এখন সন্ধ্যা ছয়টা রমনা পার্কের সামনের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছি মেয়েকে কোলে নিয়ে, বেড়াতে নিয়ে এসেছিলাম মেয়েকে।অনেক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি একটা রিক্সার জন্য কিন্তু রিক্সার দেখা নেই।বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে উঠলাম একটা লোকাল বাসে। সিট পাইনি মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি সামনে বেশ কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি আনমনে বাসের আশেপাশের গাছপালা ইমারত গুলোকে ছাড়িয়ে দেয়া দেখছি।
হঠাত সামনে ঘুরতেই একটা মেয়ে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় বসালো আমার গালে।থাপ্পড়ের চোটে আমার মোটা ফ্রেমের চশমাটা গিয়ে পড়লো কয়েকফুট দূড়ে সাথে মেয়েটার প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়া চিৎকার মেয়ে দেখলেই গায়ে হাত দিতে ইচ্ছা হয় তাইনা??বাড়িতে মা বোন নেই, অসভ্য, বর্বর এদের জন্য রাস্তায় বের হওয়া দায়।আমি নিজেকে সামলে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি আমার তিন বছর বয়সী মেয়েটা ঐমেয়ের উড়নার আচল মুখে দিয়ে আছে আর উনি ভাবছে আমি টান দিছি।
এবার মেয়েকে বললাম আম্মু অন্যর কাপড়ে হাত দিতে নেই, আন্টিকে সরি বলো।ঘটনার আকস্মিকতায় আমার ছোট মেয়েটাও ভয় পেয়ে গেছে।আস্তে করে কাঁদোকাঁদো গলায় সলি বল্ল।মেয়েটাও নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে আছে আর পুরো বাসের লোকজন হা করে তাকিয়ে আছে আমাদের বাবা মেয়ের দিকে। কি বলা উচিত ভেবে পাচ্ছে না হয়ত।চশমাটা কুড়িয়ে নিয়ে পড়ে সায়েন্সল্যাব বাস স্টপে নেমে পড়লাম।বাকি রাস্তাটুকু হেটেই আসছি আজিমপুর পর্যন্ত,বাচ্ছা মেয়েটা একটা টু শব্দ ও করেনি ভয়েতে।আমি ওকে আম্মুর কাছে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বেলকোনিতে আনমনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম মিলির কথা।কেন মিলি এভাবে চলে গেলে আমাদের ছেড়ে???
কিভাবে আছো তুমি ওপারে আমাদের ছেড়ে???খুব স্বার্থপর তুমি।অনেকদিন পর ফোনের গ্যালারিটা ঘাটতে ইচ্ছা করলো।মিলি চলে যাওয়ার পর আর দেখতে ইচ্ছা হয়না।কতশত ছবি আছে আমার আর মিলির।ও পরিচয়টাই তো দেয়া হলোনা। আমি পরাগ আর আমার ছোট্ট মেয়েটার নাম মিথি। মিথির জন্ম হওয়ার সময় মিলি আমাদের ছেড়ে চলে যায়,আমার আজো মনে পড়ে সেই দিনটা।ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছিলো।মিলির ডেলিভারি হওয়ার কথা ছিল আরো দিন দশেক পরে।কিন্তু বাথরুমে পড়ে গিয়ে এই অবস্থা।প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।ডাক্তার বলেছেন অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল যেকোন একজনকে বেছে নিতে হবে।সেদিন খুব স্বার্থপরের মত একটা কাজ করেছিলাম আমি মেয়েকেই বেছে নিয়েছিলাম।
মিথির জন্মের ঘন্টা দুয়েক পর মিলি মারা যায় কিন্তু তার আগে জীবনের সবচেয়ে বড় উপহারটা দিয়ে যায় আমাকে একটা ছোট্ট পুতুলের মত প্রান সেদিনই বুঝেছিলাম বাবা হওয়ার অনুভুতি কি জিনিস।কিন্তু সেই অনুভুতি পেতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে হারিয়ে ফেলতে হয়েছে আমাকে।৩বছরের প্রেম দুই বছরের বিয়ের পর প্রিয় মানুষটাকে হারানোর যন্ত্রনাটা কতখানি টের পেয়েছিলাম।সেই ছোট্ট একদিনের মেয়েটা আজকে তিন বছর পেরিয়েছে আধো আধো গলায় কথা বলতে শিখেছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম দেখো মিলি তোমার মেয়ে কত বড় হওয়া শিখেছে।অন্য বাচ্ছারা যেখানে মা ডাক দেয় আগে সেখানে আমার মা হারা মেয়েটা বাবাই ডাক শিখেছে আগে।গালটা এখনো ব্যথা করছে,যানো মিলি খুব লেগেছে থাপ্পড়টা।
রাতে খাইয়ে দিয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ড্রয়িং রুমে আমি আর আম্মু টিভি দেখছিলাম হঠাত কলিং বেলটা বেজে উঠলো।উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম।এইতো বাসের সেই মেয়েটা,হাতে একটা ছোট বাটি।বললাম কি চাই??মেয়েটা ভয়ে কাচুমাচু করে বল্ল আমরা পাশের ফ্লাটটায় ভাড়া এসেছি সকালে। আম্মু পাঠালো এটা কাকিমার জন্য।আমি বললাম ভেতরে আসুন।আম্মু বলা শুরু করল আরে তোকে তো বলাই হয়নি উনারা এসেছে সকালে আমাদের সামনের ফ্লাটটায়।ওর নাম নিলা আর নিলা ও হচ্ছে পরাগ আমার একমাত্র ছেলে।
পরিচয় পর্ব সেরে নিলা চলে গেল।সেদিনের পর নিলার সাথে আরেকবার কথা হয়েছিল ছাদে সরি বলেছিলো সেদিনের ঘটনার জন্য।তারপর থেকেই আমি যতটা পারি উনাকে এড়িয়ে চলি।ইদানিং একটা বিষয় লক্ষ্য করছি মিথির সাথে নিলার খুব ভাব হয়েছে।নিলা সারাদিন মনে হয় এই বাসাতেই থাকে আমি আসার সময় হলেই চলে যায়।বিষয়টা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে।আম্মুকে বললাম বিষয়টা নিয়ে দেখো এটা ঠিক হচ্ছে না অবিবাহিত মেয়ে দশজনে দশকথা বলবে এসব শুনলে।আম্মু যেন এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলেন।তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।কি পেয়েছিস তোরা বাপ বেটি। দিন দিন কি আমার বয়স কমে যাচ্ছে, তোর মেয়েকে সামলাবে কে??কতদিন ধরে বলছি একটা বিয়ে কর শুনেছিস আমার কথা??
আর একটা মেয়ে একটু কাজ এগিয়ে দিচ্ছে বলে খুব গা জ্বালা করছে তাইনা??তোর বউয়ের দরকার না থাকতে পারে কিন্তু মিথির একটা মায়ের দরকার আছে।তুই কি বুঝবি থাকিস সারাদিন অফিসে আমি বুঝি বাচ্ছা মানুষ করার কত জ্বালা বলেই আচলে মুখ বুঝে কান্না শুরু করলো।বুঝলাম ভিমরুলের মৌচাক এ ঢিল ছুড়েছি।মিথিকেও কিছু বলতে পারিনা।রাতে ঘুমানোর সময় বাবাই মাম্মাম এর মত করে একটা গল্প শুনাও।কথাটা শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাবার মত অবস্থা।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম তোমার মাম্মাম তো আকাশে আছে মা, তুমি কিভাবে গান শুনলা???মেয়ে বল্ল কি যে বলোনা।মাম্মাম তো পাশের বাসায় থাকে।বুঝলাম বিষয়টা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে।আমি বললাম তোমার মাম্মামকে আমার সাথে একটু কথা বলতে বলিও কেমন।এবার লক্ষি মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড়।
পরেরদিন শুক্রবার অফিস ছুটি।পত্রিকা পড়ছি।হঠাত কলিং বেল বেজে উঠলো। আম্মা রান্না ঘরে তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই খুলতে হলো।খুলতেই দেখি নিলা।ভিতরে আসতে বলে চলে আসলাম।নিলাও আমাকে অনুসরন করে পিছে পিছে এসে বসলো।আমি কোন রকম ভনিতা না করেই বললাম দেখুন নিলা যেটা হচ্ছে অন্যায় হচ্ছে।আমি আমার মেয়েকে সামলে নিতে পারবো।আপনি ওকে অতিরিক্ত আশকারা দিয়ে মাথায় উঠাবেন না।চেস্টা করবেন ওর থেকে দুড়ে থাকতে।আশা করে বুঝাতে পেরেছি।কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলার পর নিলার দিকে তাকিয়েই দেখি চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।আমি চুপচাপ উঠে রুমে চলে আসলাম।কারন যে চোখের পানি মুছতে পারবোনা তা দেখা নিরর্থক।
সন্ধ্যা বেলা নিলার বাবা মা বাসায় হাজির।আমি মিথি আর আম্মু টিভি দেখছিলাম।এসেই আমাদের নামে যাতা বলা শুরু করলেন। আমি নাকি আমার মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছি ওনার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য,আমার আর আম্মার কুবুদ্ধিতেই নাকি নিলা ওর বাবা মাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে করলে আমাকেই করবে।আমি নাকি সম্পত্তির লোভে তাদের মেয়ের পিছনে লেগেছি।এরপর যে ভাষায় গালাগাল করলো ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য।আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম দরজার আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে কাদছে।আমি উঠে গিয়ে দেখি নিলা।হাতটা ধরে টেনে ওর বাবা মার সামনে টেনে এনে বললাম আশা করি এবার এবার শান্তি পেয়েছ বলেই ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় দিলাম।উনার বাবা মাও চুপ হয়ে গেছে।চুপচাপ ওরা চলে গেল।আম্মুর দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
এমন অপুমান সারাজীবন হন নি।পরেরদিন অফিস না গিয়ে মিথিকে নিয়ে ঘুরতে বেরোলাম।আজকে সারাদিন বাবা মেয়ে ঘুরবো।মেয়ে মুখ গোমড়া করে বসে আছে।কি হয়েছে বলতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বল্ল আমি আর যাবোনা ওই বাসায়, আমায় মাফ করে দেও বাবাই।দুজনে সারাদিন অনেক ঘুরাঘুরি করার পর বাসায় আসলাম।বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।হঠাত নিলার বাবা মার আগমন।চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।এসেই হাত ধরে বল্ল আমার মেয়েটাকে বাচাও বাবা।কাল এসবের পর ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল।ভাজ্ঞিস আমরা ঠিক সময়ে বুঝতে পেরেছলাম।হাসপাতালে আছে এখন।একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে।সারাক্ষন মিথি মিথি করছে।তুমি কি একটু মিথিকে নিয়ে হাসপাতালে যাবা?? এমনভাবে বল্ল যে না করতে পারলাম না।
হাসপাতালে দেখি সদ্য সহাস্যমুখের মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে।মিথি মাম্মাম বলে তাকাতেই চোখ খুলে দেখে আমি আর মিথি দাঁড়িয়ে আছি।মিথিকে ইশারায় কাছে ডাকলো।মিথি কাছে যেতেই এমন ভাবে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলো দেখে মনে হবে যেন মিথিই ওর সব।নিলা হাসপাতালে থাকতেই নিলার বাবা মা নিলার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো আমাদের বাসায়।আমি চুপচাপ শুনছি আর আম্মু কি বলে সেটাই দেখছি।আম্মু কিছুক্ষন ভেবে আচ্ছা ঠিক আছে নিলা ফিরুক তারপর ভেবে চিনতে দেখা যাবে।আমিতো কিছুতেই বিয়ে করবোনা আম্মুকে সাফ জানিয়ে দিলাম উনারা চলে যাওয়ার পর।আম্মু এবার আমার কপালে হাত দিয়ে বল্ল বাবারে সবসময় নিজের জিদকে দেখতে হয়না।
আমি জানি মিলিকে তুই কতটা ভালোবাসিস কিন্তু মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েটা করে নে।মা ছাড়া মেয়েটা মানুষ হবে কিভাবে।মা কথাটা এমন ভাবে বল্ল যে না করতে পারিনি।সিদ্ধান্ত হলো নিলা যেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরবে ওইদিনই বিয়ে। নিলা ফিরেছে।খুব ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হয়ে গেল।আমার কথাতেই অনুষ্ঠান এসব বড় করে করা হয়নি।সারাটা দিন আমার পিচ্চি মেয়েটা কোলে বসে অবাক হয়ে রীতিনীতি দেখছে।একবার আমার কোলে আরেকবার নিলার কোলে।বিয়েটা হয়ে গেল।
রাত ১০টা। রুমের সামনে পায়চারি করছি। আজকে নিজের রুমে ঢুকতেই ভয় লাগছে।একটু পর মিথি এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলছে বাবাই তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন??মাম্মাম অপেক্ষা করছে চলো রুমে চলো।আমি রুমে ঢুকতেই দেখি নিলা টুকটুকে একটা লাল শাড়ি পড়ে বসে আছে বিছানায়।আমাকে দেখেই বলে উঠলো শুনেন আমি বিয়েটা করেছি শুধু মিথির জন্য।সারাজীবন ওর কাছে থাকার জন্য।নাহলে কি আর আপনার মত একটা ইয়েকে বিয়ে করি।বের হোন রুম থেকে।আমার আর আমার মেয়ের জন্য চিপস, আইস্ক্রিম নিয়ে আসেন।কথামতো নিচে নামলাম চিপস আইস্ক্রিম কিনতে।নিচে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাসর রাতে জামাই বাহিরে কেন এইটা ভেবে।আমি খুশি আমার মেয়েটা একটা সত্যিকারের মা পেয়েছে বলে।ভালো থাকুক মা মেয়ে।