনে করবে তাঁর বিয়ের কালাভুনা খেতে এসেছি। হুহ! এতদিন আমার নরম মন দেখেছে। আজ কঠিন দিকটা দেখবে।”

হড়বড় করে কথাগুলো বলেই মেয়েটি নিচু হয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই শাড়ির কুচি ঠিক করতে লাগল। যেন আমি তার অতি পরিচিত কেউ। কোন সংকোচ, দ্বিধা কিচ্ছু নেই। আচ্ছা মেয়েটির কী মাথা খারাপ? একমাত্র পাগলদেরই দ্বিধা, সংকোচ কিছু থাকেনা। আমি এবার সোজা হয়ে বসে মেয়েটির দিকে তাকালাম। অতিরিক্ত হালকা গড়নের। “ফু দিলেই উড়ে যাবে” টাইপ হালকা । পড়নে সবুজ রঙের হাফসিল্ক কাতান শাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে এই প্রথম শাড়ি পড়েছে। কুচি এমনভাবে ধরে আছে যেন লুঙ্গি পড়েছে। গায়ের রঙ ফর্সা। চোখের নিচে কালি পড়ে আছে। ফর্সা গালের ডানদিকে দুটো লাল লাল পিম্পল বেশ গর্বের সাপথে সেটে আছে। আমার পকেটের ভেতর থেকে মোবাইলটা বেজে যাচ্ছে। মোবাইল বের করে দেখলাম শাহীন কল দিচ্ছে। কলটা কেটে দিয়ে আমি মেয়েটির দিকে ঘুরে বসলাম। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললাম,

–“আমার মনে হয় আপনি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। আমি কী ঠিক বললাম?” মেয়েটি চেয়ারে বসতে বসতে বলল,

–“ঠিক ধরেছেন। আপনার বুদ্ধি ভালো। আপনাদের পাত্র, মানে নিয়াজের সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা বলতে চাচ্ছি। দেখুন আমি কিন্তু এখানে কালাভুনা খেতে আসিনি ভাই। এসেছি একটি নিষ্পাপ মেয়ের জীবন বাচাতে। একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখুন তো, দেখে মনে হয় কখনো কাউকে কষ্ট দিয়েছে? তাহলে সে কেন এরকম একটা বাজে, ধোকাবাজ, সবচেয়ে বড় কথা, এমন লোভী একটা ছেলেকে বিয়ে করে মেয়েটে কেন সারাজীবন কষ্ট পাবে?” স্টেজে বসে থাকা নিষ্পাপ কনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,

–“আপনি নাদিয়ার পরিচিত?
–“নাহ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,

–” কিন্তু এসব কথা আপনি আমাকে কেন বলছেন?
–“কারণ আপনি কনে পক্ষের লোক। আপাতত কনে পক্ষের এমন কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা যে ফ্রি আছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সারারাত খেটে এখন ক্লান্ত, রেস্ট নিচ্ছেন। তবে ফ্রি তো আছেন। একজন মানুষের কিছু কথা শুনার মতো এনার্জি নিশ্চয়ই আছে আপনার। সবকিছু শুনার পর যদি আপনাদের মনে হয় বিয়েটা হবে, তাহলে আমার কিছু বলার নেই ভাই।” আমি মাথা চুলকে বললাম,

–“নিয়াজ কী খুব বেশি লোভী ছেলে?
–“হ্যারে ভাই। সব কাহিনী তো আর একদিনে বলা সম্ভব না। শুধু ও যে কী পরিমাণ লোভী সেই কাহিনীটাই বলবো আপনাকে।”

–“সবই বুঝলাম। কিন্তু আপনি আমাকে কথায় কথায় ভাই ডাকছেন কেন? আমি আপনার কোন জন্মের ভাই হই? আল্লাহ না করুক, ধরুন কাল আমাদের বিয়ে হয়ে গেল! তখন কী করবেন? নিশ্চিত আজ ‘ভাই’ ডাকার জন্য আফসোস করবেন। জেনেশুনে আপনি কেন আফসোস করবেন? তারপর ধরুন! মেয়েটি আমাকে থামিয়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

–“এত ধরাধরি তো করতে পারবোনা। আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন সেটা বলুন।আমি কী এমন মহাঅন্যায় করে ফেলেছি? ভাই ডাকবো না তো কী আপা ডাকবো? আর আল্লাহ না করবে কেন? আমি কী দেখতে এতটাই খারাপ! আপনার কী ধারণা, আমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবেনা?

আমি হঠাৎ করেই লজ্জ্বা পেয়ে গেলাম। মেয়েটির কমন সেন্স ভালো। সুযোগ পেয়ে আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সত্যিই তো! আমি এত রেগে যাচ্ছি কেন? রেগে যাওয়ার মত কোন কিছু কী ঘটেছে? ঘটেনি। নিজের ব্যাক্তিগত সমস্যার কারণে মেজাজ খারাপ হতেই পারে। তাই বলে সেটা এই মেয়ের উপর ঝেড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছেনা। রাগ, অভিমান করতে হয় প্রিয়জনের উপর। এই কঙ্কাবতীর উপর রাগ করার কোন মানে হয়না। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসলাম। দুঃখিত টাইপ হাসি। আমি কখনো কাউকে সরি বলিনা। সরির বদলে নিজের ‘দুঃখিত’ হাসি দেই। কেউ কেউ আমার সেই সরি গ্রহণ করে আবার কেউ কেউ ভুল বুঝে ফেলে। ভাবে আমি ঠাট্টা করছি। মেয়েটির আমার দুঃখিত হাসি গ্রহণ করেছে কিনা বুঝতে পারছিনা। সে এখন খুব আগ্রহ নিয়ে নিয়াজের গল্প বলে যাচ্ছে।

–“নিয়াজের সাথে আমার পরিচয় মাত্র চারমাসের। নাক, কান, গলার বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাজমুল হোসেইনে’র চেম্বারে তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা। সাথে ছিলেন আমার আম্মা। সে আমার দিকে এমন ভাবে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল যেন আমি পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় কোনো প্রাণী। যাদের সচরাচর দেখা যায়না। যাইহোক ওর তাকানো পর্ব শেষ হলে উঠে এসে আমার সামনে এসে দাড়ালো। তারপর হঠাৎ করেই কাব্যিক ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “এতদিন কোথায় ছিলেন? কোথায় কোথায় আপনাকে খুজেছি জানেন! এ শহরের সমস্ত পার্কিংলট চষে বেরিয়েছি। কিন্তু হায়! না পেলাম আপনার খোজ, আর না পেলাম আপনার সেই সাদা গাড়ির দেখা।”

কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে হাটু গেড়ে বসে আমাকে প্রোপোজ করে ফেললো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। চেম্বারের সবাই হতভম্ব চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আর আমি ভয়ে ভয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই মহিলা সাংঘাতিক সন্দেহবাজ মানুষ। নিজের সন্তানদের ওপর বিশ্বাস বরাবরই একদম কম। নিজের ছেলে-মেয়ে বাদে পৃথিবীর সমস্ত ছেলে- মেয়ে উনার কাছে সোনার টুকরা। এইযে এখন যতই বুঝানোর চেষ্টা করিনা কেন যে এই ছেলেকে আমি চিনি না, আজকের আগে কোনদিন দেখিনি, তারপরও তিনি বিশ্বাস করবেন না। হয়তো দেখা যাবে আমার কানের কাছে দুই হাতে পটাশ পটাশ শব্দ সৃষ্টি করে বলবেন, দেখলি তো? এক হাতে তালি বাজেনা।”

বাসায় গেলে আমার কী অবস্থা হবে সেটা ভাবতে ইচ্ছে করছিলো না। বারবার গলা শুকিয়ে আসছিলো। আম্মা হয়তো আজ আমার সঙ্গে কথাই বলবেন না। যা করার আব্বা আসলে করবেন। তিনি আসার পরই আসল নাটক শুরু হবে। আব্বা তখন গ্রামে গিয়েছেন, পরেরদিন সকাবেলাই চলে আসবেন। সকাল বেলা? সকাল বেলার কথা ভাবতেই আমার সব দুশ্চিন্তা কর্পূরের মতো উবে গেল। সকাল থেকেই আম্মা কানে কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। উনার ‘কান’ দেখাতেই আজ ডাক্তারের কাছে আসা। তারমানে নিয়াজ যা বলেছিল, সেগুলো কিছুই আম্মা শুনতে পানি নি। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আম্মার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম। আম্মা হাতের ইশারায় জানতে চাইলেন ছেলেটা কী বলছে।

নিয়াজ তখনও হাটু গেড়ে আমার সামনে এক হাত বাড়িয়ে বসে আছে। আমি আম্মার পার্স থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় আম্মাকে বুঝালাম যে সাহায্যের জন্য এসেছে। আম্মা আমার কথা বিশ্বাস করেছিলেন কি-না জানিনা। তবে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিয়াজ পঞ্চাশ টাকার নোট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে ভেবেছিল আমি একা এসেছি। আমার পাশে আম্মাকে দেখে এতক্ষণে তার টনক নড়লো। দুইহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে মাথা নিচু করে তড়িঘড়ি করে চলে গেল। সেই থেকেই আমাদের পরিচয়। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে সাদা গাড়িতে উঠার সময় সে আমাকে প্রথম দেখেছিল। তখন থেকেই নাকি আমাকে খুজছিলো। গাড়ির নাম্বারও মুখস্থ করেছিল। কিন্তু অনেক খুজেও পায়নি।

মেয়েটি মূল কাহিনী না বলে অহেতুক বকবক করে যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তাই বেশি বলছে। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ফটোগ্রাফারের কাজ দেখতে লাগলাম। ফটোগ্রাফার ছেলেটার নাম শিহাব। শিহাব এখন নাদিয়ার ছবি তোলায় ব্যাস্ত। আর নাদিয়াকে দেখাচ্ছে একদম পুতুলের মতো। যে পুতুলটি এখন শিহাবের কথায় উঠছে আর বসছে। শিহাবের বলতে দেরি হচ্ছে কিন্তু নাদিয়া পোজ দিতে দেরি হচ্ছেনা। বিয়ে নিয়ে সে খুব এক্সাইটেড। ভীষণ খুশিও। খুশি না হয়ে উপায় আছে! বর পেয়েছে তার মনমতো। একদম বিসিএস ক্যাডার। হ্যা হতে পারে একটু লোভী। হোকনা! ক্ষতি কী! লোভ তো আজকাল সবারই কমবেশি থাকে।

–“আপনি আমার কথা শুনছেন তো? মেয়েটি প্রশ্ন করলো। শাহীন আবার কল দিচ্ছে। আমি আবার কলটা কেটে দিয়ে বললাম,
–“অবশ্যই শুনছি। ভূমিকা শেষ হলে দয়া করে মূল কাহিনীতে আসুন। মেয়েটি একমূহুর্ত ভেবে নিয়ে বলল,

–” গত একমাস ধরে আমি খেয়াল করছিলাম যে নিয়াজ আমার ওপর বেশ বিরক্ত। কেমন খিটখিটে মেজাজ নিয়ে আমার সাথে কথা বলে। প্রতি বৃহস্পতিবার আমরা দেখা করতাম। সে আমাকে আমার পছন্দের কালাভুনা খাওয়াতো। এই একটা জিনিসই আমি আনলিমিটেড ভাবে খেতে পারি। আর কিছুই আমার মুখে রুচেনা। তো এক বৃহস্পতিবার দিন কালাভুনা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,

–“সমস্যা কী? আমার ওপর কোন কারনে বিরক্ত নাকি?” সে আরো বিরক্ত হয়ে বলল,
–“আমি কী একবারও বলেছি সে কথা? পার্সোনাল কিছু সমস্যায় আছি। তাই একটু চিন্তিত।
–“কী সমস্যা?
–“সেটা তোমার না জানলেও চলবে।
–“আচ্ছা যাও, জানলাম নাহ।

আমি আর কিছু না বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। মনে মনে ঠিক করলাম আজকের বিলটা আমিই দেব। প্রতি সপ্তাহে সে’ই দেয়। আমার উচিত মাঝে মধ্যে কন্ট্রিবিউট করা। প্রেম তো সে একা করছে না। আমিও করছি। আমি সবসময় মনে প্রানে একজন আদর্শ প্রেমিকা হতে চাইতাম! পুরনো কিছু গল্পের বই বিক্রি করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম নতুন দুইটা বই কিনবো। বই আর কেনা হবেনা এটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি নিয়াজের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম। সেও ফ্যাকাসে হাসি হাসলো। তারপর আহত গলায় বলল,

–“তুমি সত্যি জানতে চাইবে না?
–“তুমি চাইলে অবশ্যই জানবো। নিয়াজ লজ্জ্বিত কন্ঠে বলল,
–“তুমি চাইলে কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে পারো।” আমি অবাক হয়ে বললাম,

–“তাই নাকি! সেটা কিভাবে?
–“আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করেছি একটা কার রিসার্ভ করে সিলেট ট্যুরে যাব। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি গাড়ির ব্যাবস্থা আমি করে দেব।
–“হুঁ তো এখানে সমস্যা কোথায়?
–“তোমার গাড়িটা আমাকে কিছুদিনের জন্য দিতে পারবে? প্রমিস! আমি গাড়িটায় কোন আঁচ পড়তে দেবো না!
আমি দুইমিনিট চুপ থেকে বললাম,
–“ঐ গাড়িটা আমার সেটা কে বলল?
–“মানে কী? কিছুই তো বুঝলাম না!
–“ওয়েট, বুঝিয়ে বলছি।

আমার বান্ধবী ইলা আর আমার একইদিনে জন্মদিন। প্রতি জন্মদিনে ইলার বাবা ইলাকে গিফট দেন। আর ইলা আমাকে গিফট করে। কিন্তু আমি ইলাকে কিছুই দিতে পারিনা। আমি লক্ষ্য করেছি প্রতি জন্মদিনের সময় আমার আর্থিক অবস্থা চূড়ান্ত মাপের খারাপ থাকে। অনেক সময় ডাল-ভাত খেয়ে জীবনধারণ করতে হয়। তো গত জন্মদিনে ইলার বাবা ইলাকে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাদা গাড়ি গিফট করেছেন। টয়োটা এলিয়ন। ইলা আমাকে বলল জন্মদিনে আমি কি চাই। আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম প্রতি বৃ্হস্পতিবার সারাদিনের জন্য তোর গাড়িটা আমাকে দিবি, আমি সারাদিন ঘুরবো। এখন সে সত্যি সত্যি সপ্তাহের ঐদিনটায় ড্রাইভারসহ গাড়িটা আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। ব্যবহার করো আর না করো, সকাল ন’টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত গাড়িটা বাড়ির সামনেই থাকে।”

আমার কথাবার্তায় নিয়াজ বুঝতে পারলো আমি কোন বিত্তশালী মেয়ে না। তাঁর হাতে ছিল জুসের গ্লাস। সেটা গেল হাত থেকে পড়ে। ওর মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছিলো যেন কানের আশেপাশে “ধুম ধুম তানা নানা” বাজছে। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে চলে গেল। এরপর আমার সাথে আর যোগাযোগ করতে চাইতো না। ফোন দিলে কেটে দিতো। তারপর এই তিনদিন আগে এসে দেখা করলো। তাও আবার বিয়ের কার্ড নিয়ে। আমি বুঝতে পারলাম সে আমাকে ভুল করে ভালবেসেছিলো। সে ভেবেছিলো আমি বড়ঘরের মেয়ে। অনেক টাকাপয়সা আছে। কিন্তু ওর মতো ইন্টার ফেইল একটা ছেলের জন্য, আমি অনার্স পড়ুয়া মেয়ে কী যথেষ্ট যোগ্য ছিলাম না? আপনি বলুন? আসলে ও শুধু টাকা ভালবাসে। কাউকে মন থেকে ভালবাসার মতো মন ওকে আল্লাহপাক দেননি।” কথা শেষ করে মেয়েটি আচল দিয়ে খুব সাবধানে চোখ মুছলো। কিন্তু আমি চোখে কোনো পানি দেখতে পেলাম না। যাইহোক, মেয়েটির শেষের দিকের কথা শুনে আমি দারুনভাবে চমকে উঠলাম। বিড়বিড় করে বললাম,

–“ইন্টারফেইল মানে! নাদিয়া তো বলেছিল নিয়াজ বিসিএস ক্যাডার!
–“কিছু বললেন? আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
–“নিয়াজ এইচএসসি ফেইল? আপনি শিওর? মেয়েটি জোরে জোরে উপর নিচ মাথা ঝাকিয়ে বলল,

–“হুঁ। আমার ফুপাতো ভাই ওর সাথে একই কলেজে পড়েছিল। টানা তিনবার ফেইল করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে বাবার মুরগীর ব্যাবসা সামলাচ্ছিল। বর্তমানে সেই ব্যাবসায় উথালপাতাল লস খাচ্ছে। এখন বড়লোক কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সে বড়লোক হতে চাচ্ছে। আচ্ছা এতক্ষণ ধরে কথা বলছি, অথচ আপনার নামটা পর্যন্ত জানা হলোনা।” আমি গাল চুলকে বললাম,

–“আমি শ্রাবণ। আপনি?
–“রূম্পা। আচ্ছা আপনি কী কনের আপন ভাই হন? নাকি চাচাতো/খালাতো/মামাতো/ নাকি ফুপাতো ভাই, কোনটা?” আমি উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললাম,
–“উহু! কোনটাই না।
–“তাহলে?
–“বয়ফ্রেন্ড হই। রুম্পার চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেল,
–“এত সিরিয়াস একটা মুহুর্তে আপনি ঠাট্টা করছেন?
–“আমাকে দেখে মনে হচ্ছে ঠাট্টা করছি? রূম্পা কিছু বলল না। রাগী রাগী চেহারা নিয়ে বসেই রইলো। আমি বললাম,

–“নাদিয়ার সাথে আমার একবছরের প্রেম। একবছর উরাধুয়া প্রেম করার পর হঠাৎ এসে বলে, বিয়ে করতে গেলে নাকি বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। ওর কোন এক কাজিনের বিয়ে হয়েছে বিসিএস ক্যাডার পাত্রের সাথে। এখনও সেও জেদ ধরে বসে আছে। তার খেসারত এখন আমাকে দিতে হবে। যেহেতু আমিও চেয়েছিলাম আদর্শ প্রেমিক হতে। তাই ওর কথা মতো পরীক্ষাও দিলাম। কিন্তু প্রিলিতেই টিকতে পারলাম না। এ নিয়ে নাদিয়ার সে কী রাগ! অনেক কথা শুনাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে আমিও চেচিয়ে উঠলাম। ব্যাস! দুজন প্রায় একঘন্টার মতো চিল্লাচিল্লি করে ব্রেকআপ করে ফেললাম। নাদিয়া চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, একমাসের মধ্যে সে বিয়ে করবে। এবং পাত্র অবশ্যই বিসিএস ক্যাডার হবে।” রূম্পা বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল,

–“তাহলে আপনি এখানে কী করছেন? আমি কিছু বলে উঠার আগেই শাহীন আবার কল দিলো। মোবাইলটা রুম্পাকে দেখিয়ে অল্প হেসে বললাম,

–“আমার বন্ধু শাহীন। বার বার কল দেওয়ার কারণ হচ্ছে, ওর ধারণা আমি এই বিয়েতে কোন গন্ডগোল করতে এসেছি। সে ভাবছে বিয়েতে গন্ডগোল করার চেষ্টার অপরাধে আমি গণপিটুনি খেতে পারি। শাহীন এখন ঢাকার বাইরে। এখানে থাকলে এতক্ষণে আমাকে ধরেবেধে নিয়ে যেত। আমি এত করে ওকে বুঝালাম যে আমি খেতে এসেছি ঠিকই, কিন্তু সেটা গণপিটুনি নয়। শাহীন আমার কথা বিশ্বাসই করছে না। ভাবছে ঠাট্টা করছি।” রূম্পা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত আমি এখানে কেন এসেছি সেটাই ভাবছে। হঠাৎ সে বুঝে ফেলার মতো একটা ভঙ্গি করে হেসে ফেলে বলল,

–“আমি কী ঠিক ভাবছি? আমিও হাসিমুখে মাথা ঝাঁকালাম। আমি লক্ষ্য করেছি, অদ্ভুতভাবে এইমেয়ের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে, ওর পছন্দ অপছন্দের সাথেও আমার মিল আছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এই হলের মেইন শেফ শরাফতকে দেখিয়ে ফেলে বললাম,

–“মানুষটা এত ভাল কালাভুনা রান্না করে যে, খাওয়ার পর ইচ্ছে করে তাঁকে ধরে সাদাভুনা করে খেয়ে ফেলি!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত